দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৮ নভেম্বর, ২০২০ at ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ

হিম কারবালা

বাঘ কাবু করা মাঘের শীতেই না শুধু, গোটা শীতকাল জুড়েই ঐ দিঘীতে গোসল করার যে রীতিটি প্রচলিত ছিল আমাদের, তা হলো দুপুরের রোদে বেশ অনেকক্ষণ খালি গায়ে দীঘির পাড়ে বসে থেকে, শরীর তাঁতিয়ে অতঃপর হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়া ঐ দীঘির কাকচক্ষু স্বচ্ছ শীতল জলে। বিশ্বাস ছিল আমাদের এই যে, এ টেকনিকে শীত কম লাগে। বালকবেলার আর কিশোরকালের সেই বিশ্বাসটির উপর আস্থা রেখে, এখানেও দরজা পেরিয়ে দিলাম ঝপ করে ঝাপ ঘোলা কুয়াশায় ঢাকা জলহীন হিমচ্যানেলে।
কী অবাক ব্যাপার বালক বেলার বিশ্বাসের ভিত্তিতে দাঁড়ানো সেই টেকনিকটি মনে হচ্ছে এখানেও কাজ করলো চমৎকার। কারণ একটু আগের মতো হলাম না কিংকর্তব্যপ্রস্তরাবরফাবৎ এবার আর! এ কী তবে অতিরিক্ত যে উলের সুয়েটার আর হাতমোজা পরলাম তারই মাজেজা, নাকি হিমচ্যানেলকে মোকাবেলা করার মানসিক প্রস্তুতি থাকার ফল?
তা সে যাই হোক, সে নিয়ে সময় নষ্ট করার মানে নাই। বড় কথা হলো জলহীন এই হিমচ্যানেলে একটু আগে যে ঝাপ দিলাম তা তে যে ব্রজেন দাশের সুনাম হুমকির মুখে যে পড়ছেন, তাতে বেশ সন্তুষ্ট হলাম নিজের উপর।
এসময় সামনের দিকে চোখ ফেলতেই দেখলাম নিজেদের মাঝখানে নিরাপদ দূরত্বের চেয়ে অনেক বেশি দূরত্ব বজায় রেখে, আগমনী লাউঞ্জের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকারের দুটো বাস। বাসগুলো দেখে স্বস্তি পাওয়ার সাথে সাথে একটা তাড়াও এলো মনের ভেতর থেকে, আর তা হল এক্ষুনি সবাইকে নিয়ে বাসে উঠে হোটেলমুখী যাত্রা শুরু করার তাড়া। সাথে সাথে এও মনে পড়লো যে, ফাইলে সায়মার দেয়া নোট মোতাবেক বাস তো ধরতে হবে ১৫ নম্বর। কিন্তু এ দুটোর মধ্যে কোনটা যে ১৫ নম্বর বাস তা তো বুঝতে পারছি না! ধরেই নিয়েছিলাম যে ঐ নম্বরটা লেখা থাকবে বাসের উইন্ডশিল্ডে, কিন্তু সে জায়গাটা তো একদম ফকফকা। কিছুই লেখা নাই সেখানে। তাহলে জিজ্ঞেস করি তা, কাকে? হ্যাঁ লোকজন কিছু দেখছি বাসের আশেপাশে, তবে তারাও সম্ভবত আমার মতোই বাসের যাত্রীই। অতএব ওদের জিজ্ঞেস করে তো কোন লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ ওরাও হয়তো খুঁজছে আমারই মতো তাদের নিজ নিজ বাসের নম্বর । বাসের ড্রাইভার, কন্ডাকটর বা হেল্পার তো মনে হচ্ছে না তাদের কাউকে। ধরেই নিয়েছি যে বাসকর্মী যারা, থাকবে তাদের ইউনিফর্ম, যদিও জানি না সে ইউনিফর্মটি কেমন বা কি তার রং। কিন্তু তারা যে ওইরকম রং বেরঙয়ের জ্যাকেট, টুপি আর জিন্স ফিন্স শোভিত হবে না, তা নিশ্চিত ধরে নিয়ে খুঁজতে থাকলাম ইউনিফর্মধারী কাউকে পাই কি না। হোক সে বাসকর্মী কিম্বা এয়ারপোর্টকর্মী, তাদের যে কেউ নিশ্চয়ই বলতে পারবে এই দুটোর মধ্যে কোনটা আমার কাংখিত বাস।
ঠিক তখনি নজরে পড়লো দুটো বাসের সামনেই পোতা আছে এককোমর উঁচু সারিবদ্ধ পাঁচটা করে লোহার পাইপের থাম, যা দিয়ে আসলে একটা বেষ্টনী বা ব্যারিকেড তৈরি করা আছে যাতে বাসগুলো তার চে বেশি সামনে এসে না দাঁড়ায় । দুটো বাসই দাঁড়িয়েছে ঐ লোহার বেষ্টনি থেকে কমপক্ষে মিটার খানেক দূরে। আমাদের দেশে হলে কোন অকারণ কারণেই ঐগুলো দাঁড়াতো ঠিক ঐ বেষ্টনীর গায়ে গা লাগিয়ে, আর তা করতে গিয়ে নির্ঘাত ধাক্কা লাগিয়ে ওই লোহার পাইপগুলোর কোন কোনটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিতো। ঐ রকম দুমড়ানো কোন পাইপ না থাকায়,ওগুলোর অক্ষতাবস্থা এখানকার ড্রাইভারদের ডিসিপ্লিনের সাক্ষী দিচ্ছে নীরবে। অবশ্য তাতে যতোটা না খুশি হলাম তারচেয়ে বেশি উৎফুল্ল হলাম যখন চোখে পড়লো সেই লৌহ পাইপ বেষ্টনীর, মাঝের পাইপটিতে হলুদ রঙয়ের একটা ধাতব পাতে কালো কালিতে একটা নম্বর লেখা দেখে। আর হ্যাঁ কপাল ভাল নম্বরগুলো লেখা হয়েছে ইংরেজিতে, তাতেই ওগুলো যে নম্বর, বুঝতে পারলাম । সাথে সাথে চকিতেই এও বুঝে নিলাম যে ওই নম্বরগুলোই হলো আসলে বাসের নম্বর!
দ্রুত চোখ বোলালাম তাই গোটা হিমচত্বরটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওই বাস বেষ্টনীগুলোতে লাগানো নম্বরগুলোর দিকে , আমাদের বাসটির জন্য নির্ধারিত স্থানটি বের করার জন্য। আগেই বলেছি গোটা চত্বরে এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে মাত্র দুটোই বাস, বাকি বাস বেষ্টনীগুলো দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাহাকার শূন্যতা নিয়ে। সে যাক চোখ বুলিয়ে দ্রুত নম্বরের গুলোর ক্রম আন্দাজ করে বাঁ দিকে তাকাতেই দেখি হাত দশেক দূরে জ্বলজ্বল করছে কাঙ্ক্ষিত ১৫ নম্বর! যাক, এই হিমে সবাইকে নিয়ে এই হিমচ্যানেলের দূরবর্তী কোন অংশ গিয়ে বাসে উঠার ঝক্কি থেকে বাঁচা গেল, কারণ আমাদের নির্ধারিত বাসটিতে উঠতে লাউঞ্জের উষ্ণতা থেকে বের হয়ে, খুব জোর ফেলতে হবে ১৫/২০ কদম।
কিন্তু বাস যে কখন এসে দাঁড়াবে ওখানে, আর কখনই বা ছাড়বে; তা তো জানি না এখনো ! নাকি এরই মধ্যে ছেড়ে গেছে ওখানে দাঁড়ানো বাসটি তাও তো জানি না। প্রথমবার এখানে পা দিয়ে তো হিমে কিংকর্তব্যপ্রস্তরবরফাবৎ হতেই, নিজের জান তো পরের কথা, প্রথমেই পুত্রদের নিরাপত্তার কথা বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়তেই, আর কোন দিকে দৃকপাত না করে ওদের বগলদাবা করে ঢুকে গিয়েছিলাম লাউঞ্জের উষ্ণতায় । যার কারণে আশেপাশের বাকি সবকিছুর ব্যাপারে হঠাৎ করেই ব্ল্যাক আউট হয়ে গিয়েছিলাম মনে হয়! আর না হয় এই যে এতো বড় দুটো বাস এখন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি, ওগুলো চোখে পড়লো না কেন? নাকি ওগুলো এসেছে এখানে আমরা ঢুকে যাবার পর? তাও যদি হয় , তখন কি একটা বাসও ছিলো না নাকি এখানে? বাকি যে যাত্রিরা এসেছিল আমাদের সাথে, তারা সবাই নিশ্চয় নিজস্ব গাড়িতে করে যায় নি শহরে। অনেকেই গেছে বাসে। তারমানে চক্ষু মেলিয়া থাকার পরও ঐ সামান্য ক্ষণটিতে চক্ষু মেলিয়া আমি কিছুই দেখি নাই। এদিকে এতক্ষণে হিম তার দাঁত বসানো শুরু করেছে ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে শরীরে কারণ কেমন যেন একটা শিরশির শীতভাব হচ্ছে শরীরে । বিশেষত নিম্নাংগের জিন্সের প্যান্টকে ঠাণ্ডায় জমিয়ে দিয়ে ভেতরের সুতি থার্মালটি পেরিয়ে চামড়ার উপর বসাতে শুরু করেছে শীত তার তীক্ষ্ণ আঁচড় । এছাড়া হাতে যে রেঙিনের গ্লাভস পড়েছি তাতেও কাজ হচ্ছে না তেমন । বিশেষত গ্লাভসের আংগুলগুলোর সেলাইয়ের ফাঁক দিয়ে অবলীলায় হিম, ভেতরে ঢুকে পরে আংগুলগুলো জমিয়ে দেবে মনে হচ্ছে! যার মানে হলো আর এরকম স্থির দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। হাঁটতে হবে, আর তাতে শরীরের জীববিজ্ঞানীয় নিয়মে ভেতরে কিছু তাপ উৎপন্ন হবে । যদিও শরীরে অতিরিক্তি তাপ উৎপন্ন হওয়া মানে তো হলো, ঠাণ্ডা আর বেশি লাগা। কারণ থার্মোডিনামিঙে বা তাপগতিবিদ্যার সূত্র মেনে, তাপ উচ্চ তাপমাত্রার স্থান থেকে তাপ ধাবিত হয় নিম্ন তাপমাত্রার দিকে। মানবসৃষ্ট সামাজিক বা অর্থনৈতিক নিয়ম যেমন তেলা মাথাতেই ক্রমাগত তেল ঢেলে ঢেলে, ক্রমাগত তৈরি করে চলে তুমুল আর্থসামাজিক অসাম্য, তার বিপরীতে পদার্থবিদ্যায় তাপ, উচ্চ তাপমাত্রা থেকে নিম্ন তাপমাত্রার দিকে নিজ গতি স্থির করে তৈরি করতে চায় তাপের সাম্যতা ।
সে সূত্রানুযায়ী এখন আমার শরীরে যতই তাপ উৎপাদিত হবে, ততই তা দ্রুত মিশে যাবে বেইজিংয়ের হিম বাতাসে। কিন্তু এই হিমে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও তো এক্কেবারে জমে যাবো! অতএব “লিখে রাখো একফোঁটা দিলেম শিশির” এর মত আমিও না হয় শরীরে কিছু তাপ বাড়তি তাপ উৎপাদন করে এই বেইজিং এর হিম চ্যানেলে বাড়তি কিছু তাপ বিতরণ করেই যাই। এ ভেবে দ্রুত পা চালিয়ে সচল হলাম ফের তাই।
হোটেলে যাবার বাসটিকে না পেলেও, আপাতত বাসটির দাঁড়ানোর জায়গাটির হদিস পাওয়াতে সেই থেকে বেশ একটা স্বস্তির ভাব এসেছে মনে, অতএব লাউঞ্জের সামনের লম্বা বারান্দা মতো জায়গাটি ধরে সামনে এগুলাম কোন দোকান আছে কিনা তা দেখার জন্য, এই হিমচ্যানেলের কোন খানে। অবশ্য ওই দুটো বাস বাদে সামনের দিকে বা আশে পাশের পুরোটাই তো নজরে পড়ছে। তাতে তো কোথাও কোন দোকানপাটের টিকিটিরও দেখা পেলাম না ! তারমানে ভেতরে গিয়ে যদি দেখি, আমি পানি নিয়ে ফিরছি এইভেবে, ওরা খাওয়া দাওয়া শুরু করে দিয়েছে, তবে তো ঝামেলা হবে। তারা তো জানে না জলহীন এই হিমচ্যানেল আসলে সকল অর্থেই জলহীন হিম কারবালা!
ইস কি যে ভুল করলাম! সকালে হোটেল ছাড়ার আগে তো সবাই একটা করে পানির বোতল ঢুকিয়ে নিতে পারতাম ব্যাগে, তাহলে তো আমাদের এই হিম কারবালা অবস্থা হতো না এখানে। হোটেল থেকে পানি না নেয়ার পর, কানমিং এয়ারপোর্টেও তো সে সুযোগ ছিল। ওখান থেকেও তো ক’বোতল পানি কিনে নিতে পারতাম । ওখানে তো দোকানপাটের অভাব ছিল না। ভাবতে ভাবতে মনে হল, আরে চায়নার রাজধানী বেইজিঙয়ের এয়ারপোর্টের অবস্থা যে এরকম ভেঙ্গে যাওয়া কোন গ্রাম্যহাটের মতো দোকানপাটহীন হবে, তা তো ভাবিই নি ঘুণাক্ষরেও। “আগে যদি জানিতাম তবে” কি সেধে সেধে এরকম নিধিরাম সর্দার মার্কা হয়ে হাজির হতাম এই হিম কারবালায়!
আরে বলে কি, জানলেও কি ব্যাগে পানির বোতল নিয়ে উঠতে পারতে নাকি প্লেনে? সবই তো ফেলে দিতে হতো নিরাপত্তা তল্লাসির সময় ডাস্টবিনে , অবচেতন এ সময় মনে করিয়ে দিলো সচেতনকে।
তাইতো! যতোই এখানে না হয়ে থাকুক এখনো আইসিস, তালেবান, বোকো হারাম বা হরকতের বোমাবাজি হামলা , যার কারণেই লাজুর নিরাপদ দেশে বেড়াতে যাওয়ার দাবি পূরণের লক্ষ্যে আসা এইখানে ; কিন্তু তারপরও এখানকার এয়ারলাইন্স কিন্তু আর সব দেশের মতোই , বিমানে তরল পদার্থ নিয়ে উঠতে দেয় না। এ কথা মনে হতেই ফের মন বিষিয়ে গেল গোটাগ্রহজুড়ে এক দমবন্ধ করা ভয়াবহ নিরাপত্তাহীন অবস্থার তৈরি করা ঐসব জঘন্য নৃশংস খুনিগুলোর উপর!
মন বিষিয়ে যাওয়া বিরক্তির ভাবটি স্থায়ী হলও না বেশিক্ষণ কারণ এ সময়েই প্রথমবারের মতো নজরে এলো করিডোরটির ঐ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা, পুরানোমডেলের লম্বাটে বনেটের সবুজ রঙয়ের গাড়িগুলোর দিকে। না পুরো সবুজ নয় গাড়িগুলো, প্রত্যেকটির পেটে হলুদ রংয়ের মোটা একটা স্ট্রাইপ আছে এমাথা ও মাথা। ঐ ট্যাঙিগুলো চোখে পড়তেই মনে হল আরে আমাদের বাস তো দেখিই নাই। শুধু ১৫ নম্বরের বাস কোথায় দাঁড়াবে তা দেখতে পেয়েই এমন নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম কেন? আমরা তো ইচ্ছে করলে এখুনি রওয়ানা করতে পারি। তাহলে তো আর এই হিম কারবালায় পানিয় জলের অভাবে কারো কষ্ট করতে হবে না, বা অকারণ লাউঞ্জে বসে বসে ঝিমুতেও হবে না।
তবে এই ট্যাঙিতে যাওয়া যাবে না। একে তো আমাদের সব ব্যাগ সুটকেসের জায়গা হবে না এর পেছনের ডিগিতে। অন্যদিকে এক ট্যাঙিতে তো কানমিংএই দেখেছি তিনজনের বেশি তোলে না, তার নিশ্চয় ব্যত্যয় হবে না এখানেও। সেক্ষেত্রে উপায় হলও দুটো ট্যাঙি ভাড়া করে পরিবারের সবাই দু ভাগে ভাগ হয়ে ট্যাঙি তে ওঠা। তাতে অবশ্য ব্যাগ সুটকেস দুই ভাগে নেবার ব্যাপারে একটা সুরাহা হলেও হতে পারে। লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাজার অর্থনীতির এ যুগে সরকার পরিচালিত ব্যবসায়িক কার্যক্রম প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাসীরা আতঙ্কে : মানুষ বাঁচলে ধর্মও বাঁচবে