দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

কনফুসিয়াসের দেশে সক্রেটিস
গল্পবর্ণিত বেহেস্তি টিকিট হাতে পাওয়ার আনন্দে বাগ বাগ হয়ে আগমনী লাউঞ্জে ঢুকে সবার কাছে ফিরতেই, আমার এই আনন্দটিকে ভুলভাবে আঁচ করে উৎসুক লাজু জিজ্ঞেস করলো : ‘পানি পেলে নাকি?’ -আরে দূর, পানি পাব কোথায়? আগেই তো বললাম এ তল্লাটে কোন দোকানপাট নাই; এ হল হিম কারবালা। তবে পেয়েছি যা, তা হল হোটেলে যাবার বাসের টিকিট। বলেই টিকিটটা দীপ্রর হাতে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম হাতের দস্তানা খোলায়। কারণ ওটা হাতে দিয়ে শীতের মোকাবেলা করতে পারলেও, বাকি সব কাজ করা, মানে যেমন টাকা গোনা বা ভ্রমণ ফাইলের পাতা উল্টানো এসব করতে গিয়ে বেশ ঝক্কিতে পড়েছিলাম। জানি না যেসব দেশে এরকম বা এর চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়ে সে সব জায়গায় মোটা দস্তানা পড়ে কিভাবে মানুষ দৈনন্দিন কাজ করে! যদিও এখন আমার হাতে, করার মতো তেমন কোন কাজ করার নেই এ মুহূর্তে, তারপরও দস্তানার ঐ অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রথম সুযোগটি পেতেই নিজেরই অজান্তেই, হাতের টিকিট দীপ্রর হাতে গছিয়ে দিয়ে তা দস্তানামুক্ত হওয়ায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম আর কি ।
‘তাই নাকি? কটায় ছাড়বে বাস? কোত্থেকে উঠতে হবে বাসে’? নিমিষেই পানি প্রসঙ্গ আলোচনা থেকে বাদ হয়ে গেল লাজু আর হেলেনের যুগল কন্ঠের একই প্রশ্নে। তাতে হাঁফ ছাড়লেও ধাঁধায় পড়ে গেলাম দুজনের করা মধ্যের প্রশ্নটি নিয়ে। মানে কটায় বাস ছাড়বে, টিকিট হাতে পাওয়ার উত্তেজনায়, ঐটি যে কখন ছাড়বে তার তো কোন খোঁজই নিইনি। এ ছাড়া যেহেতু ঐ ১৫ নম্বর বাসটি এখনো এসে দাঁড়ায়নি নির্দিষ্ট জায়গায়, তাই ধরেই নিয়েছিলাম যে আগে তো বাস আসবে। তারপর তো যাত্রীরা উঠবে, তারপর না সে বাস রওয়ানা দিতে পারবে? অবচেতন মনে এরকমই একটা সিদ্ধান্ত মনে হয়ে গেঁড়ে বসেছিল বাসস্ট্যান্ডে আমাদের নির্দিষ্ট বাসটির জায়গা খালি দেখায়। তাই বাসের সময় নিয়ে অতোটা উৎসুক হইনি এতোক্ষণ। তবে এখন হেলেন লাজুর যুগপৎ প্রশ্নে নিজের বেকুবি ওদের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে প্রমাদ গুনলাম মনে মনে । কথা ঘোরানোর জন্য তাই বললাম যে, বাস ছাড়বে আমাদের গেটের বাইরের সবচেয়ে কাছের জায়গাটি থেকে। আর ঐ জায়গাটা এখনো খালি আছে। মানে বাস এসে দাঁড়ায়নি এখনো ওখানে। মুখে এটুকু বলে,মনে মনে ওদের উদ্দেশ্যে, অতো উতলা হবার কিছু নেই; এইরকম একটা অস্বস্তি প্রকাশ করে ফের রওয়ানা দিলাম গেইটের দিকে। উদ্দেশ্য উঁকি দিয়ে দেখে নিশ্চিত হওয়া যে এই অবসরে আমাদের বাস এসে আবার ওখানে দাঁড়ায়নি তো?
‘আরে আবার যাচ্ছ কোথায়? খেয়ে যাও’ লাজুর এই উতলা প্রশ্নের জবাবে, যাচ্ছি না, শুধু বাস আসলো কি না দেখে আসছি বলে এগিয়ে গেলাম -গেট পেরিয়ে সামনের চাতালে দাঁড়িয়ে, মাথা বাড়িয়ে বা দিকটায় নজর দিতেই দেখলাম একটা বাস এগিয়ে আসছে ঐ দিকটার স্ট্যান্ড গুলোর কোন একটাতে থামার জন্য। তা দেখে যুগপৎ একদিকে যেমন আনন্দে লাফিয়ে উঠল মন,এতো তাড়াতাড়ি অতি কাঙ্ক্ষিত বাসটি চলে আসায়; একই সাথে ধক করে উঠল মন এই ভেবে যে, আর একটু হলেই তো, টিকিট কেনার পরও বাস মিস করার সম্ভাবনা ছিল! এক্ষুণি ১৫ নম্বর বাস চলে আসবে এমন তো ভুলেও ভাবিনি!
কিন্তু নাহ! এমুহূর্তে মনে ঝলকে উঠা আনন্দ আর শংকা দুটোর মাথাতেই সামনের হিম চ্যানেল থেকে একবালতি হিম তুলে এনে ঢেলে দিয়ে, বাসটি গিয়ে থামল ১৫ নম্বর বাদ দিয়ে, বা দিকেরই অন্য আরেকটি স্ট্যান্ডে। যাক তাড়াহুড়া করা থেকে বাঁচা গেল তা হলে, ভাবলাম মনে, যদিও একটু আগেই উৎসুক ছিলাম তাড়াতাড়ি হোটেল ফেরা নিয়ে। আসলেই নিজের মনের মতিগতি তো বোঝা ভার দেখছি। নাহ ‘নিজেকে জানো’ এই কথা মহামতি সক্রেটিস এমনি এমনি বলেন নি।
থাক কনফুসিয়াসের দেশে সক্রেটিস ভাবনা দূরে থাক এখন। ওসব চিন্তার চেয়ে এক্ষুণি দীপ্রর কাছ থেকে টিকিটটি নিয়ে, ফের সেই ঘরের সামনের আমার মুশকিল আসান কারী বাহলুল মজনুর কাছে যাওয়া জরুরী, যার সহায়তায় টিকিট ঘরের চাচার কাছ থেকে পেয়েছিলাম টিকিট! টিকিট দেখিয়ে তার কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়া দরকার, বাস ছাড়ার সময়ের ব্যাপারে।
আসলে তখন টিকিট হাতে পেয়ে, সঠিক টিকিটই পেলাম কি না, তা নিয়েই বেশি উদগ্রীব থাকায়, আমার চায়নিজ বাহলুল কে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম, আমাদের বাসটি আসবে কখন?
“কি বাস এলো নাকি” ? আমাদের বসার জায়গাটার কাছে এসে দাঁড়াতেই যুগল প্রশ্ন লাজু আর হেলেনের।
নাহ, আমাদের টা এখনো আসে নি। দীপ্র বাবা, দাও তো টিকিট টা, দেখি ওখানে লেখা আছে কি না বাস ছাড়ার সময়? যুগপৎ উত্তর আর প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম লাউঞ্জের আমাদের ক্ষণস্থায়ী পারিবারিক কর্নারের বাতাসে ।
হাতানো যন্ত্রের স্ক্রিনে গভীর মনোযোগী চোখ রেখে দ্রুত আংগুল চালিয়ে গেম খেলায় ব্যস্ত দীপ্র স্ক্রীন থেকে চোখ না তুলেই , বললো “এই তো আমার পাশে রেখেছি, নাও তুলে”
একদিকে ঐদিকে তাকিয়ে দীপ্রর পাশে টিকিট দেখতে পেলাম না যেমন, তেমনি অন্যদিকে ওর জবাব দেয়ার ভঙ্গিটাকে চূড়ান্ত বেয়াদবি মনে হওয়ায়, ভেতরে একই সাথে তুমুল বিরক্তি আর রাগ ঘোট পাকিয়ে একটা জবর ধমক হয়ে বের হতে যাবে যখন মুখ দিয়ে, সামলালাম নিজেকে তখন। ভাবলাম আমার বালকবেলা আর দীপ্রর বালকবেলা এক নয়। এরকম অবস্থায় আব্বার একটা বাঘা ধমক আমার জন্য অনিবার্য যে হতোই, তা নিয়ে কোনই সন্দেহ নাই। কিন্তু এখন তো আমাদের পিতা পুত্রের সম্পর্কটা ওরকম না। এছাড়া ডিজিটাল যুগে বাচ্চাদের, তার চেয়ে বড় কথা বালক কিশোরদের আত্মসম্মান বোধ আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রখর।
অতএব উচ্চস্বরে ধমকের বদলে স্থির ঠাণ্ডা গলায় বললাম, বাবা এটা কি ঠিক? তোমার হাতে টিকিট টা দিয়েছিলাম এই একটু আগে। আর এখনি আমি সেটা চাচ্ছি, ক’টার সময় বাস ছাড়বে তা দেখার জন্য, কিন্তু সেটা তুমি দিতে পারছ না। আবার সেটাকে তুমি যেখানে রেখেছ বলছ, সেখানে তো তা দেখতেই পাচ্ছি না! কি হবে, এটা যদি চেয়ার থেকে উড়ে মেঝেতে পড়ে কারো জুতার তলায় লেগে চলে গিয়ে থাকে? এটা কি তোমার কোন রেন্সপনসিবল কাজ হল? আর কারো কথার জবাব যদি এভাবে দাও, সেটাও কি ঠিক?
“আরে সেই থেকে তো এই খেলা নিয়েই আছে ছেলেটা। খেতে বলছি, তাও শুনছে না। এমনিতেই কোন কিছু যত্ন করে রাখতে জানে না ছেলেটা। আবার এখন করছে এরকম অভদ্রতা! একদম মার দিতে হবে ধরে ইত্যাদি ইত্যাদি“ তীব্র গলায় ওপাশের চেয়ার থেকে বলতেই থাকলো লাজু।
সাথে সাথে নিজেকে সামলালাম আরো। কারণ একইসাথে বাবা মার আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে দীপ্র বেচারার অবস্থা তো করুণ হয়ে যাবে। অবশ্য ততক্ষণে দীপ্রও বুঝে গেছে বিপদের মাত্রাটা, অতএব সাথে সাথে ও খেলা বাদ দিয়ে টিকিটটা খোঁজার জন্য, সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই, একই সাথে দুজনেরই চোখে পড়লো কিছুটা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কাগজটা। টিকিটটা পাশে রেখে গভীর মনোযোগে খেলতে গিয়ে কখন যে ওটা চলে গেছে ওরই নীচে , তা বেচারা খেয়াল করেনি।
আমি ওটা ধরতে যাওয়ার আগেই ছো মেরে চেয়ার থেকে দীপ্র ওটা তুলে ‘সরি বাবা’ বলে আমার হাতে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সামলাতে লাগলো মায়ের বাক্যাক্রমণ।
ঠিক আছে, ঠিক আছে! পাওয়া গেছে ওটা। এ কথা বলে দীপ্রর উদ্দেশ্যে ছোড়া লাজুর শব্দশেলের তোড় থামানোর চেষ্টা করার সাথে সাথে, ছেলেকে বললাম যাও বাবা, মা যা খেতে বলছেন তা নিয়ে আস মা’র কাছ থেকে।
এ মুহূর্তে কাছে গেলে মায়ের শব্দশেলের তোড়ের কিয়দাংশ যে চড় থাপ্পড়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা যে শতভাগ সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়াতে ঐদিকে যাওয়ার কোন উদ্যোগ না নিয়ে, দীপ্র বলল ‘আমাদের বাস তো ছাড়বে ফোর থার্টিতে’।
তাই না কি? কিভাবে জানলে ? এখন ক’টা বাজে ? একই সাথে এই তিন প্রশ্ন বেরিয়ে এলো মুখ থেকে নিজেরই অজান্তে।
“তিনটা বাজে এখন” ভাইয়ের বিপদ দেখে হাতফোনে খেলায় ব্যস্ত অভ্র, খেলা থামিয়ে জবাব দিল।
“কেন টিকিটেই তো লেখা আছে? দেখ নি তুমি?” বলতে বলতে দীপ্র ঠিকই আমার কাছে হিজিবিজি হিজিবিজি মনে হওয়া কাগজটিতে ছোট করে হলেও ইংরেজিতে লেখা সময়টি দেখিয়ে দিল।
দ্বিবিধ কারণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। প্রথমত টিকিট পাওয়া গেছে। তার মানে হল টিকিট হারিয়ে ফের টিকিট কেনার ঝক্কি থেকে যেমন বাঁচা গেল, তেমনি কিছু রেন মেন বি ও জলে গিয়ে বাইরের হিচ্যানেলের ঠাণ্ডায় জমে বরফ হল না । অবশ্য এ অবস্থায় কড়কড়ে রেন মেন বি র জলে গিয়ে বরফ হয়ে যাওয়ার দুঃখের চেয়ে, ফের টিকিট কিনতে যাওয়ার ঝক্কিটাকেই বড় ঝামেলা মনে হচ্ছিল।
হাঁফ ছাড়ার দ্বিতীয় কারণ হল, আমাদের বাস আসার আর কিছু সময় হাতে আছে। সুতরাং বাস স্ট্যান্ডের ১৫ নম্বর বাসের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটি খালি থাকলেও তেমন আশংকার কিছু নাই। একটু আগে তৈরি হওয়া উত্তেজনাকর অস্বস্তিটি এক্ষণে চলে যাওয়ায়, উম উম গরমের আরমদায়ক উষ্ণতার লাউঞ্জটির আবহাওয়া যাতে আরো বেশি গরম হয়ে অসহ্য হয়ে না উঠে তার নিদান হিসাবে লাজুর দিকে এগিয়ে গিয়ে, ওর কাছ থেকে পিতা পুত্র তিনজনের জন্য তিনটা ভোমা সাইজের কলা আর তিনটা উজ্জ্বল কমলা রঙয়ের চায়নিজ কমলা যার পোশাকি নাম ম্যান্ডারিন, তা নিয়ে দুই ভাইকে দু পাশে বসিয়ে মন দিলাম ফলাহারে। লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিশোর গ্যাং স্টার : রুখবে কে
পরবর্তী নিবন্ধকরোনায় রমরমা মাদক ব্যবসা, অর্থ পাচার এবং কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি