বহুকালের অভ্যাস মতো এসেছিলাম অফিসে সেদিনও সকালে, ঝাড়পোঁছ করা কর্মীদের কাজের সময়। এরই মধ্যে আমার এই অভ্যাসটি বুঝে গেছে সারাদিন অফিসে নানানজনের রুমে চা কফি দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত তরুণটিও, যে আবার সকালে ঝাড়পোঁছও করে। ফলে বেশ কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছে আমার রুমই সে ঝাড়পোঁছ করে রাখে আগেভাগে।
জনবিরল এ সময়টাতেই একদম নিজের অফিসিয়াল কাজগুলো করা যায় অখণ্ড মনোযোগে। ফলে সেদিনও একমনে কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ পর, সকালবেলার ঝিমঝিমানি ভাব কাটানোর জন্য যে ব্ল্যাক কফি খাই রোজ, তারই একটি ধোঁয়া ওঠা কাপ ছেলেটি সসম্ভ্রমে টেবিলে রেখে গেলে, ল্যাপটপ ছেড়ে, চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে সেই কাপে চুমুক দিতেই, গেল চোখ রুমের খোলা দরজায়! এই সাতসকালেই ওখানে দেখছি, ফিলের ভাষায় এক পেঙ্গুইনকে! সর্বাঙ্গ কালো পেঙ্গুইনের গলার দিকটা সাদা যেমন, তেমনি ইনারও রমনীয় মুখটি বেশ ফর্সা। দেখেছিলাম কী এই মুখ আগে? বুঝতে পারছি না। তা এই সাতসকালে কী জন্য যে দিয়েছেন ইনি এখানে হাজিরা, ঠাহর করতে পারছি না!
এদিকে ওনাকে দেখা মাত্রই সাধারন ভদ্রতা হিসেবে কফির কাপ হাতে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে,তাঁকে রুমে এসে আসন গ্রহণ করার সাদর আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েও চাপলাম অকস্মাৎ জোর ব্রেক! কে জানে? এটাই না হয়ে যায় এখানে অত্যন্ত আপত্তিকর ইঙ্গিতের সামিল। জানি ফিল এখানে এসে যোগ দেবার পর, এই অফিসে কিছু রমণীর কর্মসংস্থান হয়েছে। আর তা করার জন্য এখানকার নিয়ম মেনে মেয়েদের জন্য আলাদা সেকশন করা হয়েছে অফিসের নীচতলায়। বেশীরভাগ সময়ে থাকেন তারা সেই ঘোরটোপেই। তবে যখন কারো কোন কাজের দরকার পড়ে, অফিসের পুরুষরাজ্যে অবশ্যই আসেন। তবে এখন পর্যন্ত কারো রুমে ঢুকতে দেখিনি তাদের কাউকে।সারেন কাজ বা কথাবার্তা ওফিসের কমন স্পেস বা করিডোরেই। অতএব সকালের এই জনবিরল সময়ে যদি ডাকি ইনাকে রুমে ভেতরে, তবে হলিউডি “ইনডিসেন্ট প্রপোজাল” সিনেমার কাহিনীর মতো ব্যাপারের অবতারণা হয়েও যেতে পারে!
ফলে এদিকে উড়ে আসা নারীকণ্ঠের সালামের জবাব দিয়ে সহাস্যে কফির কাপ হাতে টেবিল ও রুম দুটোই ছেড়ে, করিডোরে আপাত নিরাপদ দূরত্বের চেয়েও কিছুটা বেশি দূরত্ব বজায় রেখে ওনার মুখোমুখি হতেই, নাকে পারফিউমের চমৎকার সৌরভ এসে পৌঁছানোর সাথে, তার হড়বড় করে বলা আরবি এক্সসেন্টের ইংরেজির যা এসে পৌছালো কানে, মানে দাঁড়ায় তার উনি ইনারা খালেদি। ড. খলিল তাকে নাকি বলেছে আমাকে নিয়ে যেন সে আজ ফিল্ডওয়ার্কে যায়। এসেছেন তিনি তাই।
মনে মনে হাসতে হাসতে ভাবলাম, সহকর্মী থেকে ক্রমশই বন্ধু হয়ে ওঠা হেড অব সেলস খলিল, আমি ফিল্ডওয়ার্ক করতে চাই শুনে সেই যে বলেছিল, তাহলে পাঠিয়ে দেবে সে তার টিম থেকে, হুরপরী ওটা নিছক রসিকতাই নয়। এর আগে পাঠিয়েছিল সে এক জর্ডানি সুন্দরীকে। মনে মনে এসব ভাবলেও বললাম মুখে; হ্যাঁ তা তো বলেছিলামই ড. খলিলকে। খুব ভাল হয়েছে আপনি এসেছেন। তা কখন যেতে হবে? কোথায় ও কতদূরে যেতে হবে?
উত্তর এলো, সমস্যা নাই। মিনিট ১০/১৫ পর রওয়ানা করলেই হবে। খুব দূরে না। কাছেই একটা পলিক্লিনিকে কাজ। গাড়িতে গেলে যেহেতু একটু ঘুরে যেতে হবে, তাই ১৫ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট লাগতে পারে, ট্রাফিকের উপর নির্ভর করে। হেঁটে গেলে মিনিট দশেক লাগতে পারে। ঠিক আছে তাহলে কফিটা শেষ করে নেই। হেঁটেই যাবো, যদি আপনার কোন সমস্যা না থাকে। আপনাকেও কফি দিতে বলি?
“না, না এ সময় কফি খাবো না।” একগাল হাসিতে উত্তর দিয়ে গিয়ে বসলেন উনি এই তলার ভিজিটরস সোফায়। অতঃপর নিজের স্বাভাবিক গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে কফি শেষ করে, ল্যাপটপ বন্ধ করে টেবিলটা একটু গুছিয়ে মিস খালেদির সাথে রওয়ানা করার পর, অফিসের চৌহদ্দি পেরিয়ে রাস্তায় নেমেই মনে হল, অফিসে যতোই সহজে কথা বলি থাকি না কেন বেগানা এই নারীর সাথে, বাইরে বেরিয়ে বেশ আশংকিত হয়ে পড়েছি! বলা তো যায় না, কোন ফাঁক ফোঁকর বা চিপা থেকে বেরিয়ে আসে কখন বেত হাতে মোতাওয়া! আর গায়েরে মাহরাম আমি হাঁটছি কেন বেগানা নারীর সাথে, এ অপরাধে লাগায় শপাং শপাং বেত! রিয়াদের বিবেচনায় অত্যন্ত যৌক্তিক ঐ আশংকার কারনে তার থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে নানান দালানের বারান্দার ছায়ায় ছায়ায় তার পিছু হাঁটতে হাঁটতে মুখেও মেরে রেখেছি তালা না শুধু, সাথে এমন ভাব ধরে আছি যে তাকে চিনিই না!
জানি না এইরকম নারী বৈরি পরিবেশের কারণেই এখানে বসবাসকরা নারীরা বেশী সাহসী হয়ে উঠে কী না? সেদিনকার সেই জর্ডান সুন্দরী নাদিয়ার মতো ইনি বেপরোয়া রকমের সাহসী না হলেও, ইনারও সাহস তো কম মনে হচ্ছে না। যতোই আমি শুধু লেডিস ফার্স্ট নিয়ম না শুধু , ইনি যেহেতু আজকের কাজের জায়গা সেই পলিক্লিনিকটির পথপ্রদর্শকও বটে, তাই ওনাকে আগে হাঁটতে দিয়ে, বেশ পিছিয়ে হাঁটতে চাচ্ছি, তাতেও ফলাফল দাঁড়াচ্ছে, নিজ গতি কমিয়ে উনি অচিরেই আসছেন চলে পাশাপাশি!
দু ‘বার এমন হতেই, মনে হল নাহ! এরকম স্পিকটি নট হয়ে আমার পিছিয়ে হাঁটার ব্যাপারটাকে ইনি আবার আমি বাঙ্গালের কাপুরুষতা ভেবে বসেন কি না? বলা তো যায় না। কিন্তু তা হতে দেবার সামান্যতম সুযোগও তো দেয়া যাবে না। পড়ে যদি তাতে ঘাড়ে মোতাওয়ার বেত, পড়ুক! নেই কুছ পরোয়া! এই ভেবে তৃতীয়বার উনি পিছিয়ে আসতেই, অনুচ্চ স্বরে বলতে শুরু করলাম টুকটাক কথা। এভাবে টুকটাক কথায় প্রথমে জানলাম, উনি প্যালেস্টাইনি। খুব বেশী দিন না, বছরখানেক হল যোগ দিয়েছেন আমাদের সেলস টিমে মেডিক্যাল এডুকেটর মানে রিপ্রেজেন্টিভ হিসেবে এবং তিনি একজন ফার্মাসিস্ট। ব্যক্তিগত তার পরিচয় জানার সাথে জানা গেল কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যে সব তথ্য, তাও। যেমন জেনেছি, এখানে যে কোন হাসপাতালেই মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের প্রবেশাধিকার অত্যন্ত রেস্টট্রিক্টেড। কিছু কিছু হাসপাতালে খুব জোর এক ঘণ্টার একটা সময় দেয়া থাকে ডাক্তার ভিজিট করার জন্য, তাও আবার সপ্তাহের প্রতিদিন না। হাসপাতালের সিকিউরিটিদের চোখে নানান কায়দায় ধুলো দিয়ে, কাজ সারতে হয়। সে হিসাবে মেয়েদের একটা বিশেষ সুবিধা হল, আবায়ায় মুখ ঢাকা থাকায় সিকিউরিটিরা চিনতে পারে না। আর এ কারণেই তারা শুধু নিজেদের ব্যাক্তিগত হ্যান্ডব্যাগ নিয়েই যায় কাজে। অফিসের দেয়া মার্কামারা ব্যাগ না।
এছাড়া পলিক্লিনিক শব্দটি এতোদিন নানান ডকুমেনটস দেখলেও এবং নানানজনের মুখে উচ্চারিত হতে শুনলেও এটি যে আসলে কী তা বুঝতাম না। বুঝলাম তা এখন যে এ হলো আসলে আমাদের দেশে যেকম ডায়গনোস্টিক কাম কন্সালসেশন সেন্টার আছে, যেখানে বসে ডাক্তাররা রোগী দেখেন; ঐরকম একটা ব্যাপার। তবে এখানে অতিরিক্ত যা আছে তা হলো রোগীদের জরুরী চিকিৎসা সেবা দেবার ব্যবস্থা। সব পলিক্লিনিকই বেসরকারি।
সরকারী হাসপাতালে ফ্রি তে অনেক সেবা পাওয়া গেলেও, খুব দরিদ্র না হলে ওখানে যায় না সৌদিরা। এমনিতে পলিক্লিনিকগুলোতে এখানকার বিদেশী কর্মীরা চিকিৎসা নিতে গেলেও, এখন যেটিতে যাচ্ছি আমরা সেটিতে মূলত সৌদিরাই যায়। তবে এটির ডাক্তাররা সবই বিদেশী। এখন পলিক্লিনিকটিতে মোটামুটি ৭/৮ জন ডাক্তার পাওয়া যাবে। এর সাথে মিস খালেদি বেশ আনন্দের সাথে জানালো, এটি তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পলিক্লিনিক, কারণ এখান থেকে সে বেশ ভাল ধরনের সেলস পায় আমাদের ব্যথার ঔষধ ভ্লটারেন ইঞ্জেকশনের। হ্যাঁ এই বাঙ্গাল যে কাপুরুষ না তা প্রমাণ করার জন্য কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে কথাবার্তা শুরু করাতেই অবশেষে পেয়ে গেলাম কাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য যেমন, তেমনি কপালগুনে কোন ঝুট ঝামেলা ছাড়াই পৌঁছে গিয়েছিলাম পলিক্লিনিকে। তদপুরি এই সব কথাবার্তায় মনে হল মিস ইনারার যে আড়ষ্টভাবটি ছিল শুরুতে, কেটেছে তাও। যা একটি ভাল খবর।
কিন্তু নাহ! গন্তব্যে পৌঁছে ক্লিনিকটির করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল আবারো সে হয়ে পড়েছে নার্ভাস। হড়বড় করে জানাচ্ছে তাই যে, এখানে রিপ্রেজেন্টেটিভদের ভিজিটিং টাইম সকাল সাড়ে ৮ থেকে সাড়ে নটা। বাজছে এখন সকাল ৮ঃ২০। কিন্তু এরই মধ্যে সে বুঝতে পারছে যে নানান কোম্পানির লোক ঢুকে পড়েছে ক্লিনিকে। অতএব ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে লাইনে পড়তে হতে পারে! এ কারণে সে বেশ অনিশ্চিত আশংকা চোখে নিয়ে তাকালো আমার চোখে চোখে।
দ্রুততার সাথে তাই তাকে অভয় দিয়ে বললাম যে, নো টেনশন। আমিও একসময় রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলাম। এই কাজের যাবতীয় চ্যালেঞ্জ আমার জানা। বিশাল কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম বি এ করার কারনে কোম্পানিতে যোগ দিয়েই চিফ মার্কেটিং অফিসার হয়ে যাইনি আমি। প্রতিনিয়ত সে যেভাবে কাজ করে, করবে ওটাই, আজও সে। তার কাজের ভুল ধরতে আসিনি আমি। এসেছি বরং কাজ করতে গিয়ে সেলসের লোকজন কী কী ও কেমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তা বোঝার জন্য। ক্লিনিকের টানা করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলছি যখন এসব, তখনি মিস ইনারা উত্তেজিতভাবে বললো
ড. সেলিম ঐ যে, ঐ ডাক্তারের চেম্বারের সামনে কোন রিপ্রেজেন্টেটিভ দেখছি না। ইনি খুব ভ্লটারেন ইঞ্জেকশন লিখেন। বলেই দ্রুত পায়ে গিয়ে ঐ দরজার ঝুলতে থাকা পর্দা ফাঁক করে সম্ভবত সালাম দেয়ার সাথে ভেতরে ঢোকার অনুমতি নিয়ে সে রুমে ঢুকে পড়তেই, নিয়েছিলাম পিছু আমিও! ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ডাক্তার সাহেবকে সালাম দিতেই, নিজ চেয়ার ছেড়ে উনি উঠে দাঁড়িয়ে আমার সাথে হাত মিলিয়ে বসতে বললে বসে পড়লাম দু জনেই! কিন্তু বসার বেশ কিছুক্ষণ পরও মিস ইনারা কিছু না বলে যখন চুপ করে থাকলো, তৈরি হল তাতে রুমে অস্বস্তিকর নীরবতা এক। বুঝলাম এতক্ষণ যতোই সাহস দিয়ে থাকি না কেন, নার্ভাস হয়ে ব্লকড হয়ে গেছে বেচারি। ব্যাপারটি সামলানোর জন্য তাই নিজের করা নিয়ম নিজেই ভঙ্গ করে, শুরু করলাম কথা ডাক্তার সাহেবের সাথে। প্রথমে নিজ ও দেশের নাম তারপর এখানকার পদবি জানিয়ে বললাম, মিস ইনারা আমাকে বলেছে যে উনি প্রচুর ভ্লটারেন লিখেন, সে জন্য জানাচ্ছি তাঁকে ধন্যবাদ অসংখ্য। তবে যেহেতু সদ্যই এসেছি আমি এইদেশে আজ এখন তার কাছ থেকে কিছু সবক নিতে চাই। প্রথমত সৌদি হেলথকেয়ার সিস্টেমের কিছুটা বুঝতে চাই। আর জানতে চাই রোগীদের ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।