দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৬ মার্চ, ২০২৫ at ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বিনা প্রশ্নে দ্রুত নিষ্ক্রমণ

বেশ দ্রুতই দরজার দিক থেকে আগুয়ান মচমচ জুতার শব্দে বুঝলাম তসরিফ রাখছেন অচিরেই মোহাম্মেদ হাশিশ। সেই প্রথম দিন পরিচয় হবার পর থেকে একে দেখলেই, আমার যা মনে হয় তা হলো, আমাদের দেশের মতো এই আরবেও চাঁদ, সুরুজ নামে মানুষের নাম রাখা হয় যেমন, তেমনি মানুষের নাম জামাল, মানে উটও রাখা হয়। এই নাম গুলো আরবিতে হলে আমাদের দেশে সে গুলোকে অত্যন্ত পবিত্র ও ইসলামী মনে করা হয়, তাই ওসব নামের বেশ কদর ওখানে। তবে আমাদের দেশের বেয়াক্কেল আনপড় আতরাফ জাতের মোসলমানেরাও একসময় তাদের পুত্রদের জন্য পঁচা মিয়া, ঝাড়ু মিয়া, ইত্যাকার নাম বরাদ্দ করলেও, কেউ তাদের পুত্র বা কন্যার নাম আফিম, গাঁজা বা তামাক রেখেছে এমনতো শুনিনি। কিন্তু এরা তো দেখছি সেটাও ছাড়ে না। আচ্ছা আরবিতে হাশিশের অন্য কোন অর্থ আছে কি না , সেটা এক সময় জেনে নিতে হবে। মনে আমাদের যে সব কথা সতত উড়াউড়ি ঘোরাঘুরি করে তার সব তো আমরা বলি না , কারন বলা তো যায় না তা নানা কারনেই। সেরকমই হাশিশকে অনেকবারই জিজ্ঞেস করবো করবো ভাবলেও, এখনো জিজ্ঞেস করিনি তার নামের উৎপত্তি ও বুৎপত্তি কী?

এদিকে খোলা দরজা পেরিয়ে আগুয়ান হাশিশ, টেবিলের সামনের চেয়ারে হাসিমুখে সারবিনিকে বসে থাকতে দেখে, দ্রুত মহসিনের উপর ঘোরতর তীব্র উষ্মা উগরে দিতে দিতে বলল, মহসিন মোটেও সময়ের কাজ সময়ে করে দেয় না কখনই তার মজ্জাগত অলসতার দোষে । তদুপরি মার্কেটিংয়ের যে কোন কাজ তার কাছে গেলেই, ফেলে রাখে সে তা। এ ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুতর এবং এ ব্যাপারে সে আমার দ্রুত কার্যকরী একশন দেখতে চায়। সাথে যোগ করলো আরো যে, এখন এই ব্যাপারে বোঝার উপর শাঁকের আটি হয়েছে কমপ্লায়েন্সের আহমেদ মেতওয়াল্লি। এদের কারনে মার্কেটিং এর সব কাজ স্থবির হয়ে যাবে অচিরেই!

টেবিলের ওপাশে প্রজ্বলিত ঐ উষ্মার আগুনে দ্রুত পানি ঢেলে দেয়ার মানসে, বললাম মাদের ব্যবসায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক সব কিছুই দেখবো আমি অবশ্যই। আপাতত সে যেন এই ডকুমেন্ট দুটো পড়ে, ওগুলোর সারসংক্ষেপ বয়ান করে দ্রুত আমাকে। কারণ সারবিনি এই দুটো কাগজের অভাবে তার পরিকল্পিত সাইন্টেফিক মিটিং নিয়ে চাপে পড়েছে । আর আমি মোটেও বুঝতে পারছি না, কেনইবা এইগুলো নিয়ে তাকে এখন দু দুটো পুলিশের অফিসে যেতে হবে ?

আমার কথায় একটু থমকে গেলেও দ্রুতই তা শিরোধার্য করে ডকুমেন্টস দুটোতে চোখ বুলিয়ে জানালো হাশিশ যে, ঐ চিঠি দুটো দেয়া হয়েছে যথাক্রমে, রিয়াদের মোতাওয়া এবং স্বরাষ্ট্র পুলিশ অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বরাবর । বিষয়বস্তু, সারবিনি কথিত সেই চিকিৎসা বিষয়ক বৈজ্ঞানিক সেমিনারের টাইটেল, তারিখ ও স্থান জানিয়ে সেই মোহতারেমদের সদয় অনুমতি প্রার্থনা!

আমাদের কোম্পানির মতো গবেষণানিভর্র ঔষধ কোম্পানি তাদের নব নব আবিষ্কার নিয়ে চিকিৎসা বিষয়ক নানান সেমিনার করবে সেটাই স্বাভাবিক। আর সেটি ঠিকঠাক মতো করার জন্য কোম্পানির নিজস্ব আভ্যন্তরীণ এপ্রুভাল প্রসেসের বাইরে, বাইরের কোন কর্তৃপক্ষ থেকে যদি থেকে অনুমতি নিতেই হয়, নিতে হতে পারে তা সংশ্লিষ্ট দেশের স্বাস্থ্যবিভাগ বা ঔষধ প্রশাসন থেকে। যদিও তেমন লাগে কোথাও, শুনিনি এমনও। না লেগেছে তা কখনো বাংলাদেশে, না সিঙ্গাপুরে। মিশরে লাগে নাকি? তাহলে এখানে পুলিশ ও মোতাওয়ার অনুমতি নিতে হবে কেন? কী কারণে?

না মিশরেও ঐরকম অনুমতি লাগে না। তবে এটা সৌদির নিয়ম।“

আহা, বুঝলাম তো যে, এটা এখানকার নিয়ম। কথা তো তা না। জানতে চাচ্ছি আমি যে এখানে এরকম আচানক নিয়ম আছে কেন?

হাশিশের ঐ গড়পড়তা তো না, এক্কেবারে আমজনতা মার্কা উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পেরে, ফের তাকে এই “কেন” মার্কা প্রশ্নটি করে সাথে সাথেই যখন বুঝলাম, নাহ অপাত্রে ঘি ঢেলে লাভ নাই। লাগসই উত্তরের অভাবে মেজাজ খারাপই হবে তাতে বরং। অতএব নিজ মনে হার্ডব্রেক চাপার সাথে মনে হলো , মানবসমাজে “কেন”র উত্তর খোঁজা বা কোন কিছুর কার্যকারণ নির্ণয়ের পেছনে সময় ব্যয় করা লোকের সংখ্যা সকল দেশে ও সমাজেই অতিবিরল। হাশিশ অবশ্যই সেই বিরল জাতের মানুষ নয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী হলেও বুদ্ধিমত্তা ও সহজাত কৌতূহলের নিরিখে নিতান্তই সাধারণ মানের সে, যারা নাকি বিনাপ্রশ্নে মেনে নেয়, সবকিছু !

কথা আর না বাড়িয়ে তাই, চিঠি দুটো দ্রুত সই করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রথমে মনে হল, নাহ অচিরেই বেরুতে হবে ফিল্ডওয়ার্কে। কোন দেশের, সমাজের বা জায়গার প্রচলিত নিয়ম কানুন, জীবন যাপনের সংস্কৃতি জানতে বুঝতে চাইলে, ফিল্ডওয়ার্ক হল অত্যন্ত কার্যকারী উপায়। যে কোন সমাজের মানুষের জীবনাচরণের লিখিত অলিখিত নানান নিয়ম কানুন প্রথা নিয়ে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় সেই সমাজের মানুষদের বিবিধ রোগ সম্পর্কিত রোগী সংস্কৃতি। ঔষধ কোম্পানির বিপণনবিদদের যা জানা অতি জরুরি।

এভাবে ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকে বলা চলে এক্কাবারে ঘাড় ধরে, এরকম একটা নিতান্তই রুটিন বিষয়ে মনোযোগী হতে বাধ্য করে এইমাত্র বুঝিয়ে দিয়েছে এরা আমাকে যে, দিতে হবে নজর কোন দিকে জরুরি ভিত্তিতে!

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসন্দ্বীপের প্রধান সড়কগুলো জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার ও প্রশস্ত করা হোক
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ