উর্বর চন্দ্রভূমি মানে
ফার্টাইল ক্রিসেন্ট
ভাষাবিভ্রাটের দুর্লঙ্ঘ সাহারা পেরিয়ে অতপর খাবারের ট্রে কাউন্টারে এসে পৌঁছুতেই, বাপবেটা তিনজনে মিলে পাঁচজনের জন্য পাঁচ ট্রে তে দেওয়া খাবারের প্যাকেট তিন ট্রেতে সাজিয়ে, ঝটপট উর্ধগমনের উদ্দেশ্যে মানে এই ম্যাক আউটলেটের উপরের তলার দিকে যাত্রা করলাম যাকে বলে তিলার্ধ বিলম্ব না করে।
পুত্রদ্বয়কে সামনে রেখে এগুচ্ছি নিজে মোটামুটি সাবধানে, ধীরে, যাবতীয় তরল পদার্থ ভর্তি ট্রেটি নিয়ে, কারণ কাউন্টার থেকে খাবারের ট্রে বুঝে নেবার সময়, খাবারগুলোকে তিনটা ট্রে তে পুনরায় সাজাবার সময়, কফি আর ড্রিংক্সয়ের গেলাসগুলো সব একটাতে সাজিয়ে সেটিই নিয়েছিলাম নিজে।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই নিজেদের ট্রে নিয়ে যে রকম তড়িঘড়ি এগুলো দুপুত্র টেবিলের দিকে, তাতে পরিষ্কার দৃশ্যমান হয়ে উঠল চোখের সামনে দু’জনের উদরস্থ ক্ষুধা নামের ছুঁচোর নৃত্য। মোচড় দিয়ে উঠল বুকের ভেতরটা। সাথে সাথেই মনে হল, আসলে ক্ষুধা জিনিষটা যে কী ভয়ংকর একটা ব্যপার এটা তো তারা সম্ভবত কোনোদিন বোঝেইনি। চাইবার আগেই তো চলে আসে নানান খাবার সামনে। ক্ষুধা লাগবারই তো অবকাশ নেই তাদের। আজকাল ঘরের নানান জায়গাতেই তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে নানান খাবার, ছিল না যা আমার নিজেরই বালকবেলায়। তদুপরি দুর্ভাগ্যপীড়িত প্রবঞ্চিত বিশ্বের নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুধার্ত মানুষদের যে কি দুর্দশায় কাটে জীবন, তা সম্ভবত ওদের কল্পনাতেও নেই।
‘কি ব্যাপারে এতো দেরী কেন? আমার দিকে এই শক্তিশেলটি ছুড়ে দিয়েই, পুত্রদের উদ্দেশ্যে মাতৃমুখ থেকে ঘোষিত হল নয় নম্বর বিপদসঙ্কেত ‘এই এই খবরদার! হাত না ধুয়ে খাবারে হাত দেবে না বলছি তোমরা কেউ’!
সেই নীচতলা থেকে টলটলায়মান তরলপদার্থ ভর্তি ট্রে নিয়ে যে আসছিলাম বেশ সাবধানেই, তা তো বলেছি আগে। তাতে ঠিকই ছিল সব এতোক্ষণ, কিন্তু এক্কেবারে টেবিলের কাছাকাছি হতেই কিনা তীরে এসে তরী ডোবার অবস্থা হলো; এই মাত্র নিজের দিকে ছুটে আসা শক্তিশেলটির কারণে যেমন, তেমনি পুত্রদের জন্য জারী হওয়া নয় নম্বর বিপদ সংকেতের কারণে। থমকে যাবার কারণে হঠাৎ হাঁটার গতির ছন্দপতনের ধাক্কায় ট্রে তে রাখা পাঁচ পাঁচটি তরলপূর্ণ গ্লাস উঠল টলে। কপাল ভাল ওগুলোর সব মুখ বন্ধ করা আছে, না হয়, ছলকে গিয়ে ঠাণ্ডা ড্রিংঙ হাতে পড়লেও সমস্যা ছিল না, কিন্তু এই ঠাণ্ডাতেও যদি লাগতো হাতে গরম কফির ছ্যাঁকা তবে, খবর ছিল! গেলাসগুলো পড়ি পড়ি টলটলায়মান ভাব দেখতেই নিজের অজান্তেই সার্কাসের জাগ্লারদের মতো নাকি রক্তের ভেতর সারাক্ষণ খেলা করা আমারই অরণ্যচারী পূর্বপুরুষদের বৃক্ষশাখায় বিচরণের কৌশলে শরীর আর হাতের যুগপৎ কায়দায় কী করে যেন ওগুলোর পতন ঠেকানো গেল।
‘হাত ধুয়ে এসেছি আমরা ? বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো’? বেশ জোরের সাথে দীপ্র জানালো মা’কে
টেবিলে নিজ হাতের ট্রেটি রাখতে রাখতে, পুত্রের দাবির প্রতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই, হেলেন লাজু দুজনেই জানতে চাইল কোথায় সেই জায়গা? শুধুই হাত ধোয়ার জায়গা হোক তা, কিম্বা হোক তা রেস্টরুম তারা যাবে সেখানে।
‘না আমি যেতে পারবো না এখন তোমাদের নিয়ে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বা দিকে ঘুরে পেছনের দিকে গেলেই পাবে ওটা’। দৃপ্ত কণ্ঠে আগেভাগেই এ ঘোষণা দিয়ে মা আর ফুফফির অতি সম্ভাব্য অনুরোধ বা আদেশের জবাব দিয়ে দীপ্র তার বিগ ম্যাকের খোলস মানে বার্গারের উপরে যে কাগজ মোড়ানো থাকে তা খুলতে লেগে গেল। অন্যদিকে অভ্রের আঙ্গুল ঝাঁপিয়ে পড়েছে আলু ভাজার মানে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্যাকেটে।
এদিকে আমার নিজেরও ফের যেতে ইচ্ছে করছে না নীচে হাত ধোবার জন্য, বিশেষত বরফ শীতল পানির কথা কল্পনা করে। কিন্তু সে কথা তো বলা যাবে না মুখে। বললেই তো আছে খবর! তাই কথাবার্তা আর না বাড়িয়ে দু’জনকেই বললাম চল, আমারও তো হাত ধুতে হবে।
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে নামতে হাত না ধোয়ার যে গোপন ইচ্ছেটি জেগেছিল মনে এইমাত্র, সেটির লেজ ধরেই চলে এলো ভাবনা, আচ্ছা এই যে ফাস্টফুড এ তো হাতের ছোঁয়া না লাগিয়েও খাওয়া যায় ইচ্ছে করলে, কিন্তু তারপরও আমরা কেন হাত ধুতে যাচ্ছি এই ঠাণ্ডায়? এখানে চায়নিজদের কাউকে তো খাবার ট্রে নিয়ে তা টেবিলে রেখে হাত ধোয়ার জন্য যেতে দেখছি না। আগেও দেখিনি তা ইউরোপ আমিরিকার কোনো ফাস্ট ফুড শপেই। এমন কি রেস্টুরেন্টেও দেখিনি তা। খাওয়ার সাথে হাত ধোয়ার এই ওতপ্রোত সম্পর্কটি কি শুধু আমাদের সংস্কৃতিতেই আছে না কি? অবশ্য তারা হাত দিয়ে খেলেও খাবারে তো হাত লাগায় না। ছুরি, কাঁটা চামচ, চামচ কিম্বা কাঠিই তো ওদের খাবার খাওয়ার অনুষঙ্গ। সে জায়গায় আমরা সহ প্রাচীন ভারতীয় ভূখণ্ড, মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকাতেই না মানুষ হাত দিয়ে খায় খাবার, যতোটা মনে পড়ছে।
আড়াই থেকে তিন লাখ বছর আগে আজকের আধুনিক মানুষরা মানে হোমো সেপিয়েন্সরা এ গ্রহে আফ্রিকাতেই তো প্রথম পা রেখেছিল, তারপর ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবীতে। অরণ্যচারী সংগ্রাহক ও শিকারী মানুষেরা তো অবশ্যই হাত দিয়েই খেতো খাবার। আবার কৃষিকাজ শিখে অরণ্যচারী মানুষ যখন প্রথম থিতু হয়েছিল মিশর, মেসোপটেমিয়া, লেবানন, নুবিয়া মানে এখনকার সুদান, ইসরাইল, জর্ডান, প্যালেস্টাইন, ইরাক আর ইরান জুড়ে যে উর্বর চন্দ্রভূমি নামে পরিচিত এলাকা আছে যেটিকে ইংরেজিতে বলে ফার্টাইল ক্রিসেন্ট, এ গ্রহের মানব ইতিহাসের তুলনায় অতি নগণ্য সময় মাত্র দশ বারো হাজার বছরের আগে, তখন থেকেই তো অত্র এলাকার সবাই হাত দিয়েই খাচ্ছে। কী কারণে তাহলে ইউরোপিয়ান, চায়নিজ, জাপানিরা খাবার খাওয়ার জন্য ছুরি কাঁটা চামচ, কাঠি এসবের প্রচলন করলো ? এ কি তবে খাবারের ধরনের কারণে নাকি স্বাস্থ্যগত কোনো কারণে? প্রকৃতির অফুরন্ত জল সম্পদের অধিকারি আমাদের দেশের মানুষের বার বার হাত ধোয়ার জন্য যেমন পানি পেতে অসুবিধা হয় না, তেমনি আমাদের খাদ্য রন্ধন প্রণালি যা, তাতে সে খাবার হাত দিয়ে না খেলে তো পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া যায় না। হাত দিয়ে ডাল ভাল মতো ভাতে মাখিয়ে আলুভর্তা দিয়ে না খেয়ে, কাঠি বা চামচ দিয়ে তা খেলে বাঙালির তৃপ্তি দূরে থাক ক্ষিধেই তো মিঠবে না!
‘কি ব্যাপার? তুমি কি আমাদের সাথে মেয়েদের রেস্টরুমে যাবে না কি? না কি ঐ যে টেবিলে বসে আছে সুন্দরী তাকে ধরেছে মনে, বসবে গিয়ে তার টেবিলে’?
একেই বলে পড়বি পর মালির ঘাড়ে। কি দরকার ছিল ঐ যে একটু দূরে একাকী উদাস হয়ে বসে আছে এক দির্ঘাঙ্গি চায়নিজ সুন্দরী, এই মুহূর্তে তার ঐ টেবিলে একাকী বসে থাকার? চোখের সামনে এরকম এক সুন্দরীর উপস্থিতিতে কোন পুরুষের মন যে যেতে পারে অন্য কোনখানে, এ কথা আর যেই বিশ্বাস করুক না কেন, এ জগতের কোনো স্ত্রীকেই তো বিশ্বাস করানো যাবে না। যতই বলি চোখ আমার ঐদিকে থাকলেও দেখিনি তো তাকে, কারণ মন তো ছিল আমার উর্বর চন্দ্রভূমিতে। মন আর চোখের তো যোগাযোগ ঘটেনি মোটেও। নাহ বৃথা হবে সে চেষ্টা নিশ্চিত! অযথা কথা বাড়িয়ে কী লাভ? তাই কিছুটা থতমত খেয়ে ডানে ঘুরে ঢুকে গেলাম হাত ধোয়ার আঞ্জামে।
কলের নীচে হাত রাখার আগে মনে মনে বরফ শীতল জলের তীব্র ছোবলের আশংকায় আশংকিত থাকলেও, সংবেদনশীল এই কল তার নীচে গলা পেতে দেয়া এই বঙ্গসন্তানের হাতকে আর নাকাল করলো না। এক্কেবারে গরম পানি না হলেও, পানিটা হল বলা চলে ঘরটির মতো ওম ওম উষ্ণতার। ঝটপট সসাবান হাত ধুয়ে, বাইরে এসে ওদের ফিরে আসার অপেক্ষা করতে করতে ফের মনে হল আচ্ছা আড়াই তিন লাখ বছর আগে আফ্রিকায় হোমো সেপিয়েন্স জন্ম নিয়ে টিকে গেল এই গ্রহে, নির্মাণ করলো আজকের সভ্যতা দিকে দিকে নানান চেহারায়, সেখানে এই বেইজিং শহরে তার থেকে আরো কয়েক লাখ বছর আগে আসা পিকিং মানব কি তাহলে টিকতে পারল না, এখানকার এই ঠাণ্ডার মরণ কামড়ের জন্যই নাকি? আচ্ছা সেই আদ্যিকালের পিকিং মানব কি এখনকার চায়নিজদের মতো মংগোলয়েড ছিল না কি?
নাহ, পরীক্ষা পাশ দেবার জন্য সেই বহুদিন আগে যতোটুকু প্যালিওন্টোলজি মুখস্থ করেছিলাম, সে বিদ্যা হাতড়ে পেলাম না কোনো উত্তর। আবার এ ব্যাপারে আর ভালো করে জানতে হলে তো পড়তে হবে এন্থ্রপোলজিও, সে বিষয়ে তো জ্ঞান আমার লবডঙ্কা। আসলে ঐ গালভরা নামটি ছাড়া ঐ বিষয়ের কিছুই তো জানি না। অতএব আফ্রিকা উদ্ভুত আধুনিক মানব প্রজাতি কবে যে ফের চারটি রেইসে ভাগ হয়ে পড়েছিল তার তো কোনো হদিসই জানি না! ‘কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলে নাকি?’
ঘাড় ঘুরিয়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিতে গিয়ে ফের নজরে এলো সেই উদাস নয়না টেবিলে একাকিনী চায়নিজ সুন্দরীর দিকে। প্রমাদ গুনলাম মনে, এই ভেবে যে এক্ষুণি হয়তো আবার আসবে সেই সুন্দরী বিষয়ক খোঁচাটা। চুপচাপ সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হাঁফ ছেড়ে ভাবলাম, কপাল ভাল যে দাঁড়িয়েছিলাম এবার একাকিনী উদাসি সুন্দরীর দিকে পিঠ দিয়ে, না হয় এবার আর উপায় ছিল না বাঁচার।
লেখক : প্রাবন্ধিক; ভ্রমণসাহিত্যিক