বাঙ্গালকে নিষিদ্ধ নগরী দেখানো
পসরাতো দেখলাম গরম কাপড়ের, যার মধ্যে আছে অভ্রপ্রার্থিত নানান সাইজের হাত মোজাও। ওগুলোর মধ্যে কোনোটা না কোনোটা লেগেও যাবে হয়তো ওরা হাতে। কিন্তু তারপরও পুত্রের তুমুল উৎসাহের বিপরীতে কেমনে যেন মিইয়ে গেলাম মনে মনে যার প্রথম কারন হলো, এই বারান্দার মেঝের একটা অংশজুড়ে সাজিয়ে রাখা ওগুলোকে দেখে চায়নিজের মধ্যেও ঘোরতর চায়নিজ কোয়ালিটিরই মনে হল ওগুলোকে। এর চেয়ে ঢের ভাল জিনিষ পাওয়া যায় আমদের ঢাকা কলেজের সামনের ফুটপাতে বা গুলিস্তানের ফুটপাতে। এছাড়া দ্বিতীয় যে ব্যাপার মনে আসায় মিইয়ে গেছি তা হল, যেহেতু মিস রিনার বয়ানে এরই মধ্যে জেনে গেছি যে এলাকায় টাউট বাটপারের আনাগোনা আছে তাই পসরা সাজিয়ে বসে থাকা ঐ হকারের চেহারায় তাদেরই কোন মাসতুতো বা পিসতুতো ভাইয়ের চেহারা দেখতে পাচ্ছি। ফলে মনে হচ্ছে এ বেটা নিশ্চিত মওকা পেয়ে আমি বাঙ্গালকে হাইকোর্ট না দেখাতে পারলেও, অদেখা সেই নিষিদ্ধনগরী ভালই দেখাবে। কিন্তু করার তো কিছু নাই! কারণ এরই মধ্যে মহা উৎসাহে একে একে দু তিনটা হাতমোজা হাতে গলিয়ে পরখ করে সন্তুষ্ট না হতে পেরে বাকিগুলোকে যখন চোখজরীপ করছে অভ্র তখন সেই হকার পাশে রাখা বস্তার ভেতর থেকে একটা হাত মোজা বের করে ধরিয়ে দিয়েছে ওর হাতে কোন রকম চুং চাং ফুং ফাং করা ছাড়াই।
অন্যদিকে বাইরের তীব্র হাওয়ায় ভর করে আসা তুমুল হিমের কামোট কামড় থেকে বাঁচার জন্য তড়িঘড়ি করে দলের সবাই যে একটু আগেই এই রাস্তার পাশের ইটালিয়ান বা ছাপড়া মার্কা রেস্টুরেন্টের পেটের ভেতরের ঢুকে গিয়েছিল ওমের আশায়, বেরিয়ে এসেছে ওরা আমাদের খোঁজে বারন্দায়।
“কি ব্যাপার ভেতরে না ঢুকে তোমরা কি করছ এখানে? আর অভ্র তুমি ওটা কি নিয়েছ হাতে?”
“আমার গ্লোভস লাগবে মা” এইমাত্র হাতে পাওয়ে গ্লোভস গুলো হাতে পরতে পরতে কোন দিকে না তাকিয়েই মায়ের প্রশ্নের জবাব দিল অভ্র ।
“এই এই তুমি আবার কি নিতে যাচ্ছ? কিচ্ছু নেবে না এখান থেকে! এগুলো তো খুব একটা ভাল কিছু মনে হচ্ছে না” মায়ের এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দীপ্র ততোক্ষণে মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা পসরা থেকে একটা মাংকিক্যাপ জাতীয় কান্টুপি মাথায় চড়ানো উপক্রম করতেই-“এই বললাম না কিছু কেনা যাবে না এখান থেকে, তুমি আবার ওটা মাথায় দিচ্ছ কেন? ময়লা এই টুপি। না ধুয়ে এসব গায়ে দেয়া যায় না কি?“ বলেই দীপ্রর হাত থেকে অনেকটা ছোঁ মেরে টুপিটা নিয়ে, মেঝেতে মেলে রাখা ঐ পসরার মধ্যে লাজু ছুড়ে দিতেই, হকারটির কপালে বিরক্তির তীক্ষ্ণ ভাঁজের দেখা মিলতেই ভাবলাম, আহ! এ ঘটনা যদি ঘটতো ঢাকার কোন ফুটপাতে, তবে নিশ্চিত সেই হকার এক্কেবারে তেড়েমেড়ে উঠত এতক্ষণে। সাথে অবশ্যই যোগ দিত আশেপাশের যাবতীয় হকারেরা। মোট কথা সব মিলিয়ে একটা খুবই বেমক্কা পরিস্থিতির উদ্ভব হতো! এখানকার হকারেরাও এরকম কি না কে জানে? কিন্তু ঘটনা যাই হউক কাজটি ঠিক হয়নি মোটেই। সমস্যা হচ্ছে সে কথা মুখ ফুটে বলার মতোও তো ঘাড়ে আমার দুটো মাথা নেই । তারপরও কিছুটা বিরক্ত হয়েই সবাইকে তাড়া দিলাম যেন রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে যায় ফের। সাথে এও বললাম যে এ জিনিষগুলো অবশ্যই ভাল নয়। কিন্তু উপায় নেই অভ্রর জন্য এক জোড়া হাতমোজা তো কিনতেই হবে, আর তা কিনেই আসছি আমরাও ভেতরে।
“বাবা, বাবা, এটা ফিট হয়েছে আমার হাতে “একজোড়া রংচঙ্গা কৃত্রিম উলের হাতমোজা হাতে চড়িয়ে অভ্র ঘোষণা করতেই একবার ভাবলাম বলি যে, না এই রকম ঠাণ্ডায় এই মোজা কোন কাজই দেবে না। একেতে কৃত্রিম উল, এ দেখতে যতই চটকদার আর গরম ভাবের হউক না কেন কাজের ব্যাপারে এ আসলে লবডঙ্কা। তার উপর উলে বোনা এই মোজায় আছে অসংখ্য ফাঁক ফোঁকর, যেই ফাঁক দিয়ে অনায়াসে এখানকার হিমকামোট বসিয়ে দিতে পারবে দাঁত ওর কচি হাতে।
কিন্তু না পুত্রকে আর কিছু না বলে, কপাল কুঁচকে বসে থাকা সেই চায়নিজ হকারকে প্রথমে ইংরেজি বলতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে মত পাল্টে খাঁটি বাংলায় বললাম, ভাতিজা চামড়ার দস্তানা তো তুমি দিতে পারবে না জানি, আবার এই উলের মোজাতেও তো কোন কাজ হবে না। পারলে একটা রেঙিনের মোজা দেখাও না, ওর হাতের মাপের। বাংলায় বলছি , কারন এ ক’দিনেই তো বুঝে গেছি এর কাছে যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্ন, চায়নিজ বলতে না পারলে আর যে ভাষাতেই কথা বলি না কেন, সবই সমান এর কাছে।
দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকা চায়না হকার আমার কথায় আড়মোড়া দিয়ে বসা থেকে উঠে , সামনে মেঝেতে রেখে দেয়া তার বড় ক্যালকুলেটরটি হাতে নিয়ে, ক্যালকুলেটরের বোতাম টিপে, কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওইটির পর্দার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই হায়রে, আমি কই কী আর আমার সারিন্দা বাজায় কী, মনের ভেতর গুঞ্জরন তুলে ক্যালকুলেটরের পর্দায় চোখ যেতেই দেখছি ওখানে চায়নিজ না ইংরেজি অংকে লেখা আছে ৮০!
আরে বলে কি ব্যাটা ত্যাঁদড়! বাংলা টাকাতেই তো এর দাম আশি হওয়া উচিৎ না, আর এ কিনা বলছে এর দাম আশি রেন মেন বি?
সাতপাঁচ ভেবে, ঐ যন্ত্র হাতে নিয়ে ওটাতে কতো লিখবো? কতো লিখলে ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতে সাহস করে ২৫ লিখে তার হাতে দিতেই , ফের সে কপাল কুঁচকে, চুং চাং করে কি যে বলল তা তো বুঝিই নি বলাই বাহুল্য, কিন্তু তার মুখের ভ্যাংচানোভাবে বুঝলাম যে সে বলছে আমি একটা মহাগাড়ল। এই মহার্ঘ হাত মোজা কেনা আমার কম্ম না।
অতএব দ্রুত সেই পঁচিশ কে ৪০ করে দিয়ে, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই, ছোঁ মেরে হাত থেকে ক্যালকুলেটরটা নিয়ে মুখে চুং চাং ফুং ফাং করতে করতে সংখ্যাটিকে ফের ৮০ বানিয়ে চোখের সামনে ধরে দেখিয়ে, ঘুরে নিজ আসনে গিয়ে বসার উপক্রম করতেই বুঝলাম বলছে ব্যাটা যে, আমার সাথে দরাদরির করার তার কোন ইচ্ছা বা সময় কোনটাই নাই। দাম তার এক। নিলে আমাকে সেই দামেই নিতে হবে। আর এ হল যাকে বলে এক্কেবারে খাঁটি কাশ্মীর উলের দস্তানা। আমি যে দাম বলেছি তাতে চায়নিজ জিনিষও পাওয়া যাবে না! অতএব আমি যেন তার সময় নষ্ট না করে রাস্তা মাপি!
ব্যাটার দেহভঙ্গিতে এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ব্যাপারটা এমনই প্রকট হয়ে উঠল যে তাতে যাকে বলে চান্দি এক্কেবারে গরম হয়ে, অপমানে রাগে গা রি রি করে উঠল। ফলে, কোন কথা না বলে পাশব্যাগ থেকে মানিব্যাগ বের করে আশি রেন মেন বি ওর হাতে গছিয়ে দিতে দিতে বললাম, নে শালা। না তোকে দাম দিচ্ছি না। পুত্রের জন্য গচ্ছা দিচ্ছি এ টাকা তোরে। ধরে নিচ্ছি যে পড়েছি তোর মতো এক পকেটমারের পাল্লায়, তাই খোয়া গেছে ঐ টাকা। অতপর অভ্রর হাত ধরে গটগট করে ঢুকে গেলাম সেই রেস্টুরেন্টের ভেতর।
নাহ, রেস্টুরেন্ট টা আকারে বেশ বড়সড় হলেও, এর চেয়ার টেবিলগুলোর দেখছি এক্কেবারে ঠাই নাই ঠাই নাই অবস্থা। সবগুলো টেবিলেরই চেয়ার আর টুলগুলো সম্ভবত আগে থেকেই ভরা ছিল। অতএব কোথাও বসার জায়গা না পেয়ে, লাজু হেলেন আর দীপ্র দাঁড়িয়ে আছে ঢোকার দরজার পাশেই দেয়ালের গা ঘেঁষে।
ওদের পাশে দাঁড়িয়ে, রেস্টুরেন্টের অন্দরমহলের ফের করা তড়িৎ চোখজরিপে হৃদয়ঙ্গম করলাম যে, এখানকার বাইরেটা জনশূন্যতায় খাঁ খাঁ করলেও, ভেতরের অবস্থা এক্কেবারে যাকে বলে লোকজনে ভরপুর, টইটম্বুর আর সরগরম। চেয়ারে বা টুলে বসে টেবিলের দখল নেওয়া কেউ কেউ চুং চাং ফুং ফাং করতে করতে সামনে রাখা বড় বড় একেকটা জামবাটি থেকে কাঠি দিয়ে তুলে তুলে সুরুত সুরত করে খাচ্ছে নুডুলস। কেউবা চুমুক দিচ্ছে চা নাকি কফির কাপে। আর কেউবা বসে বসে মারছে গুলতানি। বাইরের ধোঁয়াশার মতোই এর ভেতরটাও ধোঁয়াশায় ঢাকা, যার মধ্যে টিম টিম করে ঘরটির তিন কোনায় জ্বলছে তিনটা বাল্ব। আর যে দরজা দিয়ে ঢুকলাম, তার উল্টা দিকটায় বুক সমান উঁচু একটা কাউন্টারের সামনেও অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে দেখছি। যাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে পেয়ে গেছে হাতে, হয় নুডুলসের বাটি, না হয় খাবার ভরা ট্রে। বুঝলাম কিছু খেতে হলে ওখান থেকেই গিয়ে আনতে হবে। কিন্তু অর্ডার করবো কোথায়?
যদিও জানি না এখনাকার অর্ডার করার তরিকা, তারপরও সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম যে কেউ কিছু খাবে কি না? উত্তরে সকলের নীরবতায়, বুঝে গেলাম পছন্দ হয়নি কারোই এই রেস্টুরেন্ট।
“আরে আমার ব্যাগে যে কেক বিস্কিট আছে ওগুলোই খাই না কেন। “বলেই এসময় লাজু ব্যাগ খোলার উপক্রম করতেই বললাম যে, না ওটা যেন ভুলেও না করে এখানে। এই রেস্টুরেন্ট ঢুকে আমরা এখানকার খাবার না খেয়ে, বাইরের খাবার খাচ্ছি দেখলে যদি এরা আমাদের বের করে দেয় এখান থেকে ! তাহলে তো বাইরে দাঁড়িয়ে লি খাঁর অপেক্ষায় হিমে জমে পাথর হয়ে যেতে হবে! “ড্রাইভার আসবে কখন?”
হেলেনের এই জিজ্ঞাসায় নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে অনিশ্চিতভাবে বললাম আসবে হয়তো তাড়াতাড়িই । কারন মিস রিনা তো বলেছেই গোটা এলাকাটা লি খাঁ র খুব ভাল চেনা। তদুপরি এখনতো রিনা বেগম নির্দেশিত জায়গাতেই আছি আমরা। অতএব লি খাঁকে তো, আমাদের খুঁজে বের করার জন্য এলোপাথারি ঘুরে বেড়াতে হবে না। শুধু ব্যাপার হচ্ছে এ মুহূর্তে আছে সে কত দূরে? আর কোথায়ই বা গাড়ী পার্ক করে তাকে হেঁটে আসতে হবে এ পর্যন্ত। এসবেরই উপর নিভর্র করছে কতক্ষণ হবে আমাদের অপেক্ষার প্রহর। সান্তনার ব্যাপার হল, এখানে শুধু মাথার উপর ছাদই পাই নি আমরা। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার জন্য পেয়েছি একটা ওম ওম গরম রুমও। এই হিম তেপান্তরে পথ হারিয়ে এ যে পেয়েছি সেটাই তো বিরাট পাওয়া। আচ্ছা, ঠিক আছে তোমার কেউ যখন কিছুই খাবে না, আমিই তবে একটা কফি আনি গিয়ে। এতে অন্তত এখানে আশ্রয় নেয়াটা হালাল হবে। অতএব কফি নেয়ার মানসে, সেই কাউন্টারের দিকে নজর দিয়ে সেটিকে ভাল করে জরীপ করে ফের বুঝতে চেষ্টা করলাম যে, আসলে নিয়ম টা কি এখানকার? খাবার নেবার লাইনে দাঁড়ানোর আগেই কি কোথাও দাম মিটিয়ে ওখান থেকে স্লিপ নিয়ে তারপর দাঁড়াতে হবে লাইনে? না কি ওখানেই সরাসরি লাইনে দাঁড়িয়ে অর্ডার করে খাবারের দাম মিটিয়ে তারপর নিতে হবে খাবার?
নাহ বুঝলাম না কিছুই। আবার কাউকে যে জিজ্ঞেস করে এখানকার নিয়মটা বুঝে নিতে পারি তেমন কোন মুখও নজরে এলো না। অতএব যা আছে কপালে দাঁড়াই গিয়ে ঐ লাইনে। দেখা যাক তারপর কি ঘটে। ভেবে এগিয়ে গেলাম
নাহ, লাইনটা এখন আর তেমন বড় না। মাত্র জনা তিনেক লোক আছে সামনে। পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম বেশ দ্রুতই চলে এলো আমার পালা। বললাম ঝটপট তাকে যে কফি খেতে চাই। কত দিতে হবে? হ্যাঁ বাংলাতেই বললাম, আর মানি ব্যাগ বের করে দেখালাম। মনে আশা, আর কিছু না হোক কফি কথাটা তো সে বুঝবে। আর মানি ব্যাগ দেখে নিশ্চয় সে বুঝবে যে কফির দাম দিতে চাই। কিন্তু হা হতোম্মি, আমার আবেদনের জবাবে দয়াপরবশ হয়ে শুধু একবার এদিকে তাকিয়ে, কথা বলা শুরু করেছে সে এখন আমার পেছনে এসে দাঁড়ানো নতুন আরেক চায়নাম্যান খরিদ্দারের দিকে।
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক