নারীর করতলাবদ্ধ আধেক আকাশ
আচ্ছা চায়নিজদের কি কোন বেগম রোকেয়া আছেন, যিনি হাজার হাজার বছর ধরে পা বেঁধে রাখা মেয়েদের পা খুলে দিতে চেয়েছেন? নাহ জানি না এ ব্যাপারে কিছু। তবে থাকলে নিশ্চয় এই যাদুঘরে তার দেখা মিলতো। আসলে সব জাতির কপালে জোটে না একজন বেগম রোকেয়া। এদিক দিয়ে তো এগিয়ে আছি ঢের আমরা চায়নিজদের থেকে।
অবশ্যই এছাড়াও যে আমরা এগিয়ে আছি চায়নিজদের থেকে নারীর মুক্তি আর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে এখনও, সেটাই তো মনে হচ্ছে আপাত দৃষ্টিতে। হ্যাঁ কর্মক্ষেত্রে শুধু চায়না কেন গোটা মঙ্গোলিয়ান জনগোষ্ঠীতে নারীদের অংশগ্রহণ আমাদের চেয়ে অনেক আগে থেকেই বেশী থাকলেও তাদের মধ্যে নারীনেত্রী তো তেমন দেখি না। আজ পর্যন্ত চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টির কোন মহিলা নেত্রির নামে শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না। এখানেও, এই যে লং মার্চ, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নানা ছবি, ভাস্কর্য দেখতে দেখতে এগুচ্ছি তাতেওতো নারীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
মাও সে তুং ই সম্ভবত নারীদের সমানাধিকারের ব্যাপারটি উচ্চকিত ভাবে বলেছিলেন চায়নায় প্রথম । মনে পড়ল বিদ্রোহী কবি যেমন বলেছিলেন “অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর” তেমনি মাওয়ের বিখ্যাত উক্তি ছিল “নারীরা তুলে ধরে আছে হাতে অর্ধেক আকাশ”!
আচ্ছা সমাজতান্ত্রিক মাওয়ের এ কেমন ও অবৈজ্ঞানিক কথা? অনাদিকাল ধরে মানুষ নানাভাবে আকাশকে একটা ছাদজাতীয় কিছুই বিশ্বাস করে আসছে। কিন্তু যাদেরই চিন্তা ভাবনা, বিজ্ঞান দিয়ে সামান্যতমও প্রভাবিত, তারা জানেন আকাশ বলে কিছুই নেই আসলে। যা দেখি আমরা মাথার উপরে, তা এক বিশাল শূন্যতারই বিভ্রম! এ কথা তো মাও নিশ্চয় ভালভাবেই জানতেন, সে জায়গায় তিনি কেন ঐ কথা বলতেন।
তখনি মনে হল আরে কিছুক্ষণ আগেই তো গ্রেটহলে, মাওয়ের কবিতাকে আশ্রয় করে আঁকা এক বিশালাকার চিত্রকর্ম দেখে আসলাম। অতএব নিশ্চিত বলা যায় কাব্য করেই মাও ঐ কথা বলেছিলেন। আচ্ছা নজরুল যে তার অনেক আগেই একই কথা বলেছিলেন, তা কি জানতেন নাকি মাও? কবিগুরু চায়না গিয়েছিলেন। তাঁর সাথে চায়নার কবি শিল্পী সাহিত্যকদের গভীর যোগাযোগও ছিল, অতএব তাঁর কবিতার সাথে, সাহিত্যকর্মের সাথে মাওয়ের পরিচয় থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু নজরুল চীনে গিয়েছেন বা তাঁর সাথে চায়নার কবিসাহিত্যিকদের কোনরকম যোগাযোগ ছিল বলে তো শুনিনি। যদি থাকতো, তাহলে না হয় ধরা যেত, মাও নজরুলের সেই কবিতা পড়ে, সেটির ভাব মেরে দিয়েই বলেছিলেন ঐ চায়নিজ কথাটা, বাংলায় যেটির কাব্যিক ভাবানুবাদ দাঁড়ায়, নারীর করতলাবদ্ধ আধেক আকাশ!
পাবলো পিকাসো নাকি একবার বলেছিলেন যে ভাল শিল্পীরা নকল করলেও, প্রতিভাবান শিল্পীরা চুরিতে সিদ্ধহস্ত । অবশ্য এ ব্যাপারটা তেমন না হয়ে, হতে পারে ইংরেজি সেই প্রবাদের মতো যা বলে যে জ্ঞানীদের চিন্তা একমুখি হয়। যদিও দুর্মুখেরা এও বলে থাকে যে বোকাদের ভিন্ন চিন্তা করার ক্ষমতাই নাই! তবে কাজী নজরুল আর মাও এই দুজনকে বোকা ভাবার মতো অপরিণামদর্শী বোকা বা বেকুব তো আমি নই ।
সে যাক নারীদের হাতে আকাশের অর্ধেকটা দেখা কবি মাও, নারীমুক্তির জন্য প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হলো , চায়নার বিবাহ সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করা। যে আইনে একদিকে যেমন ছেলে এবং মেয়েদের বিয়ের বয়স বেঁধে দেয়া হয়েছিল, তেমনি বিয়ে রেজিস্ট্রি করার বাধ্যবাধকতাও করা হয়েছিল। এর আগে চায়নার মেয়েদের বিয়ে তো হতো আমাদের দেশেরই মতো “উঠ ছেরি তোর বিয়া” মার্কা কায়দায়। এছাড়া একবার বিয়ে হয়ে গেলে তা যতই অসহনীয় পর্যায়েরই হউক না কেন কোন চায়নাকন্যার কাছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আত্মহত্যাই ছিল তার একমাত্র পথ। মানে নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদ চাওয়ার মতো অধিকার চায়নিজ সমাজে স্বীকৃত ছিল না আগে, যা ছিল পুরুষের।
“বাবা, বাবা আমি একটু টয়লেটে যেতে চাই“ একমনে হাঁটতে হাঁটতে দেয়াল ঝোলানো লং মার্চ আর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নানান ছবি দেখতে দেখতে, যে নারী বিষয়ক ভাবনায় বুঁদ হয়েছিলাম তাতে ছেদ টানল অভ্র। বরাবরের মতো মনে হাসলাম ওর এই কথায়। কি এক অজানা কারণে ও এভাবেই, তার দাবি বা ইচ্ছা প্রকাশ করে। কদাচিৎ ওকে সরাসরি বলতে শুনেছি যে, বাবা, বা মা আমার এটা লাগবে। বা আমি এটা নেব কিম্বা খাব। বেশীর ভাগ সময়েই কেমন যেন ইংরেজিতে যাকে বলে প্যাসিভ ভাবে বলা, বাংলায় যে ওটাকে কি বলব মনে পড়ছে না। আচ্ছা ঘুরিয়ে বলা, বলা চলে কি একে? মনে মনে এ কথা ভাবলেও মুখে বললাম – ওহ তাই না কি? ঠিক আছে বাবা। এখানে তো কোন টয়লেট আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। যেতে হবে বাইরে, মানে ঐ যে ঢোকার মুখের হল ঘরে। চল নিয়ে যাই তোমাকে। এদিকে অভ্র মনে করিয়ে দেয়ায় মনে হল ডাকছে প্রকৃতি আমাকেও। অতএব এখন ঐ প্রাকৃতিক ডাকের ঘর থেকে একবার ঘুরে আসলে খারাপ হয় না।
অভ্রকে নিয়ে, অদূরে ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো পরিবারের বাকীদের কাছে গিয়ে একটু গলা উঁচিয়ে সবাইকে জানালাম যে যাচ্ছি প্রাকৃতিক ঘরে অভ্রকে নিয়ে। আর কেউ যাবে কি না সঙ্গে। গেলে যেতে পারে
“টয়লেট কোথায় এই ঘরে” প্রশ্ন লাজুর
নাহ এ ঘরে তো নিশ্চয়ই টয়লেট নাই। যাবো সেই ঢোকার মুখের হলে ঘরে। ওখানেই টয়লেট আছে।
“মানে ওখানে গিয়ে আবার ফিরে আসবে? তার দরকার কি? আর কতোক্ষণ থাকবে এখানে? একবারেই বেরিয়ে যাই না কেন? তোমার না আর কোথায় কোথায় যাওয়ার প্লান আছে আজ। আবার ওদের তো খাওয়ারও সময় হয়েছে।” একটু আগে নারীস্বাধীনতা আর নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন থেকে এই মুহূর্তে নারী মুখনিসৃত এই প্রশ্ন আর প্রশ্নসংলগ্ন যুক্তি অস্বীকার করলে তো, করা হয় নিজের সাথেই দ্বিচারিতা। বড় কথা হচ্ছে এ নারী যে সে কোন সামান্য নারী নয় যে তাকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। এ তো হল সাক্ষাৎ স্ত্রী আমার! যার কাছে থেকেই নিরন্তর ক্ষমতা প্রার্থনা করে নিজেকেই হতে হয় ক্ষমতায়িত। অতএব একটু আগে জারী হওয়া অবশ্য পালনিয় বাণী সব অগ্রাহ্য করি কি করে?
দ্রুত দুই হাত তুলে নিজের সম্মতি জানিয়ে বললাম। তাই তো ঠিকই বলেছ। একবারেই বেরিয়ে যাওয়াটাই ভাল। বলেই অভ্রকেই জিজ্ঞেস করলাম, যে ওর এই প্রাকৃতিক ডাকটা কতোটা জরুরী। মানে এক্ষুণি যাওয়া লাগবে কি না?
ওর উত্তরে বোঝা গেল যে নাহ, এক্ষুণি সাইরেন বাজিয়ে ঐদিকে দৌড় শুরুর করার মতো জরুরী ব্যাপার না ওর । অতএব ভাবলাম, যে দেয়ালের ছবিগুলো দেখছিলাম এতোক্ষণ, সে দেয়ালের শেষ ক’টা ছবি দেখেই বেরুই সবাই একসাথে ।
যেই ভাবা সেই কাজ। সবাইকে একাট্টা করে সেই দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেয়ালমুখি হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাকী ছবিগুলো দেখতে একদম শেষ মাথায় এসে একটা ভিন্ন ধরনের ছবি দেখে থমকে দাঁড়াতে হল।
হ্যাঁ এই ছবিটা আর সব ছবির মতো লং মার্চ বা সাংষ্কৃতিক বিপ্লবের ইতিহাসের ছবি নয়। এছাড়া এটা কোন চায়নিজ ছবিও নয় শুধু। মানে এই ছবির বিষয় বস্তু হিসাবে যারা আছেন তারা সবাই চায়নিজ নন । ছবিটিতে চোখ বুলিয়ে প্রথমেই যাকেই প্রথচ চেনা চেনা মনে হল, তিনি তো শুধু চায়নারই নয় এ গ্রহের তাবৎ মানুষদের হাজার বছরের ভুতুড়ে চিন্তার মোড়, ভীষণ এক ঝটকায় ঘুরিয়ে দিয়ে ইতিহাস নির্মাণ করা লোক!
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক