দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১২ জুন, ২০২২ at ৮:২৫ পূর্বাহ্ণ

গাঁটের পয়সা দিয়ে খাদ্য কিনে তা সংগ্রহের নিমিত্তে ম্যাক আউটলেটের আসমান থেকে মানে উপরের তলা থেকে পিতাপুত্র নেমে, লাইনে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য তড়িঘড়ি করে এগুলো ভাবছি যখন, তখনই চোখে পড়লো করিডোরটার বা পাশে রাখা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারিশ্মাটির দিকে!

একটু আগেই গিয়েছি এদিক দিয়ে সবে মিলে বসবার মতো জায়গার খোঁজে, তখন নজরে না পড়লেও পড়ল এখন তা। বেশকটা বড় আয়তাকার স্পর্শপর্দা বা টাচস্ক্রীন সাঁটানো আছে পর পর এক মানুষ সমান উচ্চতার স্টিলের ফ্রেমে। প্রথম দর্শনে ও গুলোকে নেহাতই বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড মনে হলেও,একটু ভাল করে তাকাতেই মনে হলো এ হলো ঐ যে বললাম চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারিশমা! যে কারিশমায় বিশেষত জনবিরল তথাকথিত উন্নত বিশ্বে অনেক মনুষ্যকর্ম হাত বদল হয়ে চলে গেছে এরই মধ্যে যন্ত্রের কাছে, এ হলো কী না এই জনবহুল চায়নাতেও তারই নমুনা। ঋণাত্মক জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে আক্রান্ত ও বয়োবৃদ্ধ জনসংখ্যায় ভারাক্রান্ত ইউরোপ আমেরিকায় না হয় কাজ করার লোক নাই, যার কারণেই না, প্রথমত তারা আমাদের মতো জনবহুল দেশগুলো থেকে কর্মক্ষম জনসংখ্যা আমদানি করেছে নানান নামে, বৈধ আর অবৈধ উপায়ে। আর দ্বিতীয়ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে তারা বলা চলে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সময়কাল থেকেই আবিষ্কার করে চলেছে নানান যন্ত্র, যেগুলো দিয়ে করানো যায় নানান কাজ। ডিজিটাল টেকনলজির এই যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভূতপূর্ব অগ্রগতির কারণে আজকালকার অনেক মনুষ্যনির্ভর কাজই, যন্ত্রে করা যাবে সম্পাদন। সেটা কর্মক্ষম মনুষ্যবিরল ইউরোপ আমেরিকার জন্য ভাল খবর হলেও, চায়না বা আমাদের মতো জনবহুল দেশের জন্য মোটেও ভাল খবর নয়। যেহেতু এটি কর্মক্ষম মানুষকে বেকার করে দিয়ে সমাজে চাপিয়ে দেবে বেকারত্বের বোঝা! ‘বাবা, দাঁড়িয়ে আছো কেন? চল যাই লাইনে গিয়ে দাঁড়াই’ আমার তব্দা লাগা ভাবকে ঝাঁকিয়ে বিদায় করতে ব্যস্ত দীপ্রকে বললাম, ঐ যে দেখো? ওগুলো কী বলোতো?

ওহ, ওগুলো তে অর্ডার করা যায়। আগেই তো দেখেছি, তুমি দেখো নি? উপরে যাওয়ার সময়েই দেখেছি ওগুলো তো সব চায়নিজ, তাই আমরাতো ওগুলো থেকে অর্ডার করতে পারব না। চল তাড়াতাড়ি লাইনে যাই’।

ঠিক আছে তুমি গিয়ে লাইনে দাঁড়াও, আমি দেখি একটু এগুলোতে ইংলিশ ভার্সন আছে কি না। যদি থাকে, তাহলে তো লাইনে দাঁড়িয়ে যতোক্ষণে অর্ডার করতে পারবো তার অনেক আগেই অর্ডার পৌঁছে দিতে পারবো ম্যাকের কিচেনে। আর ঐ যে দেখো, ঐ মেয়েটি টাচস্ক্রিনে অর্ডার করার পর, ঐ স্ক্রিনের নীচে লাগিয়ে রাখা মেশিনটিতে দাম ও মিটিয়ে দিচ্ছে। ‘না বাবা, একা দাঁড়াব না লাইনে। তুমি আমি এক সাথেই দাঁড়াব’। বলেই দুজনের একদম কাছের স্ক্রিনটায় অর্ডার করা শেষে মেয়েটি চলে যেতেই দীপ্র গিয়ে তড়িঘড়ি দখল নিল সেটির।

নানান ম্যাক মেনুর ছবির সাথে থাকা ওগুলোর চায়নিজ বর্ণনাসম্বলিত চায়নিজ লেখাগুলো দীপ্রর হাতের কারিশমায় অচিরেই ইংরেজিতে রূপান্তরিত হয়ে পড়তেই, বিজয়ীর ভঙ্গিতে বললাম, দেখলে তো বাবা! কোন কিছু চেষ্টা না করেই, তাতে কাজ হবে না বলতে নেই। এই যে তুমি নিজেই এটির ইংরেজি ভার্সন বের করে ফেলেছো। এখন দিয়ে ফেল অর্ডার।

দেখ বাবা, ওরা কিন্তু কার্ড দিয়ে পে করছে, তোমার কার্ড দিয়ে কি পে করা যাবে এখানে’?

পুত্রের কথায় দ্রুত কাঁধব্যাগের পকেট থেকে নিজের আন্তর্জাতিক বাইক্কা কার্ডটি বের করে থাকলাম অপেক্ষায়। যদিও জানি এই বাইক্কা মানে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ভিনদেশি মুদ্রায় ভিনদেশে কিছু কিনলে, ব্যাংকের নানান গাণিতিক মারপ্যাঁচে বেশিই দাম দিতে হবে অবশেষে, কিন্তু সেটিকেও পাত্তা দিচ্ছি না এ মুহূর্তে। যেহেতু বাঁচবে সময় এতে, ঐ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অর্ডার করে দাম মিটিয়ে খাবার হাতে পেতে যে সময় লাগবে তার তুলনায়। সাধে কি আর বিদগ্ধজনেরা বলেছেন যে সময় অমুল্য !

তোমার আর মা’র জন্য কি কফির অর্ডার করবো? আমার আর অভ্রর জন্য কিন্তু এঙট্রা চিজ এন্ড মেয়নেজ এড করবো বার্গারে, সাথে নেব এঙট্রা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর এঙট্রা লার্জ ড্রিঙ্কস’ বুঝলাম গত ক’দিনে ভাষাগত ঝুটঝামেলায় পুত্র আমার মনের মাধুরী মিশিয়ে ম্যাকের সার্বজনীন মেনুকে নিজ পছন্দ মতো করে নিতে পারেনি যেহেতু, নিশ্চয়ই তাতে মন তার খচ খচ করছিল। এখন এই ডিজিটাল যন্ত্রে নিজে অর্ডার করার সুবিধা পেয়ে তা উসুল করতে চাইছে। সহাস্যে তাই বললাম, ঠিক আছে দাও তোমার ইচ্ছা মতো অর্ডার! এছাড়া এ মুহূর্তে এখানে তো আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই পেছনে। দাও অর্ডার ধীরে সুস্থে।

নাহ খুব বেশী সময় নিল না দীপ্র। অচিরেই জানাল সে ‘অর্ডার হয়ে গেছে বাবা। এবার পে করো’। অতএব দ্রুত এগিয়ে ছোঁয়াপর্দাটির নীচের দিকের একটা খোপে লাগিয়ে রাখা যন্ত্রটিতে নানান কায়দায় নিজের কার্ড ঘসে আর সেটির নানান বোতামে নানান রকম চাপে টেপাটেপি করে যখন চায়নিজ লেখা ভিন্ন অন্য কিছু দেখতে পেলাম না, হতাশ হয়ে পেছন ফিরতেই এক চায়নিজ যুবককে দেখতে পেয়ে, হড়বড় করে ইংরেজি তো বললাম, দেখো তো ভাই এই মেশিন কি বলছে? আমার এটা ইন্টারন্যাশানাল ক্রেডিট কার্ড। এই যন্ত্রে শুধু চায়নিজ আসছে কেন? একে একটু ইংলিশে নিয়ে দাও না। কি বুঝল, কি বুঝল না বেটা, কোন কূল কিনারা পেলাম না তার ! উত্তরে যখন দেখলাম সে শুধু হালকা হাসিতে ঐ পর্দাটির দিকে নির্দেশ করল কিছু একটা অনিশ্চিতভাবে! হাল ছেড়ে তাই পুত্রকে বললাম, চল বাবা। তুমিই ঠিক বলেছ আমার কার্ডে কাজ হবে না। চল লাইনেই গিয়ে দাঁড়াই।

দীপ্রসহ সামনের দিকে এগিয়ে তিনটা লাইনের মধ্যে যেটিকে মোটামুটি ছোট মনে হল সেটিতেই দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়েই সারসের মতো গলা লম্বা করে সামনের মাথাগুলো গুনে দেখি এক্কেবারে টায়ে টায়ে আছি দশজনের পেছনে আমরা। যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় অপেক্ষা, করতে হবে কমপক্ষে আধাঘণ্টা ! কিন্তু কি আর করা?

এমনিতেই যে কোন আ লা কার্তে রেস্টুরেন্টেই খাবারের অর্ডার দিয়ে, গুলগাপ্পি মারার মতো কেউ পাশে না থাকলে চুপচাপ টেবিলে বসে থাকতে লাগে বিরক্ত। আর এখানে তো আছি রেশনদোকান বা লঙ্গরখানার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে। তার উপর ছোঁয়াফোন বা যন্ত্রকে যে এখানকার ওয়াইফাইয়ের সুবিধা নিয়ে ঘুরে বেড়াবো ভার্চুয়াল জগতে তারও তো উপায় নাই। কাকে জিজ্ঞেস করি ওয়াই ফাইয়ের পাসওয়ার্ড? এদিকে ততোক্ষণে দীপ্রও আমার পেছন থেকে লাইনে ছেড়ে বেরিয়ে বলল,

বাবা আমি একটু ঘুরে দেখি? তুমি তো লাইনে আছো’। ঠিক আছে যাও। তবে কাছাকাছি থেকো। না হয় অতগুলো খাবারের ট্রে নিয়ে ঝামেলা হবে। আমার সায় পেয়ে হাসিমুখে দীপ্র সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই মন ভাল হয়ে গেল দ্বিবিধ কারণে। প্রথমত, এসময় এগুতে পারলাম দু’ পা নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জনের সাথে তাল মিলিয়ে, যার মানে হচ্ছে কাউন্টারের সামনের জনের কাজ শেষ হতেই লাইন থেকে আরেকজন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ! দ্বিতীয় মন ভাল হবার কারণ হল, মাথা না ঘুরিয়েও বুঝতে পারছি আমার পেছনে কয়েক জন খাদ্যান্বেষী এসে দাঁড়িয়েছে ফলে লাইনের শেষ ব্যক্তির অবস্থান থেকে আমার প্রমোশন ঘটেছে। মনের এই দ্বিতীয় ভাবনাটি মনে আসতেই হাসি পেল।

ঐ হাসির লেজ ধরেই ফের ভাবনাএলো আচ্ছা দাঁড়িয়েছি কি আসলে ঠিক লাইনেই? ঐ যে অর্ডার দেয়ার স্বয়ংক্রিয় ছোঁয়াপর্দাগুলো বসিয়ে রেখেছে এরা, তাতে যারা অর্ডার দিচ্ছে, তারা নিচ্ছে কোথা থেকে খাবার? ওখানে অর্ডার দিয়ে, দাম মিটিয়ে তারা কি আলাদা কোনো লাইনে দাঁড়ায় নাকি? যেমন হয় আর কি এয়ারপোর্টে অনলাইন বোর্ডিংকারীদের জন্য। এখানেও কি তেমন নাকি? যদি হয় এটাই সেই লাইনে আর এতোক্ষণ অপেক্ষা করে এতোটা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে কাউন্টারের সামনে গিয়ে যদি সেই ভুল ধরা পড়ে, তবে তো খেয়ে যাবো এক্কেবারে রামধরা! ব্যাপারটি নিশ্চিত হবার জন্য একটু কাত হয়ে সামনের দিকে নজর দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম যে, এ কাউন্টারে অর্ডার দিয়ে দাম চুকিয়ে খাবার নেবার সুযোগ আছে কী না? নাকি এটা হল সেই স্পেশাল লাইন যেখান থেকে শুধু খাবার সার্ভ করা হয় তাদের, যারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবজাত স্বয়ংক্রিয় মেশিনে খাবারের অর্ডার করার পর দাম চুকিয়ে খাবারের টোকেন নিয়ে দাঁড়িয়েছে।

যাক, কাউন্টারের দিকে নজর ফেলে যে নজরে এলো তাতে আশ্বস্ত হওয়া গেল। কারণ এক্ষণে দেখছি যে ক্রেতা আছেন একদম সামনে, সে দাম মিটাচ্ছে তার অর্ডারের। পাশের দুটো লাইনের কাউন্টারের দিকে তাকিয়েও একই দৃশ্য দেখে, ভাবনা এলো আচ্ছা ঐ মেশিনের অর্ডার করা লোকজন তাহলে খাবার নেয় কোত্থেকে? এতো দেখছি এক বিরাট ধাঁ ধাঁ। নাকি আমেরিকায় যেমন কিছু কিছু ম্যাক আছে যেখানে ড্রাইভ থ্রু নামে একটা সার্ভিস দেয়া হয়, এটাতেও আলাদা সেরকম কোনো কাউন্টার আছে বাইরের দিকে? যদিও আমেরিকায় যে ড্রাইভ থ্রু দেখেছি বছর সাত আটেক আগে, ওখানে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে, গাড়িতে বসেই জানালার কাঁচ নামিয়ে ক্রেতাকে ম্যাক আউটলেটের রাস্তা লাগোয়া জানালার মতোকাউন্টারে অর্ডার করে দাম মিটিয়ে খাবার নিয়ে, গাড়ী ছুটিয়ে দিতে হয়। এখানে কি তবে তারই একটা ভিন্ন সংস্করণ দেখছি নাকি। এই আউটলেট রাস্তা লাগোয়া হলেও, রাস্তা থেকে এটা যতোটা উপরে তাতে ঐ রকম ড্রাইভ থ্রু কাউন্টার করা তো সম্ভব না এখানে। তাই কি এই ভিন্ন ব্যবস্থা? আর হলোই বা তা, সেই ড্রাইভ থ্রু খাবারটাই বা সার্ভ করছে কোন কাউন্টার থেকে? যদিও এ ডিজিটালযুগে ঘটে যাওয়া নানান ভোজবাজির তুলনায় এটা তেমন কোনো বিশাল তেলেসমাতি না। তেলেসমাতি তো হতো সেটা; যদি দেখা যেত যে, কেউ বাড়িতে, অফিসে বা পার্কে বসে কিম্বা রাস্তায় গাড়িতে বসেই ছোঁয়াফোনে খাবারের অর্ডার দিয়ে দাম মিটিয়ে, হেঁটে বা গাড়িতে করে ম্যাকে এসে কাউন্টার থেকে খাবার সংগ্রহ করে বসতে পারত গিয়ে স্বয়ংক্রিয় ভাবে রিজার্ভ করে রাখা টেবিলে। হুম ম নাহ। এটাকেও তেমন কোনো তেলেসমাতি মনে হচ্ছে না।

আচ্ছা ডিসরাপ্টিভ ইনোভেশনের বাংলা কী হবে? তেলেসমাতি উদ্ভাবন কি হতে পারে এর অনুবাদ? ডিসরাপ্টিভের বাংলা তো হল, ভাংচুর করা, বিঘ্ন সৃষ্টি করা কিম্বা ওলট পালট করা। এ ধরনের উদ্ভাবনগুলো তো প্রথাগত সব ধ্যানধারনা আচরণ ভেঙ্গেচুড়ে বা ওলট পালট করে নির্মাণ করছে সম্পূর্ণ নতুন ধ্যানধারনা, প্রথা, ব্যবসায় এবং সমাজে। কিন্তু কথা হচ্ছে উদ্ভাবনের মতো একটা ধনাত্মক শব্দের সাথে ঐরকম ঋণাত্মক শব্দ কেমন যেন বেমানান। তার চেয়ে তেলেসমাতি উদ্ভাবন বলাটাই ভাল। ওহ! অঘটনঘটনপটিয়সী বা কী দোষ করলো। এটাতে তো যেমন আছে ছন্দ, তেমনি আছে ধনাত্মক ব্যঞ্জনা ! তাহলে হোক না ওটাই।

লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনব আনন্দে, নতুন প্রেমে
পরবর্তী নিবন্ধহযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ ছিরিকোটি