মাও যে শুধু তার যোগ্য উত্তরসূরি কে হবেন? তা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন তা ‘ই নয়! আর সবদেশের মধ্যযুগীয় রাজরাজড়া আর একনায়কদের মতো তিনিও যে পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলেন মুষ্টিমেয় চাটুকার সুযোগসন্ধানীদের দ্বারা, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সেটিও আজ এক ঐতিহাসিক সত্যই। ফলে একদম পরিণত বয়সে মাওয়ের মৃত্যু হওয়ার পরও, সে সময় সাথেসাথেই চায়নিজ সরকার আর পার্টি পড়েছিল নেতৃত্বশুন্যতার গহ্বরে? কপাল ভাল সে সময় ঐ সুযোগ সন্ধানী চাটুকারেরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফেলতে পারেনি। মাওয়ের মৃত্য পরবর্তী সময়ে চায়নার আকাশে ঘনায়মান দুরযগের ঘনঘটা কাটিয়ে দ্রুতই ক্ষমতা দখল নিয়ে নেন দেং শিয়াও পিং। তাতে অচিরেই মাও কে ঘিরে থাকা ঐ মোসাহেব স্বার্থান্বেষীরা চিহ্নিত হয়েছিল, কুখ্যাত চার কুচক্রী হিসাবে। ফলে হতে হয়েছিল তাদের কঠিন বিচারের সম্মুখীন! যার মধ্যে একজন আবার ছিলেন মাও এরই অভিনেত্রী তৃতীয় স্ত্রী! নেতা হিসাবে মাওয়ের এ এক দুর্ভাগ্যই বলতে হয়। কারণ আজ এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, ভাল নেতা যোগ্য নেতার অনেক জরুরী কাজের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ তো হল নিজের যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করা । অথচ এ ব্যাপারে তো মাওকে ভয়াবহ ব্যর্থই বলতে হয়। আর সে ব্যর্থতা নিশ্চয়ই তার স্বেচ্ছানির্ধারিত।
এদিকে মাওয়ের কবিতানির্ভর করে আঁকা বিশালাকার ছবিটি ঘিরে সবার ছবি তোলাতুলির ধুম, আর ঐটি খুঁটিয়ে দেখার আগ্রহ, দুটোই যখন থিতিয়ে এসেছে, তখন আর উপরে ঘোরাঘুরি না করে নিম্নগামী হওয়ার মানসে সেই চওড়া সিঁড়ির দিকে এগুতেই, ফের মনে পড়ল একটু আগে ছবি তুলে পকেটে রাখা হাতফোনের সেই ডিজিটাল ভুতুড়েপনার ব্যাপারটির কথা, যার কোন কার্যকারণ এখনও মিমাংসিত হয় নি! এমাত্রইতো ফের এটা দিয়ে কোন ধরনের সমস্যা ছাড়াই ছবি তুললাম যখন, তখনও দেখলাম যে তার চার্জ এখনও তেমন কমেনি। অথচ এই হলে ঢোকার আগে তার চার্জহীন অন্ধকার মুখ দেখে, নিজেরই চার্জ ফুরিয়ে যাচ্ছিল ধুপ করে!
এমত ভাবনা ফের মাথায় ঘোরাঘুরি শুরু করতেই, মানসচক্ষে ভেসে উঠলো লি খাঁর গাড়ির ড্যাশবোর্ডের যেখান দিয়ে গাড়ীর হিটার থেকে বের হয় গরম হাওয়া, ঠিক সেখানেই একটা ছোট্ট নেটের শিকায় ঝুলতে থাকা তার ফোনটি। সে ছবি দেখতে পেতেই, সাথে সাথেই মনের ভেতরের দু’জন সমস্বরে “ইউরেকা”, বলে চিৎকার করে উঠল, মনে মনে!
হ্যাঁ পেয়ে গেছি অতঃপর ফোনের আপাত ব্যাখ্যাতিত সেই ডিজিটাল ভুতুড়েপণার কার্যকারণ! গাড়ীর হিটারের গরম বাতাস বেরুবার জানালায় লি খাঁ যে ঝুলিয়ে রাখে তার ফোন, তা থেকেই পেয়ে গেলাম এর ব্যাখ্যা। বুঝলাম বাইরের রক্ত না শুধু এক্কেবারে হাড়হিম করা এই যে ঠাণ্ডা, তা ফোনের ভেতরকার বিদ্যুৎ প্রবাহকেও নিশ্চয় জমিয়ে দেয়। তাতেই ফোন হয়ে পড়ে যাকে বলে জীবম্মৃত। ভেতরে যতই তার চার্জ থাকুক, ঠাণ্ডায় সেই চার্জেরও আর নড়াচড়া করার চার্জ থাকে না! ফলে লি খাঁ গাড়ীর ভেতরেও হিটার থেকে বের হওয়া গরম হাওয়ার মুখে ফোনকে ঝুলিয়ে রেখে, ওটাকে সারাক্ষন তরতাজা রাখে!
আচ্ছ, এ কেমন কথা? পদার্থবিদ্যা বিষয়ে নিতান্তই আমড়া কাঠের ঢেঁকি আমি, এ মুহূর্তে যতোটা মনে করতে পারছি বহুকাল আগে মুখস্থ করা পদার্থবিদ্যার নানান নিয়ম কানুন, স্বতঃসিদ্ধ আর সুত্র ; তাতে এমন কিছু কখনো পড়েছি বলে মনে তো পড়ছে না! তদুপরি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা এর মতো মুখোমুখি হলাম কী না আরেক নতুন প্রশ্নের! যা হল, ফোনের ব্যাটারিতে যে বিদ্যুৎ থাকে, তা কি স্থিরবিদ্যুৎ নাকি চলবিদ্যুৎ?
ভেবে আসলেই কূল পাচ্ছি না যে, ব্যাটারির মধ্যে যে বিদ্যুৎ আবদ্ধ থাকে তা কি স্থির বিদ্যুৎ? যদি তাই হয়, তবে সে বিদ্যুৎ ফোনের নানান কার্যক্রম চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয় কিভাবে? নাহ বোঝা যাচ্ছে যে, স্কুল কলেজ জীবনে পরীক্ষা পাশ দেবার জন্য না বুঝে শুনে যতোটুকু পদার্থবিদ্যা গলাধঃকরণ করেছিলাম, তার সকলি গরল ভেল!
অতএব এ ব্যাপারে দীপ্রর শরণ নেয়াটাই ভাল মনে হল। কারণ দেখেছি এ বয়সে ওরা বিজ্ঞানের নানান বিষয়ে যা পড়ছে, বা যতোটা গভীরভাবে পড়তে বাধ্য হচ্ছে, তা নিজে আমি কলেজ জীবনেও পড়িনি। এ ভাবনায় দীপ্রর খোঁজে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে, আশেপাশে তাদের দেখা না পেয়ে, সামনে বেশ ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া সিঁড়ির দিকে তাকাতেই দেখি, ওরা দু ভাই লাফিয়ে লাফিয়ে ইতিমধ্যেই নেমে গেছে একদম নীচের দিকে । এছাড়া তাদেরই অনুসরণ করে অতোটা দ্রুত না হলেও আমাদের চেয়ে ঢের বেশী দ্রুত নামতে থাকায়, হেলেনও আমাদের এই নিম্নমুখী অগ্রগমনে এগিয়ে আছে অনেকটাই।
আচ্ছা ফোনের বিদ্যুৎ, স্থির হোক আর চল বিদ্যুৎ হউক সেটিই যদি ঠাণ্ডায় জমে এরকম চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে , তবে এই হিমে গোটা বেইজিং শহর জুড়ে বিদ্যুতের যে তার টানা আছে, হউক মাথার উপরে কিম্বা ধরণীর গভীরে , সেগুলোর তাহলে কি অবস্থা হয়? অবশ্য এখন পর্যন্ত কোন বৈদ্যুতিক খুঁটি নজরে পড়েছে বলে তো মনে পড়ছে না। এখানে কি তবে বিদ্যুৎ সব চলাচল করে ভূগর্ভস্থ তারের মধ্য দিয়ে? ভুগর্ভস্থ তার বেয়ে চলাচল করলে অবশ্য এই ঠাণ্ডার ঝাপটা ঐখানে পৌছুবার কথা নয় । আর যদি কোথাও বৈদ্যুতিক খুঁটির মাথায় তার টানানো থাকেও, তবে সেগুলো নিশ্চয়ই ঐরকম তার, যেগুলোর গায়ে আছে উলেন বা তাপ অপরিবাহী মোড়ক। ফলে বাইরের ঠাণ্ডা হয়তো ওগুলোর কাছ পর্যন্ত যেতে পারে না। আর না হয় এরকম ঠাণ্ডায় তো বেইজিং এর বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার সাথে গোটা শহরেরই জীবনযাত্রা ভেঙ্গে পড়ারই কথা।
ভাল কথা, এই যে ডিজিটাল বিশ্বের মানুষের অনেক কিছুকেই আমূল বদলে দেওয়া সেই একটুখানি কামড়ে খাওয়া আপেলটি, মানে অ্যাপেল কোম্পানি কি জানে যে তাদের স্মার্টফোন কোন তাপমাত্রায় গেলে তার স্মার্টনেসই হারায় না, বরং একদমই কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে পরিণত হয় জড়বস্তুতে?
নিশ্চয়ই জানার কথা। তা না হলে প্রতিনিয়ত বিশ্বকে চমকে দিয়ে, সেটিকে জয় করছে, শাসন করছে কিভাবে অ্যাপল তার নিত্য নতুন উদ্ভাবনি দিয়ে? বলে উঠল এ কথা মনের দ্বিতীয়জন, সুযোগ বুঝে। তা হলে কি অ্যাপল এ গ্রহের বিভিন্ন আবহাওয়ায়, বিশেষ করে এরকম চরম আবহাওয়ায় যাতে সঠিক কাজ করে তাদের নানান যন্ত্র, সে জন্য একই যন্ত্রের তারা ভিন্ন ভিন্ন ভার্সন বানায় নাকি? প্রশ্ন রাখল মনের প্রথম জন!
“কি ব্যাপার তখন থেকে দেখছি ঝিম মেরে আছ? কি ভাবছ এমন মনে মনে?”
স্ত্রীর প্রশ্নে থতমত খেয়ে, কি উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। কি বললে আবার কি অর্থ হয়ে দাঁড়ায় তার, তারও তো কোন ঠিক ঠিকানা নেই। যদি বলি যে পদার্থ বিদ্যার সূত্র মনে করে ভেবে বের করতে চেষ্টা করছিলাম, কেন আমার ফোন কাজ করেনি সকালে?
ওরকম স্বীকারোক্তির নিশ্চিত উত্তর হতে পারে “তুমি কি আবার এ বয়সে আইনস্টাইন নিউটন হতে চাইছ না কি ?” কিম্বা হতে পারে এর উত্তর তারচেয়েও অকল্পনীয় কিছু। তাতে মেজাজ খিচড়ে গিয়ে এক্কেবারে গরম না হলেও হতে পারে ঈষদুষ্ণ বাক্য বিনিময়ের অবতারণা।
এমুহূর্তে গ্রেটহলের ভেতরে যথেষ্ট আরামদায়ক উষ্ণতা বিরাজমান। ফলে এখানে কোন ধরনেরই বাড়তি উষ্ণতার প্রয়োজন নাই। এমনকি বাইরের হিম ঠাণ্ডায় হলেও এই বিশেষ ধরনের উষ্ণতার ব্যাপারে আমার কোন রকমই লোভ নেই। ফলে কিছুটা সামলে বললাম যে, ভাবছি এখন নীচে নেমে আর অন্য কোন দিকে ঘোরাঘুরি না করে, গ্রেট হলের গ্র্যান্ড কনফারেন্স রুমটা খুঁজে বের করব। ওটা দেখা শেষ করেই বেরিয়ে যাবো বাইরে। অনেক কিছুই তো দেখার আছে এই তিয়েন আন মেন স্কয়ারের আশেপাশে। যতোটা পারা যায় দুপুরের মধ্যে তা দেখে, যেতে তো হবে আবার সেই পাখির বাসা, মানে এখানকার বিখ্যাত অলিম্পিক স্টেডিয়াম দেখতে ।
“তা হলে আমরা এতো আস্তে ধীরে নামছি কেন?”
আরে তাইতো, আমার তো পায়ে ব্যথা নাই কেন হাঁটছি আমরা এতো ধীরে? এ প্রশ্নের উত্তরে সত্যবয়ান ঝাড়তে যাই যদি তাহলেই তো আবার গরম হয়ে যাবে এখানকার আবহাওয়া। অতএব সে প্রশ্নের মিমাংসায়ও আর না গিয়ে, বললাম ঠিক আছে চল নামি তাড়াতাড়ি তবে।
অতপর গত কয়েক দিনের তুলনায় দু’জনে বেশ দ্রুততায় নামতে পাড়ায় ভাবলাম যে, যাক ওর পায়ের ব্যাথাটা হয়তো কমেছে। আর এ তো অতীব ভাল খবর। আগামীকাল তো যাবো বেইজিংয়ের বাইরে, সেই ছোটবেলা থেকে বই পড়ে মুখস্থ করা, পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি মহাপ্রাচির দেখতে। যদিও ঐ এলাকা সম্পর্কে এখনও কোন রকম ধারনাই নেই, তারপরও ধরেই নিচ্ছি ঐ মহাপ্রাচিরে তো আর লিফটে উঠা যাবে না। উঠতে হবে হেঁটেই। অতএব লাজুর পায়ের ব্যাথাটা এখন এভাবে কমে যাওয়া তো বেশ একটা স্বস্তিকর ব্যাপারই।
“বাবা, আমরা এখন কোনদিকে যাবো।’ নীচতলায় এসে দু জনে পা রাখতেই, এই হলঘর আর এর প্রশস্ত করিডোরময় দৌড়ঝাপে ব্যস্ত দু পুত্রের মধ্যে প্রশ্নটা এলো দীপ্রর কাছ থেকে ।
তোমরা তো এতোক্ষণ এখানে দৌড়াদৌড়ি করেছ। কোন সাইন পোস্টে কি লেখা দেখেছ যে কোনদিকে গেলে দেখা মিলবে, গ্রেটহলের গ্রেট কনফারেন্স হলের ?
“ঐ তো বাবা ঐদিক দিয়ে যেতে হবে ’ বলেই বা ‘দিকের করিডোরের দিকে এগুলো অভ্র। সাথে সাথেই দীপ্র ওর অনুগামী হতে হতে তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলল “ঐ ছেলে, তুমি বললে কেন ? বাবা তো আমাকে জিজ্ঞেস করেছে।’
“তুমি তো দেখোই নাই লেখাটা। তাই বলতেও পারো নাই। আর বাবা তো শুধু তোমাকে না, দুজনকেই জিজ্ঞেস করেছেন।’ বিজয়ীর হাসি হেসে অভ্র জবা দিতেই, দীপ্রর বাড়িয়ে দিল ছোট ভ্রাতার দিকে তার দৌড়ের গতি। এতে নিজেও কিছুটা দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে দু জনের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুই ভাইয়ের মধ্যে যাতে কোন যুদ্ধের দামামা না বেজে উঠে, তা নিশ্চিত করার লক্ষে দ্রুত এগিয়ে আসা দীপ্র কে থামিয়ে, ওর কাঁধে হাত রেখে অভ্রকেও ডেকে থামালাম। কারণ, এতোক্ষণের মধ্যে এই করিডোরেই প্রথম দেখা মিলল আরও কিছু দর্শনার্থীর।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক