দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩০ জুন, ২০২৪ at ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

দাম কম তো কামও কম

নো, নো। নো লেত। থাত্তি , থাত্তি” বলতে বলতে নিজ আসন ছেড়ে উঠে, সামনে এসে আমার একদম নাক বরাবর আমি যে একটু আগে ১৫ রেন মেন নি দিয়েছিলাম তাকে। সেগুলো তুমুল অসিহষ্ণুতার সাথে নাড়াতে লাগলো এই স্টলের ক্যান্ডিওয়ালা। এতে প্রথমে মনে হল, বাহ! চান্দুর মুখে তো দেখি ফুটছে বুলি! কিন্তু শুরুতে তার দেহভঙ্গিতে যে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠেছিল, সেটি দ্রুতই মনে হচ্ছে পরিণত হচ্ছে মারমুখী ভঙ্গিতে! ঠিক যেমনটা হয়েছিল অভিজ্ঞতা আজই বিকেলে, ঐ হুতং মানে গলির বাজারের স্যুভেনির বিক্রেতা হেমাঙ্গিনীর সাথে। এদিকে তার মুখের উচ্চস্বরের চুং চাংয়ের সাথে ঐ সামান্য ইংরেজি বাতচিত মিলে যে তুমুল শোরগোলের মতো শোনা যাচ্ছে, তা দেখছি সচকিত করে তুলেছে আশপাশও। বড়ই বিব্রত বোধ করতে লাগলাম এতে। নাহ আর দেরী করা যায় না, টাকা পয়সার চেয়ে মানসম্মান বড়। ভাবতে ভাবতে দ্রুত তার হাতে থেকে আগের দেয়ায় নোটগুলো নিয়ে, একটা পঞ্চাশের নোট গুঁজে দিতেই, জোঁকের মুখে বুঝি নুন পড়লো!

নোটহাতে পেয়ে দ্রুত নিজ আসনে গিয়ে বসে, ব্যাটা এখানকার নিয়মমাফিক পঞ্চাশের নোটটিকে টিপে টুপে পরখ করে , ঐটি যে জাল নয় তা নিয়ে সন্তুষ্ট হবার পর ক্যাশ বাক্সে তা রেখে বাকি টাকা হাতে ফেরত দিতেই, তিলার্ধ দেরী না করে আশেপাশের স্টলগুলোর কোনটার দিকেই আর ভ্রূক্ষেপও না করে এগুলাম সামনে দ্রুত।

নাহ এই বেটা যে উচ্চকিত নাটকের অবতারণা করলো এইমাত্র, তাতে মনে হচ্ছে আশপাশের স্টল থেকে আর কিছু কেনার ভরসা পাচ্ছি না। কেন জানি মনে হচ্ছে আশেপাশের সব বিক্রেতারাও আমাকে তাদের কোন ক্রেতা তো নয় বরং আজীব জীবই ঠাউরে, করবে নানান নাটকের অবতারনাই।

কিন্তু ঘটনাটা যে কী হলো? তা তো বুঝতে পারছি না। আমাদের দেশে চায়না থেকে যে ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্রগুলি যায় , সেগুলি তো শুনেছি নাকি এমনভাবে ক্যালিব্রেট করা থাকে যে, তার কোনটা ৮০০ গ্রাম, কোনটা বা ৯০০ গ্রামকে নির্দ্বিধায় দেখায় ১ কেজি। এখানে ঐ যন্ত্র কি তাহলে তারচেয়ে কমকেও ১ কেজি দেখায় নাকি?

সাথে সাথে মনে পড়লো বেশ কিছুকাল আগে ঢাকাতে এক চেনা ব্যবসায়ীর কাছে ক্রেতা ঠকানোর এই চায়নিজ ক্যারিশমার কথা শুনেছিলাম। ঐ ভদ্রলোক সেসময় চায়না থেকে এম পি থ্রি নিয়ে ঢাকায় বিক্রি করতেন পাইকারিভাবে।

তার ভাষ্যমতে তার চেনা এক চায়নিজ উৎপাদক নাকি বাহ্যিকভাবে দেখতে একই চেহারার, এমপি থ্রি ঢাকারই দুই ব্যবসায়ীর কাছে দুই দামে বিক্রি করতো নির্দ্বিধায় । ব্যাপারটা এরকম, ধরা যাক দুই ঢাকাই ব্যবসায়ি চায়নায় গিয়ে দুজনেই একশ মেগাবাইট মেমরির এম পি থ্রি কেনার মনস্থ করেছে। কিন্তু তাদের একজন প্রতি এম পি থ্রির জন্য ৫০ রেন মেন বি দিতে রাজি হলেও, অন্যজন ৩০ এর বেশী দিতে রাজি নয়। কিন্তু চায়নিজ সেই উৎপাদক দুজনের কাউকেই হারাতে রাজি নন। তাই সে বাইরে থেকে দেখতে একই রকম দুটো এম পি থ্রির চালান তৈরি করে দিয়ে দিত দুজনকে দুই দামে। দেখতে একই রকম ঐ গুলোর মগজের ধারণক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য কেউ যদি ওগুলোকে কেনার আগে কম্পিউটারে চেক করে, তবে দুটোতেই ১০০ মেগাবাইটের জায়গা আছে দেখা যাবে। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যাবে যে, কম দামেরটায় তিনটা চার বা পাঁচটা গান বা মিউজিক কপি করার পর আর জায়গা নাই। অন্যদিকে বেশী দামেরটায় ঠিকই দেখা যাবে ঢের বেশী গান বা মিউজিক স্টোর করা যাচ্ছে। যার মানে হচ্ছে দেখতে একই রকম হলেও, দাম ভিন্ন তো কামও ভিন্ন।

আচ্ছা তেমনি কিছুই হল নাকি আমার সাথেও? কিন্তু আমি তো টাকা কমও দেইনি? আরো কথা হচ্ছে ভিনদেশে এইরকম দুই নম্বর কারিশমার পণ্য পাঠিয়ে ব্যবসা করলেও, নিজদেশেও কি চায়নিজরা তাই করবে না কি? তা ই বা করবে না কেন? যে যাবতকাল ব্যবসা করা শিখেছে মানুষ, সে শুরুর দিক থেকে বহুকাল ব্যবসায়ীর কাছে শুধুমাত্র লাভ করাই তো ছিল মোক্ষ। পরে না নানা দেশে, সমাজে, নানান আইন কানুন করে সেই লোভের মুখে লাগাম লাগানোর চেষ্টা হয়েছে এবং হচ্ছে এখনো। আমাদের দেশেই কি দেশী ব্যবসায়ীরা, নানান পণ্যে নানান ভেজাল মিশিয়ে নিজ দেশের মানুষকে খাওয়াচ্ছে না? তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন চায়নায়?

আরে বোঝ না চায়নায় তো আইন কানুন খুব কড়া।

হুম তা আইন যদি অতোই কড়াকড়ি হয়, তাহলে এখানে জাল নোট থাকে কিভাবে ? অতএব দুই নম্বরী নিজ দেশেও করতে পারে চায়নিজরা।

তাও ঠিক। তবে মনে হচ্ছে ওইরকম করলেও, করবে নিশ্চয়ই তারা গ্রামে গঞ্জে । বেইজিং শহরের ডাউন টাউন এলাকার অভিজাত শপিং মলের আশেপাশের দোকানে বা বাজারে ঐরকম জালিয়তি করার তো কথা না।

আচ্ছা, আমিই বা কেন মনে করেছিলাম যে, এইযে দামগুলো লেখা আছে এগুলো সব এক কেজির দাম? হতেও পারে এগুলো এক কেজি না, এক পাউন্ডের দাম। চায়নিজরা কেজি, পাউন্ড নাকি তাদের নিজেদের কোন ওজনের এককে, এসব বিক্রি করছে তা তো জানি না। একসময় আমাদের দেশেও তো মন, সের, ছটাক, তোলা এসবকে ওজনের একক হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখেছি এই আমি নিজেও শৈশবে। এমনকি বইপত্রে সের কে ওজনের একক পড়লেও, কুমিল্লায় দেখেছি বিশেষত চাল, আটা এসব বিক্রি হয় সোয়া সের এককে! একইরকম কিছু কি এখানেও হচ্ছে নাকি? আচ্ছা দেখিই না গিয়ে ঐ স্টলে পরীক্ষা করে।

এইসব ভাবতে ভাবতে আর মনের দুজনের আলোচনা শুনতে শুনতে এরই মধ্যে চলে এসেছি ঐ স্টল ছেড়ে একদম অন্যমাথার আরেকটি স্টলের সামনে। ছোট্ট এই স্টলের ওজন মাপার যন্ত্রটা বসানো একদম কাউন্টারের উপরেই। কাছে গিয়ে সেটির পর্দায় নজর দিতেই দেখি ওটা আসলেই গ্রাম, কেজি এককেরই যন্ত্র। তাতে লেগে গেল ধন্দ আরো?

নাহ ধন্দে থাকার দরকার কী? দেখিই না পরীক্ষা করে। এই ভেবে এখানকার দোকানিকেও হাতের আঙ্গুলে এক দেখিয়ে বললাম দাও তো দেখি তোমার মাল এক কেজি। নাহ এখানে আর টেস্ট করলাম না স্যাম্পল। কারণ ঐ যে, বেশ কিছু স্যাম্পল চেখে দেখার পর কোনটারই স্বাদ আর আলাদা করতে পারছি না জিভে। অতএব বৃথা সে সাধনা।

আমার কথায় এরই মধ্যে দোকানি একটা পলিথিন ব্যাগে আড়াই মুঠো মতো পরিমাণ ক্যান্ডি ঢুকিয়ে, সেটি ঐ যন্ত্রের উপর রাখতেই দেখি, কাঁটাটি তার ঠিকই নড়চড়ে গিয়ে ঠেকেছে একদম ৫০০ গ্রামের কাছাকাছি ঘরেই। সেটি দেখে দোকানি তাতে আমাদের দেশের দোকানিদের মতোই প্যাকেটটা হাতে তুলে দেবার আগে আরকেটা ক্যান্ডি ঢুকিয়ে ধরিয়ে দিল আমার হাতে। ভাবখানা এমন যে, “এই যে দেখো দিলাম তোমারে অতিরিক্ত বোনাস একটা”হাতে নেবার আগে চোখের আন্দাজেই বুঝেছিলাম এটাতেও আগেরটার পরিমাণই দিয়েছে। যার মানে হচ্ছে, এইখানে যদি যন্ত্রে কম দেবার কেরামতি থাকেও, তবে আছে তাতে ৫০ গ্রাম কিম্বা ১০০ গ্রামের হেরফের। একদম আধা কেজিকে, এক কেজি দেখাবার মতো হেরফের করছে না। অতএব নিশ্চিত এরা হয় পাউন্ডের এককে ওজন করে বিক্রি করছে, না হয় ব্যবহার করছে কোন চায়নিজ ওজনের একক। আর সেই ১ একক হল আম্রিকান ৫০০ গ্রামের সমান। নিজ মনে এইরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছে একে এর প্রাপ্য দাম ২০ রেন মেন বি দিতেই, নিঃশব্দে সেটি সে ক্যাশ বাঙে রাখতেই, মাথার ভেতরের ক্রেতাটি একাউন্টেন্ট হয়ে উঠলেন আড়মোড়া ভেঙ্গে ।

ব্যাপার হচ্ছে, শুরুতে তো বাংলা টাকায় এখানকার ক্যান্ডিগুলোর দাম হিসাব করেছিলাম এক কেজি ধরে, এখনতো দেখছি ঐ দাম তো আধা কেজির! এতে তো সব দামই তো ঝট করে হয়ে গেল দ্বিগুণ! ফলে ক্রেতা হিসেবে জিতে যাচ্ছি ভেবে যা কিনলাম, নতুন হিসাবে তো মনে হচ্ছে নাহ জিততে পারিই নি, বরং মনে হচ্ছে তো হেরেই গেলাম অবশেষে! আরে রাখো তো তোমার ও হারজিতের হিসাব। দেখছো না এখানকার সব চায়নিজ ক্রেতাই তো কিনছে এসব এই দামেই। ওরাও যদি হেরে থাকে হেরেছ তুমিও। তদুপরি দেশে যেসব বন্ধুবান্ধব আত্মিয় স্বজনদের জন্য নিচ্ছ এসব, তাদের কাছেতো এ বস্তু অবশ্যই ভিন্নধর্মী চমৎকার কিছু মনে হবে। অতএব এ নিয়ে আর চিন্তা করার দরকার কি? তারচেয়ে বরং কম দাম, বেশী দাম মিলিয়ে আরো তিন চার রকম নিয়ে নাও। তবে এখন নেবে সেসব স্টল থেকে যেখান থেকে স্যাম্পল খেয়েছ । নুন খাওয়ার পর গুণ গাইতে না পারো কেনা তো উচিৎ তার কাছ থেকেই।

মনের দ্বিতীয়জনের যুক্তি এবার নির্দ্বিধায় মেনে নিয়ে, জনা চারেক স্টল থেকে ক্যান্ডি/মোরব্বা/ আচার কেনার পর, ওগুলোর সম্মিলিত ওজনের হিসাব কষে, কেনাকাঁটা ক্ষান্ত দিয়ে ঐ আচার মার্কেট থেকে বেরুতে বেরুতে, বাজে এখন ক’টা? দলের বাকিরা আছে এখন কে কোথায়? যে যেখানেই থাকুক আটটায় সবাইকে ম্যাকের সামনে জমায়েত হতে বলেছিলাম তো। এসেছে কি আদৌ তারা কেউ? এসব ভাবতে ভাবতে দরজা ঠেলে বেইজিং হিমে ঝাঁপিয়ে পড়তেই“বাবা , ঐ যে বাবা? “

আমি দেখেছি আগে! আমি দেখেছি আগে!”

শোরগোল তুলতে তুলতে পুত্রদ্বয়ের মধ্যে অভ্র ছুটে এলো ম্যাকপ্রান্ত থেকে, যেখানে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মা ও ফুপ্পি । আর বড়পুত্র এলো দৌড়ে সামনের নানান রঙ্গয়ের আলোক সজ্জায় সজ্জিত চত্বরটি থেকে।

এদিকে এই আমি দুইভাইয়ের হস্তগত হয়ে পড়তেই, দুজনে ওরা টেনে টেনে নিয়ে তারা হাজির করলো তাদের মা ফুপ্পির কাছে।

বাহ তোমাদের কেনাকাটা সব শেষ নাকি? কখন এসেছ তোমরা এখানে? দেখোতো বাজে কয়টা এখন? পুত্রদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে করতে লাজু ও হেলেনকে এসব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই

সেভেন ফিফটি বাজে এখন?”

আমি তো বেশ আগে এসেছি।“

এইমাত্রই আসলাম আমরা।”

এলো উত্তর যথাক্রমে দীপ্র, হেলেন আর লাজুর কাছ থেকে।

তোমরা এইমাত্র আসলে মানে? অভ্র দীপ্র তো হেলেনের সাথে গিয়েছিল। তোমাকে পেল কোথায়?

হ্যাঁ ঐ মার্কেটে দেখা হয়েছিল আমাদের। একসাথে অভ্রর জন্য ব্যাগও তো কিনে ফেললাম, এই যে দেখ?

ভেরি গুড! সবাই আমরা তাহলে সময়মতো এসেছি। কেনাকাটাও তো শেষ মনে হচ্ছে। আচ্ছা তা হলে আমরা কি এখন ম্যাকে ঢুকবো নাকি খাওয়ার জন্য? হোটেলে ফেরার আগে খাওয়া দাওয়ার কাজ সারা হয়ে যাক। কী বল?

না বাবা, এখন ম্যাক খাবো না তাই না ভাইয়া? কে এফ সি খাবো!” অভ্রর এ দাবীর ঘোরতর সমর্থন এলো দীপ্ররও কাছ থেকে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ : প্রেক্ষিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়