চায়নিজ কাশ্মীর পশমিনা
ঘটনা হচ্ছে কাউন্টারাসীন মোহতারেমা দেখে বুঝতে পারছি না ইনি কি মালিক, নাকি ম্যানেজার এখানকার? মালিক হোক আর ম্যানেজার হোক, ইনি ছাড়া কোন সেলসগার্ল বা ম্যান নাই নাকি এই দোকানে? একলাই চালায় নাকি এই স্টোর এখানকার মালকিন বা ম্যানেজারনি? তাও যদি হয়, তার দায়িত্ব কি শুধুই চুরিদারি ঠেকানোই নাকি? কোনও আগুন্তুক স্টোরে ঢুকলে সে কিছু কিনবে কি না, তা জিজ্ঞেস করা কি তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? এমনতো নয় যে তার দোকানে আছে অতি প্রয়োজনীয় বা জীবন বাঁচানোর মতো কোনও পণ্য যা অন্য কোথাও নেই, তাই যার দরকার সে এটি কিনতে একদম বাধ্য। নাকি এ কদিন যেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের এই চায়নায়, সে রকমই আমাদের মতো বাংগালদের করছে সে নীরব উপেক্ষা? কিম্বা আজকের মতো এদের বিক্রিবাট্টা বন্ধ হয়ে গেছে নাকি? মনের ভেতরে এসব সাত পাঁচ ভাবনা খেলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। তারপরও যাচ্ছি সেই কাউন্টারের মোহতারেমার দিকে দাম জানার জন্য যখন
‘থাক দাদা, দরকার নাই। কিনবো না, চল এখান থেকে যাই এখন তাহলে।’
হেলেনের এই সিদ্ধান্ত তখন কানে যেতেই, আনন্দিত হলাম দ্বিবিধ কারণে। প্রথম কারণটি পেশাগত। একজন সম্ভাব্য ক্রেতা বিক্রেতার কাছ থেকে ঠিক মনোযোগ না পেলে, সে যে তার কেনার সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই বাতিল করে দিতে পারে, এ তো হল তার এক্কেবারে হাতে হাতে পাওয়া প্রমাণ, পড়েছি যা বইয়ে এবং বলিও যা নানানজনকে পেশাগত কারণে।
আনন্দিত হবার দ্বিতীয় কারণটি হল নিতান্তই অর্থনৈতিক অতএব বলা চলে তা হল পকেটগত কারণ। একটু আগে পকেটের উপর যে একটা ভালো কোপ পড়ার উপক্রম হয়েছিল তা থেকে এভাবে অভাবনীয়ভাবে বেঁচে যাওয়ায়, এখানে আর তিলার্ধ দেরী করা সমীচীন হবে না ভেবে দ্রুত হাঁফ ছেড়ে না শুধু মহানন্দে এ স্টোর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য উল্টো ঘুরতেই দেখি, দরজার কাছাকাছি থাকা লাজু ও পুত্ররা এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে স্টোর থেকে, আর হেলেন তাদের করছে অনুগমন।
অতঃপর সবার শেষে এই ডিম্বনগর থেকে বেরিয়ে দেখি এরই মধ্যে দলের মহিলা সদস্যার ঢুকে পড়েছেন পাশের সেই দোকানটিতে যেটিকে লক্ষ করে এসেছিলাম এদিকটায়। ঐদিকে পুত্ররা দোকানে না ঢুকে, দরজার মুখে দাঁড়িয়েই দেখছি কী যেন আলাপ করছে দুজনে।
কী ব্যাপার এই ঠাণ্ডায় তোমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এ কথা বলতে বলতে ওদের পেরিয়ে দরজা ঠেলে দোকানের ভেতরে পা রেখেই বেশ বড় সড় লম্বাটে আকৃতির এই দোকানটিকে দেখে ঢাকার গাউসিয়া বা নিউমার্কেটের শাড়ি বা বিশেষত মেয়েদের জামা কাপড়ের দোকানের মতোই মনে হল এর সাজসজ্জা। এখানে বঙ্গনারী উপযোগী শাড়ি বা সালোয়ার তো থাকার কথাই না, অতএব কী কিনবে এরা এখান থেকে, এ ভাবনা মাথায় উদয় হতেই চোখে পড়ল নানান ধরনের ইউরোপিয়ান স্টাইলের মেয়েদের জন্য তৈরি নানান পোশাক, দেখা যায় যেরকম ঢাকার বঙ্গবাজার কিম্বা ঢাকা কলেজের সামনের মার্কেটে। একই সাথে নজরে এলো আছে এখানে মিটার বা গজ হিসাবে বিক্রি করার মতো চায়নিজ নানান মোটিফ ছাপা কাপড় যেমন, তেমনি দেখছি আছে যাকে বলে ছিটকাপড়, তাও।
‘এই দেখো তো এগুলো। বেশ সুন্দর না? দাম কতো জিজ্ঞেস কর তো?’
লাজুর এ কথায় ওর দিকে ঘাড় ফেরাতেই দেখি নজর তার উর্ধ্বমুখী। দেখছি হেলেনও তাকিয়ে আছে উপরের দিকেই। ফলে ওদের চোখ অনুসরণ করে নিজের চোখ উপরের দিকে চলে যেতেই, দেখলাম মাথার কিছুটা উপরেই ঝুলছে দুজনেরই উদ্দিষ্ট কাপড়গুলো। অপটু হাতের ভুল বানানের ইংরেজিতে বেশ বড় অক্ষরে কোনটাতে লেখা পশমিনা, কোনটাতে কাশ্মীর। সাথে লেখা আছে দামও।
হ্যাঁ দোকানের সাজসজ্জা যেমন ঢাকার গাউসিয়া বা নিউমার্কেটে দোকানের মতো লাগছে, দোকানের ঢোকার মুখ থেকে শুরু করে নানান জায়গায় মাথার উপরে ঝুলিয়ে রাখা মেয়েদের এই শালগুলো অবশ্যই পাওয়া যায় ঢাকার ঐসব দোকানে। যদিও জানি না ঢাকায় এগুলো আসলে কতো দামে বিক্রি হয়, তবে রেন মেন বি তে এখানে যে দাম লেখা আছে, আসল পশমিনা বা কাশ্মীরী শাল অবশ্যই এই দামে পাওয়া যাওয়ার কথা নয় কোনমতেই। ফলে দ্বিধাহীন ভাবেই ধরে নেয়া যায় এসবই হল নকল বা চায়নিজ কাশ্মীর আর পশমিনা।
বাংলাদেশি চারশ, পাঁচশ থেকে শুরু করে হাজার দেড় হাজার টাকা দামের পশমিনা আর কাশ্মীর নামের এই শালগুলোর দাম শুনে হেলেন আর লাজু দুজনেই ঘোষণা করলো এগুলো কিনতে হবে। দামে আর ডিজাইনে মিলে এরকম মাল নাকি ঢাকায় মেলা ভার।
কী আর করা? বললাম ঠিক আছে। নিয়ে নাও পছন্দ করে নিয়ে নাও ঝটপট।
“একটু নামিয়ে দাও না? দরদামও করে দাও না।“
আমার মনে হয় না, দরদাম করে কেনা যাবে। দেখছ না দাম লিখে রেখেছে। এর পেছনেই তো আছে ঐ হুতং মানে গলির মধ্যকার ফুটপাত মার্কেট। ওখানেও দেখনি দরদাম করার তেমন সুযোগ ছিল না। আগে নেবে কয়টা, আর কোনটা কোনটা, ঠিক কর দুজনে। তারপর দেখি একসাথে কিনছি বলে কোনরকম পাইকারি দাম দাবী করতে না পারলেও মোটের উপর কিছু কম দিতে পারি কি না, দাম মেটানোর সময়। লাজুর অনুরোধের জবাবে এসব বলতে বলতে, মাথার উপরে ঝুলতে থাকা ঐ স্যাম্পলগুলো টেনে নামাতে গিয়ে কোন ঝঞ্ঝাটে আবার পড়ি ভেবে, ওর সেই অনুরোধ নীরবে উপেক্ষা করে। বেশ বড় লম্বাটে এই দোকানের নানান জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা সেলস ম্যান/সেলস গার্লদের মধ্যে সবচেয়ে কাছের জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য, এই যে খালা এই দিকে একটু আসেন, বলার সাথে মাথা একটু নড মতো করতে করতে, নাড়লাম হাতও সামান্য।
বাহ বেশ দ্রুতই দেখছি কাজ হল। হাত ও মাথার ঐ যৎসামান্য ইশারার সাথেই সাথেই খালা যেভাবে এগিয়ে এলেন, তাতে যে কারোই ভ্রম হতে পারে যে খালা বুঝি বুঝেছেন আমার বাংলা! কাছে এসে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে আমার চোখে খালা চোখ রাখার চেষ্টা করলেও আমি পেলাম না দেখা তার চোখের। আসলে খালার চায়নিজ ব্র্যান্ডের চোখ দুটো কপালের, মুখের, গালের বলি রেখার চাপে একদম মুদেই আছে বলে মনে হচ্ছে। আহা রে! কত বয়স হবে খালার? আন্দাজ তো করতে পারছি না। আন্দাজ করতে না পারলেও কেন যেন মনে হচ্ছে এই বয়সের মহিলাকে যদি তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক সমাজও, তার নাতি নাতনিদের সাথে খেলাধূলা করে সময় কাটানোর সুযোগ না করে দিতে পারে তাহলে আর আমাদের দেশের কী দোষ?
মনে মনে এসব ভাবনা চলতে থাকলেও একই সাথে হাতের ইশারায় তিন জনে মিলেই দেখিয়ে দিলাম কোন কোন শালগুলো দেখতে চাই।
এদিকে আমাদের দেখানো শালগুলোর দিকে দু তিন বার তাকিয়ে, আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলে খালা ঘুরে হাঁটা দিতেই, লাজু আর হেলেনকে আন্দাজের উপর ভর করেই বললাম এগুতে তার সাথে। আমার ধারণা ঝুলিয়ে রাখা এই স্যাম্পলগুলোকে স্থানচ্যুত না করে, ওগুলোর জমজগুলোকে বের করবেন উনি, এই দোকানের কোনও না কোনও শেলফ থেকে। এরই মধ্যে খালা, একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে হেলেন ও লাজুকে তার পিছু পিছু আসতে দেখে, মাথা ঘুরিয়ে নিশ্চিন্তে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে, বুঝলাম আন্দাজ আমার সঠিক।
লম্বায় দোকানটা বেশ বড়সড় হলেও চওড়ায় ততোটা না। মাথার উপরে ঝুলতে থাকা শালগুলো দেখতে পেয়েছিল দুই বঙ্গনারী, বলা চলে দোকানে ঢোকার মুখেই। আর খালাও দাঁড়িয়ে ছিলেন মোটামুটি আমাদের কাছেই। এখন খালা লম্বাটে এই দোকানটির মাঝমাঝি গিয়ে ওখানকার বা দিকের দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শেলফ থেকে, দেখছি একে একে নামিয়ে রাখলেন বেশ কটা শাল ঐ শেলফের সামনে থাকা টানা কাউন্টারের উপর। সাথে সাথে লাজু আর হেলেন গভীর মনোযোগে উল্টে পাল্টে সেগুলো পরখ করা শুরু করতেই প্রমাদ গুনলাম মনে, প্রথমত কতো যে যায় গচ্ছা এখন পকেটের, তা ভেবে। দ্বিতীয়ত মনে হল, যেরকম রয়ে সয়ে দেখছে তারা প্রতিটি শাল তাতে তাদের এই পছন্দ করা পর্বই বা কতো যে দীর্ঘ হয় তাও তো বলা যায় না।
নাহ, এ নিয়ে এই ভ্রমণের একদম এই শেষ মুহূর্তে এসে আর দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। বরং এ কয়দিন যে কেনাকাটা করা থেকে তারা বিরত ছিল, তাতেই তাদের দুজনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ আমার। বেইজিঙয়ের আজকের এই শেষরাতটি তো হল আমাদের গোছগাছ করার রাত। সকাল ছ’টা কী খুব জোড় সাড়ে ছটার মধ্যেই দিতে হবে রওয়ানা এয়ারপোর্টের দিকে। এই টেনশনে তো এমনিতেই সম্ভবত কারো ঘুম হবে না খুব একটা। যতোটুকুই পারা যায় ঘুম দিতে হবে বেইজিং টু কুনমিং ফ্লাইটেই। এখানে যেদি কিছু দেরী হয় তাতে আর তেমন কিছু আসে যায় না। দেখুক ওরা নিশ্চিন্তে। আমি বরং দেখি গিয়ে এই হিমে দোকানে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পুত্রদের হাল হকিকত। ভাবতে ভাবতে এগুলাম দরজার দিকে।
দরজার বাইরে পা দিয়ে ধক করে উঠলো বুক অজানা, না অজানা নয় বল উচিৎ ছোট থেকে মনের গভীরে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে যাওয়া সেই পুরানো আশঙ্কাটির কারণে, যা হঠাৎ করেই তুলেছে মাথা। নাহ, নাই ওরা দাঁড়িয়ে ওখানে! আজ সন্ধ্যায় করা নানান সওদাভরা ওদের পিঠ ব্যাগদুটো অবহেলায় পড়ে আছে দেখছি দরজার পাশেই! কী ব্যাপার ছেলেধরার পাল্লায় পড়লো নাকি ছেলেরা আমার? সেই ছোট বেলায় আমাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য বড়রা অহরহই যে ভয় দেখাতেন সেটিই কি না তীব্র ঘাই মেরে উঠল মনে! একই সাথে যোগ হয়েছে পেশাগত কারণে জানা আরেকটি ভয়। তা হল চায়নার অংগপ্রতিস্থাপন ব্যবসা বিষয়ক কেলেংকারির কথা, যা নিয়ে মোটামুটি তোলপাড় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল পশ্চিমা মিডিয়া বেশ কিছুকাল আগে। এই দুইয়ে মিলে এই হিমে তিন চার স্তরের গরম কাপড়ের নিচে গরম হয়ে থাকা হাত পা এক্কেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল নিমিষে। রাতের ধোঁয়াশায় ঢাকা এই চত্বরটিকে চায়নিজ নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে নানান রঙ্গয়ের আলোয় সাজানোর কারণে কিছুক্ষণ আগেও এই জায়গাটিকে বেশ মোহময় মনে হলেও, এখন মনে হচ্ছেই সবই বুঝি অন্ধকার!
কপাল ভালো, দ্রুতই খুঁজে পেল চোখ ওদের। লুকোচুরি জাতীয় কোনও একটা খেলায় মেতেছিল মনে হচ্ছে ওরা। এইমাত্র
‘ভাইয়া এই যে আমি এখানে’ অভ্রর গলা কানে যেতেই তা অনুসরণ করে দ্রুত চোখ বাঁয়ে ঘুরে যেতেই, দেখা গেল মিটার বিশ পঁচিশ দূরের শপিংমলের সামনে জায়েন্ট পাণ্ডা এবং অবশ্যই বান্দর বছরের বানর, ও গাছপালা সহযোগে যেই কৃত্রিম বনের আবহ তৈরি করা হয়েছে, সেইখানে আলো আধারিতে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্র।
দ্রুত মেঝে পড়ে থাকা ব্যাগ দুটো দু হাতে নিয়ে, ওদের দিকে এগুতে এগুতে তুমুল উদ্বিগ্ন এবং অবশ্যই কিছুটা বিরক্তি মাখা গলায়, কী ব্যাপার তোমার এখানে কী করছ? আমি তো তোমাদের দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এই ব্যাগগুলো ওখানে ফেলে রেখেছিলে কেন? চোরেরা যদি নিয়ে যেতো?
এসব বলতে বলতে ওদের দিকে এগুতেই, ঐ কৃত্রিম বনের দুই ফাঁক থেকে বেরিয়ে দুপুত্র, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলতে থাকল সরি বাবা, সরি বাবা, সরি। লেখক: প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।