লেখা চায়নিজ, ছবি না!
আশার কথা হলো ঐ বন্রুটিগুলোর প্যাকেটের উপর সবই চায়নিজ লেখা হলেও, কপালগুণে ছবিগুলো চায়নিজ না। তাই ছবি দেখে বুঝতে পারছি কোনটার অন্তরে বা অন্দরে মাখা আছে কোন ফলের জ্যাম বা জেলি । অন্তরে উন্নত মানের তেল, মানে মাখন দেয়া রুটিকে যখন আমরা ডাকি বাটারবন, তবে এদের এই ফলের জেলি দেয়া বনকে অবলীলায় ডাকা যায় জেলিবন। আচ্ছা দাম কতো এগুলোর একেকটার? আন্দাজে এগুলো ঝুড়িতে নিয়ে, দাম মেটাতে গিয়ে শেষে আবার ভির্মি খাবো না তো?
এমত ভাবনায়, একটা প্যাকেট নিয়ে উল্টে পালটে দেখতে দেখতে ভাবছি, আচ্ছা এই হিজিবিজি চায়নিজ লেখা উল্টে পাল্টে দেখে আর কি হবে? চায়নিজ যেহেতু পড়তে পারি না, ওর মধ্যে দাম লেখা থাকলেও সেটাও তো আমার কাছে যেই লাউ সেই কদু, মানে হিজিবিজিই হবে। কি আর লাভ হবে এই প্যাকেটের গায়ে গরুখোঁজার মতো দাম খোঁজার পণ্ডশ্রম করে? নিলে আর কতোই বেশি নেবে দু চার পাঁচটা জেলিবনের দাম এরা। আছে যা কপালে, তাই হবে নেই না নিয়ে, ভেবেই একটা জেলিবন ঝুড়িতে ফেলতেই, ঐটি একটা ডিগবাজি দিতেই, বিশাল না হলেও মোটামুটি মাপের মুশকিল আসান হিসাবে তার গায়ে ছোট একটা কমলা রঙ্গয়ের স্টিকারে দামটা জ্বলজ্বল করতে দেখলাম পরিষ্কার ইংরেজিতে!
দামটা দেখার সাথে সাথেই এদিকে মাথার ভেতরের স্বয়ংক্রিয় কারেন্সি ক্যালকুলেটর, যেটা দেশের বাইরে পা রাখতেই চালু হয়ে যায় নিজে নিজে, সেটি তার কাজ শুরু করে দিতেই ঐ দাম বাংলা টাকায় পরিণত হয় গেল। ঐ দামের ভারে বোঝা গেল যে, এগুলো বেশ সৈয়দবংশীয় বেকারির জেলিবন হবে। মানে যেরকম দামে ঢাকার গুলশান বনানি ধানমণ্ডির অভিজাত বেকারিগুলো তাদের পাউরুটি ব্রনুটি বিক্রি করে, এগুলোও ঐরকমের দামের। দামের ব্যাপারটির এভাবে খোলাসা হতেই বুঝলাম, নাহ বেমক্কা আর ধরা খেতে হবে না, দাম মিটাতে গিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকা ঐ খাম্বাবৎ ক্যাশিয়ারের কাছে। অতএব নিয়ে নেই এগুলোই আধা ডজন। কিন্তু নেব কোন ফলের জেলিবন? কারণ দুইপুত্রের আবার ফল এবং ফলের জেলি বিষয়ক বাছ বিচার আছে! নাহ, কমলার জেলিবনই নেব সবার জন্য। দেশে বসেই যখন আখছারই নানা আকারের চায়নিজ কমলা কিনে খাই, তাতে চায়নায় এসেও চায়নিজ কমলার জেলিবনই খাওয়াই ভাল। আর এই ফলে ঘরের কারুরই কোন অরুচি নাই, অতএব সেটি নেয়াই ভাল।
কিন্তু সমস্যা হল গোটা তাকটিতে একই ফলের ছবিওয়ালা জেলিবন পাচ্ছি না একাধিক। মানে আমাদের পাঁচজনের জন্য পাঁচটা কমলার জেলিবন তো পেলামই না, পেলাম না অন্য কোন একই ফলের পুর দেয়া পাঁচটা বনও! ঘটনা কি? এখানে কি এগুলো স্যাম্পল সাজিয়ে রেখেছে না কি? দোকানের ভেতরে আছে নাকি কোন স্টোর? তাহলে এই কমলার জেলিবনটি নিয়ে গিয়ে, ঐ খাম্বাকে দেখিয়ে বলবো নাকি যে, লাগবে এটা আমার আধা ডজন না হলেও কমপক্ষে পাঁচটা। কিন্তু তাতে কি লাভ হবে কোন? থাক এগুলো যদি স্যাম্পলই হয়, তবে সেই স্যাম্পলই নিয়ে নেই। আমাদের দেশের মানুষের বিশেষত ঔষধ কোম্পানির ঔষধের ব্যাপারে একটা ধারণা হলো, বাজারে যে ঔষধ বিক্রি করে নানান বাংলাদেশী কোম্পানিরা, তাদের সে সব পণ্যের চেয়ে, তারা ডাক্তারদের যে স্যাম্পল দেয় সেগুলোর মান ভাল। আর চায়নিজ পণ্যের ব্যাপারে সারা বিশ্বেরই মানুষের যে খুব উঁচু ধারণা নেই, তা তো সর্বজনবিদিত। অতএব দেশিসূত্র ধরে এখানেও না হয় জেলিবনের স্যাম্পলই কিনি।
অতএব এক এক করে পাঁচটা জেলি বন তুলতে গিয়ে, তার একটার উপরের ছবি দেখে মনে হল, ঐ ছবিটা কোন ফলের নয়, বরং মিষ্টি আলুর! মিষ্টি আলুর আবার জেলি হয় না কি? অবশ্য চায়নার ব্যাপারে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীমহলে হালের একটা বহুল প্রচলিত কথা হল যে, ওদেরকে ক্রেতা যা বানিয়ে দিতে বলবে, তারা তাই বানিয়ে দিতে পারে ঠিক ঠিক? কিন্তু এই দোকানের জেলিবন তো আর রপ্তানি পণ্য না? এটা তো এখানকার পাড়াতো মুদি দোকান। তার মানে মিষ্টি আলুর জেলি না হলেও ওটিকে পুড়িয়ে বা সিদ্ধ করে পেস্ট বানিয়ে, মাখন বা জেলির মতো রুটিতে মাখিয়ে এরা নিশ্চয়ই খায় এখানে সচরাচর। আর না হয় যে বেকারিই এটা বানিয়ে থাকুক না কেন, সে তা বানাবে না কেন?
চায়নিজরা মিস্টি আলু মাখা বন খেলে খেতে পারে, কিন্তু আমরা তো মিষ্টি আলু দিয়ে রুটি খাই না। অতএব এটা আমার নেয়া চলবে না, এ ভেবে উল্টে পাল্টে দেখলাম আর কটা বন। আর তাতে পরিষ্কার হল অন্তত একটা মিস্টিআলুর পেস্টবন যদি না নেই, তবে আমার পাঁচটা বনের কোটা পূরণ হচ্ছে না। অতএব নিয়ে নিলাম তার একটা। নিতে নিতে ভাবলাম, আচ্ছা ছোটবেলায় তো আমরা অনেক খেয়েছি মিষ্টি আলু সিদ্ধ করে, পুড়িয়ে কিম্বা, যাকে বলে তাওয়ায় টেলে। কিন্তু ইদানিং তো ঢাকার বাজারে কালেভদ্রে নজরে পরে ঐ মিষ্টিআলু। তার মানে কি? আমাদের দেশে কি এখন আর আগের মতো মিষ্টি আলুর চাষ হয় না নাকি? না কী একদিকে এখনকার প্রজন্ম ঐ মিষ্টি আলু খাওয়ার মজা জানে না বলে, অন্যদিকে আমাদের প্রজন্মের লোকজন স্বাস্থ্য সচেতনতার ফলে মিষ্টিআলু খাওয়া বাদ দিয়ে দেয়াতে এর চাহিদা কমে যাওয়াতেই কি কৃষকরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে সেটি উৎপাদন করার? আর তা যদি হয়েই থাকে চায়নায় তা হলো না কেন?
চায়না তো দেখছি তার মিষ্টি আলুকে তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে অভিজাত রুটির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে! সে জায়গায় তো আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে মিষ্টি আলু সম্ভবত হয়ে উঠেছে নিতান্তই গ্রাম্য খাবার! মাছে ভাতে বাঙ্গালির সন্তানেরা যদিও আজকাল টনে টনে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পটেটু চিপস, পটেটু ওয়েজেজ নামের গোল আলুভাজা খেলেও, নিজদেশের মিষ্টি আলুকে মনে করে গ্রাম্য খাবার! আর হয়েছে এটি আসলে বহুজাতিক নানান কোম্পানির প্রচারনার কারসাজিতে, যার ছোঁয়া যে চায়নাতেও লেগেছে, তাও বুঝতে পারছি। কারণ এখানেও দেখতে পাচ্ছি গোল আলুর চিপসের নানান প্যাকেট। কিন্তু সাথে চায়না তো তার নিজের উৎপাদিত মিষ্টি আলুকেও অভিজাত বানিয়ে ছেড়েছে, এই বন্রুটিতে ঢুকিয়ে দিয়ে। তা হলে কি ঘটনা আমাদের এমন হবে যে, নিজদেশের মিষ্টি আলু না খেলেও একদিন আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা ঠিকই খেতে শুরু করবে চায়নিজ মিষ্টি আলু ? আর ঘটবে তা চায়নার বাণিজ্যিক বুদ্ধি আর কারসাজিতে?
যদি হয় তা হোক। কি আর করার আছে আমার তাতে। মোদ্দা কথা হল ছোটবেলায় মিষ্টি আলু খাওয়ার যে স্বাদ পেয়েছিলাম, তা এখনও ভুলিনি আমি। তাই যখনই বাজারে চোখে পড়ে মিষ্টি আলু, অল্পস্বল্প কিনে আনি ঘরে। কিন্তু সেই মিষ্টি আলু সিদ্ধ করে খাওয়ার মানুষ ঘরে আছে মাত্র দু’জন। যার একজন হলাম আমি নিজে, আরেকজন হেলেন। অতএব এই মিষ্টি আলুর পুর দেয়া বন অন্য কেউ খাক না খাক, নিজেই বরং খেয়ে দেখবো।
বন নেয়া শেষ হতেই দ্রুত কিছু বিস্কিট আর বাদামের প্যাকেট ঝুড়িতে রেখে, ডজনখানেক পানির বোতল ওতে তুলতেই, ঝুড়িটি বেশ ভারি হয়ে যেতেই, ভাবলাম আর ওজন বাড়ানো ঠিক হবে না। কারণ না হলেও তো কিলোমিটারের কাছাকাছি পথ হাঁটতে হবে, হোটেলে ফিরে যেতে। সুতরাং ক্যাশের সামনে গিয়ে স্বয়ংক্রিয় ক্যাশমেশিনের পাশে ঝুড়ি রাখার জায়গায়, আমার সওদাপাতি ভরা ঝুড়ি রেখে নিজেও দাঁড়িয়ে গেলাম খাম্বাবৎ। আর কাজ হল তাতেই, মানে নড়েচড়ে উঠলেন ক্যাশমেশিন সামনে নিয়ে বসে থাকা খাম্বা চায়নিজ।
একে একে সদাপাতিগুলো সে যখন স্ক্যান করছিল, মেশিনের ডানে থাকা ছোট্ট একটি মনিটর যাতে সবুজ রঙ্গয়ের লেখায় ভেসে উঠছিল পণ্যটির দাম, দেখলাম পড়তে পারছি তা। কারণ এই ক্যাশমেশিন হিসাব নিকাশ করছে সব ইংরেজিতে। ঝুড়ির সব পণ্য স্ক্যানিং করা হয়ে যাবার পর, মোট দাম ঐ মনিটরে ওঠার সাথে সাথে সেই খাম্বা চোখে চোখ রাখতেই, মানিব্যাগ বের করে দাম মেটানোর জন্য দিলাম প্রয়োজনীয় তাকে নোট। নোটগুলো হাতে যেতেই দেখলাম আমার সাথে তার এতক্ষণের আচরণে সে খাম্বাবৎ হলেও, ব্যবসায়িক হিসাব তার টনটনে। কারণ আমার দেয়া নোটগুলোর মধ্যে একটা পঞ্চাশ রেন মেন বি’র নোট থাকায়, সে সেটিকে হাতের আঙুল দিয়ে বেশ ডলে, তারপর চোখের সামনে ধরতেই, বুঝলাম বেইজিং ও মুক্ত নয় জালটাকা থেকে। আর এ ব্যাপারে তার হিসাব খুব টনটনে। কিন্তু কথা হচ্ছে আমার দেয়া নোট নিয়ে তার এতো সন্দেহ হওয়ার কি কারণ? আমি তো আর বাংলাদেশ থেকে এই নোট নিয়ে আসিনি। আর মুদ্রাবিনিময় তো করেছি আমি, পাঁচতারকা হোটেলে, যেখানে জাল টাকা থাকার সম্ভাবনা শুন্যের কোটায়। তখনই মনে হল এর খাম্বাবৎ আচরণকে দোষ দেয়া গেলেও, তার এই ব্যবসায়িক সাবধানতা কে জানাতে হু সাধুবাদ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক