দেশ হতে দেশান্তরে

বিনা প্রশ্নে দ্রুত নিষ্ক্রমণ

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৯ মার্চ, ২০২৫ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

হাতে নেয়া কাজে ডুবেছিলাম গভীর মনোযোগে, পাইনি টের তাই ঢুকেছে কখন মহসিন। সেই প্রথম পরিচয়ের ক্ষণ থেকেই দেখেছি, যাপিত জীবনের সকল দুঃখ বেদনা নিরাশা হতাশা সব একাট্টা হয়ে সার্বক্ষণিকভাবে মহসিনের ঘাড়ে মাথায় চেপে বসে থাকায় মহসিনের মুখশ্রীর মুখোমুখি হলে নিজেরও কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়। ফলে কোন কাজে সে আমার শরণাপন্ন হলে, কিম্বা বসের সেক্রেটারি হিসেবে তার কাছে কোন কারণে নিজেরই যেতে হলে, সেরে ফেলতে চেষ্টা করি তা ঝটপট। এখনো তাই তার উপস্থিতির ব্যাপারে সচেতন হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই, হাতের ফাইলটি টেবিলে রাখতে রাখতে ভারতীয় উচ্চারনের ইংরেজিতে মিন মিনে আওয়াজে ত্যক্ত বিরক্ত ভঙ্গী ও স্বরে জানাল

অত্যন্ত জরুরী দুটি চিঠি আছে এতে। এক্ষুনি তা সই করে দিলে ভাল হয়। কারণ ঐ চিঠি দুটোর জন্য, এরই মধ্যে মিশরিদের মজ্জাগত বদঅভ্যাসমাফিক, তার জান একদম ফানা ফানা করে ফেলেছে আমারই কোন এক প্রডাক্ট ম্যানেজার।

জানতে চাইলাম, কোন সে প্রডাক্ট ম্যানেজার, দিয়েছে তাকে এরকম জরুরি এলান? ইতোমধ্যে মহসিনের সাথে কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, তারই নিরিখে করা এ প্রশ্নের জবাবে মহসিন হায়দারাবাদি এ যাবতকালে যতোটা বুঝেছি তার স্বভাব, সেটিকেই নিশ্চিত করে, প্রাসঙ্গিক নামটির খোঁজে মনে মনে বাতাস হাতড়াতে হাতড়াতে, মুখে আমতা আমতা করতে থাকায়, বললাম

শেষ হোক হাতের কাজ আগে। তারপর চিঠি দুটো পড়ে সন্তোষজনক মনে হলেই তা সই করবো । আর এরই মধ্যে এ মুহূর্তে সে যার নাম মনে করতে পারছে না, আমার সেই প্রোডাক্ট ম্যানেজার যদি তার কাছে গিয়ে ফের উৎপাত করে, তবে সে যেন সেই জনাবকে সোজা এখানে পাঠিয়ে দেয় ।

আমার কথা শুনে কেমন যেন একটু বিভ্রান্ত হয়ে, “ওকে স্যার”, “ওকে” “ওকে” বলতে বলতে বেরিয়ে গেল মহসিন ।

এখানে এসে কাজে যোগ দেবার পরমুহূর্ত থেকেই, এখানকার কাজের ধরণ ধারনের ব্যাপারে সামান্যতম ধারণা তৈরি হবার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম পরিষ্কার যখন যে, ঐসব বোঝাবুঝির কাজ সারতে সারতেই চালু রাখতে হবে দৈনন্দিন অপারেশনাল কাজও। তদুপরি এখানকার নানান জনের কথিত ও অকথিত ভাবেভঙ্গিতে আর মনে হয়েছে যে, দৈনন্দিন কাজে কোন ছন্দপতন ঘটলে, এমন শোরগোল তৈরি হবে তাতে মনে হবে এ মুহূর্তেই তাহলিয়া স্ট্রিটের আমাদের অফিসটির উপর বুঝি পুরো আকাশই ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় শুরুর দিকে দিন দুয়েকের মধ্যেই জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, যে সব কাজ অত্যন্ত জরুরি ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো অবশ্যই ছেড়ে দেবো আমি দ্রুত। প্রয়োজনে বিনা প্রশ্নেও ছেড়ে দিতে পারি। ফলাফল? অচিরেই শুধুই অতীব জরুরি ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে ফাইলে আমার টেবিল উপচে উঠতে থাকলো! এতে বাধ্য হয়েই বদলাতে হয়েছিল আমার সেই “বিনা প্রশ্নে দ্রুত নিষ্ক্রমণ”কর্মকৌশল।

এখন কথা হচ্ছে দুটো । প্রথমত, আমি ঐ চিঠি দুটো পড়ার পর সই করবো বলায়, মহসিন একটু যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, কিম্বা তাকে যে বিভ্রান্ত মনে হলো, তা হলো কেন? দ্বিতীয়ত মহসিন হলো, কান্ট্রি হেডের সেক্রেটারি, তাকে দিয়ে কেনইবা কাজ করাতে গেছে আমার প্রডাক্ট ম্যানেজার? কী ই বা সে কাজ?

আসসালামুয়ালাইকুম ডক্টর। মে আই কাম ?”

সারা মুখে বালসুল্‌ভ হাসি লেপটে দরজায় উঁকি দেয়া, সুটকোটটাই শোভিত বিশালবপু সম্ভাব্য মিশরি এই যুবককে দেখেছি বেশ অনেকবারই অফিসের করিডোরে ও নানান জায়গায়। সেসব দেখা সাক্ষাতে দুজনের মধ্যে সৌজন্যসুলভ সালাম বিনিময় হলেও তার সঠিক পরিচয় জানার সুযোগ আমার না হলেও, সে যে নিশ্চিত আমার পরিচয়ের ব্যাপারে, বুঝতে পারছিলাম তা তার সশ্রদ্ধ দেহভঙ্গিতে। কী জানি? কী কাজে এসেছে এখন সে? ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে তার সালামের জবাব দিতে দিতে, টেবিলের সামনের ভিজিটর চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করতে করতে দিলাম বাড়িয়ে হাত, হাত মেলানোর জন্য-“মোহাম্মদ আল সারবিনি। সিনিয়র মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, স্যার।” হাত মেলাতে মেলাতে নিজের নাম এবং পদের উল্লেখ করতে করতে জানালো সে আরো, এইমাত্র মহসিন তাকে জানিয়েছে তার অতি প্রয়োজনীয় ও জরুরী দুটি চিঠির অবস্থান হল এ মুহূর্তে আমার টেবিলে। দয়াপরবশ হয়ে আমি যদি দ্রুত সে গুলো হস্তান্তর করি, তাতে তার সমূহ উপকার হয়। তুমুল চাপে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা তার ব্যাপারটি নিয়ে!

বুঝলাম একটু আগে মিন মিন করে অতি জরুরী বলে যে ফাইলটি রেখে গেছে মহসিন আমার সইয়ের জন্য, বলছে সারবিনি সেটিরই কথা। সারবিনির মতো নিজ দেশে একসময় নিজের চাকুরী জীবনের শুরুটাও হয়েছিল রিপ্রেজেন্টেটিভ পদেই। জানি তাই ঐ পদের লোকজনদের সুখ দুঃখের আগাপাশতলা হাড়ে হাড়ে। ফলে এই পদের যে কারোরই প্রতি আছে আমার বিশেষ পক্ষপাত। একটু আগেই যদিও ভেবেছিলাম, হাতের কাজ শেষ করেই ঐ ফাইলের ডকুমেন্ট পড়ে সন্তোষজনক মনে হলে সই করবো তা, সারবিনির সম্মানে সেই মত বদলে, এক্ষুণি সে কাজ সম্পন্ন করার নিমিত্তে ফাইলটি টেনে ভেতররে ডকুমেন্ট দুটো বের করতেই চোখ হয়ে গেল ছানাবড়া

আরে! দুটো ডকুমেন্টই তো দেখছি খাস আরবিতে লেখা! দেখতে দুটো একই হলেও আসলেই তা একই কি না বুঝতে পারছি না। ছোটবেলায়, বিশেষত আম্মা কর্তৃক নির্ধারিত একটি বয়সের মধ্যে পবিত্র কোরান খতম করার অলঙ্ঘনীয় ও অমোঘ টার্গেট পূরণ করার লক্ষে প্রাণপণে আব্বা ও আম্মার কাছে আরবী পড়ার যে সবক নিয়েছিলাম, তাতে ভর দিয়ে এখনো অতি চেনা পবিত্র কোরান পড়তে পারলেও, অর্থ তো বুজি নাই কখনই তার। এখনও অচেনা এই ডকুমেন্টদ্বয় হোঁচট খেয়ে খেয়ে, সময় নিয়ে পড়তে যে পারবো, তা নিশ্চিত। তবে মাথা মুণ্ডুও তো বুঝবো না।

বুঝতে পারছি এখন, ঐগুলো পড়ার পর সই করবো বলায়, কেন বিভ্রান্ত হয়েছিল মহসিন। তবে সমস্যা কী? এই মুশকিলের আসান, তো সামনেই হাজির। সারবিনি তো মিশরি। অতএব তার দিকে চিঠি দুটো ঠেলে দিয়ে বললাম, দেখো তো কি লেখা আছে এগুলোতে?

একথা শুনেই ঐ ডকুমেন্টগুলো পড়ার বদলে, দ্রুত হড়বড় করে জানালো সারবিনি, এগুলো যে কী সে তা জানে না! . হাশিশ বলেছে তাকে, এগুলোর একটা নিয়ে রিয়াদের একটি নির্দিষ্ট মোতাওয়া মানে শরিয়াহ পুলিশের অফিসে, আরেকটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন পুলিশের অফিসে জমা দিয়ে অনুমতি নিতে হবে । এগুলোর জন্য তার একটা সাইন্টেফিক সেমিনার যেটি নাকি তিন দিন পর হওয়ার কথা, সেটি আটকে আছে! এ নিয়েই সে লবেজান পেরেশান এই মুহূর্তে তার এমত বয়ানে কর্মজীবনে দেশে অহরহ দেখতে পাওয়া অতি পরিচিত একটি চরিত্রের দেখা, এ মরুতেও মিলে যাওয়ায় মুচকি হেসে, দ্রুত অফিস বয়কে ফোন করে তিন কাপ চা দেবার ফরমায়েস দিয়ে, জরুরি এলান দিলাম প্রোডাক্ট ম্যানেজার মোহাম্মদ হাশিশকে। (চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজয় হোক নারীর
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর