লাল সবুজ নুডুলস বার
ভাতুষ্পুত্রদের নিরাপত্তা বিষয়ে অস্থির হেলেনকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, চিন্তা করিস না। সব তো ফকফকা এখানে। লোকজনও নেই তেমন। ফুটপাতটাও বিশাল। চোখের সামনেই তো আছে ওরা। তবে আমার এ কথাগুলোর কতোটুকুই যে ঢুকলো ওর কানে, নিশ্চিত নই। আছে তো ও দৌড় না জগিং এর উপর। তাই পুরো কথা যে শোনেনি ও এ বলা যায় হলফ করেই। এদিকে নিজে মনে যতোই স্বস্তি বোধ করি না কেন গোটা আবহটির কারণে, ওদের তিনজনের তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যাওয়াটা কী রকম যেন একটা চাপ সৃষ্টি করলো ভেতরে, গতি বেড়ে গেল নিজেরও তাই কিছুটা।
রাস্তার এ পাশটাও মোটামুটি জনশুন্য হলেও বেশ জমজমাট ভাব আছে এর। আসলে এ পাশে অনেকটা গায়ের সাথে গা লাগিয়ে থাকা বেশ কিছু আলোকোজ্জ্বল দালান থাকায়, আর হাবেভাবে যেগুলোর বেশ ক’টাকে মার্কেট জাতীয়ই মনে হওয়াটাই সম্ভবত ঐ জমজমাট ভাবটির নীরব কারণ। তার উপর যোগ হয়েছে এ পাশে আলোর উজ্জ্বলতা। রাস্তার ঐ পাশটাতে মানে বেইজিং শহরের আমাদের বাসস্থান রিজেন্ট হোটেল যে পাশে আছে, ওখানটায় রাস্তায় আলো দিচ্ছে মূলত একটা আরেকটা থেকে বেশ দূরত্ব রেখে পর পর দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টগুলোই। সাথে আছে আইল্যান্ডের গাছে গাছে জ্বলতে থাকা আলোকসজ্জার নরম আলো। কিন্তু এদিকটায় ল্যাম্পপোস্ট আর আলোকসজ্জার নরম আলোর সাথে যোগ হয়েছে আশেপাশের দালানগুলোর গা থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকা জোরালো বাতির আলোর ঝলক। ফলে শুরু থেকেই ধোঁয়াশার মধ্যেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম ১৫০/২০০ মিটার দূরে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে টগবগ করতে থাকা দুপুত্র, হাত দিয়ে নির্দেশ করছে তাদের সামনে ফুটপাতের ডানে থাকা দোকান মতো ঘরটার দিক। ধারনা করছি সেটাই হল দীপ্রর দেখা সেই নুডুলস রেস্টুরেন্ট।
এদিকে জগিং স্পিডে এগিয়ে যাওয়া হেলেন ওদের সাথে এসময় যোগ দিতেই, পুত্ররা অস্থিরতা প্রকাশ করলো আমার গজেন্দ্রগমনের প্রতি। যদিও কিছুটা বাড়িয়েছিলাম গতি, কিন্তু সন্তুষ্ট নয় ওরা তাতে। দু’জনে চার হাতে ডাকাডাকি করে অস্থিরতা প্রকাশ করতেই, নিজেও জগিং করে অচিরেই পৌঁছে গেলাম।
কপালে বড় আকারের চাইনিজ লেখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভাব্য সেই নুডুলস হাউজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে নজর ফেলতেই, হাসিমুখে সম্ভাষণ জানালো দরজার পাশে বড় একটা জামবাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই চায়নিজ বান্দর বছরের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বান্দর মহাশয়। কার্ডবোর্ড কেটে শিল্পীর তুলির আঁচড়ে তৈরি সেই বানরটি আকারে গরিলার চেয়েও বড় এবং দেখতে বড়ই খাসা ও হৃষ্টপুষ্ট। শরীরের নানান বাঁকের কারুকাজে তার জ্বলছে নানান রঙের ছোট ছোট বিজলিবাতি।
‘বাবা বাবা, আমরা কি ঢুকবো না এখানে’? দীপ্রর এই প্রশ্নে ভাবলাম বলি, এখানে তো এলামই এই রেস্টুরেন্টের খোঁজেই।
তবে তা না বলে, চল যাই বলে, দরজার দিকে এগুতেই, দীপ্র ফের বলে উঠলো, ‘কিন্তু এ রেস্টুরেন্ট কি খোলা আছে ? কোনো লোকজন তো দেখছি না’।
‘এই মনু, পিকাসো তোমরা এই বানরটার পাশে দাঁড়াও তো, দেখি একটা ছবি তুলি ‘রেস্টুরেন্টটি খোলা আছে কি না তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় থাকা ভাইপোর কথার পিঠে হেলেনের এই কথা, তুমুল বিরক্তি কারণ হয়ে দাঁড়াল দু’পুত্রের কাছেই।
‘না না, এখন ছবি তুলবো না’ বলে দুজনেই প্রতিবাদী হয়ে উঠতেই, ব্যাপারটি সামলানোর জন্য বললাম, ঠিক আছে, আগে ওরা খেয়ে নিক, তারপর বের হওয়ার সময় ছবি তোলা যাবে। ভেতরে আর কোনো লোকজনের দেখা এখনও না পেলেও, বানর বাবাজি তো আছেনই সর্বক্ষণ মওজুদ এখানে কাস্টমারদের স্বাগত জানানোর জন্য।
বলতে বলতে দরজা পেরিয়ে ভেতরে পা রাখতেই, ডান থাকা একটা উঁচু টেবিলে রাখা স্বয়ংক্রিয় ক্যাশমেশিনের ওপাশের মনুষ্যমুখটির দেখা পেতেই বুঝলাম, নাহ একদম খা খা তেপান্তর না এটা, আছে মানুষ একজন অন্তত ক্যাশ কাউন্টারে।
এদিকে আমাদের উপ্সহিতিতে ক্যাশ কাউন্টারের পেছন থেকে দ্রুত সে মনুষ্যমুখটি সশরীরে বেরিয়ে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে সামনে দাঁড়াতেই, দেখি ছোট খাট আকারের গাট্টাগোট্টা ধরনের চায়নিজ মহিলা উনি। এক ঝলকের আপাদমস্তক জরীপে মনে হল ইনিই সম্ভবত ম্যানেজার কিম্বা স্বয়ং মালিক। তা তিনি যাই হোন কেন, দেখে মনে হচ্ছে ইনি নিশ্চয় নিজেও ভোজনরসিক। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বা মালিকদের টিং টিঙে হাভাতে চেহারা ও আকার মোটেই মানানসই নয়। সেদিক থেকে ইনি মালিক বা ম্যানেজার হিসাবে এক্কেবারে খাপে খাপ।
চমৎকার ফিটফাট সবুজকোট, লালপ্যান্ট পড়া মালিক বা ম্যানেজারের পেছন পেছন ভেতরের দিকে এগুতে এগুতে হঠাৎই মনে হল, আরে এ তো দেখছি পরে আছে আমাদের পতাকার রং! সাথে সাথে আনন্দে নেচে উঠলো মন।
কঝকে তকতকে পরিচ্ছন্ন এই রেস্টুরেন্টটির ভেতর মহলে বিনাবাক্যব্যয়ে শুধু দেহভাষার কারিগরিতে সসম্মানে আমাদের পৌঁছে দিয়ে, হাতের ইশারায় পছন্দসই যে কোনো টেবিল দখল নিতে বলে, চলে গেলেন উনি ফের ক্যাশ কাউন্টারের দিকে। পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা টেবিলচেয়ার সম্বলিত এই ঘরকে একদমই ফাঁকা বলতে হতো যদি না এ সময়ে চোখে পড়তো, এক কোণের এক যুগল টেবিলে বসে সুড়ুত সুড়ুত করে নুডুলস খেতে থাকা যুগলের দিকে।
এদিকে দুপুত্র ততোক্ষণে দ্রুত গিয়ে ঘরটির মাঝামাঝি জায়গায় পেতে রাখা চারজন বসা যায় এমন একটা টেবিলের দখল নিয়ে দু পাশের চেয়ারে মুখোমুখি বসে পড়তেই নিজেরাও গিয়ে বসলাম দু পাশে ভাগ হয়ে। পুরো রেস্টুরেন্টটা এবার ভাল করে চোখ জরীপ করতেই টের পেলাম ঐ ম্যানেজারের পোশাকের রঙয়ের মতোই ভেতরের সাজসজ্জাতেও আছে লাল সবুজের খেলা। আচ্ছা, এর নাম কি তবে লালসবুজ নুডুলস বার? হতেই পারে। চায়নিজ সংস্কৃতিতে তো লাল মানে হল সাফল্য, সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য। আর সবুজ মানে তো হলো পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা। অতএব সাজসজ্জা আর পোশাকের মতো এর নামও যদি লালসবুজ হয়, তবে তা হয় লাগসই।
‘কেউ কি আমাদের অর্ডার নিতে আসবে না নাকি বাবা’? টেবিলে থাকা মেনুবুকে গভীর মনোযোগে চোখ বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করলো দীপ্র।
মেনুটা কি তুমি পড়তে পারছ ?
‘কেন পারবো না। এটা তে তো চায়নিজের সাথে সাথে ইংরেজিও লেখা আছে’ দীপ্রর উত্তর পেতেই, অভ্রর দিকে তাকিয়ে সেখি তারও গভীর মনোযোগ ঐ মেনুবুকেই। ওদেরকে তাই আর না ঘাটিয়ে হেলেনকে বললাম তুই ও দেখ না, কি খাবি ঠিক কর।
‘নাহ এখানে আমি কিছু খাবো না। ওরা অর্ডার করার পর দেখি কি দেয়। আমিও আসলে ম্যাকের বার্গারই খাবো’।
বোজা গেল নুডুলসের বাটিতে ব্যাঙ, টিকটিকি বা পোকামাকড় থাকবেই থাকবে এরকম বদ্ধমূল ধারনার বশবর্তী হেলেন, এখানে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। ঠিক ঐ কারণে না হলেও ভিন্ন কারণে আমারও এখানে কিছু অর্ডার করার ইচ্ছা ছিল না। ধারণা করছি দু’পুত্র, চায়নায় আসার পর থেকে এই প্রথম একটি চায়নিজ হোটেলে বসে নুডুলস খেতে পাওয়ার আনন্দ উত্তেজনায়, এমন কিছু অর্ডার করে বসবে যে তারা দু’জনে তা খেয়ে শেষ করতে পারবে না। তখন খাবারটুকুর দায়িত্ব তো আমার ঘাড়েই বর্তাবে। তারপরও কি মনে করে যেন তুলে নিলাম হাতে মেন্যুবুকটি।
মেনুবুকের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বোঝা গেল চেহারায় সজ্জায় এটি নুডুলস বার হলেও, মেন্যু এর অনেক বিস্তৃত। ডাক, বিফ, চিকেন, পর্ক, এগ, বা সিফুডের মিশেলে তৈরি নানান পদের ভাতও বেঁচে এরা। আর তোফু তো মনে হচ্ছে সর্বত্রই বিরাজমান। পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভাবছি দেব নাকি, ডাম্পলিং, সা’তে বা সালাদ জাতীয় স্টার্টার কিছু একটা নিজের জন্য?
‘বাবা বাবা আমি এই ৯ নম্বরের নুডুলসটা খাবো’? দীপ্রর এ ঘশ্নারর পিঠেই, অভ্রকে জিজ্ঞেস করলাম তার কী পছন্দ
‘হুম বুঝতে পারছি না। আরেকটু দেখে নেই’। ‘আরে এই বোকা আর দেখে লাভ নাই। আমি যেটা বললাম সেটাই নাও’ অনেকটা হুকুমের সাথে আসা ভাইয়ার কথার জবাবে ফোঁস করে অভ্র বলল ‘আমি তাহলে ১২ নম্বরটা খাবো’
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। ওটাই ভাল হবে। দু’জনে দুরকমের নুডুলস নিলে, দুটোই টেস্ট করতে পারবে দুজনে। ‘ফুপ্পির একথা কানে যেতেই দু ভ্রাতাই একই সাথে তীব্রস্বরে অনাস্থা ঘোষণা করতেই, টেবিলের আবহাওয়া যাতে এতে গরম না হয়ে উঠে সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে বললাম, তোমরা কি আর কিছু নেবে না? শুধু নুডুলসেই চলবে?
‘হ্যাঁ, ওটাতেই চলবে দেখছো না কতো বড় বাটিতে করে দেয় নুডুলস এরা’ বলেই নুডুলস সেই পানরত যুগলের সামনে থাকা ছোটখাট গামলা সাইজের জামবাটি দুটোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো দীপ্র।
হুম ঠিকই বলেছ। আচ্ছা আমি তাহলে একটা স্টার্টারের অর্ডার দেই। তোমার ওখান থেকে ইচ্ছে হলে খেতে পারবে বলেই অর্ডার দেবার জন্য লোকের খোঁজে ডানে, বাঁয়ে, পেছনে মাথা ঘোরাতেই কোত্থেকে যেন ভোজবাজির মতোই হাজির হল, লালসবুজ ওয়েটার ড্রেস পরা এক চায়নিজ বালক।
ওকে দেখেই মনে হল কথা আমি বাংলাতেই চালাতে পারি, কারণ স্বয়ং ম্যানেজারই যখন, আসল লাল সবুজের দেশের মানুষের সাথে কথা বলার জন্য ভুলেও মুখ খোলেননি, এ ওয়েটার ভাতিজা সেখানে নিশ্চয়ই ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবে না। মেন্যুতে যে ইংরেজি আছে তাতেই তো আমি মহা নিশ্চিন্ত।
মেন্যুবইটির পাতা উল্টে, পুত্রদ্বয়ের চাহিদা মাফিক নুডুলসের নম্বর আর নিজের জন্য চিকেন সা’তের নম্বরটি দেখানোর সাথে হাতের আঙুলে, এক নির্দেশ করে মুখে বললাম, যাও ভাতিজা একটা করে নিয়ে আস এই তিন ডিস। তিন তিনবার দিলাম একই অর্ডার দুই তিনভাবে। যাতে কোনো মতেই ভুল হবার সম্ভাবনা না থাকে। জবাবে প্রতিবারই, মুচকি হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে ভাতিজা জানাল যে, বুঝেছে সে তা ভালোই। লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক