দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

কানাকড়ি ও ফুটো পয়সা
কিছুক্ষণ আগেই সবাইকে নিয়ে এসে পা রেখেছি নীচ তলার এই প্রাচীন চায়নার রাজত্বে। চমৎকার আলোআধারিতে মোড়া সুবিশাল এ কক্ষে এসে যদি বলি চোখ ধাঁধিয়ে গেছে তবে যে কেউ এর বিরোধিতা করতে পারেন বিজ্ঞানসম্মতভাবে। অতএব বলছি আসলে মন ধাঁধিয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে এরই মধ্যে দেয়ালে আর নানান পুরাকীর্তি পাশে লাগানো নানান ইংরেজি ভাষ্য বলছে, আদ্দিকালের চায়নার পুরাকীর্তিতে সাজানো যাদুঘরের এই অংশটি সাজানো হয়েছে নানান রাজ বংশের সময়কার পুরাকীর্তি দিয়ে। যার অনেক গুলোই খ্রিস্টপূর্ব হাজার দু হাজার বছর আগেকার পুরাকীর্তি। কিন্তু ওইভাবে চায়নার নানান রাজবংশের রাজত্বকাল ধরে ধরে দেখতে গেলে যে চলবে না সে তো আগেই বলেছি। অতএব দেখাদেখি বাদ দিয়ে শুধু হেঁটেই বেড়াতে হবে, এবং করবোও তাই।
চায়নার যাদুঘরে চিনামাটির তৈরি তৈজসপত্র, ফুলদানি থাকবে না, তা তো হয় না। অতএব আছেও তা সুপ্রচুর। নানান আকারের ঐ সব ফুলদানীর যতগুলোই নজরে পড়ল হাঁটার উপরে, তার সবগুলোই হল সাদা আর নীল রঙয়ের। মানে ফুলাদানিটি ঝকঝকে সাদা চিনামাটি দিয়ে তৈরি হলেও, তার উপরে আঁকা কারুকাজগুলো হল সবই নীল রঙয়ের। আচ্ছা চীনারা কি প্রাচীনকালে এই নীল রং বাদে অন্য কোন রঙয়ের খোঁজ পায়নি না কি? এমন ভাবতেই ঠিক তখনি ডান দিকের দেয়াল সংলগ্ন কাঁচের শোকেসে রাখা অপূর্ব সুন্দর ফুলদানী দুটো নজর পড়তেই এগিয়ে গেলাম।
লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, আর অতি অবশ্যই নীল ইত্যাদি সব নানান রঙয়ের ঠাসবুনটে রাঙ্গানো, অপূর্ব কারুকার্যময় ফুলদানী দুটো দেখে এবারে আসলেই এই আলো আধারিতেও মনের সাথে চোখও ধাঁধিয়ে গেল। ওগুলোর নীচ দিকটায় একটা পিতলের প্লেটে যা লেখা আছে তার মধ্যে পাঠযোগ্য অংশ জানান দিল বয়স এগুলোর হাজার বছরের উপরে!
“বাবা বাবা এদিকে এসে দেখে যাও” হাত ঝাকাতে ঝাকাতে দীপ্রর আকুল এই ডাকাডাকিতে রওয়ানা দিলাম ওর পিছু পিছু , আবারো পেছন দিকেই, মানে যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম সেদিকটার দিকে। ঐদিকটায় একটু দূরে দেখছি অভ্র গভীর মনোযোগ দিয়েছে দেয়ালসংলগ্ন আরকেটা শোকেসে। দীপ্রর সাথে যাচ্ছি এ মুহূর্তে সেদিকেই। বোঝা গেল দুই ভাইয়েরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে বিশেষ কিছু , যা দেখানোর জন্য ছোট ভাইকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে, দীপ্র এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে। বেখেয়ালে হাঁটতে গিয়ে এভাবে পুত্রদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায়, নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিচ্ছি যখন, তখনই দেখলাম যে নাহ, ওদের মা আর ফুপ্পি আছে আশেপাশেই আমিই শুধু হেঁটে গিয়েছিলাম একাকী সামনের দিকে। “এই যে দেখ ওল্ডেস্ট মানি অব দি ওয়ার্ল্ড “ দীপ্রর সাথে গিয়ে পেছনে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরিয়ে বলল অভ্র।
আরে! আসলেই তো! নানান রকমের ধাতব মুদ্রা দেখছি সাজানো আছে ঐ শোকেসে। যার মধ্যে আছে ফুটো পয়সারও ছড়াছড়ি। আমাদের দেশেও নাকি ফুটো পয়সার চল ছিল এক সময়। নিজ চোখে ঐরকম চলতি ফুটো পয়সা কখনো দেখিনি, যদিও পাঠ্যবই আর সাহিত্যে পড়েছি ঐ ফুটো পয়সার কথা। তবে এটাই যে আমার প্রথম ফুটো পয়সা দেখা, তা নয়। আগেও দেখেছি এরকম ফুটো পয়সা অন্যসব যাদুঘরে। এখানে সাজিয়ে রাখা দুই তিন হাজার বছরের পুরানো এই ধাতব মুদ্রাগুলো দেখে মনে হচ্ছে এগুলো সম্ভবত তামার বা ব্রোঞ্জের তৈরি।
“বাবা, বাবা ঐ ছোট্ট ছোট্ট ছুরি গুলো আর চাবিগুলো এখানে রেখেছে কেন ? “শোকেসের ভেতরে গোলাকার ঐ ফুটোযুক্ত বা ফুটোমুক্ত প্রাচীন মুদ্রাগুলোর সাথেই রাখা ব্রোঞ্জ না কি তামার তৈরি ছোট্ট ছোট্ট আকারের ছুরি আর চাবিগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল দীপ্র এবার। দাঁড়াও দেখে নেই, পড়ে নেই ঐ লেখাটার যতোটুকু ইংরেজিতে লেখা আছে তা। তার পর বলছি। আর তোমরাও তো পড়ে দেখতে পারো। দেখো না। পড়ে দেখ, বলে দু ভাইকে উৎসাহী করতে করতে নিজেও পড়তে শুরু করলাম -নাহ তেমন বিশেষ কিছু লেখা নাই ওখানে ওগুলোর ব্যাপারে আলাদা করে। যা লেখা আছে তা হল ওগুলোর সময়কাল আর কোথায় পাওয়া গেছে এই সব। আর এগুলো যে সব মুদ্রাই, তাও লেখা আছে। এতে ধরে নিতে হয় ঐ চাবি আর ছুরি আকারের ধাতব বস্তুগুলোও আসলে মুদ্রাই । সেটাই ছেলেদের জানাতেই -“আচ্ছা বাবা ঐ কয়েনগুলোতে ছিদ্র করে রেখেছিল কেন ওরা?” ফের প্রশ্ন দীপ্রর -আরে এটা কি একটা প্রশ্ন হল? ফুটো পয়সায় ফুটো থাকবে না তো থাকবে তা কোন পয়সায়? আর নামই যার ফুটো পয়সা, তাতে ফুটো না থাকলে তো তার ফুটো পয়সাও দাম থাকে না! নাহ এইসব মনের ভেতরে খলবল করা এসব কথার একটাও মুখে উচ্চারণ করিনি। শুধুই ভেবেছি মনে মনে। আর ভাবতে ভাবতে বুঝে গেছি এই সহজ প্রশ্নের উত্তরও আমার জানা নেই। অথচ শুরুতেই কি না ভেবেছিলাম এ আবার কি ফালতু ছেলেমি প্রশ্ন করছো রে বাবা? এ মুহূর্তে নিজের সবজান্তা ভাবের বেলুনটি ফুটো হয়ে যেতেই আমতা আমতা করে বললাম, তা তো জানি না বাবা। তবে হতে পারে এই পয়সাগুলোকে দড়িতে গেঁথে কোমরে বেঁধে যাতে বয়ে বেড়ানো যায় সহজে তাই হয়তো ফুটো করা হতো।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টল গৌরবদের জানাই অভিনন্দন
পরবর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলনে নারী