দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৯ মে, ২০২২ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

“বাবা, বাবা, ড্রাইভার আংকেল চলে এসেছে!” দীপ্রর উত্তেজিত কণ্ঠের এই কথা কটি এসময় এর ঘরকে গমগম করে রাখা চুং চাং ফুং ফাং কে অবহেলায় নিমিষেই অতিক্রম করে কানে পৌঁছুতেই, ওর দিকে মাথা ঘোরাতেই দরজায় দেখি, ভাবলেশহীন মুখে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে, সারসের মতো গলা লম্বা করে লি খাঁ তার চায়নিজ চোখ ফেলছে এদিকে ওদিকে আমাদের খোঁজে ।
একই সাথে আনন্দ আর হতাশার মিশেলে, রাখ তোর কফি তোর কাছেই এ কথা ক’টি কাউন্টারের ওপাশে ছুড়ে দিয়ে ,লি খাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য হাত উঁচিয়ে হ্যালো বলে হাঁটা ধরতেই দেখি এরই মধ্যে দীপ্র গিয়ে লি খাঁর জ্যাকেটের পকেটে বন্দি বা হাত ঝাঁকিয়ে তার মনোযোগ আকর্ষণ করছে। তার গাড়ীর আজকের ভ্রমণদলের ছোট এই সদস্যটিকে সামনে পেয়ে লি খাঁর ভাবলেশহীন মুখে ততক্ষনে আবছা এক চিলতে হাসি খেলে গেল।
আর দেরী নয় চল চল, বাকীদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলে দরজার সামনে গিয়ে লি খাঁকে খাঁটি বাংলাতেই বললাম, অনেক ধন্যবাদ চাচা, বেশ তাড়াতাড়িই চলে এসেছেন আপনি আমাদের মুশকিল আসান হয়ে। অতপর লি খাঁর অনুগামী হয়ে সবাই মিলে ফের যখন দিলাম ঝাপ বাইরের তীব্র হাওয়ামুখর হিমসাগরে, কেন জানি কেউ আর ঠাণ্ডায় আগের মতো কাবু হয়ে কুঁকড়ে গেলাম না।
“বাবা, বাবা, ম্যাকডনাল্ডসে যাই এখন চল। আমার খিদে পেয়েছে “নতুন কেনা দস্তানা মোড়া হাতে আমার জ্যাকেট খামচে ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে মওকা বুঝে অভ্র পেশ করলো দাবি।
ওকে নিশ্চিন্ত করে, লি খাঁর পিছু পিছু এগুতে এগুতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ডানে ঘুরে, একটা সরু গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে এই প্রথম এলাকাটিকে চোখজরীপ করার সুযোগ হল। আসলে পথ হারিয়ে ঐ নিষিদ্ধ নগরীর সামনের খোলা মাঠের চারদিকের সারিসারি স্যুভেনিরের দোকান গুলো পেরিয়ে এদিকটায় এসে, রেস্টুরেন্টটা চোখে পড়তেই এতোটাই উত্তেজিত ও আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে, সে সময় ঐ রেস্টুরেন্টর আশেপাশে আর কি আছে তা চোখেই পড়েনি। আসলে তার দরকারই তো ছিলো না তখন। এখন আমাদের উদ্ধারকারী লি খাঁর পিছু পিছু নিশ্চিন্তমনে হাঁটতে হাঁটতে, এই গলির দু পাশে ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পুরানো ধাঁচের একতলা বাড়িগুলো দেখতে দেখতে মনে হল, এটা সম্ভবত বেইজিং এর প্রাচীন হুতং মানে গলি সমূহের কোন একটা। তবে বিখ্যাত কোন হুতং নয় মনে হয় এটা, যেমন পড়েছিলাম আর দেখেছিলাম ছবি, প্লেনের পত্রিকায়। এ গলিতে এমুহূর্তে আমরা ক’জনা ভিন্ন অন্য কারো নেই পদচারণা। জানি না খারাপ আবহাওয়ার জন্যই সকলে ঘরে খিল মেরে বসে আছে কি না? এছাড়া কোন হকার তো দূরের কথা, দোকানপাঠও দেখছি না। এটা কি তাহলে কোন আবাসিক এলাকাই নাকি?
তা যাই হউক এগুলো, গোমড়া মুখো বাড়িগুলোর চেহারা সুরতে মনে হচ্ছে এগুলোতে লেগে আছে প্রাক সাংস্কৃতিক বিপ্লব আমলেরই ভাবভঙ্গি। এরই মধ্যে দশকে দশকে বদলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নগরী সমূহের একটি হয়ে ওঠা বেইজিং এর উন্নয়নের বলি আর আধুনিকতার ছোঁয়া বলি, কোনটাই এসে লাগে নি এখানাকার আলো হাওয়ায়। আচ্ছা, এটা কি এমনও হতে পারে যে, ইতিহাস সংরক্ষণের কারণে নগরপরিকল্পনাবিদরা ইচ্ছে করেই, সুবিখ্যাত নিষিদ্ধ নগরীর গা লাগোয়া এই হুতং টিকে রেখে দিয়েছে এর সাবেক অবস্থাতেই?
লি খাঁকে অনুসরণ করে অনেকটাই সরলরৈখিক এই সরু গলি পথের শ দেড়শ মিটার পদব্রজে পাড়ি দেবার পর এসময় অকস্মাৎ ডানে পেয়ে যাওয়া আরো সরু একটা গলির হাঁটা পথে পা রাখতেই-“আরো কতক্ষণ হাঁটতে হবে আমাদের? কোথায় রেখে এসেছে গাড়ী?” লাজুর এই যুগল প্রশ্নে পেছন ফিরে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ আর দেহ ভঙ্গিতে জানালাম যে, এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই এই অধমের। আমার অবস্থা এখন “আগে চলে অলি আল্লা পিছে চলে মালগাড়ী”। অবশ্য এরকম অনিশ্চিত উত্তরে অবস্থা ভিন্ন দিকে যাতে মোড় না নেয় আবার সেজন্য সাথে সাথেই বললাম, ধারণা করি খুব বেশী দূর আর হাঁটতে হবে না এই হিমে। লি খাঁ এই এলাকার নাড়ি নক্ষত্র ভালই চিনে। অতএব যুৎমতো ধারে কাছেই কোথাও তার বাহন কে পার্ক করে আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছিল সে নিশ্চিত।
কপাল ভালই বলতে হয়। কারণ মুখের কথা শেষ হতে না হতেই, এসময়ে সেই সরু গলির একদম শেষ মাথায় এসে লি খাঁর পিছু পিছু ফের বাঁয়ে মোড় নিয়েই মহা উল্লসিত দুই পুত্র তাদের স্বভাবমতো প্রতিযোগিতামূলক হৈ চৈয়ে ঘোষণা করলো যে অদুরেই দেখতে পেয়েছে তারা আমাদের শকটের। যুগল সেই ঘোষণায় একটু পিছিয়ে থাকা আমাদের সবারই পায়ের গতি গেল বেড়ে।
একদম সদর রাস্তা না, তবে ঐ গলির চেয়ে ঢের বেশী চওড়া একটা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঝিমুতে থাকা গাড়িটির কাছে এসে লি খাঁ সেটির পাশদরজা খুলে ধরতেই, সবাই এক্কেবারে হুড়মুড় করে উঠে পড়তেই, নিজেও ধীরে সুস্থে চালকের পাশের নির্ধারিত সিটে উঠে বসে, এক্কেবারে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এরই মধ্যে ওপাশে লি খাঁ তার সিটে উঠে বসে, ভাবলেসহীন মুখ তুলে আমাও চোখে চোখ রেখে পিট পিট করে, পরবর্তী গন্তব্যের নির্দেশনা জানতে চাইতেই, বললাম দাও তো দেখি চাচা তোমার সেই দোভাষী টেলিফোন।
‘বাবা, বাবা আমরা ম্যাকে যাবো এখন।’ পেছনের সিট থেকে দুইপুত্রের যুগল ও অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এ দাবি ফের কর্ণগোচর হতেই বুঝলাম, লি খাঁর নির্বাক জিজ্ঞাসাটি পেছন থেকে তারাও বুজতে পেরেছে। “ঠেলার নাম বাবাজি” কী এ জন্যই বলে নাকি? পুত্ররাও তো দেখছি পেছন থেকেই বুজতে পেরেছে লি খাঁর দেহভাষা!
ঐ দোভাষী ফোন হস্থগত হতেই, তাতে পরবর্তী গন্তব্য যে আমাদের সেই আম্রিকান খাবারের দোকান তা লিখে ফেরত দিতেই, সেটি হাতে নিতে নিতে অনূদিত অংশে চোখ বুলিয়ে, তার স্বভাবসুলভ আবছা মুচকি হাসিতে লি খাঁ যা বোঝাল, তার অনুবাদ করলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, আমাদের এ গন্তব্যের কথা আগেই সে জানত।
সাথে সাথেই গাড়ি হুস করে রাস্তার পাশ থেকে মূল রাস্তায় উঠে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই ঐ কথাটা প্রমাণিতও হয়ে গেল। কারণ গাড়ির নাক তো অন্য কোনদিকে আর ঘোরাতে হয় নি। ফলে ধরেই নিতে হয় যে লি খাঁ বেশ সমজদার সোফার। যার কারনে আগে থেকেই সে গাড়ী ঐ মুখো করেই পার্ক করে রেখেছিল।
‘অভ্র, অভ্র, এই যে তোমার গ্লোভস।’ পেছনের মাঝের সিট থেকে দীপ্র হৈ চৈ করে উঠতেই ঘাড় ঘোরাতেই দেখি দুই হাতে অভ্রর হারিয়ে যাওয়া দস্তানাযুগল উপরে তুলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই অতি সঙ্গত আত্মপক্ষ সমর্থনের নিমিত্তে অভ্র নিজ দস্তানাবদ্ধ হাত উপরে তুলে ঘোষণা করল -“আমি এগুলিই পরব। ওগুলো ভাল না- ‘এই খোল, খোল ঐ গ্লোভস। না ধুয়ে ওগুলো পরে আছো হাতে! এতোক্ষণ কিছু বলিনি। ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত না ধুয়ে যদি খাবারে হাত দিচ্ছো, তবে বোঝাব মজা।’
মায়ের এই অতি ন্যায্য হুমকিরমুখে, বিরস বদনে অভ্র তাড়াতাড়ি গ্লোভস খুলে পাশে বসা হেলেনের হাতে দিতেই,ও দুটো হাতে হাতে নিতে নিতে, ‘কোথায় পেলে ওগুলো মনু’ হারিয়ে খুঁজে পাওয়া গ্লোভসগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলো দীপ্রকে হেলেন।
‘এই যে, এই সিটের পকেটে পেয়েছি।’ দীপ্রর এই উত্তরের পিঠে সাথেসাথেই ছুটে এলো তীর ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা থাকা এই অধমের পিঠ বরাবর।
“যেমন ছেলে, তেমন বাপ! সামান্য একটু অপেক্ষা করলেই পাওয়া যেত এগুলো, তা না করে হুট করে কিনে ফেলল ফালতু এই গ্লোভস। টাকা পকেটে থাকলে কামড়ায় তো। এই কতো দিয়ে কিনেছ এগুলো?”
তীর পিঠে ঢুকে গেলেও, সেটি যাতে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঢুকে না পরে সে চেষ্টায় দ্রুত আত্মরক্ষার ঢাল তোলার মতো, পেছনে ফিরে বললাম, শোন অপেক্ষার প্রহর তো অনন্ত কাল ব্যাপী মনে হয়। আর যদি এগুলো এখানে না পাওয়া যেত, তাহলেও তো আগামী দু তিন এই বেইজিংবাসের জন্য কিনতেই হতো গ্লোভস ওর জন্য। এই অচেনা শহরে কোথায় খুজতাম তখন গ্লোভস। ‘দাম কতো সেটা বল?’ মাত্র আশি তে কিনেছি এই কাশ্মীরী গ্লোভসগুলো, আত্মরক্ষার তাগিদে ইচ্ছে করেই আশির আগে মাত্র লাগিয়েছি যেমন তেমন উচ্চারণ করলাম না মুদ্রার নাম।
“এইগুলি কাশ্মীরী উল? কি যে বলছো না তুমি!” কিছুটা বিভ্রান্তি লাজুর কণ্ঠে! ভাবলাম বাঁচা গেল। চায়নিজ হকারের ঝোপ বুঝে কোপ মারার কারনে যে ধরা খেয়েছি, সেটি প্রকাশিত হয়ে অধমের বোকামিটি এ বেলা আর রাষ্ট্র হলো না! খোশ মেজাজে তাই বললাম -চায় না যদি এগ্রহের একদম উল্টা দিকের আমেরিকার আপেল বানাতে পারে, তাহলে তার নিজের সীমান্তবর্তী দেশ ভারতের কাশ্মীরীউল বানাতে পারবে না কেন?
“আপেলও ওরা বানায় নাকি? চাষ করে না? সত্যি বলছ? আরে দূর কি যে বলো না।“
বোঝা গেল রসিকতাটা মাঠে, না মাঠে না এই গাড়ির ভেতরে বেঘোরে মারা পড়তে যাচ্ছে। তবে না, ঠিক তখনি দীপ্র সপ্রতিভ হয়ে বলল ‘আরে মা বুঝতে পারছো না কেন? বাবা বলল আমেরিকার অ্যাপল ফোন তো সব চায়নিজরা বানায়। তাই কাশ্মীর উল ও বানাতে পারে’- ‘আরে দূর, আমি দেখেছি এই গ্লোভসগুলো ফালতু উলের। আর্টিফিশিয়াল।’ লাজুর মুখের একথা শেষ হওয়ার আগেই ঘ্যাচ করে গাড়ী থেমে যেতেই, বাইরে নজর যেতেই দেখি সামনে একটা বেশ বড় ঝলমলে দালানের আভাস। আশেপাশে দ্রুত চোখ ফেলতেই দেখা গেল আরো বেশকটা ঝলমলে স্থাপনা। যদিও লোকজন তেমন নাই এখানেও রাস্তায়।
“ঐ যে, ঐ যে ম্যাক” অভ্রর অঙ্‌ুলি নির্দেশিত পথে এসময় চোখ যেতেই দেখি, হ্যাঁ লি খাঁ গাড়ি থামিয়েছে একদম ম্যাকের সামনের সিড়িতেই। গাড়ী থেকে নেমে খান পাঁচ সাত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেই ঢুকে যেত পারব মঞ্জিল মঙুদে।
ইতোমধ্যে লি খাঁ নেমে, পেছনে গিয়ে পাশদরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে সবাই নামার আঞ্জাম করতেই, নিজেও ধীরেসুস্থে গাড়ি থেকে নামতে নামতে ভাবছি, খুব বেশী দূর তো না ওইখান থেকে এই জায়গাটা! এতক্ষণ নিজেরা নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত থাকায় বুঝতে পারিনি, ঠিক কোন রাস্তা ধরে লি খাঁ নিয়ে এল এইখানে এতো দ্রুত! দুই তিন বার ডান নাকি বাঁয়ে যে গাড়ি নাক ঘুরিয়েছিল তা টের পেয়েছি। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কথায় মশগুল থাকায় হদিশ করতে পারিনি পথের দিশা।
বাইরে দাঁড়িয়ে গোটা এলাকাটা চোখ জরিপ করতেই বুঝলাম আছি এখন একটা বেশ ঝলমলে শপিং ডিসট্রিক্টে। আশেপাশের বিল্ডিংগুলোর গায়ে নানান রঙয়ের বাতি জ্বলতে থাকায় এই ধোঁয়াশার মধ্যেও এলাকাটাকে উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। ঐ তো একটা মার্কেটের সামনে, ক্রেতা আকর্ষণের জন্য, রঙ্গিনবোর্ড কেটে কেটে, নানা রঙয়ের প্লাস্টিকের পাত, কাগজ, নানান সাইজের টব মিলিয়ে বানানো ছোট্ট বনের রেপ্লিকার গাছপালার মধ্যে ছোটছোট নানান রঙয়ের বৈদ্যুতিক বাতির ঝিকিমিকি কেরমাতিতে, নাচানাচি করছে চায়নিজ বান্দর বছরের দু তিনটা বানর। বেশ উৎসব উৎসব ভাব আছে এখানকার আবহাওয়ায়। ‘বাবা, বাবা আসো না।’ দীপ্রর ডাকে ওদের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে ওরা ম্যাকের দরজার সামনে। তোমরা ঢুকে পড়ো। আমি আসছি বলেই, লি খাঁর দিকে ফিরে ধীরে ধীরে হাসিমুখে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম সে খাবে কি না? খেলে চলুক সেও আমাদের সাথে, ভেতরে ।
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজামাল নজরুল ইসলাম জাতীয় কনফারেন্স : তরুণ গবেষকদের নতুন প্ল্যাটফর্ম
পরবর্তী নিবন্ধপ্রসঙ্গ : অর্থঋণ আদালত