দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৬ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

রোদ থাকুক না থাকুক, হয়েছে সকাল : ২

আরে বলে কী ? পারলে আর না পারলে বলতে কিছু আছে নাকি স্ত্রীআজ্ঞার বিপরীতে স্বামীদের অভিধানে, যখন কি না আর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই তো বের হতে হবে আমাদের সারাদিনের জন্য। এর মধ্যেই তো সবাইকে নাস্তা খেয়ে তৈরি হয়ে নিতে হবে। একবার ভাবলাম তাই যাই ঐ রুমের দিকে। এক্কেবারে স্বশরীরে ঐ রুমের ঘণ্টা বাজিয়েই পালন করি স্ত্রী আজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে। কিন্তু না তা না করে মত বদলে জানালা ছেড়ে গিয়ে বিছানায় বসে ঐ রুমে ফোন করতেই একটা রিং হওয়ার সাথে সাথে ও পাশ থেকে বেশ ধীরস্থির গলায় কেউ বলে উঠল -‘নি হাও’।

প্রথমে থমকে গেলেও নিমিষেই বুঝলাম ঐটি দীপ্রর গলা! করছে সে নতুন জানা চায়নিজ সম্ভাষণের মশকো। হাসি চেপে বললাম -কি বাবা, তুমি উঠে গেছ নাকি?
‘ওহ বাবা, তুমি? তোমরাও উঠে গেছ? আমি তো ভেবেছিলাম হোটেলের লোক বুঝি ফোন করেছে, তাই তো, নি হাও বলেছিলাম। ঠিক আছে আসছি আমি।’ বলেই খট করে ফোন রেখে দিল দীপ্র -একদিকে প্রথমে থমকে গেলেও অচিরেই বেশ মজা পেয়েছিলাম পুত্রের গলায় ‘নি হাও’ শুনে। ভাবলাম আর কিছু না হোক এ ভ্রমণে চায়নার এই বহুল প্রচলিত সম্ভাষণটা তো শিখেছে ও। দ্বিতীয়ত অবাক হলাম এতো ভোরে ওর এমন চনমনে গলা শুনে! সকালে তো ঘুম থেকে উঠাতে হয় ওকে অনেক সাধ্য সাধনা করে, যার জেরে সকালের অনেকটা সময়ই কথা বলে ও ঘ্যানঘ্যানে সুরে ও স্বরে। আজ তবে ওর হলোটা কী। কোন আনন্দে বা উত্তেজনায় সকাল থেকেই এমন চনমনেভাবে আছে দীপ্র ?

টুং টাং করে এসময় ডোর বেল বেজে উঠতেই, এরই মধ্যে নাস্তা রেডি করা নিয়ে তৎপর হয়ে উঠা লাজুকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই, হুড়মুড় করে দীপ্র রুমে পা দিয়েই ঘোষণা করল, এসেছে সে এ রুমের ফ্রিজে রাখা, তার গত রাতের ডিনার থেকে আনা ঝোল নুডুলসের বক্সটা নিতে। গতরাতে এই নুডুলস গরম করার ব্যাপারে আমি যে আইডিয়া দিয়েছিলাম, সেটি সে এক্ষুণি কাজে লাগাবে ঐ রুমের ফ্লাস্ক কাম ওয়াটার হিটারটিকে কাজে লাগিয়ে।

‘না, না তুমি ও কাজ করতে যেও না। কারেন্টে শক খাবে। কী ব্যাপার তুমি কিছু বলছ না কেন ওকে ? মানা কর ওকে’। বলতে বলতে নিজের হাতের কাজ থামিয়ে দিয়ে লাজু তার আশংকিত চোখ রাখল আমার চোখে চোখে চোখে চোখ পড়লেও মুখে বললাম না কিছুই। কারণ ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যাচ্ছি আমিও পুত্রের সাথে ঐ রুমে। ওকে কিছু করতে দেব না, আমিই করে দেব নুডুলস গরম। পুত্রের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন মাকে হাতের ইশারায় আশ্বস্ত করার সাথে ফ্রিজ থেকে দীপ্রর সেই লালসবুজ নুডুলস বঙ বের করার পর, ঐ যে প্রথম রাতে কিনেছিলাম একগাদা বড় বড় পানির বোতল, তার থেকে একটা হাতে নিয়ে এ রুম থেকে বেরিয়ে ঐ রুমের দিকে এগুতে এগুতে জিজ্ঞেস করলাম – হেলেন কি উঠেছে ঘুম থেকে?

‘হ্যাঁ উঠেছে। তবে আমি কিন্তু বাবা আজ এনের আগে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম সেরে, মোটামুটি রেডি হয়ে গেছি বলতে পার’।বাহ বেশ ভাল তো। এটাই তো হওয়া দরকার বেড়াতে এসে।

‘মনে আছে তো বাবা, আজ কিন্তু আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো গ্রেটওয়াল আর যা যা কিছু আছে দেখার, তা দেখে। তুমি কিন্তু বলেছ আজ আমাকে অ্যাপেল স্টোরে নিয়ে যাবে। ওটা ভুললে কিন্তু চলবে না। আজই ওখান থেকে কিনবো আমি বিটস হেডফোন’।

এইমাত্র দেয়া দীপ্রর স্বপ্রণোদিত জবানবন্দিতেই পরিষ্কার হলো, ওর এই উত্তেজনার কারণ। হাসলাম মনে মনে। মুখে বললাম শোন বাবা, অবশ্যই ফিরে এসে যদি খোলা পাই অ্যাপেলস্টোর তবে আজই কেনা হবে তোমার হেডফোন।

এরই মধ্যে কার্ড ছুইয়ে রুমের দরজা খুলে ঘরে পা দিয়েই দীপ্র দ্রুত মিনিবারের উপরে থাকা সেই ফ্লাস্কটির দিকে তড়িঘড়ি করে এগুনোর উপক্রম করতেই, ওকে নিবৃত করে বললাম বাবা তুমি বসো চুপ করে। আমি করে দিচ্ছি সব।

‘তোমার আইডিয়াটা খুব জোশ ছিল বাবা। আমি তো ভাবছিলাম আজ সকালে উঠে আমি নিজে নিজেই নুডুলস গরম করব। এটা করা তো খুব সোজা। দাও না আমিই করি। আচ্ছা ঐ আইডিয়াটা তোমার কিভাবে মনে এসেছিল বলো না’।

পরিষ্কার হল এবার সাতসকালেই পুত্রের এরকম চনমনে ভাবের কারণ। এ হল একই কাজ নতুন তরিকায় করতে পারার আনন্দ। ব্যাপারটায় বেশ মজা পেলাম। এরকম ব্যাপারে ওকে মনঃক্ষুণ্ন করা ঠিক হবে না। ওতে পরবর্তীতে নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে ও। গতানুগতিকতার জমিতে নতুন কিছু জন্মায় না তো কখনোই কিছু। ওয়াটার ফ্লাস্ক কাম হিটারটা তাই ওর হাতে চালান করে দিয়ে বললাম ঠিক আছে চলো দুজনে মিলেই করি কাজটা।

এই বোতল থেকে আন্দাজ মতো ২০০/৩০০ মিলি পানি ঢালো ঐ ফ্লাস্কে। পানি ঢালা হলে ওইটিকে নিয়ে রাখো ঠিক মতো ওটার জায়গামতো। তারপর আমি প্লাগটি লাগিয়ে দিলে, তুমি এর এই সুইচটা দিও টিপে।

লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়
পরবর্তী নিবন্ধপরিবার ও সম্প্রীতির বন্ধন