বেশ কিছুক্ষণ হলো শুরু হয়েছে আবু আলী আর আবু ইয়াসিরের উচ্চকণ্ঠ আরবি বাৎচিত। এতদিন এ নিয়ে বেশ কৌতুক বোধ করলেও, বেশ বিরক্ত লাগছে এখন। মনের ভেতরের দ্বিতীয়জন তাই ফিস ফিস করছে
এটা কোন একটা কথা হইলো? অফিসে এই রকম চিল্লাইয়া বাতচিত করা কেমন ভদ্রতা? এইটা তো তাগো বাড়ি না । অন্য যারা কাজ করে অফিসে, তাদের কথা চিন্তা করতে হবে না? বল না কেন তাদের এটা!
হ্যাঁ, যাচ্ছে কানে ঠিকই দ্বিতীয়জনের ঐ যৌক্তিক কথাগুলো। তারপরও অতিসচেতনভাবে তা আর মগজে নিয়ে গিয়ে সেটিকে কার্যে পরিণত করছি না। উল্টা মনে করিয়ে দিচ্ছি দ্বিতীয়কে, ঐ হাফ মুন বে র বিশেষ মিটিংয়ে এবং তারপর বস ফিলের সাথে, গত রাত দুইটা পর্যন্ত যে একান্ত কথাবার্তা হয়েছে, রিয়াদ এয়ারপোর্ট থেকে ফিরতে ফিরতে, অতপর আমার ফ্ল্যাটে চা খেতে খেতে; পরিষ্কার হয়েছে তাতে কোম্পানির বিপণনের প্রধান বা চিফ মার্কেটিং অফিসার হিসাবে সৌদিতে আমার পদায়ন হলেও, ঐ পদ সম্পর্কিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব চেপেছে ঘাড়ে। তা হলো বইয়ের ভাষায় বলে যাকে চেইঞ্জ ম্যানেজম্যান্ট। বাংলায় বললে বলতে হয় সংস্কার ব্যবস্থাপনা। আর এ কাজ করতে গিয়ে কখনো বসের ডান হাত, কখনো বা হাত হিসেবে যেমন কাজ করতে হবে তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেকেই দিতে হবে নেতৃত্ব। সেই জন্যই তো বলছি। শুরু হউক সংস্কার কার্যক্রম এ মুহূর্ত থেকেই। তাইসির আর ফাহাদ কে বলো, অফিসে এরকম চিল্লাফাল্লা করা ঠিক না। এটা অফিস ম্যানার না। নিজ নিজ রুমে বসে যদি কথা বলতেই হয়, করুক তারা তা ফোনে। কিংবা ফাহাদ কেন তার বস তাইসিরের রুমে গিয়ে বলছে না কথা? করিডোরের দুই পাশে প্রায় মুখোমুখি অফিসেই তো বসে তারা।
শোন তুমি তো জানোই মানুষ পরিবর্তন পছন্দ করে না মোটেও। যদিও বেশীরভাগই জানে সবকিছুই সতত পরিবর্তনশীল তারপরও তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিজে পরিবর্তিত হতে চায় না। যদি কেউ কেউ চায়ও পরিবর্তন, তবে চায় তারা পরিবর্তিত হোক অন্যেরা । চার পাশের সব কিছুই পরিবর্তিত হয়ে গেলেও বেশীরভাগই নিজে থাকতে চায় সাবেকি চালে। সাবেকি প্রথায়। এমতাবস্থায় মূল পরিবর্তন শুরু করার আগে এই সামান্য এ বিষয় নিয়ে মশা মেরে হাত কালো করার কোন মানে নাই তো। আপাতত এ নিয়ে আর প্যাচাল না পেড়ে চুপ থাকো তো; বললাম বেশ জোর দিয়ে দ্বিতীয়কে। ঘটনা হচ্ছে রিয়াদ আসার পর থেকেই মাঝে মাঝেই, অফিসের প্রতিবেশী ফাহাদ ও তাইসিরকে নিজ নিজ রুমে বসে উচ্চস্বরে একে অন্যের সাথে, আবু আলী, আবু ইয়াসির বলে বাতচিত করতে দেখে আসছি। নিজেদের মধ্যে সামনাসামনি দুজনের টম এন্ড জেরি সম্পর্ক হলেও, বিশেষত ফাহাদ একান্তে আমাকে তার বস সম্পর্কে যা বলেছে এ পর্যন্ত, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সম্পর্ক তাদের এক্কেবারে দা কুমড়ার মতো রক্তারক্তির না হলেও, আদায় কাঁচকলায় তো অবশ্যই।
মজা লাগতো, তাদের দুজনের একে অন্যকে করা এহেন সম্বোধনের জন্য। যতই ফাহাদ আমার পেছনে আমাকে ঘিরে মিসকিন প্রপাগান্ডা করুক না কেন, এবং যতই সৌদিরা তাবৎ বাঙ্গালীকে মিসকিন বলে হেয় করুক না কেন, তাদের এহেন সম্বোধনে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, ঐ মিসকিন সংস্কৃতির অন্তত একটা ব্যাপার তারা নিজেরাও অনুসরণ করে।
হ্যাঁ তাদের একজন আরেকজনকে আবু আলী ও আবু ইয়াসির বলে সম্বোধন করতে শুনে প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম, এ দুটো বুঝি ফাহাদ আল হিন্দি আর তাইসির দাউদের ডাক নাম। কারণ খুব ছোটবেলায় আব্বা আম্মার কাছে পবিত্র কোরান পাঠের মাধ্যমে আরবি পড়তে শিখলেও অর্থ তো জানতাম না। তারপর সপ্তম শ্রেণিতে স্কুলে আরবি পরীক্ষায় হুজুর স্যারের অসিম বদান্যতায় উচ্চ নম্বর পেলেও আরবি ভাষাজ্ঞানের দৌড় তো আমার–আলাহু ওয়াহেদুন মানে আল্লাহ এক; বা জাদিদ মানে নতুন, কিতাব মানে বই, কিত্তাতুন মানে বিলাই, আন্নানাস মানে আনারস পর্যন্তই।
অফিসের নিয়মানুযায়ি এখানে এসেই অফিসের খরচে ও আয়োজনে আরবিভাষা শিক্ষার ক্লাসে ভর্তি হতে পারতাম। তবে সে আয়োজন তো করার কথা, মানবসম্পদ প্রধান গিউসির। অবশ্য আমিও তা বলতে পারি তাকে। কিন্তু গিউসি যেহেতু আমার ইকামা বের করা নিয়েই গলদঘর্ম ব্যস্ত তাই হয়তো সে প্রস্তাব দেয়ার কথা মনে নাই তার। এদিকে আমিও যেহেতু দেখছি, কাজ তো চলেই যাচ্ছে ইংরেজিতে। সমস্যা তো নাই। তদুপরি এরই মধ্যে তো শিখে গেছি কখন হাবিবি, কখন শুকরান আর কখন বলতে হবে মালিশ। অতএব অসুবিধা কী?
এমতাবস্থায় দুজনের ঐ নামবিভ্রাটে পড়ে বেশ কয়েকবারই ভেবেছি জিজ্ঞেস করি ফাহাদ বা তাইসির কে যে, আবু আলী ও আবু ইয়াসির তাদের ডাক নাম কি না। ঠিক সে সময়েই একদিন সকালে ফাহাদ আমার রুমে বসে চা খেতে খোসগল্প করতে করতে জানিয়েছিল তার বড় ছেলের নাম আলী; সাথে সাথেই চট করে মনে পড়েছিল আরে আমি তো আরও কিছু আরবির অর্থও জানি! যেমন আবু মানে বাবা! সে হিসাবে আবু আলী মানে আলির বাবা। অতএব আবু ইয়াসির মানে নিশ্চিত ইয়াসিরের বাবা। এ কথা মনে হতেই,ফাহাদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা তাইসিরের ছেলের নাম কি ইয়াসির নাকি?
বেশ অবাক হয়ে চোখ কপালে তুলে বলেছিল ফাহাদ তাতে, “ইয়ান্নি, একদম ঠিক বলেছো! তা তুমি কিভাবে জানলে ওটা! তাইসিরের সাথে খুব খাতির হয়েছে নাকি তোমার?”
উত্তরে ‘কিছু কথা থাকুক না গোপন’ ভাব ধরে হেসেছিলাম শুধুই। একই সাথে ভাবছিলাম মনে, আমাদের দেশে, অন্তত গ্রামবাংলায় একটা বয়সে এসে নারী ও পুরুষ নিজেদের নামটি হারিয়ে যেমন, কুদ্দুস বা মজিদের বাপ বা মা নামে পরিচিত হতে শুরু করে, আরবি সংস্কৃতিতেও দেখছি তাই। ইউরোপ আমেরিকায় তা তো হয় না বলেই জানি। ওখানে তো আজীবনই মানুষ তার নিজ নামেই পরিচিত থাকে। এমনকি ছোট বাচ্চারাও তাদের চাচা, চাচি, খালা, খালু, ফুফা, ফুপ্পিকে আংকেল আন্টি ডাকার চেয়ে, ডাকে বেশী মিস্টার বা মিসেস যোগ করে তাদের নাম ধরেই।
থাকুক আপাতত ঐসব কথা। গতরাতের আগ পর্যন্ত এতদিন চিফ মার্কেটিং অফিসার হিসেবে নিজের জন্য যে খসড়া কর্মপরিকল্পনা করেছিলাম, এখন তো সেটি নিয়ে থাকলে আর চলবে না। তদুপরি ল্যাটিন থেকে ইংরেজিতে ঢুকে পড়া শব্দযুগল ‘স্ট্যাটাস কুয়াও’ বাংলায় যাকে বলা যায় স্থিতাবস্থা, তা ভাঙ্গতে আমার বেশ লাগে। ফলে এখানে ম্যানেজম্যান্টের ভাষায় যাকে বলে চেইঞ্জ এজেন্ট, চেইঞ্জ ড্রাইভার, ইত্যাকার ভূমিকা পালন করতে হবে শুনে, সেই থেকেই আছি বেশ উত্তেজিত। তদপুরি আছে এখানে ফিলের ভাষায় ইতিহাসের অংশ হবার সুযোগ। মোটকথা অবস্থা এক্কেবারে সোনায় সোহাগা। তবে এখানকার বড় যা চ্যালেঞ্জ তা হলো একে নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ তদপুরি ঐ তিন বিশাল বোঝার উপ শাঁকের আটি তো না, এক্কেবারে জগদ্দল পাথর হয়ে বসে আছে, আমাকে মিসকিন জ্ঞান করার এদের ভাবনাটি। এ সব মিলিয়ে আর রাত দেড়টার দিকে আমার ফ্ল্যাটে চা খেতে খেতে বসের কথা শুনতে গিয়ে, ঘুম চোখ থেকে হয়ে গিয়েছিল পগার পাড়। ঐ রকম অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে বারবারই তাই খেই হারিয়ে ফেলছিলাম সেই চিন্তার। ফলে ভেবেছি অফিসে এসে প্রথমেই একান্তে চিন্তা করে আগামী কয়েক মাস ধরে কী কী, কখন কখন করবো তা নিয়ে মগজে একটা খসড়া রোডম্যাপ তৈরি করবো। কিন্তু তা আর পারছি কই? ক্ষণে ক্ষণেই তো তাতে বাগড়া দিচ্ছে ঐ আবু আলী ও আবু ইয়াসির হাঁক।
নাহ, আসলেই উঠে গিয়ে বলবো নাকি ঐ দুই টম এন্ড জেরি নাকি দা কুমড়াকে যে বড়ই অসুবিধা হচ্ছে এতে আমার, ভাবছি যখন এমন তখনি বেজে উঠলো টেবিলের ল্যান্ডফোন–সাথে সাথেই ফোন কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আবু ইয়াসির মানে তাইসিরের শ্লেষ্মা জড়ানো কণ্ঠ ‘সালামালাইকুম মিস্তার সেলিম’ বলে উঠতেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে ওয়ালাইকুম বলেই, জানালাম মিঃ তাইসির, এখনো আমি মেইলবক্স চেক করিনি। যখনই করবো অবশ্যই আপনার মেইল পড়বো।
আমার উপরোক্ত কথা কটি শুনে তাইসির যা বলল তা শুনে বুঝলাম, নাহ ভুল করে ফেলেছি বিরক্তি আর উত্তেজনার কারণে। ওপাশের কথা পুরো না শুনেই নিজের বদ্ধমূল ধারণার উপর ভর করে ভুল উত্তর দিয়ে ফেলেছি। ব্যাপার হচ্ছে, বিশালদেহী ফিলের চেয়ে ঢের বিশালবপুর অধিকারী তাইসির, প্রতিদিন বহু কষ্টে পা টেনে টেনে হেঁটে হেঁটে অফিসে এসে একবার তার বিশাল বপু কে ধারণ করার জন্য বিশেষভাবে বানানো চেয়ারে বসে পরতে পারলে, একমাত্র টয়লেট যাওয়া ছাড়া ঐ চেয়ারচ্যুত হয় না সে। তো সে যেমন নিজে বসে থাকে সারাক্ষণ চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে, তেমনি তার কাছে কেউ কোন মেইল করলে সেটিও তার মেইল বক্সে গ্যাঁট হয়ে পড়ে থাকে অনির্দিষ্টকাল। আর মানুষ যেহেতু অন্যকে মাপে নিজের নিক্তিতে নিজেরই বাটখারা দিয়ে, সেহেতু তাইসিরের বদ্ধমূল ধারণা সেও যখন কাউকে মেইল করে সেটিও বুঝি প্রাপক ঐরকমভাবে অপঠিত অবস্থায় ফেলে রাখে। ফলে এখানে আসার পর থেকেই তাইসিরের ব্যাপারে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা হলো সে যাকে যখনি মেইল করুক না কেন, মেইলের সেন্ড বাটনে চাপ দিয়েই সে প্রাপককে ফোন করে মেইলটি তক্ষুণি পড়ার জন্য তাগাদা দেয়।
তো এই বদ্ধমূল ধারনার উপর ভিত্তি করে তাইসিরকে তড়িঘড়ি উত্তর দিতেই, সে যখন বলল না, তা নয়! ডাকছে সে আমাকে তার রুমে বসে চা খাওয়ার জন্য, তাতে একদিকে যেমন লজ্জা পেলাম নিজের ভুলের জন্য; অন্যদিকে একটু অবাকও হলাম। কারণ এই প্রথম পেলাম তার কাছ থেকে এরকম আমন্ত্রণ!
ফলে এই দুইয়ে মিলে, কিছুটা ধাঁ ধাঁয় পরে গিয়ে নিজ রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে তাইসিরের রুমে পা রাখতেই বিশালাকায় চেয়ারে তার বিশালবপুকে হেলিয়ে দিয়ে চেয়ারের কচ কচ খচ খচ কঁকানোর সাথে আকর্ণ হাসিতে শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠে তাইসির বলে উঠে “মিঃ সেলিম, তোমার সেলিম সোলায়মান এই নামটা যে আরবি আর অত্যন্ত কাব্যিক তা কি জানো ?’
নামটা আরবি, অবশ্যই তা জানি। তবে কাব্যিক যে তা জানতাম না ।
‘কে রেখেছে তোমার নাম?’ আমার আব্বা। ‘উনি কি কবি ছিলেন নাকি? আরবি ভাষায় তো ওনার বেশ ভাল দখল আছে মনে হচ্ছে। চমৎকার অর্থবহ আর ছান্দিক নাম রেখেছেন উনি তোমরা। মাশাল্লাহ !’ ‘মাশাল্লাহ, ইয়ানি ইউ নো আবু ইয়াসির, আই তোল্দ মিঃ সেলিম, বাঙ্গালী ভেরি ইন্তেলিজেন্ত।’
তাইসিরের বলা মাশাল্লাহর সাথে প্রতিধ্বনি তুলে পেছন এসে দাঁড়িয়ে ফাহাদ ঐ কথাগুলো বলতেই, বুঝলাম, মতলব তাদের ভিন্ন। তবে তা যে কী? বুঝতে পারছি না।
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক