দেশ হতে দেশান্তরে

অচেতন পক্ষপাত

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১১ আগস্ট, ২০২৪ at ১১:০১ পূর্বাহ্ণ

কিন্তু হায়! বিধি বাম! মেন্যুভাষা, দেহভাষা আর বাংলাভাষা মিলিয়ে অর্ডার দেয়াটা মোটামুটি জলবৎ তরলং সম্পন্ন হয়ে যাওয়ায় বেশ খুশি মনে এ রাতে স্টোরটির অবস্থা কেমন তা জরীপ করার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে সোজা পায়ের তলার দিকে!

কারনণ চোখ গিয়ে পড়েছে বাঁ দিকের একদম কোণার একটা টেবিলে। ওখানে দেখছি হ্যাংলা পাতলা ভাঙাচোড়া চেহারার এক তরুণ চেয়ারে বসে পেছন দিকে ঘাড় হেলিয়ে ঘুমাচ্ছে, ইয়া হাঁ করে! তার ঠিক সামনের দুটো টেবিল পরে আরেকটা টেবিলে বসে নিচু গলায় চুং চাং চিং করতে করতে মুর্গি চিবুচ্ছে একই রকম ভাঙাচোড়া গড়নের তিন সন্দেহভাজন চেহারার চায়নিজ তরুণ! যদিও চেহারা বা পোশাক দেখে কারো ব্যাপারে কোনও ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটি বেশ অনেকদিন ধরেই এড়িয়ে যাচ্ছি সচতেনভাবে, কিন্তু এ মুহূর্তে ঠিকই অবচেতন থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো বহুকাল আগের সেই অভ্যাস, শিখেছিলাম যা নিজের অজান্তে আশেপাশের সমাজ সংসার আর পরিবেশ থেকে, যেটিকে মনোবিদরা ইংরেজিতে আনকনসাস বায়াস বলেন বাংলায় যাকে বলা যায় অচেতন পক্ষপাত।

সমস্যা হচ্ছে এখন যতোই সচেতনভাবে চেষ্টা করছি সেই অচেতন পক্ষপাতের ভূতটি ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে, তারপরও দেখছি সেটিই চেপেছে ঘাড়ে, সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো! ভয়ে ঢিপ ঢিপ করছে বুক তাই। যদিও জানি এস্টোরটিতে অবশ্যই ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা আছে, তারপরও করছে ভয়। কারণ ঐ যে এই চারজন বাদে আর তো নেই কোনও খদ্দের এই মুহূর্তে এই স্টলে। চেহারা সুরতে পোশাকে এদেরকে ঢাকার রাতের পায়ে হাঁটা রাস্তার বা ফুট ওভারব্রিজের অন্ধকার থেকে হঠাৎ করেই ছুরি চাকু হাতে বেড়িয়ে আসা হিরুইঞ্চি ছিনতাইকারীর মতোই মনে হচ্ছে!

এরই মধ্যে মুর্গি চিবানোতে ব্যস্ত তিনজনের যে জন আছে সোজাসুজি আমার নাক বরাবর, তার চায়নিজ ব্র্যান্ডের চোখের সাথে আমার চোখাচোখি হয়েছে কি না বুঝতে না পারলেও পরিষ্কার চোখে পড়লো যে তার চুং চাং কথায় বাকি দুজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো এই দিকে! অবচেতনে নিশ্চল শুয়ে থাকা ভয়ের অজগর নড়েচড়ে উঠল তাতে!

হোক তারা যে বাঁ যারাই,আমি যে ভয় পেয়েছি মনে মনে, তা বুঝতে দেয়া যাবে না এদের কোনমতেই। মনে মনে এ প্রতিজ্ঞা করে ছোটবেলায় অন্ধকার রাতে একাকী হাঁটতে গিয়ে যেমন গাইতাম গান উচ্চস্বরে, তেমন উচ্চকিতভাবে না হলেও, হাতে তুড়ি দেবার সাথে পায়ে তাল ঠুকতে ঠুকতে ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরেই অপমান! সংকটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মাণ’।

গুণ গুণ করে গাইতে গাইতে ধীরে সুস্থে গোটা স্টোরটিতে চোখ বোলাতে বোলাতে ঘুরে ফের কাউন্টারমুখি হবার চেষ্টায় আছি যখন, তখনই পেছনে খচর মচর শব্দের সাথে চুং চাং চায়নিজ শব্দে কর্ণকুহুরে প্রবেশ করতেই ঝট করে ঘুরে দেখি, কাউন্টারে তৈরি আমার অর্ডার প্যাকেট। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম তাতে।

তবে প্যাকেট হাতে নিতে নিতে ভাবছি ফের, ঐ ভয়ের ব্যাপারটি কিছুতেই টের পেতে দেওয়া যাবে না, ঐ টেবিলের সন্দেহভাজন সম্ভাব্য হিরুইঞ্চিদের। ফলে কাউন্টারের ওপাশে হাসিমুখে ধন্যবাদ ছুঁড়ে দিয়ে ধীরে সুস্থে প্যাকেটগুলো হস্তগত করে ঘুরছি যখন বেরিয়ে যাবার জন্য, তখনি কিনা মনে এলো ভয়ের ঝাপটা নিয়ে এলো আরেকটি ভাবনা!

তা হলো, এটা নিশ্চিত ছিল যে এখানে আলোকোজ্জ্বল ও সি সি ক্যামেরাসজ্জিত স্টোরের ভেতরে কোন ছিনতাইকারী নিশ্চয় সাহস করবে না উলটাপাল্টা কিছু করার। কিন্তু এখন তো যাচ্ছি বাইরে। খুব জোরে হাঁটলেও তো লাগবে কমপক্ষে ১২/১৪ মিনিট মোটামুটি নির্জন ফুটপাত ধরে হেঁটে হোটেলে পৌঁছুতে। বেশ চওড়া এই ফুটপাত থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা নানান আকার ও বয়সের দালান ও মার্কেটগুলোতে চায়নিজ নতুন বান্দর বছর উপলক্ষ্যে রং বেরঙয়ের আলোক সজ্জা করলেও, সে আলো অতো উজ্জ্বল নয়। বেশ দূরে দূরে মূলরাস্তার একদম গা ঘেঁষে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা লাইটপোস্টগুলোর মাথায় জ্বলছে যে সব আলো, সেসবও বড়ই মৃয়মাণ। ফলে ফুটপাতের বেশির ভাগের হিমেকম্বলকে ঢেকে রেখেছ ছাই রঙের ধোঁয়াশার চাদর। হাঁটতে হবে গোটা পথটাই তাই আলো আধারির মধ্যেই। এসময় যদি নেয় তারা পিছু? করবো টা কী তবে?

বেইজিংয়ের রাস্তায় রাতে বা সন্ধ্যায় ছিনতাইকারীর উপদ্রব আছে, এমন কথা শুনিনি। তারপরও মনের ভেতরে ঘুরে ফিরে সেই সম্ভাবনার কথাই ভাবতে ভাবতে এরই মধ্যে বেশ রয়েসয়ে ধীরে সুস্থেই বেরিয়ে এসেছি কর্নেলের ডেরা থেকে। বাইরে এসে অকস্মাৎ হাঁটার গতি তুমুল বাড়িয়ে দিতে দিতেই ঝট করে মনে পড়লো বিদেশের মাটিতে নিজের দুই দুইবার ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়ার ঘটনা, যার একটি ঘটেছিল রোমে, অন্যটি ম্যানিলায়। কপাল ভালো দুইবার বেঁচে গিয়েছিলাম তবে সে ভিন্ন গল্প। কথা হচ্ছে ঢাকার রাস্তায় রাতেবিরেতে বেরুলে, ছিনতাইকারী কবলে পড়তে পারি যেকোনও মুহূর্তে এরকম ভয় সঙ্গী করেই যেমন বের হই, তেমনি মনে হচ্ছে এখন। কারণ প্রথমত চায়নায় আসার পর থেকেই এখানে জাল টাকার সম্ভাব্য তুমুল ছড়াছড়ি ব্যাপারটি টের পাওয়ার পর থেকেই সম্ভবত মনের ভেতরে এখানকার সমাজে ঐ দুষ্কৃতিকারীদের উপস্থিতির ব্যাপারটি গ্যাঁট হয়ে বসেছিল। দ্বিতীয়ত জানি যেহেতু এই চায়না একসময় একদম বুঁদ হয়েছিল আফিমের নেশায়, অতএব সে জায়গা যে হিরোইন দখল করতে পারে সহজেই এমন একটা স্থির বিশ্বাস মনে গেঁথে গিয়েছিল যে মুহূর্তে দেখেছিলাম ঐ হিরুইঞ্চিদের বদন মোবারকসমূহ। তদুপরি তাদের দেখার সাথে সাথেই কেন জানি মনে হচ্ছিল একটু আগেই একটা সফল ছিনতাই অপারেশন শেষ করে সেই টাকায় মজা করে মুর্গি ভাজা খেতে খেতে, আমার মতো আরেকটি বিদেশী নধর মুর্গি দেখতে পেয়ে, মহানন্দে নিশ্চয়ই মনে মনে এঁটেছে নতুন শিকার ধরার ফন্দি!

হাঁটছি তাই এখনো তুমুল গতিতে। হ্যাঁ এই চায়না ভ্রমণে আসার পর থেকে নানান সময়ে নানান কারণে দ্রুত এগুবার জন্য এমনকি জগিংয়ের ভঙ্গিতেও এগিয়েছি, কিন্তু সে সব সময়েও এতো দ্রুত সামনে এগুতে পেরেছিলাম বলে মনে হয় না। এখন পর্যন্ত যদিও পেছন থেকে আমার চেয়েও দ্রুততর গতিতে এগিয়ে এসে কেউ ঠেকায়নি কোনও অস্ত্র পিঠে, তবুও মনে হচ্ছে ঘটতে পারে তা যে কোন মুহূর্তে। ছোটবেলায় অন্ধকার রাস্তায় একাকী হাঁটতে গেলে যেমন কানে স্পষ্ট শুনতে পেতাম, পেছন থেকে অশরীরীদের এগিয়ে আসার শব্দ, পাচ্ছি মনে হচ্ছে এখনো তেমনি কিছু, ধোঁয়াশার আধো অন্ধকার ঢাকা এই ফুটপাতের এই অংশ পেরুতে পেরুতে। আশার কথা! আশার আলো দেখতে পাচ্ছি সামনে। কারণ আর কিছুটা এগুলেই দেখা পাবো রাস্তার পাশের সেই লাল সবুজ নুডুলস বার সহ বেশ কটা রেস্টুরেন্টের, যেখানে আলোর কোনও কমতি নেই। দেখা যাচ্ছে ঐখানে দু একজন লোকও। এছাড়া এই এলাকাটা একদিকে যেমন অতি চেনা হয়ে গেছে, তেমনি এলাকাটা মোটামুটি অভিজাত সব দোকানপাঠের, ফলে ধারণা করি এখানে ছিচকে ছিনতাইকারী উপদ্রব থাকার কথা নয়। সর্বোপরি বড় কথা হলো এতক্ষণের দুরন্ত গতির হাঁটার কারণে এরই মধ্যে চলে এসে আসলে আমাদের হোটেলেরও খুব কাছাকাছি।

এমতাবস্থায় এরই মধ্যে মাওয়ের ছবিসাঁটা সেই লাল সবুজ নুডুলস বার যেখানে পুত্রদের নিয়ে ঢুকতে হয়েছিল বেইজিং আসার পরের রাতে, চায়নায় এসে খাঁটি চায়নিজ নুডুলস খাওয়ার তাদের বায়না মেটাতে সেটির সামনে এসে পৌঁছুতেই, হাঁফ ছেড়ে এতক্ষণের হাঁটার ত্রস্তহরিণগতি কমাতে কমাতে, এগুতে লাগলাম কচ্ছপ গতিতে না হলেও, হেলে দুলে দুলকিচালে। এরই মধ্যে প্রথমবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম পেছনের দিকেও। তাতে চোখে পড়লো শুধু শূন্যতা তো নয় বরং হালকা থেকে শুরু করে ক্রমশ দূরে যেতে যেতে গাঢ় হয়ে যাওয়া জমাট ধোঁয়াশা। যার মধ্যে কোন মনুষ্যাকৃতির নড়াচড়া চোখে পড়ল না!

ধোঁয়াশার চাদর সরিয়ে আগুয়ান বা অপসৃয়মান কোনও মনুষ্যমূর্তির আভাস চোখে না পড়ায় এসময় হল এক নতুন অভিজ্ঞান! এতোদিন জানতাম এবং মানতামও যে বনের বাঘের চেয়ে, মনের বাঘেই খায় বেশি মানুষকে, আর এইমাত্র অভ্রান্তভাবে প্রমাণিত হল যা তা দ্রুত হাঁটায়ও মানুষকে। এরকম হাঁটায় আর কিছু না হোক তুমুল হিমে গা গরম হয় যেমন, তেমনি এগুনোও যায় চিতার গতিতে! এতক্ষণ আসলেই বিপদ ছিল কি ছিল না সে ব্যাপারে নিশ্চিত না থাকলেও, এখনতো নিশ্চিত যে কেটে গেছে বিপদ। ভাবছি একটু থেমে জিরিয়ে নেব কি না? ঝক্কি তো গেছে ভালোই গত মিনিট পাঁচ ছয় কিম্বা সাত ধরে।

নাহ, একদম থামা যাবে না। তুমুল গতিতে একশ মিটার, দুশ মিটার স্প্রিন্ট শেষ করেও কিন্তু সাথে সাথেই একদম থেমে যায় না দৌড়বিদরা। এমনকি ম্যারাথন রেসেও তা করে না কেউ। শারীরবৃত্তিয় না হলেও মানুষসহ যাবতীয় প্রাণীর দেহ ঘিরেও কিন্তু কাজ করে পদার্থবিদ্যার স্থিতিজড়তা ও গতিজড়তার সূত্র। যেখানে প্রকৃতিই চলছে পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে অবিরল, সেখানে এই আমি কোন অপ্রাকৃতিক নাকি অতিপ্রাকৃতিক শক্তি হলাম যে উপেক্ষা করি সেই সূত্র? আর থামতেই তো হবে এমনিতেই ঐ যে সামনেই। আর দশ বিশ মিটার এগুলেই তো জেব্রাক্রসিং এর লেজে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, রাস্তা পেরিয়ে আমাদের বেইজিংএর অস্থায়ী নিবাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ফলে না থেমে হাঁটতেই থাকলাম সেই দুলকি চালেই।

হ্যাঁ ঠিকই ভেবেছিলাম। জেব্রাক্রসিংয়ের এ পাশের লেজে এসে দাঁড়াতেই হল অবশেষে, ট্রাফিক লাইটের হুকুমে। ভাবছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, আচ্ছা কাল সকালের জন্য নাস্তাটাস্তাও তো কিছু কেনা দরকার ছিল তো মনে হয়। ভোর ছটা সাড়ে ছটার দিকে হোটেলকে বিদায় জানিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা করার আগে কিছু মুখে তো দিতে হবে সবার। এখানকার এয়ারপোর্টে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রথমদিন নেমে, তাতে তো বুঝতেই পারছি এই এয়ারপোর্টে নিশ্চয় কোনও খাবার পাওয়া যাবে না। ইস মনের বাঘের তাড়ায় এইদিকে অতো দ্রুত হাঁটতে বাধ্য না হলে তো, কর্নেলের ডেরা থেকে উল্টো দিকে হেঁটে কিছুদূর এগিয়ে রাস্তা পেরুলেই পেয়ে যেতাম সেই মুদি দোকানটা, যেখান থেকে কিনেছিলাম সকালের নাস্তা বেইজিং এই পা রাখার প্রথম রাতেই।

লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে অগ্নিকাণ্ডে সুপার শপ পুড়ে ছাই
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পন