ল্যান্ড হো
ফল খেয়ে জল খেতে নাই সাথে সাথে, এমন খনা ফর্মুলার কারণে নয়, বরং সাবেকি আমলের বেইজিং এয়ারপোর্টে দোকানপাটের দৈন্যতার কারণে আছি সবাই জলহীন সেই থেকে। অতএব বাস থেকে নেমে হোটেলে রুমের দখল পাওয়া মাত্র সবাই যে প্রথমেই রুমে দেয়া পানির বোতলের উপরেই ঝাপিয়ে পড়বে তা নিশ্চিত। তারপরই সবাই নেবে শরণ বাথরুমের । অতঃপর আর কেউ না হলেও লাজু আর হেলেন নিশ্চয় শাওয়ার নিতে চাইবে। আর গোসল হলেই তাদের ক্ষিদে পাবে প্রবল, অতএব এখনি যদি দেখে রাখা যায় রেস্টুরেন্ট, আর হয় যদি তা হোটেলের কাছে তবে, এই শীতে এক্কেবারে ঝট করে না হলেও, জুবুথুবু হয়ে হেঁটে হলেও চলে আসা যাবে পেটপূজা সারার জন্য।
এমন ভাবতে ভাবতেই চলমান জানালার ওপাশে নজরে এলো পর পর কয়েকটা আলো ঝলমলে রেস্তোরাঁ জাতীয় স্থাপনা! যার মধ্যে আবার একটির সাজসজ্জা দেখে, কেন যেন মনে হল ঐটির ভারতীয় হবার সম্ভাবনা বেশি। বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো মেজাজ তাতে। আগেই তো বলেছি দেশে সকলের চায়নিজ নামের বাংনিজ রেস্টুরেন্টের খাবার পছন্দের হলেও, চায়নায় পা দিয়ে কিন্তু লাজু আর হেলেন দুজনের কেউই, চায়নিজ হোটেলে ঢোকার ব্যাপারে রাজি নয় মোটেই। ভয় তাদের, যতই আমরা দেখে শুনে খাবারের অর্ডার করি না কেন, ভাষা বিভ্রাটের কারণে শেষে কিনা পাতে, সাপ, টিকটিকি , ব্যাঙ বা কুকুর বিড়ালের স্যুপ বা ফ্রাই উঠে। অতএব চলতি বাসের জানালা থেকে এইমাত্র পিছনে ফেলে আসা রেস্টুরেন্টটির সাজসজ্জায় ভারতীয় ভাব দেখে আশ্বস্ত হবার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, পিকিং মানবের দেশে, এই বেইজিং শহরে আমাদের আগামী কয়েকদিনের নিবাস যে হোটেলটি, সেটি যে ঠিক কোথায় তাইতো জানি না! বাস তো এখন চলছে বেশ জোরেই। অতএব কতদূর যে ফের হাঁটতে হবে এই তথাধারণাকৃত ভারতীয় রেস্টুরেন্টে আসতে, তাই বা কে জানে? আর এখন যেমন সরল রেখায় এগুচ্ছে বাস , তা বাদ দিয়ে যদি এরই মধ্যে বাস ডানে বা বাঁয়ে মোড় নেয় তবে তো, সম্ভাব্য এই ভারতীয় রেস্তোরাঁ এই ঠাণ্ডার রাতে খুঁজে বের করা আমার মতো দিককানার কর্ম হবে না।
যেমনি ভাবনা আমার, তেমনি কাজ পাইলট চাচার। ব্যাপার কি আমি এই বংগসন্তানের সাথে চায়নিজ পাইলট চাচার কই এরি মধ্যে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে গেল নাকি? আর না হয় সোজা রাস্তা ছেড়ে আসলেই সে কেন এখন বাসটিকে সোজা রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে ঢুকিয়ে দিল? কিন্তু না, তা করেই আবার পাইলট বাসের গতি কমাতে কমাতে , পেছন ফিরে তাকিয়ে আমার চোখে চোখ পড়তেই দেখি ইশারা করলেন। আর সে ইশারাতেই নিজের অজান্তেই স্প্রিঙয়ের মতো লাফিয়ে উঠে উপরের বাংক থেকে একে একে সবার ব্যাগ নামিয়ে সবার হাতে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি যখন, তখন বাস এক্কেবারে গিয়েছে থেমে রাস্তার পাশে।
অতএব বাস থেকে নামার জন্য গেইটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকাতেই বুঝলাম, না এখানে নামার জন্য আমার পেছনে যে পারিবারিক মিছিলটি তৈরি হয়েছে তার মধ্যে ভিন্ন কেউ আর নেই। ততক্ষণে হুস করে দরজা খুলে যেতেই, পাইলট চাচার দিকে মুখ ফিরিয়ে হেসে মাথা ঝাকিয়ে ধন্যবাদ দেয়ার সাথে মুখেও “থ্যাংকু” বলে, বাসের পেটের ওম ওম গরম থেকে ঝপ করে সামনের হিমসাগরে ঝাঁপ দিয়েই হাঁটা ধরলাম বাসের তলপেটের দিকে। ধীরে সুস্থে ততক্ষণে তলপেটের নির্দিষ্ট স্থানের ডালাটিকেও উঠে যেতে দেখলাম উর্ধ্বে।
পেছনের দিকে না তাকিয়েও, হিমসাগরে ঝাঁপ দেয়ার কারণে পরিবারের প্রত্যেকেরই নানান সুরের আর্তনাদে বুঝে গিয়েছিলাম যে, নেমেছে সবাই ঠিকঠাক বাস থেকে, তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজেরই অজান্তে ঘাড় ঘোরাতেই, ফের চোখে চোখ পড়ল বাসের দরজা দিয়ে গলা বের করে থাকা পাইলটের । তার হাসিমুখের নিঃশব্দ ভাষা বলছে, ‘এনে তো দিলাম বাপু একদম তোমাদের মঞ্জিল মঙুদে, এবার ঝটপট নামিয়ে ফেল দেখি তোমাদের বাঙপেটরা বাসের পেট থেকে, আমার তাড়া আছে।’
“আমাদের হোটেলটা কোথায়?” জিজ্ঞেস করলো ঠাণ্ডার ব্যাপারে সর্বক্ষণ তটস্থ থাকা হেলেন এরি মধ্যে।
জবাবে, তাইতো বুঝতে চাচ্ছি বলে, সামনে তাকালাম যেদিকে একটু আগে গেছে বাসটা। ওদিকে তাকাতেই দু তিনশ মিটার দূরে ঝলমলে আলোয় মোড়ানো একটা চমৎকার উঁচু বিল্ডিং দেখে প্রথমে মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেও, একই সাথে দমেও গেল মন । খুশি হবার কারণ ঐ ঝলমলে উঁচু বিল্ডিংটাকে আমাদের সম্ভাব্য হোটেল মনে করা। আর দমে গেল মন এইজন্য যে, ঐখানে পৌঁছুতে হলে এই ঠাণ্ডায় শুধু অনেকটা পথ হাঁটতে হবে তাই নয়, সামনের ব্যস্ত রাস্তাটিও পার হতে হবে। আমাদের দেশের মতো নিশ্চয় এখানে যে কোন জায়গা দিয়ে, খেয়ালখুশি মতো রাস্তা পার হওয়া যায় না। অতএব খুঁজতে হবে হয় জেব্রা ক্রসিং না হয় ওভারব্রিজ । আর আছে সেগুলো কোথায়? কত দূরে?
যার মানে হলো ঐটি যদি আমাদের হোটেল হয়ও, তবে কোনাকুনি এখান থেকে ওটির দূরত্ব তিন চারশ মিটার হলেও, দেখা যাবে জেব্রা ক্রসিং বা ফুটওভার ব্রিজ পেরিয়ে ওখানে যেতে হাঁটতে হবে হয়তোবা, সেই এক কিলোমিটার না হলেও তার কাছাকাছি। তারউপর সাথে আছে ভোমা সাইজের তিনটা সুটকেস সহ মোট ছটা সুটকেস । এয়ারপোর্টে না হয় ট্রলি পেয়েছিলাম এসব বাঙ পেটরা টানার জন্য, এখানে তো তা নাই । মানুষ আমরা পাঁচজন হলেও, পায়ের অবস্থা যেরকম লাজুর তাতে, তাকে কোন বড় সুটকেস টানতে দেয়া ঠিক হবে না। আর পুত্ররা তো আমার ছোট। অতএব ছটা ব্যাগ টানার জন্য আছি আমরা মজুদ মূলত দুজনই ! এজন্যেই আসলে অজানা জায়গায় পরিবারসহ এমন বাঙপেটরা সমেত এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার জন্য বাস বা ট্রেন মোটেও কোন ভাল উপায় নয়। কিন্তু এছাড়া যে কোন উপায় ছিল না তা তো বলেছিই আগে।
“বাবা, বাবা ঐ তো আমাদের হোটেল “আনন্দিত উত্তেজিত দীপ্রর ঘোষণার পিছু পিছু, “কই? কই? কোথায়?” একইরকম আনন্দ আর উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করলো হেলেন আর লাজু ।
এদিকে দীপ্রর ঐ ঘোষণার সাথে সাথেই, ছোটবেলায় হোঁচট উষ্ঠা খেয়ে খেয়ে যে কটা ইংরেজি গল্প পড়েছিলাম, তা থেকে একটি শব্দ আরেকটি ধ্বনি রিন রিন করে কানে বেজে উঠল । সেই শব্দটি আর শব্দিটিকে অনুসরণ করা ধ্বনিটি হলও “ল্যান্ড হো”! এসি গল্পে, গভীর সমুদ্রে পথ হারিয়ে দিকভ্রান্ত একদল নাবিকদের একজন মাস্তুল উঠে যখন একটি দ্বীপের আবছা আভাস পেয়েছিল দূরদিগন্তে, চরম উত্তেজনা আর আনন্দে সে তখন সকলের বলে উঠেছিল “ল্যান্ড হো”। এতে গোটা জাহাজে ছড়িয়ে পড়েছিল উৎসবের আমেজ। একই ঘটনা ঘটলো এই হিমসমুদ্রের অকূল পাথারে ঝাঁপ দেয়া আমাদের ছোট্ট দলপতির মধ্যেও।
আনন্দ উত্তেজনায় সকলের সাথে দীপ্রর নির্দেশিত দিকে তাকাতেই দেখি আরে তাইতো, ঐ তো দেখা যাচ্ছে আমাদের ঠিক সামনের বাগানটির ওপাশে আলো আঁধারিতে নানান রঙয়ের ছোটছোট আলোর চুমকি বসানো চাঁদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে , আরেকটি বড় বিল্ডিং। সামনের উঁচু গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে তার নামটাকেও জ্বলতে দেখলাম এসময়, যেটি নাকি দীপ্ররই নজরে পড়েছে সবার আগে। আর এখান থেকে তার দূরত্ব হবে বড়জোর তিরিশ বা চল্লিশ মিটার। এছাড়া রাস্তা পার হওয়ারও নেই কোন ঝক্কি।এই বাসস্ট্যান্ড জাতীয় জায়গাটি থেকে হোটেলটিকে আলাদা করে রেখেছে যা, তা হল আমাদের সামনের ঐ বাগানটি। বাগানের মাঝ বরাবর আছে একটা কংক্রিটের হাঁটাপথ, যার ভেতর দিয়ে চাকা লাগানো আমাদের ব্যাগ সুটকেস নিয়ে যাওয়া যাবে অতি সহজেই।
হোটেলের অবস্থান বিষয়ক ঘোরতর অনিশ্চয়তার মাঝে, দীপ্রর এই হঠাৎ আবিষ্কার সবাইকে যে উৎফুল্ল করেছে, এমুহূর্তে তা থেকে যে বাদ পড়েনি সার্বক্ষণিক ওর তুমুল প্রতিযোগী অভ্রও টের পেলাম তা, যখন দেখলাম সকলেই একটা করে ব্যাগের হ্যান্ডেল ধরে এক্ষুণি সেদিকে রওয়ানা হওয়ার জন্য উসখুস করছে।
লাজুকে তার পায়ের অবস্থা মনে করিয়ে দিয়ে ওর ভোমা সুটকেসটা আমার হাত নিয়ে ওকে ছোট একটা ব্যাগ টানতে বলে, নিজে দু হাতে দুটো ভোমা সুটকেস টানতে টানতে, সবাইকে আমার পিছু নিতে বলে রওয়ানা দিলাম বাগানের মধ্যকার সেই হাঁটা পথের দিকে। বাগানের ভেতর একটু ঢুকেই পিছন ফিরলাম এ কথা বলতে যে, যদি দু একটা ব্যাগ এখানে আপাতত রেখে যেতে হয়, থাকুক তা। কারণ এখানে লোকজন যেহেতু নেই এখন, চুরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই । দ্রুত আমি আমার ব্যাগ দুটো হোটেলের গার্ডের জিম্মায় রেখে বাকি গুলো নিয়ে যাবো এসে।
কিন্তু পেছন ফিরতেই বুঝলাম, তার আর দরকার নেই। আমার ঠিক পেছনেই অভ্র দীপ্র আসছে যার যার চাকাওয়ালা কেবিনব্যাগ মাপের সুটকেস গুলো নিয়ে। তার পেছনে হেলেন আসছে তার ভোমা সুটকেস টেনে। সবেশেষে লাজু আসছে হেলেনের দ্বিতীয় ব্যাগ টেনে। চমৎকৃত হলাম এই ঘোরতর ঠাণ্ডায় আমার শিশপুত্রদ্বয়ের বিবেচনাবোধ জমে না গিয়ে বরং জাগ্রত হয়ে উঠায়। যেখানে আমি ব্যাগ টানার ব্যাপারে তাদের হিসাবেই রাখিনি, সে জায়গায় স্বউদ্যোগে সে দায়িত্ব তারা নিয়ে নিয়েছে নিজ নিজ কাঁধে!
বেশ দ্রুতই বাগানের সেই হাঁটা রাস্তাটুকু পেরিয়ে হোটেলের ড্রপইন জায়গাটাতে এসে, দু হাতে ভারী সুটকেস টানার কারণে গ্লোভসের নিচেও ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া হাতদুটো টন টন করে উঠায়, ও দুটোর হেন্ডেল ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই , এসময়ে আমার পাশেই নিজ নিজ ট্রলি ব্যাগ দুটো তড়িঘড়ি রেখে, ভোঁ দৌড় দিল দু’পুত্র সামনের দিকে। তুমুল সেই দৌড়ের সাথে উচ্চস্বরে দুজনকেই উত্তেজিতভাবে বলতে শুনছি, শুধু একটাই শব্দ। ‘ফেরারি’,‘ফেরারি’ ‘ফেরারি’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক












