এই হুতংয়ের খাদ্য অংশে পুত্রদের জন্য চিংড়ি কেনা শেষ হতেই, কাঁচা থেকে শুরু করে নানান প্রকারের রন্ধন প্রণালির নানান বংশের আমিষোদ্ভুত বোটকা গন্ধ, নাক দিয়ে টেনে নিয়ে সে সবের অর্ধভোজন থেকে বাঁচার জন্য ,দুজনকে বগলদাবা করে দ্রুত বাড়ালাম পা, এই সমকোণটির অন্যবাহুর দিকে যেদিকটায় আছে লাজু আর হেলেন। মোটামুটি নিশ্চিত যে এরই মধ্যে কেনার মতো জিনিষপত্র তারা দেখতে পেলেও, কিনতে কিছু পারেনি অবশ্যই। তাদের কিনতে না পারার কারন এই নয় যে, তাদের কাছে পর্যাপ্ত রেন মেন বি নেই। বরং এর একমাত্র কারন হল ভাষাবিভ্রাট। যেখানে এখানকার বড় বড় ঝলমলে শপিং মলগুলোর পোশাকেআশাকে কেতদুরস্ত বিক্রয়কর্মীদেরই ভাষাগত সমস্যা তুমুল প্রকট, সেখানে এখানে তো আছে হুতং চায়নিজরা। মানে আমজনতা চায়নিজ।
নাহ এদিকটায় এসে,বেশ অনায়াসেই পাওয়া গেল দুজনকে। এবং ওদের সাথে দেখা হতেই, কেনাকাটা বিষয়ে যা ভেবেছিলাম সেটাও সত্যি প্রমাণিত হল নির্ভুল। তবে কাজ তারা কিছুটা এগিয়ে রেখেছে এরই মধ্যে । হুতং উপচে পড়া পণ্যসম্ভার থেকে ওরা মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে কী কী কিনবে । যদিও দেখছি প্রতিটি স্টলেরই পণ্যের মাঝে ছোট ছোট সাদা কার্ডবোর্ডে ১০, ২০ ইত্যাকার সংখ্যা লেখা আছে ইংরেজিতে , যা সম্ভবত ঐসব পণ্যের দাম নির্দেশ করছে তারপরও ভাষা বিভ্রাটের ভয়ে ওরা ওসব কেনার কোনই চেষ্টা করেনি।
“এই শোন, ঐ যে ঐ মহিলা বসে আছে তার দোকানটাতে যাই চল। তার কাছেই সবচেয়ে বেশী শো পিস আছে । আচ্ছা এখানে কি দামাদামি করা যাবে?“
“কেন যাবে না দরদাম করা? এইসব তো ফুটপাতের দোকান।“
লাজুর কথার পিঠাপিঠি হেলেন দামাদামির ব্যাপারে তার মতামত বেশ জোরের সাথে জানালেও কেন জানি সন্দেহ হল আমার। যদিও আমাদের দেশের নানান ব্যাবসায়ী যারা অহরহই চায়না থেকে নানান পণ্য আমদানি করেন, তাদের কাছে শুনেছি যে অর্ডার নেবার সময় চায়নিজরা এক সেন্ট আধা সেন্ট নিয়েও তুমুল ঝুলাঝুলি করে। তারপর যদি হেরে যায় সেই দামাদামিতে বাংগালের কাছে, তবে তাও তারা তুলে নেয় পণ্যের মানের ব্যাপারে চায়নিজ টেকনিক খাঁটিয়ে। ভাবছি তাই দাম লেখা ঐ কার্ডগুলো থাকার পরেও আসলেই দামাদামি করার কোন সুযোগ আছে কি না আদৌ।
তদুপরি আজকাল ব্যাংককের বিশেষত শহরের একদম প্রাণকেন্দ্র মানে সুকুমভিত এলাকার ফুটপাতের দোকানিরাও দেখেছি জিনিষপত্র বিক্রি করে একদামে। অথচ একসময়, মানে সেই নব্বই দশকে ঐসব দোকান থেকে আমি নিজেও দামাদামি করেই কিনেছিলাম নানান কিছু। সেই রকম এই হুতং বাজারও তো আছে মোটামুটি বেইজিঙয়ের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এই ডং চেং ডিসট্রিক্টে। সেটাই বা বলি কেন, আমাদের ঢাকাতেই তো আজকাল অহরহই দেখি ফুটপাতেও হকারেরা দামাদামি করে সময় নষ্ট করতে চায় না। আজকালকার ডিজিটাল সময়ে সবই যখন হচ্ছে খুবই দ্রুত, তারপরও মনে হয় আছে সবাই সময়ের ওভাবে দৌড়ের উপরে। ফলে সময়কেও মাপছে সবাই টাকায় । জানে সবাই এখন যে “টাইম ইজ মানি” । এ বিষয়টি বাঘা অর্থনীতিবিদরা ও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসনের ঝানু শিক্ষকেরা তাদের ছাত্রদেরকে নানান থিউরি দিয়ে অংক কষে বোঝানোর চেষ্টা করলেও, ফুটপাতের এই ডিগ্রীহীন ব্যবসায়ির জেনে গেছে, বুঝে গেছে তা , নিজেদের ব্যবসার খাতিরে সহজাত ষষ্ঠইন্দ্রিয় মারফত। তাই দরদাম করে সময় নষ্ট করে একটা জিনিষ বিক্রি করে বেশী লাভ করার চেয়ে, তারা কমলাভে একদামে সেই একই সময়ে পাঁচটা পণ্য বিক্রি করে তার চেয়ে বেশী লাভের চেষ্টাতেই থাকে।
ভাবতে ভাবতে ভিড়ের ফাঁক গলে এগুচ্ছি সবাই মোটামুটি সতর্কতার সাথে, যাতে বেহুদা কারো সাথে ধাক্কা না লাগে। বলা তো যায় না এই চায়নিজ মুল্লুকের হুতংয়ে উটকো ভাবে হাজির হওয়া এই বাঙ্গালদের ব্যাপারে এখানকার চায়নিজদের কী রকম মনোভাব!
অতপর লাজুর নির্দেশিত সেই দোকানটির সামনে হাজির হয়েই মনে মনে খেলাম এক জোর ধাক্কা। কারন জবরজং এক ফোলা ফোলা মোটা জ্যাকেট পরে ওখানে একটা টুলের উপর পশ্চাতদেশ সামান্য ঠেকিয়ে দেখছি সমাসীন সাক্ষাৎ এক মৈনাক পর্বত!
এমনিতে পূঁজির পথে পা বাড়িয়ে চায়নিজদের অর্থনীতি ফুলেফেঁপে দৈর্ঘে প্রস্থে ও গভীরতায় সাই সাই করে বৃদ্ধি আগে থেকে জানলেও এবং এখান এসে তা চোখে পড়লেও, এ কয়দিনে এখানকার মানুষদের গড় উচ্চতা বৃদ্ধিটাই চোখে পড়েছে। কিন্তু ইনি তো দেখছি এদের অর্থনীতির মতোই বেড়েছেন দশদিকেই । জাপানি সুমো রেসলারদের সাইজের থলে থলে দেহের এই মৈনাকপর্বতের ভঙ্গিতেও মনে হচ্ছে এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে সে, কারো না কারো উপর। যতোই রমণীয় আর তুলতুলে হোন না কেন উনি, ঐ পাহাড়ের নীচে পড়লে যে কেউ অনায়াসে হয়ে যাবে চিড়েচ্যাপ্টা ।
“দাদা, আচ্ছা ঐখান থেকে কি বেছে বেছে নিতে পারবো যা যা লাগে?”
“হ্যা, হ্যাঁ আমিও তাই ভাবতেছিলাম। একটু আগে এদিকে দিয়ে যাওয়ার সময় যখন গেছি তখন তাই আর দাঁড়াই নাই এর সামনে।“
দলের দুই পরাক্রমশালী নারী সদস্যের করা এমত প্রশ্ন ও মন্তব্যে বোঝা গেল, মৈনাক পর্বতের ঐ মারমুখী ভঙ্গিতে তারাও কিছুটা হলেও ঘাবড়ে আছে। অতএব নিজের পৌরুষ প্রমানের এই তো সুযোগ ভেবে, কেন কেন? দেখা যাবে না কেন? সে তো এগুলি বিক্রি করতেই বসছে বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে–পর্বতের পাদেদেশের সামনের দিকটায় নানান ঝুড়িতে রাখা , নানান শো পিসগুলো উবু হয়ে নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা কোনটা নিতে চায়, কে, কয়টা? স্ত্রী ও বোনকে ঐ প্রশ্ন করতে করতে এক ফাঁকে ঘাড় একটু উপরের দিকে বাঁকিয়ে চোখ তুলে মৈনাকশিখরে চোখ ফেলতেই কোন রকম প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না ওখানে। তার বদলে চোখে যা পড়লো, তা হল তার গালের আর চোখের চারপাশের জমা হওয়া মেদভারে চায়নিজ ব্র্যান্ডের তার চোখ দুটো মনে হচ্ছে একদম বুজি মুদেই আছে।
“সব মিলিয়ে কয়টা নেব মোট? তা তো বুঝতে পারছি না! আচ্ছা আচ্ছা, ঐ যে ঐ শো’পিস গুলো দুই তিনটা করে নে। বেশী হয়ে গেলে হোক। দেশে ফিরে নানানজন কে দিতে গিয়ে কম পড়লে আর কোথায় পাবো।“ এসব বলতে বলতে হেলেন নিজেও লেগে গেল শো পিস বাছাইয়ে। এদিকে লাজুর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম মনে মনে তখনো সে হিসাব করছে নেবে কয়টা মোট।
চিনামাটি, ধাতুর তৈরি নানান ধরনের ট্রাডিশনাল এই শো পিস গুলো নাড়তে নাড়তে, মনে হল প্রথমে যদিও ভেবেছিলাম এগুলো সব হাতের তৈরি, এখন মনে হচ্ছে তা ঠিক না। প্লাস্টিক আর রাবারের তৈরি শো পিসগুলোর মতো সবই ফ্যাক্টরিতে তৈরি। হাতে তৈরি জিনিষ সব তো একদম এক ছাঁচের আর ধাঁচের হয় না। একটু আধটু এদিক সেদিক হয়ই তাতে একটা থেকে আরেকটার। কিন্তু এগুলো সবই একদম একই ছাঁচের। আসলে আজকাল কোথাও ফুটপাতে আর মনে হয় হাতে তৈরি কোন পণ্য বিক্রি হয় না। আগে ওসব পণ্য ব্রাত্য জাতের হলেও এখন সেগুলো হয়েছে সম্ভ্রান্ত। বিক্রি হয় সেসব আজকাল অভিজাত দোকানে। দামও ওগুলোর আকাশচুম্বী।
“ঠিক আছে, আমি এখান থেকে এ কয়টাই নিতে চাই। দাম কতো জিজ্ঞেস কর তো।“
নানান দামের নানান ঝুড়ি থেকে গোটা পাঁচ কি সাত শো পিস আলাদা করে এরই মধ্যে ঐ মৈনাক পর্বতের পাশের একটা সরু উঁচু বেঞ্চির উপর রেখে হেলেন একথা বলে উঠতেই , নড়েচড়ে উঠল পর্বত। আমাদের সাহিত্যের রসিকগুরু সৈয়দ সাহেবের ভাষায় মর্তমান কলর মতো আঙুলে দ্রুত ক্যালকুলেটর বোতাম টিপে মৈনাক সেটির পর্দাটি আমারই চোখের সামনে ধরতেই দেখি লেখা ৪৫০!
কিছুটা দম নিয়ে, চোখমুখ বুঝে সেই সংখ্যাটি মুছে লিখলাম ৩০০! সাথে সাথেই মৈনাক নিজের চোখের সামনে ক্যালকুলেটারটি ধরেই এক ঝটকায় জ্যাকেটের পকেটে তা চালান করে দিয়ে ফের স্থানু হয়ে গেলেন!
থতমত খেয়ে দ্রুত, ওকে, ওকে, প্লিজ, প্লিজ বলে কাতরভাবে ইশারায় বোঝালাম ঘাট মানছি। বিরাট ভুল করে ফেলেছি। দাও ফের ক্যালকুলেটরটা। ভুল শুধরে নতুন দাম বলছি–ধীরে সুস্থে নড়েচড়ে পকেট থেকে ফের ক্যালকুলেটর বের করে মৈনাক সেটির বোতাম টিপতেই ভাবলাম যাক হয়তো সে তার শেষ দাম বলে দিচ্ছে। কিন্তু হাঁ হতোম্মি চোখের সামনে সেই ক্যালকুলেটরের পর্দাটি আসতেই দেখলাম, আমাদের দেশে ভদ্রলোকের এক কথার মতো এই মৈনাকেরও দেখছি এক দাম। সেই একই ৪৫০ ই লিখে চোখের সামনে ধরে, মারমুখী ভঙ্গিতে আমাদের দেশের নেপালি কলার মতো ভোমা তার তর্জনীতে সেটি দেখিয়ে মুখে উচ্চারণ করলো দুটোমাত্র ইংরেজি শব্দ, প্রথমে “নো”, তারপর “গো”– বিদেশের মাটিতে একজন বিক্রেতার এরকম মারমুখী ভঙ্গিতে একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে তার দেহভাষা আর ঐ দুটি মাত্র ইংরেজি শব্দের অনুবাদ যা করলাম তার বাংলা হল, “ঐ হালা এই দামে নিলে নে , নইলে ফোট তাড়াতাড়ি এইখান থাইক্কা।“
“চল, চল যাই এখান থেকে। কিছুই নেব না এর কাছ থেকে। বলতে বলতে নিজের হাতের শো পিস গুলো দ্রুত ঝুড়িতে রেখে দিয়ে আমার হাত ধরে লাজু ভিড়ের ফাঁক দিয়ে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যেতেই বুঝলাম, মৈনাকের এরকম দুর্ব্যবহারে বড়ই চোট লেগেছে আমার বউয়ের দিলে! এদিকে গজ গজ করতে করতে দীপ্র আর অভ্রর হাত ধরে ওদেরকে টেনে নিয়ে পেছন পেছন আসছে হেলেন।
গোটা ব্যাপারটা খুবই দ্রুত ঘটায় এবং সম্ভবত এ সময়টায় নিজের হাতের চায়নিজ চিংড়ি রসিয়ে রসিয়ে খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকায়, দীপ্র কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি আমাদের এরকম হঠাৎ তড়িঘড়ি প্রস্থানের কারণ! পেছন পেছন আসতে আসতে ওর উৎসুক জিজ্ঞাসা– “কী? কী? কী হয়েছে এন? কি হয়েছে বাবা?”
“সি ওয়াজ ভেরি রুড।” ভাইয়ার জিজ্ঞাসার জবাবে অভ্র এই উত্তর দিতেই বুঝলাম চিংড়ি খাওয়া নিয়ে সে ব্যস্ত থাকলেও, ঘটনা সে দেখেছে গোটাই!
এদিকে ছোট ভাইয়ের উত্তর শুনে টিনএজ দীপ্রর রক্তে এই কিছুকাল আগে হাজিরা দেওয়া হরমোনেরা একসাথে সব মনে হচ্ছে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। দাঁত কিড়মিড় করে এক ঝটকায় ফুপ্পির হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে, ঘুরে দীপ্র ঐ মৈনাকের দিকে যেতে উদ্যত হতেই– “এই দীপ্র, এই মনু যাচ্ছো কোথায়? এই দাদা দেখ তো?”
হেলেনের গলায় এই তীব্র উদ্বেগ ধ্বনিত হতেই , দ্রুত পিছু ফিরে, দীপ্রর হাত ধরে বললাম , চল বাবা। কূল ডাউন। শোন এটা বিদেশ। এখানে আমরা এমন কিছু করবো না, যাতে আমাদের দেশের বদনাম হয় বুঝলে?
যাকে বলা হয় ঘাড় ত্যাড়া করা, পুত্র আমার ঠিক ওইভঙ্গিতে বলল, “আমরা যে বিদেশী এরা তো বোঝে না?”
পুত্রের ঐ ত্যাড়ামিতে হাসি পেল বড়ই। মনে পড়লো একসময় ঐ একই বয়সে আমিও ছিলাম এমনি। ঐ সময় এরকমই টগবগ করে ফুটতাম আমিও অল্পতেই। বড়ই পাতলা ছিল একসময় আমারও চামড়া। সহজেই তাতে হুল ফুঁটাতো নানান জনের নানান অপমান অবজ্ঞা। তবে বাইরের কারো ওরকম অবজ্ঞার ঝটপট প্রতিবাদ প্রতিরোধ করলেও , সবচেয়ে বেশী ঐ রকম অপমান অবজ্ঞা যাদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম তারা ছিলেন সবাই আমার আত্মীয়। তাদের ঐ সব হুল, সবসময়ই সহ্য করতে করতে ভেবেছিলাম দেব একদিন উত্তর সব একসাথে। শুধু সময় হোক । ইচ্ছে করলে এখন তো দিতেই পারি ওইসবের উত্তর, কিন্তু দেই নি তো তাও। মনে মনে এসব ভাবলেও পুত্রকে বললাম শোন
শেখ সাদী নামের একজন বিখ্যাত ইরানী কবি ও সাহিত্যিক নাকি বলেছিলেন, আদব শিখেছি আমি বেয়াদবের কাছে। এর মানে কী বলো তো বাবা? “মানে ও যেটা করে আমি সেটা করি না।”
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক