দেখলাম বেশ কিছুকাল আগে ঢাকার বংগবাজার না কোন জায়গা থেকে যেন হেলেন আমাদের সবার জন্য মানে প্রাপ্তবয়স্ক তিন সদস্যের জন্য মোটাফোমের প্যাড লাগানো যে তিনটা প্যান্ট কিনে এনেছিল, তারই একটা পড়েছে এখন। প্রায়ই করে ও এটা, মানে বলছিলাম হেলেনের হঠাৎ করেই জামাকাপড় কেনার কথা। ওর সম্ভবত নির্দিষ্ট কিছু দোকান আছে। যেগুলোতে সে মাঝে মাঝেই হানা দেয়, এক্সপোর্ট কোয়ালিটি অর্থাৎ রপ্তানিযোগ্যমানের জামা কাপড় খোঁজার জন্য। তাতে যখনই ওখানে আমাদের যে কারোই মাপ মতো কিছু পেয়ে যায়, সাথেসাথেই সে কিনে ফেলে। ঐসব জামাকাপড়ের আসলেই কারো কোন প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে কোন চিন্তা ভাবনা না করেই। আজকাল আমাদের বস্ত্র বালিকাদের কল্যাণে দেশে জামাকাপড় সহজলভ্য ও সস্তা হয়ে যাওয়ায় অকারণে নিজেও কিনে ফেলি ওরকম অপ্রয়োজনীয় জামাকাপড়। যদিও প্রতিবারই কেনার পরপরই আবার শুনতে পাই কানে বলছেন প্রয়াত আব্বা ফিসফিসিয়ে , অপচয় কারি শয়তানের ভাই। তাতে অনুশোচনা হয়। তবে এ ব্যাপারে ঘরের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হেলেনের তেমন হয় কি না জানি না।
ঠিক ঐ রকম নিয়মেই ও প্যান্টগুলো কিনেছিল কি না, নাকি এই বেইজিং সফর মাথায় রেখেই ও কিনেছিল ওগুলো কিছুদিন আগে, তাও জানি না। তবে ওগুলো সেসময় দেখে, খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম ওর উপর এই ভেবে যে ঐ প্যান্ট শুধু এস্কিমোদেরই কাজে লাগতে পারে। ফলে আমার ও লাজুর জন্য আনা সেই ফোম প্যান্ট দুটো কোথায় যে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল মনে করতে পারছি না। অন্যদিকে হেলেন কিন্তু নিয়ে এসেছে সেটা, এবং পরেছেও তা এ মুহূর্তে। যার কারণেই কি দাঁড়িয়েছে ওর এই বেঢপ আকৃতি? তবে জান বাঁচানো যেখানে ফরজ সেখানে আকৃতিতে কী আসে যায়? ওর পরনে এখন, সেটি দেখতে পেয়ে নিজের জন্যও সেদিন যেটিকে অপ্রয়োজনীয় ভেবেছলাম সেটিরই ভীষণ প্রয়োজন অনুভব করলাম। আসলে এ জীবনে কখন, কোথায়, কোন মুহূর্তে কার কাছে যে একসময়ের কোন অপ্রয়োজন হয়ে উঠে ভীষণ প্রয়োজনীয় কে জানে তা?
আচ্ছা কাল যে গেলাম তিয়েন আন মেনে প্রবল হিমে তখনও কি হেলেন পড়েছিল এই প্যান্টটা? নাহ মনে করতে পারলাম না। অবশ্য এ মুহূর্তে ওটা মনে করতে পারাও কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। এখন যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ইতোমধ্যে দীপ্র তার জামাকাপড় বদল করে পরার পরীক্ষায় সহজেই পাস করে ফেলেছে মায়ের কাছে। অতএব সদলবলে রওয়ানা করা গেল লিফটের দিকে।
লিফট থেকে নেমে লবিতে পা দিতেই বোজা গেল, নাহ ঘুমে ভাঙ্গেনি এই হোটেলবাসীদের বেশীর ভাগেরই এখনও । একদম শুনশান লবিতে নিজ নিজ নির্দিষ্ট জায়গায় ধোপদুরস্ত ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে থাকা হোটেল কর্মীদের দেখেও মনে হচ্ছে এখনও যেন ঘুম ঘুম ভাব কাটেনি তাদেরও। তবে তাদের সকলের মধ্যেই যে একজনই ব্যতিক্রম, মুহূর্তেই প্রমাণ করলো তা মিস রিনা।
দূর থেকেই আমাদের দেখেই তার স্বভাবজাত হাসির মুখে মেখে “গুদ মনিং” “গুদ মনিং”, “হাউ আর ইউ” “হাউ আর ইউ” বলতে বলতে নিজ ডেস্ক ছেড়ে এগিয়ে এসে, হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে জানাল যে, সেও অপেক্ষা করছিল আমাদেরই জন্য । কারণ দুয়ারে তো দাঁড়ায়ে শকট আমাদের ।
পাল্টা হাসিতে ধন্যবাদ দিয়ে তাকে বললাম যে আমাদের প্রতি তার এ বিশেষ খেয়ালের জন্য অবশ্যই কৃতার্থ আমরা । যদিও মনের ভেতরের দ্বিতীয় জন তখনই বলে উঠলো, সারাদিন কতজনকে যে তোমার বলতে হয় এই একই কথা ইনিয়ে বিনিয়ে, মিস রিনা তা কি আমি বুঝি না। এতে মনের প্রথমজন বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, সাতসকালেই রাখো তোমার এই ছিদ্রান্বেষণ। তার দেহভঙ্গি আর কথার স্বতঃস্ফূর্ততাতেই তো বোঝা যায়, আসলেই সে খুব আন্তরিক । আবার কাস্টমার সার্ভিসের লোকেরা ভড়ং করেও যদি এসব না বলে , তাহলেও তো দোষ ধরবে। আবার বলতে গেলেও সেটিকে ভড়ং বলে ঠাউরাবে! আচ্ছা তাহলে বলো তো দেখি , করবে টা কি এরা?
এদিকে মনের ভেতরের দুজনের এ বাদানুবাদে আর কান দেব না, এ প্রতিজ্ঞা করে মিস রিনার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে গেইটের দিকে এগুতে এগুতে জিজ্ঞাসা করে বুজতে চাইলাম যে,এখন যে আমরা যাচ্ছি গ্রেট ওয়াল মানে মহাপ্রাচির দেখতে, ওখান থেকে ফিরে আর কোন কোন জায়গায় যেতে পারবো আজ। গতকাল তো ঠাণ্ডায় কাবু হওয়ার পর পথ হারিয়ে অসমাপ্তই রয়ে গিয়েছিল আমাদের ভ্রমণ। এক তিয়েন আন মেন স্কয়ার ছাড়া তো আর কোথাও যেতে পারিনি । আজ কি তা পুষিয়ে নেয়া যাবে?
উত্তরে নো প্রব্লেম, নো প্রব্লেম বলতে বলতে গেইট পেরিয়ে আমাদের সকলকে নিয়ে লি খাঁর গাড়ীর সামনে গিয়ে আমাদেরকে গাড়িতে উঠার জন্য ইশারা করে , চুং চাং চি চি করে কি সব যেন বলতে থাকল সে লি খাঁর সাথে। জবাবে ভাবলেশহীন মুখের লি খাঁকে প্রথমে আমাদের উদ্দেশ্যে এক চিলতে হাসি উপহার দিয়ে ছোট্ট নড করে, মিস রিনার কথার জবাবে সম্মতিসুলভ মাথা নাড়াতে নাড়াতে হাতে ধরা গাড়ীর চাবি গাড়ীর দরজা খোলার জন্য ঐ দিকে তাক করে, বোতাম চেপে ধরতে দেখলাম।
চাবির ইশারায় গাড়ীর পাশ দরজা খুলে যেতেই সাথে সাথেই পরিবারের বাকীরা গাড়িতে উঠে বসতেই, পায়ে পায়ে নিজে এগুলাম অনবরত চুং চাং চি চি করতে থাকা মিস রিনার সাথে লি খাঁর দিকেই । ড্রাইভিং সিটের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লি খাঁ , ঐসব অনর্গল কথার জবাবে একদম স্পিকটি নট হয়ে বারবারই সম্মতিসূচক মাথাই নাড়াচ্ছে শুধু ।
অতঃপর মিস রিনা তার চায়নিজ বাত সমাপন করে, কোটের পকেট থেকে একটা তিন চার ভাঁজ করা ভ্রমণম্যাপ কাম গাইড জাতীয় লিফলেট বের করে ওটা আমার হাতে চালান করে দিয়ে বলল, “ওকে গো , নাউ গ্রেত অয়াল”
জবাবে ওকে বললাম, শোন , আমরা কিন্তু আজ সামারপ্যালেসেও যেতে চাই । আবার তোমাদের বার্ডস নেস্ট অলিম্পিক ভিলেজও কিন্তু দেখা বাকি আছে? এটুকু বলতেই কি বুঝল মিস রিনা আমার কথায়, জানি না। বরং দেখলাম হাসিমুখে “ওকে, ওকে, নো প্রব্লেম ‘বলতে ফের করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে ফিরতি হাঁটা দিল হোটেলের অভ্যন্তরের দিকে। ফলে নিজেও লি খাঁকে পেরিয়ে গাড়ীর সামনেটা দিয়ে হেঁটে ওপাশে গিয়ে উঠে বসলাম ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে।
“কি ঠিক করলে ? আজ তাহলে আমরা কোথায় কোথায় যাবো? এখনই বা যাচ্ছি কোথায় আমরা?” গাড়িতে উঠতেই পেছনের সিট থেকে করা লাজুর এই প্রশ্নের জবাবে , ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম যে এ মুহূর্তের গন্তব্য গ্রেট ওয়াল। এছাড়া সামার প্যালেস আর অলিম্পিক ভিলেজেও যেতে চাই তাও বলেছি। দেখা যাক “বাবা , আমরা কিন্তু আজ আগে ফিরে আসতে চাই মনে রেখ।” এসময় দীপ্র এ কথা মনে করিয়ে দিতেই
“কি যে বল না মনু তুমি ! তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরতে হবে কেন? আগে তো সব দেখতে হবে। আমরা কি আবার আসব নাকি বেইজিং এ”। ওর পাশে বসা হেলেন এ কথা বলতেই জবাবে দীপ্র কিছু একটা নিম্নস্বরে বলতেই, পেছনে লেগে গেল বালকত্ব পাড়ি দিয়ে বিদ্রোহী কৈশোরে পা দেয়া ভাতিজার সাথে ফুপ্পির কথা কাটাকাটির ভজঘট।
ইতোমধ্যে লি খাঁ ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছে, অতএব পেছনে কি হচ্ছে তার নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, ঘাড় ফিরিয়ে লি খাঁর চোখে চোখ রেখে ওকে গো বলতেই , গাড়ী সামনের দিকে এগুতেই ফের প্রশ্ন এলো লাজুর কাছ থেকে
“লাগবে কতোক্ষণ গ্রেট ওয়ালে যেতে”? জ্যাম না থাকলে মনে হয় দেড় ঘণ্টা পৌনে দুই ঘণ্টা লাগতে পারে বলেছিল একবার মিস রিনা। পেছেনের দিকে মাথা ঘুরিয়ে লাজুর প্রশ্নের উত্তর দেবার সাথে সবাইকে তাড়া দিলাম সিট বেল্ট বাঁধার জন্য। তাতে সবাই নড়েচড়ে সিট বেল্ট বাঁধার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই, নিজে মনোযোগ দিলাম একটু আগে মিস রিনার কাছ থেকে হাতে পাওয়া সেই ভ্রমণ গাইড গোছের রঙ্গিন লিফলেটে।
ভাঁজ খুলে ওটার প্রথম পাতায় চোখ পড়তেই দেখি, আছে ওখানে মহাপ্রাচির নিয়ে লেখা অবশ্যই চায়নিজ ও সাথে দয়া করে দেয়া চিংলিশ বিবরণ। ভালই হল এটা পেয়ে। কিছুটা হোঁচট খেতে সেই চিংলিশ পড়তে গিয়ে প্রথমেই জানা গেল যে যাচ্ছি আমরা মহাপ্রাচিরের মুতিয়ানু অংশে। বেইজিং থেকে প্রায় পঁচাত্তর কিলো মিটার দক্ষিণ পুবে হল এর অবস্থান । ২১ হাজার কিলোমিটারের চেয়েও দীর্ঘ মহাপ্রাচিরের এই অংশটি তৈরির কাজে, প্রথমে হাত দিয়েছিল মিং বংশের রাজারা, যা নাকি পুনঃনির্মিত হয়েছিল ১৫৬৯ সালে। যদিও খৃষ্ট পূর্ব ২২০ সালে গোড়াপত্তন করেছিলেন, কুইন রাজ বংশের মহারাজ কুন সি হাং। সে হিসাবে এই মহাপ্রাচিরের মুতিয়ানু অংশ নিতান্ত নাবালকই ।
টুরিস্ট স্পট হিসাবে এটি মাত্র ১৯৮৩ সনে অনুমোদন পেয়েছিল চায়নার স্টেট কাউন্সিল থেকে। ঐ অনুমোদন পাওয়ার পর, মহাচিনের হুয়াইরু ডিসট্রিক্ট স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ মহাপ্রাচির সংলগ্ন মুতিয়ানু গ্রামের মাতবর মানে নেতাদের নেতৃত্বে, মুতিয়ানু টুরিস্ট এরিয়া নামে এই অংশটি নির্মাণ করে, খুলে দেয় তা দেশীবিদেশী ভ্রামণিকদের জন্য ।
খুঁড়িয়ে হোঁচট খেয়ে মহাপ্রাচীরের মুতিয়ানু অংশের চাইনিজ ভাষ্যের বর্ণনা চিংলিশ অনুবাদে পড়তে গিয়ে একই সাথে আমোদিত ও বিরক্ত হলেও, এ অংশটি পড়ে বেশ চমৎকৃত হলাম। মনে হল বাহ! কি চমৎকার ভাবেই না এরা সরকারী একটি প্রকল্পে ধাপে ধাপে সম্পৃক্ত করলো স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসন মায় একদম গ্রামের মাতব্বরদেরও! এ ধরনের প্রজেক্ট আমাদের দেশে হলে দেখা যায়, বলা নেই কওয়া নেই সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক দপ্তর, এক্ষেত্রে হতে পারে তা প্রত্নঅধিদপ্তর কিম্বা পর্যটন কর্পোরেশন, অকুস্থলে গিয়ে সোজা শুরু দিয়েছে কাজ! এতেই লেগে যায় তাই ঝামেলা স্থানীয় জনগণের সাথে সরকারী অধিদপ্তরের। শুধুই কি ঝামেলা? দেখা যায় একারণে তৈরি হয়ে গেছে অত্র এলাকায় এক বিস্ফোরণমুখ অবস্থা! অবশ্য এ তো হল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে ঝামেলা হয় তা। তার আগে জনমানসের চোখের আড়ালে মাসের পর মাস এমন কি বছরের পর বছর চলে এ নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বা আন্তঃঅধিদপ্তর ফাইল ঠেলা ঠেলি! তাতে যে কোন সামান্য প্রজেক্টেরই বছর বারো মাসে না হয়ে, হয়ে যায় তা এমনকি তিন আঠারো চুয়ান্ন মাস। অথচ এখানে ১৯৮৩ সনে স্টেট কাউন্সিলের অনুমোদন পাওয়ার পর, ১৯৮৫ সনেই এক্কেবারে চালু করে দিতে পেরেছে এরা এ প্রজেক্ট ! আবার তারপর পরই এটি পেয়ে গেছে ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা! আর সেই ১৯৯২ সন থেকেই প্রায় প্রতিবছরই মুতিয়ানু মহাপ্রাচীর বিবেচিত হয়ে আসছে বেইজিং এর একনম্বর আকর্ষণীয় স্থান হিসাবে! এরকম ভাবনায় মগ্ন যখন, ঠিক তখনই সেই মগ্নতার ছেদ টেনে মনের দ্বিতীয়জন ফিসফিসিয়ে কানেকানে বলল , আরে কি যে ছাই ভাবছ তুমি! বুঝতে পারছি না। তুমি কি এটুকু বুঝতে পারছ না যে এ হতে পারে চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টির প্রপাগান্ডা। আমাদের দেশে সরকারের ভুলচুক হলে তা নিয়ে তো যে কোন জায়গার লোকই প্রতিবাদ করতে পারে। শুধু প্রতিবাদই বলছি কেন, এমন কি জনগণ পারে তাদের অপচ্ছন্দের যে কোন প্রজেক্টেরই লালবাতি জ্বালাতে এক্কেবারে। এ কি সম্ভব এই চায়নিজ মুল্লুকে? “ফেরারি! ফেরারি! বাবা, বাবা ঐ যে দেখো যাচ্ছে ফেরারি।” উচ্চৈঃস্বরে পেছনের সিট থেকে দুপুত্রের এই মুহুর্মুহু শ্লোগানে গাড়ীর ভেতরের নীরবতা খান খান হয়ে ভেঙ্গে যেতেই, গেলাম এক্কেবার হকচকিয়ে! লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক