(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নাহ, বেশ কিছুক্ষণ চোখ মুদে স্থির হয়ে শুয়ে থাকার পরও ঘুম যখন আসলো না চোখে, বেহুদা বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে প্রথমে মনে হল –আচ্ছা, একদিন যে রিয়াদ অফিসের সৌদি সহকর্মী ফাহাদ আল হিন্দি, যে নাকি আমার সামনে বাংগালিস্তুতিতে মুখরিত থাকলেও পেছনে আমাকে মিসকিন ডাকে, তাকে যে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, আমাদের দেশের প্রতিটা কৃষকই একেকজন কৃষিবিজ্ঞানী, তা যে খুব বাড়িয়ে বলিনি তার প্রমাণ তো আছে এই রিসোর্টেই। ইস এখন যদি কোন কারণে ফাহাদ আসতো, তবে তাকে হাতেনাতে দেখাতে পারতাম প্রমাণ, কিভাবে আমার দেশী ভাইয়েরা এই মরুতে পলিমাটির কৃষ্ণচূড়ার বীজ লাগিয়ে সে সব কে সার্থকভাবে অঙ্গুরোদগম করিয়ে অবশেষে পুষ্পে পল্লবে পরিপূর্ণ বৃক্ষেই পরিণত করেছে।
এই ভাবনার লেজ ধরেই মনে হল, আরে এও তো এক অবাক ব্যাপার! এটা তো মে মাস। দেশেও তো এপ্রিল মে মাসেই কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুন লাগে। এই মরুতেও ঘটেনি ব্যত্যয় তার! বহুকাল আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, নানান প্রাণী ও উদ্ভিদের বায়োলজিক্যাল ক্লক মানে জৈবিক ঘড়ি বিষয়ে একটা হাইপোথিসিস পড়েছিলাম। সেই মোতাবেক আল খোবারের মরু আলোকিত করা কৃষ্ণচূড়ারা তো দেখছি মাটি, জলবায়ু, সব কিছু উপেক্ষা করে তাদের সময়মতো ঠিকই ফুটেছে তারা। অথচ মানুষের তৈরি ঘড়িতো স্থান বদলের সাথে নিজেও বদলে যায় এখানে তো তা হয়নি।
নাহ “বৃথা এ সাধনা ধীমান।” কোন লাভ নাই বিছানায় গড়াগড়ি করে! ঘুম আমার হল বড়শি থেকে ছুটে যাওয়া মাছ বা সুতো ছিঁড়ে যাওয়া ঘুড়ি। একবার ছুটে গেলে বা ছিঁড়ে গেলে ফের তা ধরার সাধ্য কই আমার? অতএব উঠা যাক ।
অতঃপর বিছানা ছেড়ে আগের রাতের পরিকল্পনা মাফিক দুদ্দাড় করে প্রাতক্রিয়াদি সম্পন্ন করা, পোশাক পরা ও নাস্তা করার, প্রাতকালিন অবশ্য করণীয় সব বেশ ঢিমে তালে সেরে, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এই রিসোর্টের কৃষ্ণচূড়াগুলোর সাথে কুশল বিনিময় শেষে ৯টার কিছু আগে মিটিং রুমে গিয়ে হাজির হতেই দেখি, আমি এই বাঙ্গালই হলাম মিটিং রুমে আসা প্রথম ব্যক্তি!
তবে, ঘড়ির দেশ সুইজারল্যান্ডের কোম্পানির সুনাম রক্ষার্থে অচিরেই একজন বাদে সবাই এসে মিটিং রুমে হাজির হতেই, পোশাকে আশাকে এ মুহূর্তে স্মার্ট ক্যাজুয়াল বস ফিল রাশ জানালো, আমাদের স্ট্রাটেজি হেড মিশরি আহমেদ আল বাদাওউয়ি যেহেতু মিশর থেকে ফিরতে পারেনি সময়মতো, তার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নাই। এ বলেই তার স্বভাবসুল্ভ উচ্চ হাসি হাসতে হাসতে আমাকে উদ্দেশ্য করে চোখ টিপে কি যে বলতে চাইলেন, তা ধরতে না পারলেও, ব্যাপারটি যে ফিলের মোটেও পছন্দ হয়নি বুঝতে পারল সবাই তা। তাতে মিটিঙয়ের শুরুতেই একটু তাল কেটে যাওয়া ভাব হতেই, দ্রুতই গিয়ার বদলে সবাইকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলো ফিল, এই মিটিং টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার মানে এই নয় যে, সারাক্ষণই সবাই আমরা সিরিয়াস হয়ে কাজ করবো।
বরং প্রচুর ফান করবো আমার। আর ফানের ফাঁকে ফাঁকে সবাই মিলে যাকে বলে কিছু পাগলা আইডিয়া জেনারেট করবো। কারণ সৌদি মার্কেটের মতো আনপ্রেডিক্টেবল মার্কেটে আর সব দেশে যেরকম প্লান প্রোগ্রাম করে আমরা কাজ করতে অভ্যস্ত, তা কাজ করে না। এ হল তার অভিজ্ঞতা। আর এ কথা গুলো ফিল যে বিশেষত এই মার্কেটে নতুন এসে হাজির হওয়া আমি, ও সি এফ ও আমিন ইব্রাহিমের উদ্দেশ্যে বললেন, তা বোজা গেল পরিষ্কার।
তো আমাদের দুজনের উদ্দেশ্যে বলা কথাগুলো শেষ হতে না হতেই সময় ফিল তার বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন হঠাৎ -“হাই খলিল, হাউ ওয়াজ ইউর বাইরাইন এডভেঞ্চার !”
সাথে সাথে হাসির হল্লা বয়ে গেল রুমে। এদিকে ঘুম ঘুম চোখে কিছুটা ঝিমুতে থাকা খলিল থতমত খেয়ে সোজা হয়ে বসে জোর করে মুখে হাসি ঝুলিয়ে, অত্যন্ত যৌক্তিক সন্দেহে একবার আমার দিকে আরেকবার গিউসি দিকে তাকাতেই
বলে উঠল ফিল, “না না ওদের কোন দোষ নাই। ওদের সাথে তো আমার দেখাই হয় নাই রাতে। শোন খলিল, বসদের কিন্তু সব খবর রাখতে হয়। আর চোখও দু চারটা বেশী থাকতে হয় তদের। তবে এটাও ঠিক যে আমি তোমার পেছনে কোন গোয়েন্দা লাগাই নি। আরে এটা বোঝ না কেন, আমি তো এক বছরেরও বেশী সময় কাটিয়েছি তোমাদের মাঝে। তাতে কি আমি এটা জানি না, কোন উচ্চবংশীয় ধনবান সৌদি, সুদূর রিয়াদ থেকে গাড়ি চালিয়ে খোবার পর্যন্ত আসার পর, প্রথম সুযোগেই যদি একটু বাহরাইনে ঢু না মারে, তবে তো তার সৌদি নাগরিকত্ব থাকাই উচিৎ না। কি বলো?”
“ইয়ানি, ইউ নো মিস্টার ফিল, আই আম ফাইন ইভেন ইফ আই ডোন্ট স্লিপ ফর ওয়ান টু নাইট”
আমতা আমতা করে বলা খলিলের এই উত্তরে ব্যাপারটি যে আসলে তার স্রেফ রসিকতাই, তা বোঝানোর জন্য বলল ফিল, দ্যাট আই নো। আই এম রাদার ওয়ানডারিং হাউ কাম ইউ ফেইল্ড টু কনভিন্স সেলিম এন্ড গিউসি!
এটুকু বলেই প্রসঙ্গ পাল্টে জানালো ফিল, শোন আমি তো বলেছিই এটা ফর্মাল কোন মিটিং নয়। সেজন্যই আমি কোন লিখিত এজেন্ডা বানাতে বলিনি আমার সেক্রেটারি বা তোমাদের কাউকে। তবে এখন, তোমাদের একটা রাফ আউট লাইন দিচ্ছি। এখন থেকে শুরু করে ১২টা পর্যন্ত আমরা এই মার্কেটের নিয়ম অনুযায়ী হঠাৎ করেই জরুরি হয়ে উঠা কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। তারপর ঠিক ১২ টায় চলে যাবো বীচে সবাই, গোসল করার জন্য। ওখানে ধরো ঘণ্টা দেড়েক পানিতে ঝাপঝাপি শেষে, লাঞ্চ করবো এক সাথে।
তারপর আড়াইটার দিকে আবার বসব মিটিং এ, চলবে তা পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত, এর ফাঁকে চা কফি খাবো। তারপর ফের যাবো বীচে সূর্যাস্ত দেখতে। সূর্যাস্ত দেখা শেষে ঘণ্টা খানেকের ব্রেক। তারপর ৭:৩০ টায় ডিনার করে, শুরু হবে শিশা মিটিং। ঐ সময়টাই হবে আমাদের পাগলা আইডিয়া জেনারেশনের সময়। এভ্রি ওয়ান ইন দি রুম ফাইন উইথ ইট?
উত্তরে উচ্চস্বরে ওয়ান্ডারফুল, গ্রেট, দেটস কূল, এবসলিউটলি ফাইন ইত্যাকার শব্দে সম্মতি জানালাম উপস্থিত পাঁচজনা আমরা।
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক