হঠাৎ মোলাকাত কর্নেলের সাথে
চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বার এ দোকানে একজন বিদেশী ক্রেতার আগমন কোনো ধরনেরই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো না, কাউন্টারের পেছনে জবরজং শীতপোশাক পরে বসে থাকা বুড়োর!
‘গুড ইভনিং’ জাতীয় কোনো সাদর সম্ভাষণ তো নয়ই। বুঝলাম যে সে ইংরেজি জানে না। আরে তাতে কী? চাচা মিয়া চায়নিজেই না হয় বলতেন কিছু চুং চাং ফুং ফাং। আচ্ছা বুঝলাম, চায়নিজ বুঝবো না বলে বলেন নি তা। সেক্ষেত্রে একটু না হয় নডই করতেন।
নাহ এসবের কিছুই করলেন না জনাব। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার কারণে যে শব্দ হয়েছে তাতে হাতে ধরা ফোন থেকে দয়া করে একটু চোখ তুলে তাকালেন এদিকে শুধু। উনি না হয় বুঝলাম ধারেন না ধার আমি বাঙ্গালের, তাতে কি ? সেজন্য আমি তো আর ভদ্রতা বাদ দিতে পারি না। হাসতে হাসতে তাই বললাম, কি খবর চাচামিয়া? আছেন কেমন? এই যে আবারো আইলাম!
বলেই মনে হল আচ্ছা ঐ জবরজং পোশাকের নীচে বসে আছেন যিনি, তিনি কি চাচা নাকি চাচি তাই তো জানি না। সে যাক তাতে কিছু তো আর যায় আসে না। এ বান্দা তো আমার কোনো কথাই বুঝবে না অতএব লিংগ বিভ্রাট যদি করেই থাকি, কিছুই যায় আসে না। আসলে আমাদের দেশে তো দোকানপাঠ সবই চালায় পুরুষ মানুষেরা, সে কারণেই হয়তো অভ্যাসবশত ধরে নিয়েছিলাম ইনিও পুরুষই হবেন।
গতকাল সওদাপাতি করেছিলাম যেহেতু এখান থেকে, জানাই তো আছে এ দোকানের কোনদিকের সেলফে আছে, আমার যা প্রয়োজন। সে মোতাবেক পাউরুটি, বনরুটি, বাটারবন, জেলিবন ইত্যাদির পশরা সাজানো সেলফের সামনে গিয়ে, মেঝেতে থাকা একটা ঝুড়ি টেনে কমলার জেলির পুর দেওয়া আধাডজন বন নিয়ে ভাবলাম আর কিছু না নেই। এতেই তো হয়ে যাবে আমাদের সকালের নাস্তা।
এ ভেবেই ঝুড়ি হাতে কাউন্টারের দিকে রওয়ানা করতেই, ডানের শেলফে থাকা আলুর চিপসের বাহারি প্যাকেটগুলো ডাকল আয় আয়। সাথে সাথেই সে ডাকে সাড়া দিয়ে কটা চিপস, বাদাম আর চকলেটের প্যাকেটও নিলাম, পুত্রদের জন্য। আগামী সকালেই যাবো যেহেতু গ্রেটওয়ালে বেইজিং শহরের বাইরে, সাথে কিছু খাবার নিয়ে যাওয়াই ভাল।
অতঃপর দ্রুত কাউন্টারে গিয়ে ওসবের দাম মিটিয়ে, ভাল থাকেন চাচি, আবারো দেখা হবে আশা করি আগামীকাল রাতে বলে, তার কোনো উত্তরের আশা না করেই দোকান থেকে বেরিয়ে দাঁড়ালাম এসে ফের ফুটপাতে।
ভাবছি দাঁড়িয়ে, যাবো কোনদিকে? যেতে তো হবে আমার প্রথম এই রাজপথের ঐ পাশে। কিন্তু যাই কিভাবে? রিজেন্ট থেকে এই পর্যন্ত আসার সময় তো কোনো জেব্রা ক্রসিং দেখিনি এর মধ্যে। আমার চেনা জেব্রাক্রসিংটা তো আছে সেই পেছনে, মানে রিজেন্ট পেরিয়ে আরো সামনে। তবে কি ওইদিকেই যাবো নাকি?
নাহ এমন তো হওয়ার কথা না। সামনেও অতি অবশ্যই থাকতে হবে জেব্রাক্রসিং কিম্বা ফুট ওভারব্রিজ। সবাই তো আর সব সময়ই গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করে না এ রাস্তা ধরে। ঢাকার মতো প্রতি দশ বিশ মিটার পর পর পথচারীদের রাস্তা এপাড় ওপাড় করার যথেচ্ছ সুবিধা না থাকলেও, এক দুই কিলো মিটারের মধ্যেও ওরকম ব্যবস্থা থাকবে না, এমন তো হতে পারে না। রিস্ক যখন নিলামই আজ রাতে অচেনা পথ ধরে ম্যাকে যাওয়ার, আরেকটু রিস্ক না হয় নিলামই। দেখি না হেঁটে সামনে মিনিট পাঁচেক। তাতে যদি রাস্তার ওপাশে যাবার কোন পথ না পাই, তবে না হয় দ্রুতই ঘুরে হাঁটা ধরবো হোটেলমুখি চেনা রাস্তাতেই।
বেশিদূর এগুতে হল না। ঐ মুদিখানা ছেড়ে ফুটপাত ধরে খুব জোর ১০০ কি ১৫০ মিটার এগুতেই পেয়ে গেলাম জেব্রা ক্রসিংটা। নজরে এলো যখন ওটা, কপালগুণে ওইসময় দেখি ট্রাফিক লাইটেও পিট পিট করছে পথচারীদের জন্য রাস্তা পার হবার বাতি। অতএব তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম জেব্রা ক্রসিং এ। কিন্তু না, মাঝামাঝি এসে আইল্যান্ডে পা রাখতেই, ট্রাফিক লাইট সবুজ হয়ে গিয়ে জানিয়ে দিল আর এগুনো যাবে না।
কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে এই সড়কদ্বীপে তা তো জানি না । রাস্তার এ পাশটাতে মানে যে পাশটা পেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছি মধ্যরাস্তায়, মানে যে পাশ দিয়ে কাল এসেছিলাম এয়ারপোর্ট থেকে, সে পাশটায় তেমন গাড়ি চলাচল না থাকলেও এ পাশটায় দেখছি গাড়ি চলাচলের কমতি নেই। সাই সাই করে যাচ্ছে নানান গাড়ি। একবার ভাবলাম পুত্রদের মতো কোন গাড়ি কোন ব্র্যান্ডের তা বোঝার চেষ্টা করি, তাতে সময় কাটবে ভাল। আবার ফিরে গিয়ে পুত্রদের বলতেও পারবো যে দেখেছি কোন ব্র্যান্ডের ক’টা গাড়ি। তাতে বেশ মজা পাবে ওরা।
নাহ, পারছি না ঠাহর করতে তা। প্রথমত ধোঁয়াশায় মোড়া আলোআঁধারিতে যেরকম সাই সাই করে যাচ্ছে গাড়িগুলো তাতে গাড়ি বিষয়ে নিতান্তই অশিক্ষিত আমার সাধ্য নেই কোনটা কোন ব্র্যান্ডের গাড়ি তা নির্ণয় করার। গাড়ির রং আর আকার ভিন্ন অন্য কোনো ভিন্নতা নজরে পড়ছে না। সবই মনে হচ্ছে টয়োটা, যেমন দেখা যায় আর কি ঢাকার রাস্তায়। অতএব দিলা ক্ষেমা তাতে।
এদিকে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে মনে হচ্ছে বেইজিং হিম এই বাঙ্গালকে পেয়েছে বাগে বেশ কিছুক্ষণ পর অতপর। চামে চুমে তাই সে ধরতে চাচ্ছে জাপটে। কপাল ভাল একটু আগে যে হিমহাওয়া বইতে শুরু করেছিল, নাই সেটি এখন আর। তাতেই রক্ষা। কিন্তু তারপরও এরকম খাম্বাবত দাঁড়িয়ে থাকলে, তো মওকা পেয়ে বাঙ্গাল কে হাইকোর্ট না সোজা তিয়েন আন মেন দেখিয়ে দেবে ফের বেইজিং হিম। এ কথা মনে হতেই, জায়গায় দাঁড়িয়েই জগিং এর ভঙ্গিতে লাফিয়ে হিমকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো শুরু করতেই, দয়া হল বেইজিঙের ট্রাফিক কর্তৃপক্ষের। অতএব বিলম্ব না করে জগিং করেই রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাতে উঠে, হাঁটতে শুরু করলাম সামনের দিকে।
ক’টা বাজে এখন? নাহ ফোন বের করে সময় দেখে আর কী হবে ? বাজে হয়তো ন’টা বা সোয়া ন’টা। রাস্তার ঐ পাশটার তুলনায় এ পাশটাকে বেশ উজ্জ্বল আর কর্মচঞ্চল মনে হচ্ছে। ঐ পাশের ফুটপাতে জনমানবের দেখা না পেলেও এ পাশে আছে তা, যদিও খুব বেশি না। এরই মধ্যে বেশ কটা খোলা দোকান আর রেস্টুরেন্ট দেখে মনে হল, এ পাশটাতেই সম্ভবত যাবতীয় শপিং মলের অবস্থান। দোকান পাঠ বন্ধ করে দোকানিরা আর শপিং শেষ করে ক্রেতারা রেস্টুরেন্টে খেয়ে দেয়ে ফিরছে বাড়ি। উল্টো দিক থেকে এই মাত্রই এক জোড়া তরুণতরুণী শপিং ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে নিজেদের মধ্যে কি কথার জের ধরে যেন উচ্চৈঃস্বরে দুজনে হাসতে হাসতে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল আমার উল্টো দিকে।
আচ্ছা ঐ যে বিল্ডিংটা দেখছি দাঁড়িয়ে আছে যা আলোর মালা শরীরে জড়িয়ে, যার গেইটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে লাল কাগজ নাকি কাপড় দিয়ে বানানো দুটো জিভ বের করা বিরাটকায় চায়নিজ সিংহ, এটিকে তো চেনা মনে হচ্ছে!
ঠিকই তো আছে, চেনাই তো এটা। কারণ সকালে এদিক দিয়েই তো লি খাঁ গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তিয়েন আন মেনে। ঐ সময় তা চোখে পড়ার পর খুব একটা আমলে না নিলেও নিশ্চয়ই সেই ছবি মগজের কোনো নিউরনে স্মৃতি হয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে পড়েছিল। যার কারণেই এরকম চেনা চেনা মনে হচ্ছে। দিককানা আমার অবচেতন সুযোগ পেলেই মনে হচ্ছে নানা ল্যান্ড মার্ক জমা করে রাখে মগজে পরবর্তীতে যাতে তা আমার পথঘাট চেনার কাজে লাগে।
এদিক দিয়ে ঘুরে এসে ম্যাকের সেই আউটলেট খুঁজে পাবো কি না, সে ব্যাপারে এতোক্ষণ সন্দেহের দোলচালে ভুগলেও, এই সিংহ মামাদের সাথে দেখা হতেই উবে গেল তা। এখন বেশ নিশ্চিত আমি যে ঐ মলটির পরেই বা দিক দিয়ে যে পাশ রাস্তা ঢুকে গেছে মূল রাস্তা থেকে সেটি ধরে সামনে এগুলেই পেয়ে যাবো ম্যাক। দ্রুত হয়ে গেল এতে চলার গতি।
হাতের বাঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মলটি পেরিয়ে যেতে যেতে দালানটির মতোই, সারা শরীরে ছোট ছোট রঙিন বাতির মালা জড়িয়ে জিভ বের করে ক্রেতাদের স্বাগত জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা সিংহ মামাদের হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে বললাম, দেখা হবে মামারা অচিরেই তোমাদের সাথে। অবশ্যই আসব তোমাদের মলে বউ বাচ্চাসহ আগামীকাল রাতে না হলেও, পরশু দিন যে কোনো সময়। এখন তাড়া আছে, ম্যাক আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
নাহ সিংহ মামাদের মল পেরিয়ে বাঁয়ে ঢুকে যাওয়া পাশ রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর, আশপাশের সব কিছু মিলিয়ে কেন যেন মনে হল, নাহ এদিকটায় পাওয়া যাবে না ম্যাক। ওটা পেতে হলে যেতে হবে আরো সামনে এগিয়ে পরবর্তী ব্লকের বাঁয়ের পাশ রাস্তায়।
একবার ভাবলাম তাও যদি হয়, এদিক দিয়ে এই ব্লকে ঢুকে, ভেতর দিয়ে তো নিশ্চয় ঐ ব্লকে যাওয়ার রাস্তা থাকবে। অতএব এগুতে থাকি না এদিক দিয়েই। ফের মনে হল, নাহ অচেনা জায়গায় এরকম ভেতর পথে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা বেশি অন্তত আমার মতো দিককানার। তার চেয়ে বরং চেনা এই বড় রাস্তার পাশ ধরে এগুনোই ভাল। অতএব দ্রুত দিলাম ঘুর হাঁটা ।
ঘুরে এসে অচিরেই বড় রাস্তার সাথে গলাগলি করে এগিয়ে যাওয়া ফুটপাত উঠে, তাকেই অনুসরণ করে এগুতে এগুতে, হঠাতই নজরে এলো ছাগলা দাড়ি সমৃদ্ধ কর্নেল সাহেবের হাসি হাসি মুখের চেহারাটা। হাসছেন উনি আমার দিকেই তাকিয়ে। খুব জোর মিটার পঞ্চাশেক হবে দূরে আছেন উনি ফুটপাত সংলগ্ন একটা দালানের একতলার মাথার উপরে! বাহ চমৎকার একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে তো সবাইকে না হলেও অন্তত পুত্রদের। তাছাড়া কথা হচ্ছে এই হিমরাতে হঠাৎ করেই কর্নেল সাহেবের সাথে এভবে মোলাকাত হয়ে যাওয়ার পর তাঁকে অগ্রাহ্য করাতো উচিৎ হবে না মোটেই।
মহানন্দে দ্রুত তাই বিখ্যাত সেই মুর্গিভাজার দোকানের দিকে এগুলাম। এখান থেকে ইচ্ছে করলে বার্গারও নেয়া যাবে আবার নেয়া যাবে মুর্গিভাজাও। যেটাই নেই এ নিয়ে তো কারোই কোনো আপত্তি থাকবে না। অতএব মেন্যু বিষয়ক নো ঝামেলা।
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, সংগঠক