দেশ হতে দেশান্তরে

আল খোবারের কৃষ্ণচূড়া : ১

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৫ মে, ২০২৫ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

আহ হা, কি শুরু হইল এই সাত সকালে! এই তো, মোবাইলের পর্দা নিশ্চিত করলো বাজে সবে সকাল সাতটা। মিটিং তো শুরু হবে সেই নয়টায়। সেই হিসাব কইরাই তো ফোনে এলার্ম দিয়া রাখছিলাম ৮টার। আধা ঘণ্টায় তৈরি হইয়া, আধা ঘণ্টায় নাস্তা সাইরা ঢুকবো গিয়া মিটিং। এই তো আমার বরাবরের অফিসিয়াল কারণে হোটেলবাসের হিসাব।

গতরাতে জ্যোৎস্নালোকিত বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ কুসুম থেকে শুরু করে দেশে ফেলে আসা পরিবারের কথা সহ অফিসিয়াল নানান চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুম এসেছিল, তা তো মনে নাই। তবে বরাবরের মতো শেষরাতে যে রকম আআর দুই চোখ তো নয় শুধু, সমস্ত শরীর ও মনের অস্তিত্বের একূল অকূল দুকূল ছাপিয়ে ঘুম আসে, আছে তো তারই রেশ এখনো সারা দেহে মনে ও অস্তিত্বে। আরো তো ঝাড়া এক ঘণ্টা ঘুমাতে পারতাম মুল্যবান ঘুম।

বাজাচ্ছে কে, এই সকালে দরজার ঘণ্টা? রুমের বীচমুখী টানা কাচের দেয়াল দিয়ে হরহর করে সরাসরি রোদ না হলেও তার আলো বিছানায় গড়াগড়ি করলেও, গরম তো লাগছে না। তদুপরি এয়রাকুলার তো চলছে পুরোদমে। বেশ মজাই তো লাগছিল। আমার এই বাড়া ভাতে কে দিল ছাই? কী কারণে? পড়লাম এ কোন যন্ত্রণায় সাত সকালে?

এ পর্যন্ত পর পর দুইবার বেশ সময় নিয়ে বেল যে বেজেছে, গিয়েছে কানে তা। তার আগে আরো বেজেছে কি না ঘণ্টা দরজার, জানি না। ঘুমঘোরে প্রথম ঘণ্টার সুরেলা আওয়াজ কানে গেলে সেটিকে এলার্ম মনে করেছিলাম, যদিও আওয়াজটা ভিন্ন ছিল। তার বেশ কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয়বার তা কানে যেতেই বাধ্য হয়ে ঘুম ঘোর ঝেড়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম যখন যে বাজছে ৭টা, ভেবেছিলাম প্রথমে ভুল করে ৭টাতেই এলার্ম দিয়েছিলাম কি না। কিন্তু হাতে নেবার পর ফোনের নিশ্চুপ নিরবতা জানালো, না সেই ভুল করিনি।

এসময় বেশ প্রলম্বিতভাবে ফের দরজার ঘণ্টা সুর তুলতেই, মেজাজ খিচড়ে গেলেও, সাথে সাথেই মনে হল, আরে বলা তো যায় না! হতে পারে গিউসি বা খলিল এই সাত সকালেই কোন ফন্দি এঁটেছে। এই রিসোর্টের কোন কর্মী নয়, হয়তো বাজাচ্ছে তারাই আমার দরজায় এই ঘুম তাড়ানিয়া ঢংকা নিনাদ। অতএব মেজাজ তো খারাপ করা চলবে না! তদুপরি তাদের এভাবে দরজায় অপেক্ষায় রাখাটাও শোভন নয়! অতএব তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে, দৌড়ে এসে দরজা খুলতেই চোখের সামনে যা প্রথমেই পড়লো তা হল সামনের গাছ গুলোর মাথা সব লালে লাল!

ওয়াও এ তো মনে হচ্ছে কৃষ্ণচূড়া। এতো এতো কৃষ্ণচূড়া এখানে কোত্থেকে এলো! নাকি অন্য কিছু?

আস সালামুয়ালাইকুম স্যার। ঠিকই আছে কৃষ্ণচূড়াই স্যার।”

আমার স্বগতোক্তির উত্তরে আমরি বাংলা ভাষার এ কথা ক’টি কানে যেতেই সেই কথার উৎসমুখের দিকে চোখ দ্রুত নিম্নগামী হতেই দেখি কটেজে ঢোকার মুখের তিনটি সিঁড়ির নীচের ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রিসোর্টের ধরাচূড়া পর একজন। সাথে তার বেশ বড় সড় একটা জবড়জং ট্রলি। ট্রলির নানান তাকে ঝলমলে সোনালি ট্রে আর প্লেটে সাজানো সকালের নাস্তার নানান পদ। ধড়াচূড়ার ফাঁক গলে তার মুখের যতোটা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, তাতে তার উপমহাদেশীয় চেহারার আদল ও রংয়ের আভাসের সাথে একটু আগে কানে ঢোকা মুখনিঃসৃত কথাগুলো সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত করলো যে দেশী ভাই আমার, সে। ঘটনা কি বলেন তো? এতো কৃষ্ণচূড়া এখানে কিভাবে?

কেন আমাগো দেশ থাইক্কাই আমরা আইন্নাই লাগাইছিলাম স্যার। আলহামদুলিল্লাহ! আপনে স্যার আমাগো দেশের! এখন আমারে একটু জায়গা দেন, আপনার নাস্তা দিয়া যাই”

আরেহ! এই আমি তো দেখছি ঘুমানোর পোশাকেই হাঁটাহাঁটি করছি বাইরে। নাহ, দ্রুত নিজ কটেজে ফিরতে হবে! কপাল ভাল সকালের এই সময়ে এখনো বের হয়নি কেউ নিজ নিজ কটেজ থেকে।

আল খোবারের মরুর বুকে হঠাৎ করেই চোখের সমানে মাথাভর্তি লাল ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলো দেখে, দরজা থেকে নেমে আনমনেই চলে এসেছিলাম, ঐ গাছগুলোর কাছে। এখন নিজের ইজ্জত তো নয় শুধু, তারচেয়েও বড় ব্যাপার দেশেরও ইজ্জতের কথা মনে হতেই চালালাম পা দ্রুত, যাতে কারো চোখে না পড়ে এক বাঙ্গাল ঘুমানোর পোশাক পরে বেকুবের মতো এই রিসোর্টে করছে মর্নিংওয়াক।

দ্রুত পায়ে ফিরে বসার ঘরে পা দিতেই দেখি, শোফার সামনের লম্বা টেবিলসহ পাশ টেবিলেও সেই দেশী রিসোর্ট কর্মী, ব্রেকফাস্ট সূচারু রূপে সাজিয়ে রেখে গেছে আমার। তাতে সব টেবিলেরই উপচে পড়া অবস্থা। আমি তো মনে করেছিলাম ঐ ট্রলিতে করে সে বুঝি নানান কটেজের জন্য নাস্তা নিয়ে ঘুরছিল। এখন তো মনে হচ্ছে গোটা ট্রলিটাই উগড়ে দিয়ে গেছে এইখানে। এরাবিয়ান, ইজিপশিয়ান, মেডিটেরিনিয়ান ও আম্রিকান নাস্তা মিলিয়ে যে ক’টা ডিস রেখে গেছে, তাতে আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের সেই আব্দুর রহমানের কথাই মনে পড়লো। আসলে এরই মধ্যে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে বুঝেছি তাতে খাদ্য অপচয়কারী হিসেবে সৌদিরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে নির্ঘাত! হায়রে একসময় তো জানি এই জনপদের লোকজন, এক আধ খান খেজুরের সাথে দুই এক টুকরা শুকনো রুটি খেয়েই নাকি দিন গুজরান করতো। আর এখন তারা যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করে প্রতিদিন, সেই উচ্ছিষ্ট যদি সুদান, ইয়েমেন বা ইথিওপিয়ায় পাঠানো যেত, তাতে ঐদিন ঐখানে কোন মানুষকে ক্ষুধার্ত থাকতে না। ভাবতে ভাবতে এসব, শোবার ঘরে এসে গা লাগালাম ফের বিছানায়।

লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদ্রোহের আগুনে দগ্ধ, প্রেমের সুরে ভাসা এক অনন্ত কণ্ঠ
পরবর্তী নিবন্ধনারী ভাবনায় কবি নজরুল