মরুতে উইকএন্ড শুরুর দিন আজ, মানে বৃহস্পতিবার। রিয়াদ ম্যারিয়টে হোটলেবাস শেষ করে গ্রানাডা কমপাউন্ডের বাংলোতে থিতু হয়েছি হয়ে গেছে দেড়মাসের কাছাকাছি। তাতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেখছি, বৃহস্পতিবারের দিনটা যায় আমার বেশ ব্যস্ততায়। হোটেলে থাকা অবস্থায় যা যা করতে হতো না, তার অনেকগুলোই তো এখন করতে হয় নিজেকে। বিশেষত জামা কাপড় ধোয়া, শুকানো, ইস্ত্রিকরা, সাপ্তাহিক বাজার করা, রান্না করা এইসব আর কি। জামাকাপড় ধোয়া ও শুকানো মেশিনে হয়ে যায়, তাই তা নিয়ে সমস্যা নাই। তবে ইস্ত্রি করতে গিয়ে বিরক্ত তো না একঘেয়েমিতে পেয়ে বসে। কিন্তু উপায় তো নাই। যদিও একবার ভেবেছিলাম, ঘরদোর পরিষ্কার করা আর গাড়ী ধোয়ার জন্য যে আরিফ মিয়া আসে, তাকে তা করতে দেবো কী না? পরে ভেবেছি নাহ থাক। আরিফ তা পারবে কি না, তা নিয়ে তো সন্দেহ আছে। বরং কপাল আমার ঢের ভাল এই জন্য যে বাকী ভারী কাজ গুলো দেবার জন্য আরিফ মিয়া নিজেই যোগাযোগ করেছিল। ঘর পরিষ্কার করা আর গাড়ি ধোয়ার মতো শ্রমসাধ্য বড় কাজগুলো সে যে করে দিয়ে যায় মহাউৎসাহে, এই মরুতে সেটাই তো বড় পাওয়া।
বাজে এখন প্রায় সাড়ে তিনটা। ছুটির দিনের রুটিন মাফিক ১০ টার দিকে বিছানা ছেড়ে পান্তা ভাত, আলু ভর্তা, আর গরম গরম ডিম অমলেট দিয়ে এক্কেবারে ভরপেট নাস্তা করে, ঘনদুধের চা তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেয়ে, মেশিনে জামা কাপড় ধোয়া ও শুকানোর কাজ শেষ করে বসার ঘরের সোফায় গা একটু এলিয়ে দিতেই, ১১:০০ টার দিকে আরিফ দরজায় ঘণ্টা বাজিয়েছিল। সেই থেকে শার্টের আস্তিন ও প্যান্ট গুটিয়ে নিরলসভাবে গোটা ঘরের কার্পেট ভ্যাকুম ক্লিনিং করে, রান্না ঘর আর বাথরুম পরিষ্কার করে, পার্কিং লটে গিয়ে আমার গাড়ী ধোয়া শেষ করে রান্না ঘরে সম্ভবত খাচ্ছে এখন আরিফ। খাওয়া শেষ হলেই যাবে চলে। ভাবছি এমন যখন বসার ঘরের বড় সোফায় লম্বমান হয়ে, সোফার থেকে বেশ দূরে থেমে মানে রান্না ঘরের দরজা থেকে প্রশ্ন আসে মৃদু গলার– “স্যার কি ঘুমাইয়ছেন?” না তো, ঘাড় উঁচু করে ঐদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত করি আরিফকে যে, সে মোটেও ঘুমের ব্যাঘাত করেনি। “আর কোন কাজ আছে কী স্যার?” না। তুমি যেতে পারো। ভাল কথা তোমার বাটিগুলো সব ধুয়ে রেখেছো তো? “জি স্যার।” সলজ্জ হেসে উত্তর দিয়ে সালামালাইকুম বলে বেরিয়ে যায় আরিফ মিয়া।
আমার ঐ শেষ প্রশ্নটি করার মানে এই নয় যে, কাজে ফাঁকি দেয় আরিফ। বরং ঘটনা হলো উল্টা। বিশাল এই ফ্লাটের যে সব রুম বা বাথরুমে আমার পা ও পড়ে না সে সবও শুধু সে পরিষ্কারই করে না, বরং ওসব রুমের দুই তিনটা ইলেক্ট্রিক সমস্যাওনিজ থেকে বের করে, কমপাউন্ডের সংশ্লিষ্ট লোকজনদের নিজ উদ্যোগে ডেকে এনে ওসব সারিয়েছে।
ব্যপার হচ্ছে, আমার এখানে কাজে যোগ দেয়ার প্রথম সপ্তাহেই যখন লক্ষ করেছিলাম যে কাজ শেষ করে যেতে যেতে তার দুপুরের খাওয়ার সময় গড়িয়ে যায়, তাই দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই কাজ শেষে এখানে তাকে খেয়ে যেতে বলেছিলাম। তাতে সে লজ্জা পেয়ে বেশ আপত্তি করলেও অবশেষে মহাবিগলিত হয়ে দুপুরের খাওয়া খেয়েছিল। কিন্তু পরে দেখেছি যে রাইস কুকার থেকে ভাত আর ডালের হাড়ি থেকে ডাল, আলু ভর্তা এসব মোটামুটি নিলেও, বিশেষত মাছ মাংশের ঝোল ছাড়া কিছু নিয়েছে বলে মনে হয়নি। তাতে মনে হয়েছে বেচারা হয়তো বুঝতে পারছিল না কতটুকু মাছ মাংশ তার নেয়া উচিৎ! নাকি যেখানে সে থাকে ওখানে যা খাওয়ার ব্যবস্থা তাতে ঐরকম অল্প তরকারিতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে?
তো তার এই সমস্যার সমাধান হিসেবে পরের সপ্তাহে আলাদা বাটিতে করে তার জন্য তরকারি রেখে দিলেও দেখেছি খায়নি পুরোটা সে! ফলে ধন্দে পরে গিয়েছিলাম, এই ভেবে ফের যে সে কি আসলেই কম খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, নাকি বুঝতে পারছে না যে বাটির পুরোটাই তার ওইদিনের জন্যই বরাদ্দ। পরের সপ্তাহের জন্য রেখে যাওয়ার কোন দরকার নাই। অতপর তার ঐ সন্দেহ দূর করার জন্য তাকে খাওয়ার আগেই বলে দিয়েছিলাম, ঐ বাটিগুলো তাকে ধুয়ে রেখে যেতে হবে। আরো বিগলিত হয়ে গিয়েছিল বেচারা তাতে। আজও তাই আমার শেষ প্রশ্নে দিয়েছে সে ফের ঐ আন্তরিক বিগলিত হাসি! সে যাক আরিফ চলে গেলেও আলসেমির কারনে উঠে আর দরজা বন্ধ করলাম না। অবশ্য তিনস্তরের নিরাপত্তা সম্বলিত এই কমপাউন্ডে তা করারও দরকার নাই। শুয়ে শুয়ে তাই, হাফ মুন বে রিসোর্ট থেকে ফিরে সপ্তাহের বাকী দিনগুলোর কাজকর্মের একটা মনরিভিউ শুরু করতে প্রথমেই বেজে উঠলো মনে শ্লোগান “ইস্তাম্বুল অর কুয়ালালামপুর!” একই সাথে মজাও পেলাম যেমন, তেমনি হলাম প্রীতও। কারণ গত দু তিন দিন ধরে অফিসে এই ক্যাম্পেইন করতে করতে দেখছি তা গেঁথে গেছে নিজেরই অবচেতনে। বোঝা যাচ্ছে এটির সফলতার সম্ভাবনা সুপ্রচুর।
ব্যাপার হচ্ছে ঐ যে বেলছিলাম না সেদিনের কথা, মানে যেদিন আবু ইয়াসির মানে তায়সির আমার নামের কাব্যগুন এবং আর যেহেতু নামটি আব্বা রেখেছিলেন বলে জানিয়েছিলাম সেহেতু আব্বাকে অবশ্যই একজন কবি হিসেবে প্রতিপন্ন করার বেশ কিছুটা চেষ্টাচরিত্র করার পর, ভেবেছিলাম যেমন শুরুতে; সে মতই অবতারণা করেছিল সে মূল প্রসঙ্গের। তা হল সে আর তার সাগরেদ ফাহাদ দুজনে তুমুল কৌতূহলী জানার জন্য যে কী কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে হাফ মুন বে এর বৈঠকে!
বিশেষত ফাহাদ, এমন ফিস ফিস করে তা জানতে চাইছিল, যেনো বা হাফ মুন বে তে আমরা কোন গোপন ষড়যন্ত্র করে এসেছি। সাথে সাথেই তাতে মনে হয়েছিল, আমার জন্য সেই মিটিং আর তার পরবর্তীতে ফিলের সাথে একান্ত মিটিং যতোই ভাল হউক না কেন এ ব্যাপারে আমাদের সবারই, মানে যারা যারা ঐ মিটিং এ উপস্থিত ছিলাম তাদের একটাই ইউনিফাইড মেসেজ থাকা দরকার পুরো প্রতিষ্ঠানের জন্য। অথচ সেটা তো ঠিক করা হয়নি । অতএব এ নিয়ে দ্রুতই ফিলের সাথে কথা বলা দরকার। না হয় আমরা কে যে কী বলবো তার তো কোন ঠিক ঠিকানা নাই! তৈরি হবে তাতে হরেক বিভ্রান্তি। তদুপরি আমাদের যখন টার্গেট হল ডিসেম্বর, মানে আর ৭ মাসের মধ্যে কোম্পানির মালিকানা মূল কোম্পানির কাছে ফিরিয়ে আনা, যার ফলশ্রুতিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই এখনকার সাফাদ মানে সৌদি মালিকানাধীন অপারেশনের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যাবে বহুলাংশে, তাতে এমনিতেই নানান বাঁধা আসতে বাধ্য। এমতাবস্থায় কোম্পনির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক টিমের একেকজন যদি বলি একের কথা তবে গোটা কোম্পানি পরিণত হবে গুজবের কারখানায়। যা কোন মতেই হতে দেয়া যাবে নয়। এ হলে গোটা সংস্কার পরিকল্পনাই তো যাবে ভেস্তে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে, তুমুল উৎসুক ফাহাদ আর তাইসিরকে, সাপ পুরো না মরলেও মারটা যাতে ভালই লাগে আর লাঠিও যাতে থাকে অটুট, সেভাবে জানালাম দেখো প্রথমত আমি আর আমিন যেহেতু নতুন এসেছি, তাই বাকীরা এখানকার কাজের পরিবেশ আর বিজনেস প্রসেস নিয়ে আমাদের মতামত জানতে চেয়েছে, আমরা তা দিয়েছি। এতে দেখা গেছে এখানকার অনেক আইন কানুন নিয়ম আমরা সঠিক জানি না। তখন ঐসব বিষয়ে আমাদেরকে পরিষ্কার ধারণা দেয়া হয়েছে যাতে আমরা সবাইকে সাপোর্ট করতে পারি। তারপর এখানকার রাজকীয় সরকার সৌদিয়াজেশনের ব্যাপারে যে রকম সিরিয়াস, তা কিভাবে আমরা আমাদের কোম্পানিতে আত্মস্থ করতে পারি এ নিয়েও কথা হয়েছে বিস্তর। নাহ। বেশ জোর দিয়ে এসব বলার পরও পরিষ্কার মনে হলো বিশেষত ফাহাদের মোটেও মন ভরেনি। যোগ করলাম তখন আরো যে, আরেকটা অতিগুরুত্বপুর্ণ আলোচনা হয়েছে তা হল কোম্পনির পারফর্মেন্স আরো ভাল কিভাবে করা যায়, তা। এটুকু বলেই উল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলাম, আচ্ছা তোমরা কি জানো এই পাঁচ মাসে আমাদের পারফর্মেন্স কেমন?
ভড়কে গেল এ প্রশ্নে, দুজনেই। কারণ তারা তো এসবের খোঁজ রাখারই প্রয়োজন মনে করেনি কখনো। ভাবটা তাদের এমন যেন এর দায় তো শুধু সেলস মার্কেটিং এর। তো তাদের এই ভ্যাবাচ্যাকা ভাবের সুযোগ নিয়ে বললাম শোন একটু খোঁজ খবর নাও এ বিষয়ে। কোম্পানির পারফরমেন্সের দায় কোন এক বা দুই ডিপার্টমেন্টের না। ইটস এ ম্যাটার অব টিম ওয়ার্ক। সবাইকে তা নিয়ে ভাবতে ও কাজ করতে হবে। এ নিয়েও বিস্তর আলোচনা হলেও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারিনি ওখানে। আজ আবার তাই বসবো সবাই, সিদ্ধান্ত ফাইনাল করার জন্য। তারপরই তা জানিয়ে দেয়া হবে সবাইকে। এজন্যই যেতে হবে আমাকে এক্ষুনি ফিলের কাছে বলেই উঠে রওয়ানা দিয়েছিলাম বসের রুমের দিকে-“হাই বাডি। হেভ এ সিট। হোয়াটস আপ” নাকেমুখে একরাশ ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে ও কথা কটি বলতে বলতে নিজের সিগারেটে প্যাকেটটি এদিকে ঠেলে দিতেই, চেয়ারে বসতে বসতে তা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ওটা ধরাতে ধরাতে সোজা পয়েন্টে গিয়ে বললাম– শোন ফিল, আমাদের হফ মুন বে এর মিটিং এর সামারি হিসেবে একটা ইউনিফাইড মেসেজ দরকার। না হয় অফিসে নানান গুজব ছড়াতে শুরু করবে। এন্ড দ্যাট উইল বি কিলার ফর আওয়ার আপ কামিং চেইঞ্জ ম্যাঞ্জেম্যান্ট। উই নিড ক্রিয়েট পজিটিভ ভাইভ এক্রস অরগেনাইজেশন -“তা তো বুজলাম। তোমার যে প্রস্তাব আছে সেটাই বলে ফেল সোজা? আই কেন রিড অলরেডি হ্যভ ইট ইন ইউর মাইন্ড” ধোয়া মুখে হাসতে গিয়ে কাশতে কাশতে বলল ফিল– শোন সে মিটিংয়ে খলিল প্রস্তাব দিয়েছিল, জুলাইয়ের শুরুতে আমাদের মিড ইয়ার কনফারেন্স দুবাইতে করার জন্য। যেহেতু এখন পর্যন্ত আমরা খুব জোর ৯৫% সেলস টার্গেটে আছি, তাই তুমি তা মানা করে দিয়েছিলে। আমিনও তোমার পক্ষে ছিল। আর আমি যেহেতু আমাদের রুলস অব হান্ড্রেডে মানে পারফর্মেন্স মানেই ১০০%, তাতে ঘোর বিশ্বাসী , তাই কিছু বলিনি। কিন্তু আমি জানি সেলসে আমরা কিছু পিছিয়ে থাকলেও, প্রফিটিবিলিটিতে আমরা বেশ এগিয়ে আছি। কারণ আমার মার্কেটিংএ অনেক সেভিংস আছে। এমনকি খলিলের সেলসেও বেশ কষ্ট বেঁচে গেছে। আর আমাকে যেহেতু তুমি কষ্ট কন্ট্রোলের দায়িত্ব দিয়েছ, তা তোমাকে বুজিয়ে দেব। এখন তুমি সামান্য রিস্ক নিয়ে দরকার হলে হেড কোয়ার্টারকে বুঝিয়ে তাতে রাজী হয়ে গেলে, “চল চল দুবাই চল” এমন একটা হুজুগ তুলে দিতে পারি।
“ফুললি আন্ডারস্টুড। ডোন্ট ওয়ারি এবাউট হেড কোয়ার্টার, ইটস অন মাই প্লেট। লেটস গেট আদার্স কমিটমেন্ট স্পেসিয়ালি খলিলস এন্ড আমিন্স” বলেই ফোন করেছিল ফিল খলিল, আমিন, গিউসি ও সামি কে। তারপর পরবর্তী ঘণ্টা দুয়েক সবাই মিলে নানান হিসাব নিকাশ করে দুবাই যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ততো নিয়েছিলাম সাথে দুবাই মিটিং এর জন্যও একটা থিমও দাঁড় করিয়েছিলাম যা হল– “ইস্তাম্বুল অর কুয়ালালামপুর”। অর্থাৎ দুবাই মিটিং সবাইকে একটা চ্যালেঞ্জ দেয়া হবে, তারা কী বছর শেষে ইস্তাম্বুল নাকি কুয়ালালামপুর যেতে চায়? ইস্তাম্বুল যেতে হলে বছর শেষ করতে হবে টার্গেটের চেয়ে ৩% বেশী করে। আর যদি হয় পারফর্মেন্স ১০০%-১০২% গন্তব্য হবে তবে সকলের কুয়ালালামপুর!
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক