মৌনং সম্মতিনং লক্ষণং
বেলবয়ের চিংলিশ প্রশ্নের জবাবে ইশারায় ফের বোঝালাম যে অবশ্যই ঐ জায়গাটির একমাত্র দাবিদার হলো লাজুর সুটকেসটি। আমার সুটকেসটা রুমের কোন একটা ফাঁকে কোনমতে খাড়া করে রেখে দিলেই চলবে। আর ছোট ব্যাগ গুলো কোনটা কোথায় থাকবে, তা ঠিক করবে অবশ্যই ঘরের কর্ত্রী। এ মুহূর্তে এ ব্যাপারে ভুলভাল কিছু সিদ্ধান্ত দেবার মতো মহাপাপ করতে রাজি নই আমি মোটেই ।
বেলবয় সে মোতাবেক লাজুর সুটকেস নিয়ে রুমে ঢুকতেই, তার সহায়তায় নিজেও হাত লাগালাম। নিজের সুটকেসটা ট্রলি থেকে নামিয়ে এনে খাড়া করিয়ে রাখলাম বিছানা আর টয়লেটের মাঝের ফাঁকা জায়গাটায়। অতপর, বাকি ছোট ট্রলি সুটকেস দুটো, রুমে ঢোকার করিডোরের একপাশে সাজিয়ে রেখে, লাজুকে ওগুলো তার সুবিধা মতো সাজিয়ে রাখতে বলে, বেলবয়ের সঙ্গী হয়ে রওয়ানা করলাম ঐ রুমের দিকে, ওখানকার হাল হকিকত বোঝার জন্য। বলা তো যায় না, দীপ্র আবার কোন কারণে, বা শুধুই অকারণে জেদটেদ করছে কি না ফুপ্পির সাথে এরই মধ্যে।
বেল বাজাতেই হেলেন দরজা খুলতেই রুমের যে আবহাওয়ার মুখোমুখি হওয়া গেল, বুঝলাম তাতে নাহ কোনরকম ঝঞ্ঝাট নেই বা লাগেনি ঐ রুমে। এরমধ্যে বেলবয় ঝটপট এ রুমের ব্যাগ সুটকেসগুলো নামিয়ে দিতেই, তাকে ধ্যনবাদ বলে ওরে হাতে টিপস গুঁজে দিলাম। হাসি মুখে সে নড করে ট্রলি ঠেলে ঠেলে লিফটমুখি রওয়ানা করলো।
যদিও জানি এসব হোটেলের রুমের কোন সমস্যা থাকার কথা না, তারপরও সমস্যা যে একদম হয়নি কখনো তা তো নয়, অতএব রুমের ভেতরে একটা চক্কর মেরে চোখজরীপ করতে করতে, জিজ্ঞেস করলাম হেলেন কে, কি অবস্থা রুমের তোদের -‘মাত্রই তো ঢুকলাম । এখনও তো সব কিছু দেখিনি । ঠিকই আছে , তবে রুমটা অনেক ছোট ।“ হেলেনের এই উত্তরের পিছু পিছু , টয়লেট থেকে গলা উঁচিয়ে দীপ্র বলল “বাবা, তুমি যদি নীচে যাও, আমাকে নিয়ে যেও। শুধু অভ্র কি নিয়ে নীচে গেলে হবে না।’
একটু আগে দেয়া বিশদ ব্যাখ্যার বদলে, হেলেনের মন্তব্যের জবাবে বললাম, হুম, এটা তো হোটেল, আর কুনমিং এ তো ছিলাম রিসোর্টে। তারপরেও কিন্তু এই রুমের ভাড়া কুনমিং এর চেয়ে বেশী। এটুকু শুনেই হেলেন বলল, “কি বলস, এই রুমের ভাড়া ওটার চেয়ে বেশী ! থাক ঠিক আছে।’
ঐদিকে আমার কোন জবাব না পেয়ে টয়লেট থেকে দীপ্র বারবার সতর্কবার্তা দিয়েই যাচ্ছে, অতএব ওকে আশ্বস্ত করার জন্য গলা উঁচু করে বললাম, ঠিক আছে বাবা! ওহ আরেকটা ব্যাপার শোন বাবা, যদি এ রুমে কোন কিছু লাগে বা এখানে কোন সমস্যা পাও তবে, তুমি নিজেই কিন্তু হাউজকিপিংকে ফোন করে জানিয়ে ব্যাপারটা ঠিক করে নেবে । বুঝলে বাবা? এখন থেকে এ হোটেলে কোন কিছুর জন্য হাউজকিপিং এর সাথে কথা বলার ইনচার্জ হলে তুমি, বলতে বলতে ফিরতি হাঁটা শুরু করলাম নিজেদের রুমের দিকে ।
বেল বাজানোর কিছুক্ষণ পর অভ্র এসে দরজা খুলতেই রুমে ঢুকতে ঢুকতে, টয়লেটে উঁকি দিতেই বুঝলাম ঐটি ফাঁকা আছে। অতএব বেশ কিছুক্ষণ ধরে মুলতবি করে রাখা প্রাকৃতিককর্ম সম্পাদন করার নিমিত্তে ঢুকে পড়লাম।
একথা সকলেই জানেন যে টয়লেটে বা বাথরুমেই মহান জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ, বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক আর্কিমিডিস, তাঁর বিখ্যাত ইউরেকা মুহূর্তের মুখোমুখি হয়ে পেয়েছিলেন উদ্ভাবনি আইডিয়া। নিতান্তই আকাঠ মূর্খ আমার তো আর কোন ইউরেকা মুহূর্ত পাওয়ার সম্ভাবনা নাই, তারপরও কেন জানি টয়লেটেই কি না কিলবিল করা শুরু করে মাথায় নানান চিন্তা; যার ফলে অনেকসময়ই সেখানেই নিয়ে থাকি আশু করণীয় সিদ্ধান্ত, নিলাম যেমন তা এখনো।
তবে টয়লেট থেকে বেরিয়েই সেই সিদ্ধান্ত চাউর করার সাহস হলো না। রুমের আবহাওয়া আঁচ করে যখন বুঝলাম, একটু আগে রুম থেকে বেরুবার ব্যাপারে, যে কারফিউ জারী করা হয়েছিল, তা ভাঙ্গার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি টয়লেটে বসে, সেটি ঘোষণা করা মোটামুটি নিরাপদ এখন, তারপরও বাড়তি সতর্কতা হিসাবে সরাসরি সে ঘোষণা না দিয়ে, অভ্রকে বললাম বুঝলে বাবা, মা কে বিরক্ত করবে না। মা যা বলবে সে মতো জামা কাপাড় বদলে গোসল করে নাও, আমি নিচে যাচ্ছি হোটেলের কন্সিয়ার্জের সাথে কথা বলে আগামী কালকের ট্যুর প্লান করতে।
এ টুকু শোনার সাথে সাথেই অভ্র বলে উঠলো, “আমিও যেতে চাই বাবা এখন তোমার সাথে। ভাইয়া আর আমি পরে একসাথে বাথটাবে গোসল করবো গরম পানিতে। এখন মা গোসল করে নিক’।
মনে মনে হাসলাম ছোটপুত্রের এই টেকনিকে। প্রথমত বাথটাবে গরম পানি ভর্তি হতে বেশ সময় লাগবে। তাতে তাকে এখুনি ঢুকতে হবে না গোসল করার জন্য। আবার দু ভাই একসাথে গোসল করা মানে তো শুধু গোসল করা না, এর সাথে আছে তাদের নানান রকম জলক্রীড়া, যতটুকু পারা যায় আর কি বাথটাবের স্বল্প পরিসরে। যাতে সময় লাগবে আরও বেশি, আর এ মুহূর্তে লাজু নিশ্চয় তার গোসল করা অতোক্ষণ দীর্ঘক্ষণ ধরে মুলতুবী রাখতে পারবে না। ফলে এখনি গোসল করার ব্যাপারে অভ্র ছাড় পেতে পারে এ মুহূর্তে।
আবহাওয়া অনুকূল বুঝে নিজেও মিন মিন করে অভ্রর প্রস্তাবের যৌক্তিকতা সমর্থন করে বললাম, বুঝলে তুমি এই ফাঁকে গোসল টোসল করে ফ্রেস হয়ে নাও নিশ্চিন্তে। আমি ওদেরকে নিয়ে নীচে গিয়ে আগামীকালকের ঘোরাফেরার গাড়ি ঠিক করে আসি।
এতক্ষণ পিতাপুত্রের আলাপের মধ্য দিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে, আর এমুহূর্তে মিন মিন করে সরাসরি যে অনুমতির প্রার্থনা করলাম রুমে জারী করা কারফিউ ভঙ্গ করার ব্যাপারে, তাতেও তা নিয়ে নীরবতা ব্যতিত কোন উত্তর পেলাম না যখন, তখন সংস্কৃত না কি অসংস্কৃত বলে প্রচলিত মৌনং সম্মতিনং লক্ষণং কথা ক’টি মনে পড়ল। তবে হ্যাঁ মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিলেও, তাতেও যেন প্রমাদজনিত কোন ঝুঁকি না থাকে তা নিশ্চিত করার লক্ষে, অভ্রকে নিয়ে বের হতে হতে বললাম, তাহলে গেলাম কিন্তু আমরা -“যাও , আমি এখন বাথরুমে ঢুকব। যদি চট করেই ফিরে আসো তোমরা, আমি কিন্তু দরজা খুলতে পারবো না।’ বললো লাজু মায়ের ঐ সম্মতিটুকু মুখ থেকে বেরুতে না বেরুতেই, সাই করে দীপ্র কে ডাকার জন্য অভ্র বেরিয়ে যেতেই, লাজুকে আশ্বস্ত করলাম যে, দরজা খোলাখুলি নিয়ে তার দুশ্চিন্তা করতে হবে না, কারণ অতিরিক্ত চাবিকার্ড আছে আমার সাথে। অতঃপর অভ্রর অনুগামী হয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম, ঐ রুমের সামনে।
টগবগ উত্তেজনায় অভ্রর বিরতিহীন বেল বাজানোতে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে দরজা খুলে হেলেনের উদগ্রীব জিজ্ঞাসা “কি হয়েছে দাদা, কি হয়েছে ?”
দ্রুত ওকে বললাম যে ভয় পাওয়ার মতো কিছুই ঘটেনি, আমি নিচে যাচ্ছি আগামীকাল বেইজিং ঘোরাঘুরির জন্য গাড়ি ঠিক করতে। সে কারণেই অভ্র, দীপ্রকে ডাকতে এসেছে। এদিকে দরজা খোলার সাথে সাথেই অভ্র ফুপ্পির শরীরের ফাঁক গলে “ভাইয়া, ভাইয়া”, ডাকতে ডাকতে ঢুকে গিয়েছিল রুমের ভেতর, অথচ দীপ্র তখনো তার স্বভাবমাফিক আছে বাথরুমে।
দীপ্রর বেরুতে আরও সময় লাগবে ভেবে রুমে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে বসে, তখনো উপর্যুপরি ভাইয়াকে তাড়া দিতে থাকা অভ্রকে বললাম যে, কেউ টয়লেটে থাকলে তাকে এভাবে বাইরে থেকে ডাকাডাকি করতে হয় না। ওটা শোভন কোন ব্যাপার না। এছাড়া তুমি যা বলেছ তা তো ভাইয়া শুনেছেই। এখন একটু অপেক্ষা করি আমরা। কথাগুলো উঁচু গলাতেই বললাম যাতে দীপ্র আশ্বস্ত হয় যে, তাকে ফেলে চলে যাচ্ছি না আমরা নীচে -কিন্তু না তাতেও সে আশ্বস্ত হল বলে মনে হলো না, কারণ অচিরেই দীপ্র হুড়মুড় করে টয়লেট থেকে বেরিয়েই “চল যাই” বলে নিজেই রওয়ানা দিল, সাথে সাথেই অভ্রও হল তার অনুগামী। অগত্যা সোফা ছেড়ে উঠে, নিজেও রওয়ানা দিতে দিতে, বিছানায় ফেলে রাখা দীপ্রর ভারী জ্যাকেটটি হাতে নিয়ে ধরলাম লিফট মুখি হাঁটা।
লিফটলবিতে লিফটের অপেক্ষা করার ফাঁকে, দীপ্রকে তার জ্যাকেটটি গায়ে পরিয়ে দিতে দিতে দুজনকেই বললাম, শোন এখানে বাইরে যা ঠাণ্ডা, ভুলেও কখনো এই মোটা জ্যাকেট বাদে বাইরে বেরুবে না কেউ। এরই মধ্যে আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বেশ দ্রুতই লিফট এসে হাজির হতেই ভাবলাম, এ সময়ে এ হোটেলে যারা আছেন, তারা সবাই সম্ভবত থিতু হয়ে আছেন যার যার পছন্দের রেস্টুরেন্টে বা বারে, এই হোটেলের ভেতরে বা বাইরে। অতএব এমুহূর্তে লিফটে উঠানামা করছে না কেউ খুব একটা। লিফটে উঠতেই তা বিরতিহীনভাবে নামতে নামতে এক্কেবারে নীচে এসে থামতেই ঐ ভাবনাটা আরো পোক্ত হল।
এদিকে লিফটের দরজা খুলতেই দুইভাই হুড়মুড় করে বেরিয়ে বাইরের দিকে রওয়ানা দিতে উদ্যত হতেই বললাম বাবারা, শোন, আগে আগামীকালকের ব্যবস্থাটা করে নেই। তারপর যাবো তোমাদের ঐ গাড়ি পরিদর্শনে। গাড়িগুলো তো আছে শোরুমের ভেতরে, যেগুলো নাকি এখন বন্ধ। অতএব ওগুলো কেউ চালিয়ে নিয়ে যাবে এরই মধ্যে, তেমন তো আর হচ্ছে না। বলেই দুজনকে দুই হাতে ধরে ভাবছি কোনদিকে হাঁটলে পাওয়া যাবে কন্সিয়ার্জ ডেস্ক ?
আসলে হোটেলে চেকইন করার গোটা সময়টায় রুমে যাওয়ার জন্য এতোটাই তাড়াতে ছিলাম যে, সেসময় দেখা হয়নি ঠিক কোথায় আছে কন্সিয়ার ডেস্ক, তাই হাঁটা ধরলাম ডানেই যেদিকে আছে হোটেলের চেক ইন কাউন্টার। ঐদিকে হাঁটতে হাঁটতে বাঁয়ে ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পড়ল, হোটেলে ঢোকার ঐ বৃত্তাকার ঘূর্ণায়মান দরজাটির ডান পাশে, আলো আঁধারিতে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন একটা কাউন্টারের সামনে। যদিও কাউন্টারটির উপর কি সাইন বা লেখা আছে, তা দেখতে পাচ্ছি না এখান থেকে, তারপরও ওখানকার লোকজনের ভাবভঙ্গিতে মনে হল ওটাই হবে এই হোটেলের কন্সিয়ার্জ ডেস্ক। অতএব ঘুরে পা বাড়ালাম সেদিকেই। কাছাকাছি যেতেই বুঝলাম যে, নাহ আমার অনুমান এ ভর সন্ধ্যায় আমাকে আর হনুমানে পরিণত করেনি। কন্সিয়ার্জ কাউন্টারে হোটেলের স্যুট পরে আছেন এক জোড়া চায়নিজ, যাদের একজন পুরুষ আরেকজন মহিলা। তবে এ মুহূর্তে হাত পা নাড়িয়ে, একটা ম্যাপে কলম দিয়ে নানান রকম দাগ দিতে দিতে চুং চাং করে সামনে দাঁড়ানো একজনের সাথে অবিরল কথা বলে যাচ্ছেন মহিলাটিই শুধু , আর পুরুষটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তার বাঁয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে। এতে ধরে নিলাম, এই দুজনের মধ্যে ঐ মহিলারই দায়িত্ব হলো, হোটেলবাসিদের প্রয়োজনে ট্যুর বিষয়ক সাহায্য সহযোগিতা করার । তার সাথেই কথা বলতে হবে আমারও।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক