ব্যাপার হচ্ছে বাচ্চাদের জন্য লেখা আমেরিকান এই লেখকের এই সিরিজের বইগুলো অভ্রর এতোটাই পছন্দ যে, ঐ সিরিজের নতুন বই বাজারে আসা মাত্রই, ওর ওটা চাইই চাই। আর একবার হাতে আসলে সে বই, প্রথমে তো পড়ে না গেলে গোগ্রাসে। তারপর ফের পরে একাধিক বার রসিয়ে রসিয়ে। এই বইয়ের প্রতি ওর আগ্রহ দেখে মনে পড়ে আমার বালকবেলার প্রিয় সিরিজ দস্যু বনহুরের কথা। তবে আমার চেয়ে ওর কপাল অবশ্যই বহুগুণে ভাল। দস্যু বনহুর তো পড়তাম আমি প্রধানত ভাড়ায়। কিম্বা কদাচিৎ আশেপাশের সৌভাগ্যবান কেউ যখন কোন কপি কিনতো, তার পিছনে আঠার মতো লেগে থেকে নানান তোষামোদে গলাতে পারলে এক দুদিনের জন্য ধার নিয়ে। অতএব ঐ বইগুলোর কোনটাই আমার কাছে কখনোই দু তিনদিনের বেশি থাকতো না। সে তুলনায় পুত্ররা তো পায় যেকোনও বইয়েরই সম্পূর্ণ মালিকানা। ফলে অভ্র এ বইগুলো বারবার পড়ে গভীর মনোযোগে। তদুপরি এই বইগুলোর পাতায় পাতায় যে সব কার্টুন আঁকা থাকে, সময় সুযোগ করে প্রায়শই ও ওইগুলো আঁকে আপনমনে। খুব ছোটবেলা থেকেই আঁকার হাতও তার চমৎকার, যার কারণেই ওকে ওর ফুপ্পি নাম দিয়েছে বাচ্চা পিকাসো।
একই বই গভীর মনোযোগে বারবার পড়ার পর, সেই বইয়ের ছবিও যদি কেউ এঁকে ফেলে একে একে সব,তাহলে সেই বই মুখস্থ না হয়ে আর যায় কোথায়? আবার তাতেই কি শেষ নাকি? আমেরিকান সিনেমা ব্যবসায়ীরা যখন টের পেয়েছে এই বিশেষ সিরিজটি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে বিশ্বজুড়ে বাচ্চাদের মধ্যে, তারা সিনেমাও বানিয়ে ফেলেছে ওগুলোর, যেগুলোও দেখা বাদ রাখেনি অভ্র। অতএব এই বইয়ের চায়নিজ অনুবাদের বর্ণ বা অক্ষর গঠিত ভাষা ও পড়তে না পারলে কী হবে, ছবির ভাষা দেখে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। আসলে মানুষের মুখের ভাষা, লেখার ভাষা, এমনকি দেহভাষাও দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে বদলে গেলেও, ছবির মানে চিত্রকর্মের ভাষা তো বদলায় না। ছবি ও চিত্রকর্মের ভাষা তো সর্বজনীন! শুধু কি তাই? ছবির ভাষা তো মনে হচ্ছে সর্বকালীনও, বদলায় না সময় যা পরিভ্রমণেও! এ কারণেই তো ১৪/১৫ হাজার বছর আগের আলতামিরার গুহাচিত্রও আমরা পড়তে পারি। সেই প্রাগৈতিহাসিক শিল্পী, ঠিক কোন ভাষায় কথা বলতেন তা না জেনেও বুঝতে পারি ঠিকই গুহার দেয়ালে আঁকা চিত্রভাষা!
এদিকে এরই মধ্যে বইটি বেশ করে উল্টে পাল্টে নেড়ে চেড়ে পরখ করে পুরো সন্তুষ্ট অভ্র জানালো নাহ, এটা একদমই ঠিক আছে! আসলে ঢাকার রাস্তায় প্রায়শই এই বইয়ের যে কাঁটাবন সংস্করণ, মানে নকল কপি বিক্রি করে হকারেরা, তা নিয়ে ওর বেশ ক্ষোভ আছে। নকল বই থেকে যে তার প্রিয় লেখকের যে কোন লাভ হয় না বরং হয় বঞ্চিত, এটা সে জেনেছিল আমাকেই প্রশ্ন করে। সে জন্যই ঢাকার রাস্তার ঐসব নকল বইয়ের উপর ওর আছে তীব্র ক্ষোভ!
এখানেও তাই প্রথমে বইটির চায়নিজ সংস্করণ দেখেও সম্ভবত ওর সন্দেহ হয়েছিল যে এটিও কাঁটাবন সংস্করণের সমগোত্রীয় কি না? বইয়ের ভেতরের পাতা উল্টিয়ে দেখে, ছবি গুলো সব দেখে, প্রাথমিকভাবে অনুবাদের ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশের পর, সেটি নেড়ে চেড়ে আর কি যে পরখ করলো ও, ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে এখন ওর হাসিমুখ দেখে বুঝতে পারছি, চায়নার অন্যান্য সব জিনিষ এমনকি এখানকার রাস্তায় দেখা ফেরারি, রোলস রয়েস ওর সন্দেহ থাকলেও এই বই নিয়ে তা নেই! ফলে জিজ্ঞেস করলাম, নেবে নাকি বাবা ওটা?
আমার এই প্রশ্নে বেশ অবাক হয়ে বললো ও
‘ নাহ! কেন? ওটা তো আছে আমার? আমি তো চায়নিজ পড়তে পারি না!’
না মানে বলছিলাম পড়ার জন্য না, এমনি স্যুভেনির হিসাবে নেবে কি না ওটা।
‘না না। লাগবে না’ অভ্রর এ জবাবের পিঠাপিঠি শিশুকিশোরদের বইয়ের গোটা অংশটি জরীপ করে ফিরে আসা দীপ্র জিজ্ঞেস করলো, ‘কী নিতে বলছো ওকে বাবা?’
নাহ মানে বলছিলাম ও স্যুভেনির হিসাবে এই বইটার একটা চায়নিজ ভার্সন নেবে কি না।
‘ওহ আচ্ছা।’ কিছুটা বিমর্ষভাবে উত্তর এলো দীপ্রর কাছ থেকে।
‘ভাইয়া তোমার এস্টেরিঙ ওবেলিঙ পেয়েছ কি এখানে?’
‘নাহ! ঠিক আছে চল যাই এখান থেকে বাবা’ ছোট ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে কিছুটা অপ্রস্তুত দীপ্রর এই উত্তর শুনে পরিষ্কার হল ওর মন খারাপ হবার কারণ! দুই ভাইয়ের সার্বক্ষণিক যে দ্বৈরথ আছে তার একটিতে তো, ও হেরে গেল এখন! অভ্রর পছন্দের বইয়ের চায়নিজ ভার্সন এখানে পাওয়া গেলে তারটা যেহেতু পাওয়া গেল না, এই ব্যপারটাকে ছোটভাইয়ের কাছে নিজের পরাজয় হিসেবেই ধরে নিয়েছে মনে মনে ও।
নাহ দুজনের মধ্যকার এই নীরব দ্বৈরথকে সরব হতে দেয়া যাবে না। দ্রুত তাই, চল যাই এখান থেকে এখন বলে, দুজনকে বগলদাবা করে ঘুরে হাঁটা ধরলাম এই মল থেকে বাইরে বেরুবার যে গেইটটি দেখতে পেলাম সামনের বাঁ দিকে, সেই দিকে।
সপুত্রক তড়িঘড়ি করে শপিংমলের বাইরে আসতেই হিম ঝাপটার সাথে সামনের দৃশ্য বুঝিয়ে দিল বেড়িয়েছি ভুল দিক দিয়ে। কারন সামনে চায়নিজ নববর্ষের সাজে সজ্জিত ঝলমলে সেই চত্বরটা দেখছি না। তবে হ্যাঁ এদিকটাতেও সাজসজ্জার কমতি নেই। তবে এগুলো ভিন্ন ধরনের।
এতো চেনা জায়গায় রাস্তা ভুল করলাম কেন? এ নিয়ে ভাবছি যখন, সাথে সাথেই মনে পড়লো আসলে আমরা তো ঢুকেছিলাম ঐ চত্বরের দিক থেকে খেলনার দোকানে, যেটি ছিল শপিং মলটির বাইরের দিকে। সেই দোকান থেকে কেনাকাটা করে, পেটশপ খোঁজার জন্য খেলনার দোকানটির যে গেইট দিয়ে বেড়িয়েছিলাম তাতে তো ঢুকে পড়েছিলাম শপিং মলটির অন্দরমহলে। সেই অন্দর মহলের কোন গেইট দিয়ে বেরিয়ে যে কোথায় হাজির হয়েছি এখন বুঝতে পারছি না দিককানা আমি। বরং এদিককার ভিন্ন ধরনের আলোক সজ্জা দেখে পরে গেছি ধাঁ ধাঁয়। যতোই চেনা মনে করি না কেন, শহরের এই অংশটিকে, চিনি তো আসলে এই এলাকার মূল রাস্তার, বহিরঙ্গেরই কিছুটা। এখন এই ধাঁ ধাঁর জট খোলার একটাই সহজ পথ, তা হল ফের ঐ শপিংমলে ঢুকে, সেই খেলনার হয়ে চেনা পথ ধরে বের হয়ে সেই চত্বরে ফেরা। এই ভেবে পুত্রদের নিয়ে শপিং মলের ভেতরে দিকে যাত্রা করার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই – ‘কী বাবা, আমরা কি আবার যাবো নাকি ঐ মলে? কেন যাবে আবার?’ এ কথা দীপ্র জিজ্ঞেস করতেই যখন জানালাম কারন, বিজয়ীর ভঙ্গীর এক হাসির সাথে জানালো ও
‘দূর কী বলছো? ঐ যে দেখছো না ডান দিকের ঐ ল্যাম্পপোস্টটা, ওটা তো আছে ঐ বড় রাস্তার ফুটপাতের উপর। ওখানে গিয়ে ডান দিকে হাঁটতে শুরু করলেই তো চলে যাবো আগের জায়গায়। তুমি চিনতে পারছ না রাস্তাটা? আমার তো মনে আছে এদিক দিয়েই তো আমরা অনেকবার আসা যাওয়া করলাম।’
দিকভ্রান্ত পিতাকে সঠিক দিকের দিশা দিতে পেরে দীপ্র তার বিমর্ষভাব কাটিয়ে তুমুল উৎসাহে দিল হাঁটা ঐদিকে। যেরকম আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাগুলো বলে হাঁটা দিল দীপ্র, তাতে তার উপর আস্থা রাখতেই হয় ভেবে, অভ্রসহ অনুসরণ করতে করতে ভাবলাম, ভুল যদি হয়ও এতে। হোক না। সময় তো আছেই হাতে। এখন এভাবে ওকে থামিয়ে দিলেতো, নিজ থেকে কিছু করার উৎসাহ চলে যাবে ওর। তদুপরি মানুষ তো ভুল থেকেই শেখে বেশি। হলে হউক না একটু ভুল।
বড় পুত্রকে অনুসরণ সামনে এগুতে এগুতে, এসময় ফের মনে ঘাই দিয়ে উঠলো সেই বিষয়টি, যে ভাবনাটি পেয়ে বসেছিল, খেলনার দোকানে ঢোকার পর পর। মানে ডিজিটাল টেকনলজির সড়ক পথে নানান ধরনের কর্পোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে যেভাবে দিকে দিকে, দেশে দেশে, সমাজে সমাজে ঘটছে প্রসার পশ্চিমা সংস্কৃতির, মনে পড়লো সে ব্যাপারটি। খেলনার দোকানে সাজিয়ে রাখা নানা মডেলগুলো যেগুলো কি না আমেরিকান আর ইউরোপিয়ান গল্পের চরিত্র, সেগুলোর কাছে তো চায়না বা বাংলাদেশের গল্পের চরিত্র গুলো মার খেয়ে ভূত হয়ে গেছে। এখনকার বাচ্চাদের কাছে তো সেগুলোর কোনই আবেদন নাই। আছে সে গুলো আজ তাঁদের পিতামাতা ও তাদের দাদা দাদাী নানা নানির মননে। এতক্ষণ এটি খেলনা বা সিনেমার মাধ্যমে ছড়াচ্ছে বলে মনে হলেও, এখন নিশ্চিত হলাম ঘটছে তা বইয়ের মাধ্যমেও। এই ডায়েরি অব উইম্পি কিড নামের বইটি বাংলাদেশের চেয়ে এখানেই তো মনে হচ্ছে বেশী জনপ্রিয়। আমাদের দেশে তো এটির বাংলা অনুবাদ বের হয়নি, তবে চায়নায় তো ঠিকই হয়েছে চায়নিজ অনুবাদ। বাংলাদেশের অভ্র আর চায়নার কোন ফেং, চেং বা চাও নামের বাচ্চা তো এই বইয়ের কারণে দাঁড়িয়ে আছে একই সমতলে!
লেখক: প্রাবন্ধিক, ভ্রমণসাহিত্যিক।