বলে কী, সৌদিরা তাহলে এতোই গরিব! আজ এখনি না শুধু সেই প্রথম এসে, আমাদের বিজনেসপ্লান পড়তে গিয়ে, সংখ্যাটির সাথে প্রথম জকন মুখোমুখি হয়েছিলাম তখনও যেমন মনে হয়েছিল, মনে হচ্ছে ফের এখনো আবার যখন লিখছি নিজেই বিজনেস প্লান। আর এর মাঝামাঝি সময়ে একদম সচেতন ভাবেই এই সংখ্যাটির ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যাপারটির অন্তর্নিহিত অর্থ বা সত্য বোঝার চেষ্টা করেছি।
নাহ, অবশ্যই মতিভ্রম হয়নি আমার। অতএব কোনই কারণ নাই আমাকে ভুল বোঝার নাই। সৌদিদের এই দারিদ্র্য অবশ্যই আমাদের দেশের ভূমিহীন কৃষক হরমুজ আলী বা অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাওয়া রহিমন বেওয়ার দারিদ্র্য নয়। এই দারিদ্র্য হল বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট বা জেফ বেজোসের তুলনায় বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটি যতোটা দরিদ্র, ঐ রকম একটা ব্যাপার।
হ্যাঁ ২০০৯ সালে যখন আমার দেশের জিডিপি পার ক্যাপিটা মানে মাথা পিছু আয় হাজার ডলারের নিচে মাত্র ৯৮০ ডলার, সেক্ষেত্রে সৌদিদের মাথাপিছু আয় হলো বাংলাদেশের প্রায় ২৯ গুনের কাছাকাছি মানে ২৮,৫০০ ডলার! কিন্তু তারপরও, দুই দিনের বৈরাগী আমি যে ছিলাম সিঙ্গাপুরে গতবছর, তাইতো ভাতেরে অন্ন ঠেকছে, কারণ তাদের মাথা পিছু আয় যে সৌদিদের এক্কেবারে দ্বিগুণ মানে ঝাড়া ৫৭০০০ ডলার! এটা একটা কথা হইল, তেলের মতো দামি কোন রকম প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই সিঙ্গাপুরিয়ানরা দেখছি সৌদিদের তুলনায় দ্বিগুণ ধনী?
তবে শুধু সংখ্যাভিত্তিক ভাসাভাসা এরকম তুলনা করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছালে, ভুল হবার সম্ভবনা স্প্রুচুর। কারণ তুলনাও তো করতে হয় কমলার সাথে কমলার। কমলা সাথে কাঁঠালের তুলনা করে কোন বোকা? মনে হল এই কথাটা যেহেতু জানি আরেকটি সত্য তা হল–
যেখানে সিংগাপুরের এই সব রাষ্ট্রীয় ডাটা, তথ্য যেখানে অত্যন্ত পরিষ্কার ও সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত, তার বিপরীতে সৌদির এইসব তথ্য, ডাটা তো খুবই গোলমেলে, ঝাপসা এবং গোপনীয়। জানি যে সৌদি অর্থনীতির মূল খাত হল দুটি, যার প্রথমটি হল তেল বেচাবিক্রির আয়, দ্বিতীয়ত হজ্ব ওমরা ঘিরে যে আয় হয় তা। কিন্তু প্রথম খাত যে তৈল, সেটিরই তো জানা যায় ততোটাই, যতোটা জানানোর হয় মর্জি বাদশাহ নামদারের। বাকী সব তো শুধুই ধোঁয়াশা না, একদম ব্ল্যাকহোল! তেল সেক্টরের সেই ব্ল্যাকহোল বিষয়ে নিয়ে নানান সৌদি ও সৌদিতে বহু বছর থাকার সৌদি তরিকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বিদেশীদের মুখ থেকে ফিসফিসিয়ে আসা যে খবরগুলো পেয়েছি তা হল নিম্নরূপ :
প্রথমত প্রতি বছর তেল বিক্রি করে সৌদির কতো আয় হয় তা অবশ্যই গোপনীয়। তবে যে টাকাই আসুক না কেন তেল থেকে, সেটির ভাগ হয় তিনটা।
প্রথম ভাগ যায় রাজা ও রাজ পরিবারের জন্য। দ্বিতীয় ভাগ যায় রাজ পরিবারের একান্ত পোষ্য শরিয়াহ বোর্ডের করকমলে। তারপর তৃতীয় ভাগ যায় রাজ্য পরিচালনার কাজে। ফলে তা থেকে চুইয়ে পরে যায় যা, ওটুকুই আছে সাধারণ সৌদিদের কপালে। যদিও তারা তিন ভাগের কথা বলেছেন, কিন্তু সেই তিন যে সমান না তা তাঁরা নিশ্চিত করলেও, কোন ভাগ কতো বড় এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করার পর, একবাক্যে সবাই নিজেদের অজ্ঞতা স্বীকার করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিন ভাগ হয় বলেছি, কিন্তু সে তিন ভাগ যে সমান তা তো বলিনি! তা বলার কারণও নাই। কেউ কেউ আবার আরেকটু এগিয়ে বলেছেন, রাজার ভাগ কতো বড় তা জানি না ঠিক, তবে এটা শুনেছি যে, রাজ পরিবারে কোন প্রিন্স বা প্রিন্সেস জন্মালে সাথে সাথেই তার নামে একটা একাউন্ট খোলা হয় নাকি কোন এক অজানা ব্যাংকে। তারপর প্রতিদিন ঐ নবজাতক প্রিন্স বা প্রিন্সেসের নামে ১৮ হাজার করে মুদ্রা জমা হতে থাকে। ঐ মুদ্রার জাত হিসেবে তাদের কারো কারো মতো হল ওটা রিয়াল। বাকীদের মত হল রাজা তো পছন্দ করলে রাজকীয় মুদ্রাই পছন্দ করবেন, অতএব ওটা রিয়াল না ডলার! তো এভাবে প্রতিদিন অষ্টাদশ সহস্র ডলার / রিয়াল ঐ একাউন্টে জমা হতে থাকে ততদিন পর্যন্ত যতদিন না ঐ প্রিন্স/ প্রিন্সেসের বয়স যত দিন না ১৮ বছর, হচ্ছে। যেদিনই প্রিন্স বা প্রিন্সেস ১৮ তে পা দেয়, সেদিনই নাকি ঐ জন্মদিনের উপহার হিসাবে একসাথে ১৮ বছর ধরে সঞ্চিত ঐ ডলার / রিয়াল তুলে দেয়া হয়।
এই কথা শোনার পর স্বভাবতই ভির্মি খেয়ে যখন বলেছিলাম, বল কী? একসাথে অতো টাকা পেয়ে কী করে তারা? তাতে ভ্রু কুঁচকে উত্তরদাতাদের কাছ থেকে যা উত্তরে পেয়েছি তাতে ভ্রু কুঁচকানোর মানে দাঁড়ায়– আরে গাড়লের মতো এ কি প্রশ্ন তোমার? কিন্তু শব্দে বাক্যে দেয়া উত্তর ছিল তাদের, একে তো তারা প্রিন্স প্রিন্সেস। তদুপরি বয়স হয়েছে তাদের আঠারো। যা হল নাকি ব্যক্তিস্বাধীনতার বয়স। এরকম প্রশ্ন করা তো তাদের ব্যাক্তিস্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপের সামিল! শুনে ভেবেছিলাম বলি, এখানেতো ব্যক্তিস্বাধীনতা বাকস্বাধীনতা এক্কেবারে লৌহনির্মিত সিন্দুকে বন্দি, বলছিলাম তাই, আর কি। তবে সাথে সাথেই যখন মনে এরছিল, রাজপরিবার তেলের উপর পুরো দখলদারিত্ব কায়েম না করে বিরাট সহনশীলতার পরিচয় দিলেও, প্রজাদের ব্যাপারে ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতার মতো পাশ্চাত্য বিজাতীয় জিনিষ তো একদম হারাম। তবে সেই আইন তো রাজপরিবারের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাই ঐ কথা বলে নিজেকে ফের গাড়ল প্রমাণ না করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নাবালক অবস্থায় যদি প্রতিদিন ১৮ হাজার পায় রিয়াল বা ডলার তা যাই হোক, সাবালক প্রিন্স প্রিন্সেসরা পায় কতো তাহলে? “শোন সাবালকের সব খবর রাখতে হয় না। তাই ওটা জানি না। ওটা জানার চেষ্টাও করা তো প্রাইভেসি লঙ্ঘন। তদপুরি এ হল রাজকীয় প্রাইভেসি!” ওহ তাইতো, তাই তো ঠিক বলেছ। নির্দ্বিধায় বক্তার সাথে একমত হয়ে, প্রশ্ন করেছিলাম আচ্ছা এরকম প্রিন্স প্রিন্সেস আছেন ক’জন সৌদিতে?
তাতে বেশীর সৌদির উত্তর ছিল, হবে হাজার বিশেক। তবে বেশ বুদ্ধিমান একজন আবার আমার মতলব ধরে ফেলে, বলেছিল– “ওহ বুঝেছি, তুমি ২০ হাজার প্রিন্স প্রিন্সেস ধরে, তাতে ঐ ভাগে কতো ডলার পড়ে ওটার হিসাব একটা হিসাব দাঁড় করাতে চাইছো, ব্যাপার অতো সোজা না। কারণ সকল প্রিন্স জন্মগতভাবে প্রিন্স হলেও, সকল প্রিন্সেসের প্রিন্সেস হওয়াটা কিন্তু জন্মগত না। ওই ভাগে বিবাহগত প্রিন্সেসরাও আছেন।” বিবাহগত প্রিন্সেস মানে?
“শোন সৌদি রাজপরিবারের মেয়েদের মানে প্রিন্সেসদের, প্রিন্স ভিন্ন অন্য কাউকে বিবাহ করার কোন নিয়ম নাই। তারপরও তারা যদি তা করেও ফেলে ঐরকম কিছু, তবে যে তাকে বিয়ে করলো তার সৌদিতে থাকার উপায় নাই। সৌদির বাইরে গিয়েও যে সে বাঁচতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। অবশ্য প্রিন্সেসও যে বেঁচে থাকবেন তারও নিশ্চয়তা নাই। বিষয়টা রাজ পরিবারের সম্মানের। তবে প্রিন্সরা এ ব্যাপারে বেশ ভাল স্বাধীনতা ভোগ করে। তারা যে কোন মেয়ে, হউক সে সৌদি বা বিদেশী তাদের বিয়ে করতে পারে । আর ওরকম বিয়ে হয়ে গেলেই সেই কন্যা রাতারাতি হয়ে যান প্রিন্সেস!”
তার মানে কি বিবাহগত প্রিন্সেস হওয়ার পর থেকে তাদের কপালেও কি বর্ষিত হতে থাকে নাকি তেলের হিস্যা? তা সে হিসাব টা কী রকম?
“হুম, বৈবাহিক প্রিন্সেসরা বিবাহিত অবস্থা কি কতোটা পায়, শুনিনি তা। তবে ডিভোর্স হয়ে গেলে কী পায় তা শুনেছি?”
তাইতো, তাইতো । প্রিন্স তো প্রিন্স !সে কেন এক প্রিন্সেসে সন্তুষ্ট থাকবে। ডিভোর্স তো সে দেবেই!
“এই তো তুমি বুঝতে শুরু করেছ। প্রিন্স ঝোঁকের মাথায় কাউকে বিয়ে করে প্রিন্সসের মর্যাদায় তুলে ফেললেও, অচিরেই তার সেই ঝোঁক কেটে যায় যখন, কিম্বা যখন অন্য কাউকে তাঁর মনে ধরে, তখন নির্দ্বিধায় আগেরজনকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। তবে এখানে রাজকীয় দয়ার একটা ব্যাপার আছে। তা হল, ডিভোর্স দেয়ার পর কিন্তু ঐ বৈবাহিক প্রিন্সেস, প্রিন্সেসত্ব হারায় না। যদিও তা শর্তসাপেক্ষ। শর্তটি হল আবারো বিয়ে করতে হলে সে শুধু আরেকজন প্রিন্সকেই বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু অন্য প্রিন্সের কী এমন ঠেকা পড়ছে যে আরেক প্রিন্সের ডিভোর্সিকে বিয়ে করবে? অতএব মানে ধনে জানে বেঁচে থাকতে চাইলে সেই ডিভোর্সি বৈবাহিক প্রিন্সেসকে বেছে নিতে হয় একাকী জীবন।”
তাহলে সে চলে কিভাবে? একবার প্রিন্সেস হয়ে যাওয়ার পর সে বিয়ে ভেঙ্গে গেলে তাকে যদি একাই থাকতে হয়, তবে ঐ প্রিন্সেস জীবনের খরচা কে যোগাবে?
“সেটাই তো বলছিলাম। যতোটা শুনেছি ডিভোসের্র পর পরই, সেই প্রিন্সেস একটা করে বিলাশবহুল বাড়ি ও গাড়ীর সাথে মাসিক যে মাসোহারা পায়, তাতে একাকী বিলাসী জীবন চালানো খুবই সহজ। এ বিষয়ে রাজপরিবার বেশ উদার। তদপুরি ডিভোর্সি প্রিন্সেস যদি সন্তানসম্ভবা থাকেন, তবে সন্তান জন্মানোর পর তাঁর ভাগ আরো বড় হয়। কতো বড় হবে তা নিভর্র করে তিনি কি প্রিন্স নাকি প্রিন্সেস জন্ম দিলেন তার উপর। যদি প্রিন্সেস জন্ম দেন, তবে আরেকটা বাড়ি ও গাড়ী পান, সাথে দ্বিগুণ হয়ে যায় মাসোহারা। প্রিন্স জন্মালে নাকি পান আর দুটো করে বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ী এবং মাসোহারা হয় চারগুন। কিন্তু ঐ মাসোহারার পরিমাণ তো জানি না। তবে জন্ম নেয়া প্রিন্স বা প্রিন্সেসের একাউন্টে জমা হতে থাকে ১৮ হাজার ডলার তা তো বলেছিই। মা যতোই ডিভোর্সি হউক না কেন, বাচ্চাদের শরীরেতো বইছে রাজরক্ত।”
এসব কথা কতোটা সত্য, কেউ তা জিজ্ঞেস করবেন না।যতোই এসব কথা আমারও কাছে আরব্য উপন্যাসের মতো হউক না কেন, ওসবের সত্যাসত্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে বিব্রত করিনি আমিও গল্পকারদের। এটুকু বলতে পারি, ফিসফিসিয়ে বললেও বলেছে তারা তা, আত্মবিশ্বাসের সাথে। এছাড়া এরই মধ্যে তো জেনেছি, কারো কথার সত্যাসত্য নিয়ে কোনরকম সন্দেহ পোষণ করাকে আরবরা খুব অপমানজনক মনে করে। সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় তাতে। অফিসে খলিল, আর কমপাউন্ডের সৌদি সজ্জন ম্যানেজারসহ আর যে দু চারজন সৌদির সাথে যে সামান্য সম্পর্কটুকু হয়েছে তা আর নষ্ট করি কেন? তদুপরি রাজপরিবার তো রাজপরিবার। তাদের তো দলিল দস্তাবেজ দিয়ে কোন কিছু প্রমান বা অপ্রমান করার দায় নেই। তাঁর চে বরং বাংলায় যে কথা আছে, “যাহা রটে, তাহা কিছু না কিছু তো বটেই” তাতেই রাখি বিশ্বাস।
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।











