অরণ্যে রোদন
লিফট থেকে নেমেই ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে বুঝলাম, রুমগুলো সব বা দিকেই। এই লিফটগুলোর মানে মাঝখানে বেশ অনেকটা ফাঁকা জায়গা রেখে, দু পাশে মুখোমুখি দাঁড়ানো তিনটা তিনটা এই ছয়টা লিফটের অবস্থান হলো হোটেলটার পেছন দিকটার মাঝামাঝি। যে কাউকেই লিফট থেকে নেমে যেতে হবে ডানেই, কারণ বাঁয়ে গেলে শেষ লিফটের পর যা আছে, তা হলো বিল্ডিংটার পেছনের দেয়াল আর তাতে লাগানো জানালা। আর ডানে আছে লম্বা করিডোর, যার আর ডানে আর বাঁয়ে আছে এ তলার রুমগুলো।
‘কোন দিকে আমাদের রুম?’ সকলের গলায় প্রায় একই সাথে বেজে উঠলো একই প্রশ্ন , যার মানে হল প্রত্যেকেরই তাড়া আছে রুমে যাওয়ার, যার যার তার তার নিজ নিজ কারণে। যা নাকি খুবই স্বাভাবিক, কারণ রুম তো ছেড়েছিলাম সেই কাকভোরে কুনমিং এ। দ্রুত তাদের আশ্বস্ত করে বললাম দাঁড়াও দেখে নেই, কোন রুম কোন দিকে। আমাদের দুটো রুমই এই তলায় সেটাই হল বড় কথা ।
ঠিক এসময়ই নজরে পড়লো সেই ডানের করিডোরের দেয়ালে এক্কেবারে চোখ বরাবর সাঁটানো রুম নির্দেশক প্লেট টি, যেমন থাকে আর কি এ ধরনের হোটেলে। ডানে বা বাঁয়ে কত নম্বর থেকে কত নম্বর রুম, তীর চিহ্ন দিয়ে তা নির্দেশ করা প্লেট দুটো এমনভাবে লাগানো, যাতে যে কেউ লিফট থেকে নেমে ডানে তাকালেই চোখে পড়তে বাধ্য তা। এদিকে আগেই বলেছিলাম নম্বর মনে রাখার ব্যাপারে মগজ খুবই দুর্বল আমার। তার উপর মাত্রই তো পেয়েছিলাম চাবিকার্ড হাতে, যার দিকে ঠিক মতো নজরও দেইনি, অতএব মনে করতে পারছি না কোন কোন রুমের নম্বর আছে লেখা ওগুলোতে। অতএব চাবিকার্ডে চোখ বুলিয়ে,ফের দেয়ালে সাঁটা ঐ রুম নির্দেশক প্লেট দিকে তাকিয়ে , সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলাম যেতে হবে আমাদের ঐ করিডোর ধরে ডানেই। দুটো রুমের নম্বর দেখে আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে পাশাপাশি হওয়ার সম্ভাবনা নাই ঐ দুটোর কারণ একটার ঠিকানা ১৫১৬ তো আরেকটা ১৫২১। তাও কপাল ভাল যে, রুম দুটোর অবস্থান দুই ভুবনের দুই বাসিন্দার মতো এক্কেবারে করিডোরে দুই বিপরীত দিকে নয়। দুটোই পড়েছে একই দিকে ।
আমার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই এরই মধ্যে দীপ্র অভ্র দুজনেই হাত থেকে একটা করে চাবিকার্ড ছো মেরে নিয়ে, দিল ভোঁ দৌড় ডান দিকে। সাথে সাথে যন্ত্রচালিতের মতো শুরু করলাম দ্রুত হাঁটা ওদের লক্ষ্য করে, মনে ভাবনা নিশ্চয় এতোক্ষণ ধরে চেপে রাখা ওদের প্রাকৃতিক ডাক, হয়তো রুমের কাছাকাছি এসে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আর তাই যদি হয়, তবে দু রুমে দুজনে ঢুকেই যদি তড়িঘড়ি ঢুকে যায় টয়লেটে, আর রুমের ঢোকার সদর দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায় নিজে নিজে, যেমন হয় এইসব হোটেলের ক্ষেত্রে, তবে রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ঠায় আমাদের, যতোক্ষণ না বেরুবে তারা টয়লেট থেকে। এছাড়া টয়লেটে দীপ্র সময় নেয় প্রচুর। সারাদিন এয়ারপোর্ট আর রাস্তায় কাটিয়ে, রুমের সামনে এসে, সাথে সাথে রুমে ঢুকতে না পারলে, তীরে এসে তরি ডোবার হতাশায় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠতে পারে লাজু বা হেলেনের যে কারোই কিম্বা দুজনেরই একসাথে। এতে দুই ভাইয়ের কপালে খারাবিই আছে। একটু আগেই নীচে একবার ওদের বাঁচিয়েছি মারের হাত থেকে, ওরকম কিছু হলে এবার আর তাদের রক্ষা করতে পারবো না।
দ্রুত হেঁটে প্রথমেই অভ্রকে ধরতে পারলাম। কারণ সে নিয়েছে ১৫১৬ নম্বর রুমের চাবি যা নাকি আগে পড়ে। দীপ্রর ১৫২১ নম্বর রুম একটু দূরে, মানে সামনের দিকে আরো তিনটা রুম পরে হলেও দৌড়ের গতিতেও অভ্রকে হারিয়ে দেয়ায় সেও পৌঁছে গেছে একই সময় সেই রুমে দরজার সামনে। ফলে প্রায় একই সাথে দুজনেই দরজার নির্দিষ্ট জায়গায় রূপকথার জিয়ন কাঠির মতো চাবি কার্ডটি ছোয়তেই, দরজা খুলে যেতেই, একসাথে দুজনেই নিজেকে জয়ী ঘোষণা করতেই, হাসি পেল। বুঝলাম যে ৩-৩ সমতা তাদের পছন্দ না। জিততে চায় দুজনেই, তবে মুশকিল হলো, এখন তো আবারো খেলার ফলাফল ৪-৪ এ সমতাতেই থাকল!
সে যাক, সাবধানতা হিসাবে দীপ্রকে হেলেন না এসে পৌঁছা পর্যন্ত দরজা খোলা রাখতে বলে, অভ্রর সাথে নিজেও এ রুমে পা রাখতেই, আসলেই দেখি তড়িঘড়ি করে ও ঢুকে গেল টয়লেটে। অতএব খোলা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম লাজু আর হেলেন এসে পৌঁছানোর।
অচিরেই ওরা দুজন এসে হাজির হতেই, দুজনেই জিজ্ঞেস করলো এ রুমে কারা থাকবে। আর অন্যরুমটি কোন দিকে? বললাম যে কেউ যে কোনটাতে থাকতে পারে, কারণ রুম তো সব একই। তবে অভ্রকে যেহেতু আমাদের সাথে রাখবো, সেক্ষেত্রে হেলেন আর দীপ্রর রুম হবে, অন্যটা।
ততক্ষণে দীপ্র, তার রুম থেকে বেরিয়ে গলা উঁচু করে ‘এন আমাদের রুম এটা এদিকে আস’ বলে হেলেনকে ডাকতেই , ও হাঁটা দিলে সেই রুমের দিকে , যার অবস্থান আগেই বেলছি এই রুম থেকে সামনের দিকে হেঁটে দুটো রুম পেরুলেই করিডোরটির উল্টা দিকে। হ্যাঁ, রুমের দিকে আসার এই সুপ্রশস্ত করিডোরের দুই পাশে সুবিন্যস্তভাবে সাজানো হোটেলের রুমগুলো। করিডোরটির একদিকে সব জোড় সংখ্যার ঠিকানার রুম, উল্টা দিকে ঠিকানা বেজোড় সংখ্যার।
ভেবেছিলাম যা মনে হোটেলের লবিতে পা দিয়েই, ঘটেও গেল তা এ মুহূর্তে! রুমে ঢুকেই হতাশ ভঙ্গিতে লাজু বলল, ‘ও মা এই রুমটাতো দেখছি অনেক ছোট!’
নিজে ভারমুক্ত হওয়ার জন্য, পিঠের পিঠ ব্যাগ আর কাঁধব্যাগ দুটো মেঝের কার্পেটে রাখতে রাখতে বললাম, শোন এটাই হলো এ ধরনের হোটেল যেগুলো পৃথিবীর নানা দেশের শহরে আছে, তার স্ট্যান্ডার্ড রুমের সাইজ। তবে হ্যাঁ ইউরোপে এই হোটেল চেইনের স্ট্যান্ডার্ড রুমের সাইজ কিন্তু আরো ছোট। যাবতীয় পাঁচতারা হোটেল কিন্তু যে দামে এশিয়ায় যত বড় রুম দেয়, ইউরোপে তার চেয়ে বেশী দাম নিয়েও ঐ সাইজের রুম দিতে পারে না। ব্যাপারটার সাথে, ঐ জায়গার জমির মূল্যের একটা যোগ আছে। কুনমিংএ নিশ্চয়ই বেইজিং এর চেয়ে জমির দাম অনেক কম। তার উপর ছিলাম ওখানে আমরা রিসোর্টে, যা নাকি ছিল বলা চলে বনের ভেতরে, যার কারণে একজন রিসোর্টটির রিভিউতে লিখেছিল ঐটির অবস্থান হলো, ‘ইন দি মিডল অব নো হয়ার’। সে জায়গায় এটি প্রথমত হলো হোটেল। আর দ্বিতীয়ত যতটুকু বুঝতে পারছি এই হোটেলটা হলো বেইজিং শহরের এক্কেবারে প্রাণকেন্দ্রে না হলেও তার ধারে কাছেই সম্ভবত।
‘তুমি আবার ব্যাগ ট্যাগ গুলো এভাবে রুমের মাঝখানে ফেলে রাখলে কেন? একটু গুছিয়ে রাখবে না? এমনিতেই রুম টা ছোট’ এরই মধ্যে রুমের কিং সাইজ বিছানাটি পেরিয়ে ও পাশের জানালা ঘেঁসে রাখা চমৎকার সোফাটির দখল নেয়ায়, লাজুর চোখে পড়ল একটু আগে করা আমার অপকর্মটি; আর তাতেই অনিবার্যভাবেই সে বিরক্ত। আরো বুঝলাম যে এতোক্ষণ হোটেলের রুম বিষয়ক যে জ্ঞানগর্ভ বয়ানটি দিলাম, কানেই তোলেনি সে তা। অবশ্য কানে তুলবেই বা কেন? সকল সমাজে, পরিবারে স্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিপরীতে স্বামীদের কোন যুক্তিরই পাত্তা না পাওয়ার নিয়মই তো চিরন্তন সত্য! কোন ব্যাপারে স্ত্রী একবার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন যদি, তার বিপরীতে স্বামী যতই অবতারণা করুক না কেন সাত না এক্কেবারে চৌদ্দ কাহন যুক্তি, তার সবই হয়ে দাঁড়ায় অরণ্যে রোদন।
অতএব ওর বিরক্তির মিটার যাতে আর না চড়ে, সেজন্য দ্রুত একটু আগে নিষ্ক্রান্ত করা ব্যাগ দুটো হাতে তুলে নিয়ে , কাঁধ ব্যাগটা ছোট বলে ওটা টেবিলের উপরে রেখে, পিঠব্যাগটি হাতে নিয়ে বিছানা পেরিয়ে, রুমের ভেতরে ঢোকার দরজা কাছ থেকে শুরু হওয়া বেশ বড় সাইজের যে ওয়ারড্রোবটা আছে, ঢুকিয়ে দিলাম দ্রুত সেটা ওটাতে। এসময় ওয়ারড্রোবের পাশেই থাকা মিনিবারের উপরে রাখা কমপ্লিমিন্টারি মানে মুফতে দেয়া পানির বোতল দুটো নজরে পড়তেই পানির তীব্র তৃষ্ণা পেল। অতএব নিজের জন্য একটা বোতল খুলে পানি খেতে, খেতে, আরেকটির মুখ খুলে লাজুর জন্য নিয়ে আসছি যখন তখনি পেছনে টয়লেট থেকে বেরিয়ে অভ্র বলল, ‘চল বাবা, ভাইয়াকে নিয়ে নীচে যাই আমরা । ঐ এস্টন মার্টিন আর মাজারাতি গাড়ি গুলো দেখে আসি।’
‘না না, তোমরা কেউ বেরুবে না এখন। মার খাবে একদম! আগে জামা কাপড় ছাড়তে হবে , গোসল করতে হবে’ অভ্রর উদ্দেশ্যে লাজু কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে আমাকে বলল “কি ব্যাপার আমাদের সুটকেস গুলো আসছে না কেন ? ফোন করে খোঁজ নাও। আর এতগুলো ব্যাগ সুটকেস রাখবো কোথায় এ রুমে?’ পানি খাও বলে ওর হাতে বোতল টা ধরিয়ে দিয়ে, দিলাম ওর রুমবিষয়ক বিরক্তি নিরোধক একটা মোক্ষম ঔষধ। বললাম শোন কুনমিং এর রিসোর্টের রুমের চেয়ে এখানকার রুম গুলোর ভাড়া কিন্তু দশ ডলার করে বেশী পড়েছে। ‘বল কি!’ কিছুটা অবাক ভঙ্গিতে এটুকু বলেই নিজে পানি খাওয়ার বদলে অভ্রকে হাতের ইশারায় ডাকল লাজু ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক