আচ্ছা সেলিম, তুমি যে আমার সেলস টিমের পিপল এলোকেশন নিয়ে প্লানটা বানালে এটা কি ফিল কে দিয়েছ? ফিল কি জানে? না, ডিপার্টমেন্ট হল তোমার, সে জায়গায় তোমার মতামত নেবার আগে বস কে দেই কিভাবে ওটা?
খলিলের প্রশ্নের উত্তরে যা বললাম একই সাথে সেটি কিছুটা সত্যি ও কিছুটা মিথ্যা। না খুব বড় মিথ্যা না! ইংরেজিতে যাকে বলে হোয়াইট লাই, ঐরকম সাদা মিথ্যা । বলতে হয়েছে তা সম্পর্ক রক্ষার কারনেই। এ জীবনের নানা সম্পর্ক তো এভাবেই টিকিয়ে রাখতে হয়। একদম জলজ্যান্ত সত্য শুধু তো তিক্তই তো নয়, হয় এতে বদহজম অহরহই মানুষের।
বিষয় হচ্ছে মাসখানেক আগেই এই ডকুমেন্টটি পাঠিয়েছিলাম খলিলকে। এখানে আসার পর আমার টিমের করা নানান প্লানের কিছু কিছু বিষয় যে বেখাপ্পা লেগেছিল, সেগুলো ঠিক করতে গিয়ে, খলিলের কাছ থেকে যেমন চেয়েছিলাম তার অপারেশনাল প্লান , তেমনি স্ট্রাটেজি ডিপার্টমেন্ট থেকে নিয়েছিলাম নানা ডাটা। এরপর ওসব ঘাটাঘাটি করার সাথে, নিজের টিমের নানান জনের সাথে যেমন, তেমনি খলিল সহ সেলসের নানান জনকে প্রশ্ন করে, সর্বোপরি নিজে যে ক’দিন সরাসরি ফিল্ডে কাজ করেছি, পড়েছিল তাতে চোখে ধরা নানান অসঙ্গতি। এ অবশ্য খুব অস্বাভাবিক কিছু না। যেকোন জায়গায় যেকোন প্রতিষ্ঠানেরই বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল এক্সিকিউশনাল প্লান করতে গিয়ে, নানান কারনে মূল প্লান থেকে কিছু না কিছু বিচ্যুতি ব্যত্যয় ঘটে; যাতে অনেক সময় ফলাফল দাঁড়ায় কাজীর গরু খাতায় আছে , কিন্তু গোয়ালে নাই। ঘটে এর উল্টোটাও অনেকক্ষেত্রে। ঘটেছে তেমনি এখানেও।
এতে প্রথমে ভেবেছিলাম যেসব ব্যত্যয় ঘটেছে, মূল মার্কেটিং প্ল্যানের সাথে সেলসের অপারেশনাল প্লানের, তা নিয়ে ডকুমেন্ট তৈরি করি। কিন্তু দেয়নি মন সায় তাতে। এমনিতেই তো কেউ কারো নিজের দোষ স্বীকার করতে চায় না। তদপুরি এসেছি এখানে নতুন। এসেই যদি শুরু করি ভুল ধরা, তবে দেখা যাবে একদিকে যেমন এখানকার মিশরি গ্রুপ একাট্টা হয়ে, তেমনি সেলসের ব্যাপারে ওরকম কিছু হলে সৌদি খলিলও যাবে বিগড়ে। তাতে কাজ করা মুশকিল হয়ে যাবে আমার।
অতএব এখন কী ভুল ভ্রান্তি, বিচ্যুতি, ব্যত্যয় আছে, সে ব্যাপারে কিছু না বলে; আগামী বছরের বিজনেস মডেল অনুযায়ী অপারেশনাল প্ল্যান কী হওয়া উচিৎ তার ভিত্তিতে ডকুমেন্টটা তৈরি করার পর বলেছিলাম ফিলকে, যা শুনে হেসে বলেছিল বস -“দেটস হোয়াই ইউ আর হিয়ার সেলিম। ইটস ইউ, হু নিডস টু গেট ইট ডান।“
তা আর না বুঝি কেমনে। ইঙ্গিতে বস তো বলছেন আসলে, দেখি তো তোমার কর্তৃত্বহীন নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা আছে কি না? মানে ইংরেজিতে যাকে বলে লিডিং উইথআউট অথরিটি, সেই চ্যালেঞ্জই দিলেন বস।
এদিকে সৌদিতে আসার পর থেকে এতদিনে একটা ব্যাপার বুঝেছি পরিষ্কার যে, অন্যান্য এশিয়ানদের চেয়ে সৌদিরা একদিকে যেমন বেশ কর্তৃত্বপরায়ণ, তেমনি তুমুল পদমর্যাদা সচেতন। ফলে বস কিছু বলা মানে, সেটিকে তারা হুকুম হিসেবে ধরে নিয়ে সেই হুকুমের মাজেজা পুরোপুরি না বুঝলেও সেটি পালন করে ফেলে। কিন্তু পরে যদি দেখে সেই হুকুম তামিল করার পর ফলাফল আশানুরূপ হয়নি, তখন যে ছুতা দাঁড় করায় তা হলো, বস আপনি যা বলেছেন তাই তো করেছি, এখন যদি আশানুরূপ ফল না হয়, ওটা কি আমার দোষ? আবার সম পদমর্যাদার কেউ কোন প্রস্তাব দিলে, যদি কোন কারণে ভুলেও তাদের মনে হয়, তাকে হুকুম দেয়া হচ্ছে, তাহলে ঐ কাজের বাজবে নির্ঘাত বারোটা!
ফলে বিষয়টি চ্যালঞ্জিং। কারণ খলিল যতোই বাইরে বাইরে আমার সাথে বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠুক না কেন , মনে মনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সৌদিদের মতো মিসকিনই ভাবে কী না সে আমাকে, হদিসতো পাইনি তার। তদপুরি আমরা দুজন একই পদমর্যাদা হলেও, আমার পদটি নীতিনির্ধারণী বিষয়ক হওয়ায় সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঠেকে। ফলে এই পদটির প্রতি সমমর্যাদার অন্যসব পদধারীদের একটু ঈর্ষার ভাব আছে, এই কোম্পানিতে, সব দেশেই।
এসব কিছুই মাথায় নিয়ে মাসখানেক আগে খলিলকে সেই ডকুমেন্টসটি মেইল করে বলেছিলাম, সে যেহেতু সৌদি অতএব অবশ্যই সে এই মার্কেটের বিশেষজ্ঞ। তাই আমার মাথায় যে বিষয়গুলো ঘুরছে, সে গুলো নিয়ে আমি যে ডকুমেন্টস তৈরি করেছি সেটির বিষয়ে তার বিশেষজ্ঞ মত চাই। কিন্তু তারপরও এতদিনেও সে টু শব্দটিও করেনি খলিল। আমিও দেইনি তাগাদা। শুধু করছিলাম অপেক্ষা মোক্ষম মুহূর্তের।
চলছে এখন যেহেতু আগামী বছরের বাজেট প্ল্যানিংয়ের সময়, তাতে অচিরেই তো দিতে হবে খলিলকে তার ডিপার্টমেন্টাল প্ল্যান, সে জন্যই হয়তো আমার ঐ প্রস্তাবটির কথা মনে পড়েছে ইদানিং। তারপরও অফিসিয়ালি না, এই ক্যাবসা পার্টির উসিলায় সে হয়তো আজ সেটিরই খুটিনাটি বিষয় বুঝতে চায়। আগে বিষয়টি টের না পেলেও, এখানে এসে খলিলের সাথে দেখা হবার পর, তার হাতে আমার ডকুমেন্টটির প্রিন্টেড কপি দেখে আঁচ করেছিলাম।
আর আমরা আসতেই স্বভাবসুলভ হাসির সাথে উচ্চকণ্ঠে মিনিট তিন চার ধরে “ইয়া হাবিবি গিউসি, ইয়া হাবিবি সেলিম, মাই ফ্রেন্ডস হাউ আর ইউ? ওয়েলকাম, ওয়েলকাম। ভেরি হ্যাপি আই এম! বোথ অফ ইউ কেইম, আরবি ইংরেজি মিলিয়ে ইত্যাকার নানান আরবসুলভ স্বাগত সম্ভাষণ করা শেষে সুস্থির হয়ে, কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রথমেই জানতে চেয়েছে খলিল, এটি আমি ফিল কে দিয়েছি কি না, বস এটা দেখেছে কী না? বলেছি যা শুরুতেই এদিকে আমার এই কাজটির ব্যাপারে ফিলকে অবগত করলেও, যেহেতু ডকুমেন্টসটি তাঁকে দেইনি, খলিলের প্রশ্নের উত্তরে শুরুতে বলেছিলাম যা, সেটিকে তো আর মিথ্যা বলা যায় না।
তো আমার উত্তর পাওয়ার পর থেকেই খলিল তার সামনে অপেক্ষায় থাকা ছোট্ট এরাবিয়ান কফির কাপটির কথা ভুলে একমনে পাতা উল্টে উল্টে ডকুমেন্টটি দেখতে দেখতে বিড় বিড় করছে দেখছি আনমনে। অন্যদিকে এখানে আসামাত্রই আরবীয় ট্র্যাডিশন মোতাবেক হোটেল কর্তৃপক্ষের দিয়ে যাওয়া খেজুর ও ছোট কাপ ভর্তি কফি শেষ হয়েছে আমার বেশ আগেই। ভাবছি সামনের চমৎকার কারুকার্যময় তামাটে ট্রের উপর একই রং আর কারুকাজের ধাতব এরাবিয়ান স্টাইলের কফি পট থেকে নেবো কি না আরো কফি। কারণ সন্ধ্যায় বেশি কফি খেলে তো রাতের ঘুম হয়ে যাবে পগার পার, আমার! অতএব ট্রের উপরে রাখা ঝুড়ি থেকে খেজুর তুলে চিবুচ্ছি একমনে। ঐদিকে গিউসি তার কাপ খালি হতেই ভর্তি করে নিচ্ছে সাথে সাথেই। ব্যস্ত সে তার ফোনে।
দুজনের এই নীরব ব্যস্ততার ফাঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবছি, বাইরে থেকে নজদ ভিলেজ নামের এই রেস্টুরেন্টটিকে যতোটা না আরব ঐতিহ্যের মনে হয়েছিল, অন্দরমহলে এটিকে ঢের ঢের বেশি আরবিয়। মেটে রঙ্গয়ের এর দেয়ালগুলো দেখে বুঝতে পারছি না আসলেই দেয়ালগুলো মাটির তৈরি কি না? মাথার উপরের ছাদে দেখতে পাচ্ছি কাঠের, না কাঠ তো না গাছের তৈরি যে কড়িবরগাগুলো, তাতে বেশ একটা পুরানো দিন পুরানো দিন ভাব এসেছে। জায়গায় জায়গায় শৈল্পিকভঙ্গিতে ঝুলতে থাকা হারিকেনগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাদের গ্রামগুলোর হারিকেন আলোর সন্ধ্যার স্মৃতি। তবে ঐ হারিকেন থেকে যে আলো বেরুচ্ছে, তা যে অল্প ভোল্টের বৈদ্যুতিক আলো তা বুঝতে পারছি। এন্টিক ধাঁচের কাঠের দরজা, জানালা ও আসবাবপত্রগুলোর নানান জায়গায় লাল নীল সাদা রঙ্গের নানান জ্যামিতিক ডিজাইন আর ফুল লতাপাতা আঁকা দেখে, প্রথমবারের মতো মিলেছে দেখা এয়াবিয়ান পেইন্টিংয়ের।
হাটু সমান উঁচু দেয়াল ঘেরা চারকোনা যে খুপরির মোটা কার্পেট মোড়ানো মেঝেতে বসেছি , সেটি সহ একই ধরনের আর সব খুপরিগুলোর কার্পেট, তাকিয়া, কোল বালিশ সবই চতুর্ভুজ ত্রিভুজ সহ নানান জ্যামিতিক আকারের প্যাটার্ন খচিত মোটা কাপড়ে মোড়ানো। রঙ্গয়ের মধ্যে প্রাধান্য লালের।সব মিলিয়ে সিনেমায় আরবিয় তাঁবুর ভেতরে যেরকম আবহ দেখেছিলাম, ঐরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু এই কাপড়গুলো তো অন্য কোথাও চোখে পড়েনি। এ সময় ফোন থেকে মনযোগ সরিয়ে গিউসি আমার উদ্দেশ্যে বলল – “কি বোর লাগছে নাকি তোমার?”
না না তা না। বেশ চমৎকার সাজসজ্জা এই রেস্টুরেন্টের। এন্টিক এন্টিক ভাব আছে। আচ্ছা গিউসি এই যে কার্পেট আর তাকিয়াগুলোর কাভার, এগুলো কোন ধরনের কাপড় দিয়ে তৈরি? কাপড়ের এই ডিজাইন তো শহরের কোথাও দেখিনি।
“হুম এ হল বেদুঈন নারীদের হাতে বোনা বিশেষ কাপড়। উট, দুম্বা, ভেড়ার লোম দিয়ে বানানো, এই কাপড়ের নাম আল সাদু। গোটা আরবজুড়েই পাওয়া যায় আল সাদু। আচ্ছা, আমি একটু টয়লেট হয়ে আসি” এই বলে গিউসি উঠে চলে যেতেই –এতক্ষণ যে বিড়বিড় করছিল সেটির ভ্ল্যুম বাড়িয়ে বলল খলিল, “আচ্ছা সেলিম, এক জায়গায় দেখলাম তুমি লিখেছো সৌদি হল চার রাজধানীর দেশ, এটা তুমি কি লিখেছ?”
ওহ সরি, এখানে আসার পর থেকে নানান কিছু দেখার পর ঐ ব্যাপারটা আমার মাথায় ঘুরছে বলে, কোন ব্যাখ্যা না দিয়েই অবচেতনভাবে ওটা যে লিখে ফেলেছি, বুঝতে পারছি তা এখন। বিষয় হচ্ছে সৌদির যে কটা অঞ্চল বা প্রদেশ আছে, তাতে যত শহর আছে তার মধ্যে চারটিকে চার কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার। সেটাই লিখেছি ওভাবে। রিয়াদ তো অবশ্যই রাজনৈতিক বুরোক্রেটিক ও ডিপ্লোম্যাটিক কার েকাগজে কলমে রাজধানী। ঐদিকে জেদ্দা কিন্ত অনেক অনেক আগে থেকেই বন্দরের কারণে গুরুত্বপূর্ণ, তাই ঐটিকে মনে হয়েছে সৌদির ব্যবসায়িক মানে কমার্শিয়াল রাজধানী। দাম্মাম হলো সৌদি আরামকোর হেড কোয়ার্টার। তার আশেপাশেই আছে এই গ্রহের অন্যতম বৃহৎ তেলক্ষেত্র। ফলে ওটাকে খুব সহজেই বলা যায় তেলের রাজধানী। সব শেষে জেদ্দার একদম নিকটবর্তি শহর হলেও মক্কা তো শুধু মাত্র সৌদির না, বিশ্বের সকল মুসলিমের ধর্মীয় রাজধানী!
“ওহ এখন বুঝলাম কেন তুমি মক্কা, মদিনা আর দাম্মামে লোক বাড়ানোর প্রস্তাব করেছ। এটা আমিও চেয়েছিলাম, কিন্তু লোক পাইনি বলে করতে পারিনি। তবে বন্ধু তুমি জেদ্দা, না জেদ্দা না রিয়াদে লোক কমাতে বলছ কেন?”
শোন খলিল, অবশ্যই সৌদির ভূগোল তুমি ভাল জানো। আমি যা করেছি তা তো হল মূলত ব্র্যান্ড স্ট্রাটেজি, নানান শহরের অর্থনৈতিক অবস্থা ও আমার জানামতে ঐসব শহরের স্বাস্থ্যসেবার যে সব অবকাঠামো আছে তার উপর ভিত্তি করে করা, খসড়া প্রস্তাব মাত্র। তবে সব মিলিয়ে আমি কিন্তু তোমার লোকবল বাড়ানোর প্রস্তাব যে করেছি, তা কী লক্ষ্য করেছ?
“শোকরান সেলিম শোকরান।” আমার কথার উত্তরে এটুকু বলতে না বলতেই এসময়, ডিনারের অর্ডার নেবার জন্য খানদানি এই রেস্টুরেন্টের আরব ঘরানার ইউনিফর্ম পড়া এক ওয়েটার এসে সবিনয়ে দাঁড়াতেই বলল খলিল
“শোন সেলিম, এখানে অর্ডার করলে এখনি কিন্তু আস্ত একটা দুম্বা জবাই করে আমাদের জন্য ক্যাবসা বানিয়ে দেবে। দেবো নাকি, ছোটখাট একটা আস্ত দুম্বার অর্ডার?”
আরে বলছো কী? আমরা তো মাত্র তিনজন। তোমাদের ক্যাবসা যে পরিমাণে দেয় দেখেছি হোটেলগুলো তাতে আমার মনে হয়, তুমি দুইজনের অর্ডার করো। কারণ সাথে তো সাইড ডিসও থাকবে। আমার ধারণা তাতেও পুরোটা খেয়ে শেষ করতে পারবো না তিনজনে।
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক










