কিন্তু পিকিং মানবের দেশে প্রথমেই পা রেখে, পরিবারের সকলে দুইভাগে ভাগ হয়ে ট্যাক্সিতে উঠার মতো চরম ঝুঁকি তো নিতে পারি না কিছুতেই। পরিবারের সবার জন্য আলাদা দুটো ট্যাক্সি ঠিক করার পর, যতোই বলি না কেন তাদের, তারা যেন একজন আরেকজনের পেছন পেছন থাকে সর্বক্ষণ, কোনই কাজ হবে না তাতে। কারণ গাড়ি চলা শুরু করার পর, যতোই দুই চালক পিছু পিছু থাকার চেষ্টা করুক না কেন, কোন ট্রাফিক সিগন্যালে পড়ে বা জ্যামের ঘোরপ্যাঁচে দু ট্যাক্সির পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা শতকরা একশ ভাগ। আর তা হলে আমিহীন ট্যাক্সির ড্রাইভারকে, কি করে লাজু বা হেলেন বোঝাবে আমাদের হোটেলের ঠিকানা! নাহ যতোই কষ্ট পাই না কেন পানির অভাবে এই হিম কারবালায়, দু ভাগ হয়ে উঠা যাবে না দু ট্যাক্সিতে কোন মতেই। এছাড়া ঠিক এই কারনেই তো আমরা কানমিং এও যখন চড়িনি দুভাগ হয়ে ট্যাক্সিতে, সেখানে এ শহরে কিছুক্ষণ আগেই পা ফেলেই আবার নেই কিভাবে এরকম তুমুল ঝুঁকি?
এসব ভাবতে ভাবতে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটির ৩০/৪০ গজের মধ্যে এসে পৌঁছাতেই, একটা ট্যাক্সির ভেতরে সামনে পেছনে লোহার খাঁচা দেখে খেলাম ভিরমি। সেই ভিরমি খাওয়ার সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠল, ঢাকা শহরের ভ্রাম্যমাণ লৌহখাঁচাগুলোও; যেগুলোকে একসময় আমরা ডাকতাম বাচ্চা ট্যাক্সি বা বেবিট্যাক্সি, হালে যেগুলোর নাম হয়েছে সিএনজি। মলমপার্টি ছিনতাইকারীদের দৌরাত্মে ঢাকা শহরের ঐ যান্ত্রিক ত্রিচক্রযান, যেগুলো পেট্রোলের বদলে যখন থেকে চলতে শুরু করেছে আমাদেরই দেশের মাটির নীচে থাকা বায়বীয় সোনা গ্যাস দিয়ে, আরো সঠিক করে বলতে গেলে বলতে হয় কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস দিয়ে ; আর তখন থেকে ওগুলো সাবালকত্বপ্রাপ্ত হয়ে বেবিট্যাক্সি নাম হারিয়ে গেছে সি এন জি নাম; সেগুলো তো এরই মধ্যে যাত্রীদের নিরাপত্তার খাতিরে এক একটি পরিণত হয়েছে ভ্রাম্যমাণ লৌহ খাঁচায় ! সে গুলোরই তো মাসতুতো ভাই মনে হচ্ছে দেখছি এখানকার খোদ ট্যাক্সিক্যাবগুলোকেও!
এর মানে কি তা হলে? এখানেও কি তাহলে আছে নাকি মলমপার্টি, ঝাপটাপার্টি জাতীয় ছিনতাইকারীর উৎপাত? কই কখনও তো শুনিনি তা! বাংলাদেশ থেকে কতো মানুষই তো প্রতিনিয়ত ব্যবসায়িক কারনে আসা যাওয়া করছে চায়নায় । যদিও তাদের বেশীর ভাগই আসা যাওয়া করে গুয়াংজু , কানমিং এসব শহরে , তার মানে তো নয় যে কেউই আসে না তারা বেইজিংএ। তাদের কারোর মুখেই তো শুনিনি কখনো এখানকার আইন শৃংখলার এ অবস্থাটির কথা! নাকি চড়েননি তারা কেউ কখনও ট্যাঙিতে। আর না চড়লেই কি দেখা যায় না নাকি এই চলমান লোহার খাঁচাগুলোকে? আমি ও তো চড়িনি এখনো এখানকার কোন ট্যাক্সিক্যাবে, কিন্তু সামনে দাঁড়ানো ট্যাক্সিগুলোকেই দেখেই তো বুঝতে পারছি যে ওগুলো এক একটা ভ্রাম্যমাণ লৌহখাঁচা বই কিছু নয়। আসলে আমাদের দেশের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাস দেয়া, দেশ বিদেশ ঘোরা, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের একটা বদভ্যাস অত্যন্ত শ্রুতিকটুভাবে প্রকট না শুধু, এক্কেবারে ব্রহ্মতালু জ্বালিয়ে দেবার মতোই প্রকট। আর তা হলো এরা যে কোন সুযোগে মুক্তকণ্ঠ হয়ে উচ্চকণ্ঠে নিজ দেশের বদনাম করে। আর একটু আধটু বিদেশে ঘোরার সুযোগ পেলে তো আর কথাই নেই, তখন তারা এক্কেবারে মাইক্রোফোন লাগিয়ে তাদের একদা ভ্রমণকৃত ঐ বিদেশটিকে পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হিসাবে অহোরাত্রি গুণগান করে । তাতে অবশ্য সমস্যা নেই , কারন ভাল কোন কিছুর গুণগান করা তো খুবই স্বাভাবিক। সমস্যা হল পাশাপাশি তারা যা করে তা হল, নিজের দেশকে তুলনামুলকভাবে বানিয়ে তোলে এক্কেবারে জাহান্নামের নর্দমা। এমুহূর্তে ঠিক এই ব্যাপারটিরই সাক্ষাত প্রমাণ পেলাম সামনের ট্যাক্সি ক্যাবগুলোর দিকে দৃকপাত করেই।
পেটের মধ্যে মোটা হলুদ ডোরাকাটা সবুজ এই ট্যাক্সিগুলোর পেছনের সিটে যেখানে যাত্রীরা বসবে সেই জায়গাটির সামনের অংশটি, মানে সামনের সিট থেকে পেছনের সিট আলাদা করার জায়গাটি যেমন লোহার রডের জাল আলাদা করা হয়েছে এ ট্যাক্সিগুলোতে, তেমনি এগুলোর ড্রাইভিং সিটের পাশের সিট, যেটিতে বসবে তৃতীয় যাত্রী, সেটিকেও দেখছি এরা লোহার গারদ লাগিয়ে আলাদা করে রেখেছে ড্রাইভারের কাছ থেকে! আর প্রতিটা ট্যাক্সিক্যাবেরই এ অবস্থা দেখে ভাবলাম, এ কি তবে করা হয়েছে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য? নাকি এ করা হয়েছে যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীদের কবল থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের নিরাপত্তার জন্য? তা, যার নিরাপত্তার জন্যই করে থাকুক না কেন এ অবস্থা, এ দৃশ্য থেকে বুঝতে পারছি পরিষ্কার, ট্যাক্সিতে পরিবারের সকলে দু ভাগ হয়ে ভ্রমণ করা তো দুরের কথা একসাথেও ভ্রমণ করা নিরাপদ নয় এই পিকিং মানবের শহরে। অতএব প্রশ্নই উঠে না দুই ট্যাক্সিতে করে পরিবারকে দুই ভাগ করে হোটেলে যাবার পরিকল্পনা করার! অথচ বেইজিং এয়ারপোর্ট থেকে শহরমুখি যাতায়াতের এ রকম অনিরাপদ অবস্থাটির কথা চেনাজানা কারো মুখেই তো শুনিনি কখনও, যারা অহরহই ভ্রমণ করেন চায়না !
আচ্ছা এখানকার ট্যাক্সির নামের এই ভ্রাম্যমাণ লৌহখাঁচায় হোটেলগমন চিন্তা না হয় বাদই দিলাম নিরাপত্তা বিষয়ক যৌক্তিক কারণে; তারপরও এখানকার মাইক্রোবাস বা ভ্যান গুলোর কি অবস্থা দেখি না একটু জরিপ করে, এই ভেবে ফেললাম পা ফের সামনে। এরকমের সিদ্ধান্তের পেছনের যুক্তি হলো এই যে, ভ্যান তো এরকম ভ্রাম্যমাণ খাঁচা না হতেও পারে। এছাড়া ভ্যানেতো একসাথেই যেতে পারবো সবাই, অতএব অসুবিধা কি?
সাথে সাথেই এটাও মনে হল যে, সেই ভ্যানের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কোথায়? একমাত্র একসাথে সবাই যেতে পারবো এই সুবিধাটুকু ছাড়া, ঐগুলো কি ট্যাক্সির চেয়ে বেশি নিরাপদ হবে নাকি? কিন্তু নিজ মনের এইসব প্রশ্নের অবতারণা সত্ত্বেও ভাবলাম, দেখি না তারপরও এখানকার ভ্যানগুলোর অবস্থাও কি একই রকম কিনা? মানে ওইগুলোও পরিণত হয়েছে কি না একেক টা ভ্রাম্যমান লৌহখাঁচায়? ভাবতে ভাবতে গোটা স্ট্যান্ড টাতে একবার নজর বুলিয়ে বুঝলাম ঐ জায়গাটা আদতে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডই। ওখানে ট্যাক্সিক্যাব ভিন্ন অন্য কোন জাতের বাহণেরই স্থান নেই। যার মানে হলো গোটা এলাকাটা জরিপ করেই বুঝতে হবে ভ্যানস্ট্যান্ড জাতীয় কোন কিছু আছে কি না এখানে! কিন্তু এমত ভাবনা আসতেই মনে হল, আরে এদের ট্যাঙির চেহারাতেই যখন বোঝা যাচ্ছে , ঢাকার তুলনায় এখানে যাত্রীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রবল, সেখানে ওগুলো দেখার আর কি দরকার! আর যা ই হোক ঢাকায় ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস যতই অপ্রতুল আর অনিরাপদ হোক না কেন, ওগুলো কিন্তু এখানকার ট্যাক্সিক্যাবগুলোর মতো ভ্রম্যমান লৌহখাঁচায় পরিণত হয় নি! এমতাবস্থায় ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ভাড়া করা মাইক্রোবাস নিয়ে বিদেশ প্রত্যাগত যাত্রীদের যে হয়রানি আর ঝুঁকির কথা প্রায়শই দেখি পত্রিকায়, তাতে তো মনে হচ্ছে এখানকার ভ্যান সার্ভিসের অবস্থা ঢাকার চেয়ে খারাপ বই ভাল হবার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। অতএব কি লাভ আর এখানে ভ্যান খুঁজে। তার চেয়ে বরং নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে ঐ চিন্তা এক্ষুনি বাদ দেয়া অতীব জরুরি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক