“ওয়েলকাম টু দিস বি–জাআ ল্যান্ড বাডি! হোপ সাউদি ইজ ইয়েট টু শক ইউ সেলিম! ওয়েল জাস্ট গি মি ফিউ মোমেন্টস, গাইস! ” দরজা ঠেলে রুমে পা দিতেই, বিশালকায় টেবিলের ওপাশে নিজ আসনে বসে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে চোখ তুলে দেখার সাথে হাত নাড়িয়ে, নাকেমুখে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে ধোঁয়ার চাদরের ওপাশ থেকে স্বভাবগত উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে বলল বিশালদেহী ফিল রাশ!
নাহ খুব একটা বদলায়নি ছোট করে ছাটা এক মাথা কাঁচা পাকা চুলের ফিলের চেহারা। পোশাকে আশাকেও আছে একই। খুব যে বেশি দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল ফিলের সাথে, তা কিন্তু নয়। তবে কিছু কিছু মানুষের সাথে একবার দেখা হবার পর, কথাবার্তা হবার পর, অনেক অনেকদিন পরও দ্বিতীয়বার দেখা হলেও যেমন তাকে মনে হয় অতিচেনা, ফিলের সাথে আমার এই দ্বিতীয় দেখায় এবং তার উচ্ছ্বসিত ও আন্তরিক সাদর সম্ভাষণে ঐরকমই ফিল করলাম, এ মুহূর্তে!
বছর তিন কী চার আগে ফিলের সাথে দেখা হয়েছিল প্রথম ব্যাংককে। কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে সে তখন একটা বিজনেস ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে, তার বিজনেস ইউনিটের ব্যবসা বাড়ানোর কৌশল বিষয়ক একটা কর্মশালা পরিচালনা করতে এসেছিল বাসেল থেকে উড়ে সেসময় ব্যাংককে।
সেই কর্মশালার শুরুতে, ডকার্সের বাদামি গ্যাবাডিন প্যান্টের উপর ডাবল নাকি ট্রিপল এক্সেল সাইজের টিম্বারল্যান্ড ব্র্যান্ডের ঢল ঢলে সুতি চেক শার্ট আর গাব্দা গোব্দা পায়ে কোনক্রমে দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় নিজেদের স্থান করে নেয়া বাদামি লোফার পরা ফিল, নিজের পরিচয় দিচ্ছিল যখন, তখন তাকে বিশ্বখ্যাত বৈশ্বিক কোম্পানির বড় হর্তাকর্তা বা যাকে বলে কর্পোরেট বস, তা মনে হয়নি মোটেই! বরং মনে হয়েছিল হতে পারে সে কোন পেশাদার আম্রিকান সকার বা রাগবি দলের কোচ।
সেইরকমই দেখছি ফিলকে এখন। সে বার তাকে প্রতিদিনই নানান রং আর প্যাটার্নের টিম্বারল্যন্ড ঢলঢলে হাওয়াই শার্ট আর ভিন্ন ভিন্ন বাদামি সেইডের ডকার্স ট্রাউজারে যেমন দেখেছিলাম, আজো সম্ভবত তাই আছে। টেবিলের ওপাশে বসে থাকায় ট্রাউজারের হদিস না করতে পারলেও, গায়ের হাল্কা নীল সাদা চেকের খাঁটি সুতির ঢল ঢলে এই শার্টটিও যে টিম্বারল্যান্ডের, তা তো দেখাই যাচ্ছে পরিষ্কার, শার্টিটি পকেটে এমব্রয়ডারি করা লোগোতে। আচ্ছা, টিম্বারল্যান্ডের প্রতি কী ফিলের বিশেষ কোন পক্ষপাতিত্ব আছে নাকি?
এছাড়াও এ রুমে পা দেবার পর এরই মধ্যে আরো যে তিনটি জিনিস নজরে পড়েছে বিশেষভাবে, তা হল টেবিলে ল্যাপটপের পাশে রাখা আমাদের দেশের কাসার থালার মতো বিশাল আকারের একটা কাঁচের ছাইদানি, যাতে এরই মধ্যে জমা পড়েছে গোটা ছয় সাত সিগারেটে ফিলটার, তার পাশেই আধাআধি পড়ার পর উল্টা করে রাখা আছে একটা বইয়ের পাশে। আছে বই আরো কটা এলেমেলো ভাবে বুক চিতিয়ে টেবিলে! তার চেয়ার থেকে পাঁচ ছয় ফিট দূরে, ধ্যানি সারসের মতো এক ঠ্যাং এ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে একটা কোট রেক, সারা গায়ে হাল্কা ধুলোর আস্তর মেখে বড় অবহেলায় ঝুলতে ঝুলতে একটা নীল ব্লেজার আর লাল টাই, কাতর নয়নে তাকিয়ে আছে চেয়ারাসীন ফিলের দিকে! মোটকথা জন্মগতভাবে বৃটিশ হলেও পরবর্তীতে আম্রিকান নাগরিকত্ব নেয়া ফিলের পোশাক আশাক থেকে শুরু গোটা রুমের অবস্থা পুরাই আম্রিকান! শুধু, এরই মধ্যে তার সাথে যতো বাত চিত হয়েছে, তাতে মাঝে যে হিউমার আর উইট ঝলকে উঠেছিল থেকে থেকে, সেটাই ছিল জাত বৃটিশ। আজ তার অফিসে এসে পা রাখার মাসখানেক আগে আমার এই সম্ভাব্য এসাইনমেন্ট নিয়ে তার সাথে যে দাপ্তরিক নিয়মানুযায়ি টেলিফোনিক ইন্টার্ভিউ হয়েছিল, যেটি অবশেষে পরিণত হয়েছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা ব্যাপি এক টেলিফোনিক আড্ডায়, তাতেও বারবার ঝলকে উঠেছিল, তার ঐ হিউমার আর উইট। বাকীটা এখনো জানি না। আপাতত এই হলো ক্যাজুয়াল আম্রিকান উইটি ব্রিটিশ ফিল।
সে যাক ফিলকে তার প্রার্থিত সময় বরাদ্দ করে, রুমের এ পাশটায় রাখা গোল মিটিং টেবিল ঘিরে বসে তুতেনখামেন, আখেনাতন ও আমি অনুচ্চ গলায় চালিয়ে যাচ্ছি সেই আলোচনা শুরু হয়েছিল যা, হোটেল থেকে অফিসে আসতে আসতে। বিষয় মিশর, কায়রো, নীলনদ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ছোটবেলায় একদিকে যেমন ছোট্ট ঝুড়িতে নীলনদে ভাসতে ভাসতে ছোট্ট শিশু মুসার (রহঃ) খোদ ফেরাউনের ঘরে পালিত হয়ে নবী হয়ে ওঠার কাহিনী শুনেছিলাম দাদি, নানি, আম্মার কাছে, তেমনি শুনেছিলাম তা নানান হুজুরদের ওয়াজ মাহফিলে।
অন্যদিকে পরবর্তীতে নীলনদ অববাহিকায় গড়ে উঠা এই গ্রহের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা এবং বিশেষত পৃথিবীর সপ্তাশ্চযের্র অন্যতম পিরমিড বিষয়ে নানা রহস্যময় কাহিনী অল্প বিস্তর যা পড়েছিলাম, তাতে এ নিয়ে আছে আমার বিশেষ আগ্রহ। অতএব আচমকা দুই মিশরিয়র দেখা পেতেই, মননে মগজে ঝাপাঝাপি দাপাদাপি শুরু করেছিল কায়রো, প্যাপিরাস, হায়ারগ্লিফিক, ক্লিউপেট্রা, আলেকজান্দ্রিয়া এইসব নানান নাম ও শব্দ সমূহ।
অতএব মহাউৎসাহে ঐসব নিয়েয় আলাপ শুরু করেছিলাম। হোটেল থেকে অফিস পর্যন্ত যেহেতু তুতেনখামেন মানে কোজাক মাথার গাট্টাগোট্টা ফর্সা রঙ্গয়ের মোহাম্মেদ গিউসি গাড়ী চালাচ্ছিল, মাঝেমধ্যে সে হু হা করে সে আলাপে যোগ দিলেও, পেছনে বসে আলাপের ড্রাইভিং সিটে থাকা আমার সাথে এসিট্যান্ট হিসেবে ছিল গাড়ীর ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা বাদামি গাত্রবর্ণের, একমাথা কোঁকড়া চুলের আখেনাতন মানে মোহাম্মদ মেতওয়াল্লি।
এ মুহূর্তে সুযোগ পেয়ে সেই আলাপের ড্রাইভিং সিটের দখল নিয়ে গিউসি বলল– “তোমার তো দেখছি সেলিম মিশর নিয়ে তুমুল আগ্রহ! তা এ পর্যন্ত ক’বার গিয়েছ মিশর? গেছইবা কোথায় কোথায়?”
খেলাম এক্কাবারে রামধরা! তুমুল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যাওয়া তো হয়নি একবারও মিশরে। তদুপরি আমিতো কোন ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং জাতীয় জাত ভ্রামনিক নই। হলাম আমি যাকে বলে কর্পোরেট ভ্রমানিক, দাপ্তরিক পয়সায় দাপ্তরিক প্রয়োজনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য যাই এবং গেছি নানান জায়গায়। সেই লিস্টিতে মিশর কায়রো কখনোই আসেনি। কিন্তু তাতে কি? এই মরুতে প্রথমদিনেই হার মানবে বাঙালি তা তো হতে পারে না! বললাম তাই,
শোন দৈহিক ভ্রমণ যদি বলো, তা এখনো করা হয়ে ওঠেনি আমার মিশরে। তবে মানসিক ভ্রমণ থামায় কে? নানান বইপত্র পড়ে অনেক গিয়েছি মিশরে। পোর্টসৈয়দে জাহাজ থেকে নেমে, চলে গেছি সোজা কায়রোর ক্যাফেতে, কফি খেতে। ঘুরেছি পিরামিডে পিরামিডে। বলেই মনে মনে ঠুকলাম সালাম বঙ্গদেশের তাবৎ সৈয়দের মধ্যে বড় সৈয়দ তো অবশ্যই এমনকি বাংলা সাহিত্যেরও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সৈয়দ সাহেবকে। একটু ভির্মি খেয়ে গেল আমার উত্তরে গিউসি। দ্রুত বলল “না না জেদ্দা থেকে জাহাজে পোর্ট সৈয়দে যেতে হবে না। রিয়াদ থেকে ধরো পা বাড়ালেই যাওয়া যায় অনায়াসে কায়রোতে। মাত্র ঘণ্টা তিনেকের ফ্লাইট। সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই একাধিক ফ্লাইট আছে। আগে পাকাপাকি ভাবে চলে আস তুমি। প্রতিমাসেই তো যাই আমি কায়রো তে পরিবারের সাথে দেখা করতে। তোমাকেও না হয় নিয়ে যাবো সে সময়।”
আর এ তো দেখছি ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে অবস্থা। আমি কি তাহলে ভুল করলাম নাকি? দেখা হবার পর থেকে দাপ্তরিক বাঁ ব্যাবসা বিষয়ক কোন কথাবার্তা তো বলিনি এ পর্যন্ত! মানে ধান ভানতে গিয়ে আমি তো গেয়েছি শিবের গীত! এদিকে গিউসি তো সুযোগ পেয়েই ঢেঁকিতে পাড় দিতে শুরু করেছে। জাত মানব সম্পদ ম্যানেজারের মতো সে, আমি যেন শেষ পর্যন্ত এই এসাইনমেন্টটা নেই, সেই নিশ্চয়তা চাচ্ছে!
“কি ব্যাপার? যতোটা মনে পড়ে ব্যাংককের মিটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে একমাত্র তোমার সাথেই নিয়মিত দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল স্মোকিং কর্নারে। তাহলে ধরাচ্ছ না কেন সিগারেট? ওহ বুঝেছি! শোন সুইজারল্যান্ডের আইন এই মরুতে এখনো বলবত হয়নি। তা, বল ঘুম হল কেমন তোমার?”
ফিলের গলা কানে যেতেই ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, সদ্য মুখাগ্নি করা নতুন সিগারেটটি দ্রুত ঠোঁটে ঠেসে দিয়ে বাড়িয়েছে সে হাত, চেয়ার ছেড়ে উঠে দ্রুত সেই হাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই অবস্থা হল আমার হাতের তেমন, হয়েছিল যেমন সৈয়দ সাহবের হাতের পেশওয়ারে, শেখ আলী আহমদ পাঠানের থাবায় ঢোকার পর। কপাল ভাল আমার,এ হল ব্রিটিশ কায়দার হাত মেলানো, পাঠানি কায়দা না।
ঐ হাতাহাতি শেষে পাশের চেয়ারটি টেনে বসতে বসতে আবারো জিজ্ঞাসা ফিলের “তা ঢাকা রিয়াদ ফ্লাইট কেমন ছিল? রাতের ঘুম হল কেমন?” ঘুমের সুযোগ পেলামইবা কোথায়? হোটেলেই তো পৌঁছেছি এই ধরো ঘণ্টা দুয়েক আগে।
“ কী ?” তুমুল অবাক হয়ে একই সঙ্গে বলে উঠলো টেবিলের তিনজন।
“তার মানে কী, ফ্লাইট কি ডি লে হয়েছিল নাকি?” থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো গিউসি। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আমাকে এই অতি জরুরি প্রশ্নটি এতক্ষণ না করায় ভুগছে বড়ই সে মনোবেদনায় এই মুহূর্তে বসের সামনে।
দ্রুত সবাইকে আশ্বস্ত করে বললাম, কোন সমস্যা নাই। দোষ তো আমারই। বাঁচাল আমি তো তুমি বা মেতওয়াল্লি কাউকে কোন সুযোগ না দিয়ে শুরু করেছিলাম মিশরনামা। এছাড়া ফিলের সাথে যখন টেলিকনফারেন্স হয়েছিল, তখনতো সে আমাকে বলেইছিল যে এখানে নানান সময়ে কী আচানক ঘটনা ঘটে! তাই ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিলাম।
“বুঝেছি, বুঝেছি। এবার ঝেড়ে কাশো তো?” বলল ফিল। অতপর বলতেই হল যে, হ্যাঁ যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য ফ্লাইটের ঢাকা থেকে চার ঘণ্টা দেরীতে ছেড়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারপরও গত রাত সাড়ে দশটার দিকে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালেও , ইমিগ্রেশন অফিসার এসেছিলেন মধ্যরাতেরও পরে। তারপর ঢিমে তালে, কফি চা খেতে খেতে পাশের বক্সের অফিসারদের সাথে খোস গল্প করতে করতে, যেহেতু কাজ করছিলেন তিনি, আর যেহেতু ছিলাম আমি লাইনের একদম শেষে, সে জন্যই গোটারাতই কেটেছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আর আমি যেহেতু ঘোড়া নই, তদুপরি ইমিগ্রেশন পুলিশরা যেরকম ধমকা ধমকি করছিল ঢাকা লাইনের লোকজনদের, তাতে ঘুম তো দূরের কথা, ঝিমুনিও আসে নাই চোখে। এছাড়া সকালে হোটেলে পৌঁছে কুসুম গরম পানিতে একটা চমৎকার গোসল করার পর সব ক্লান্তি চলে গেছে। আর নাস্তা করার পর মেরেছিলাম একটা এস্প্রেসো কফির ডাবল শট। তাইতো, ভুলেই গিয়েছিলাম যে ঘুম হয় নাই আমার। নিজের ইজ্জত বাঁচানোর লক্ষেই চেপে গেলাম বিস্তারিত হেনস্থাগুলো।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণসাহিত্যিক।