কী? কী? ওরা একা বেরিয়ে গেছে মানে? কোথায় গেছে? দীপ্র অভ্রর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে তাদের ফুপ্পির এই বয়ানের পিছু পিছু, রুমের ভেতর থেকে ভেসে এলো তাদের মায়ের তুমুল উৎকণ্ঠা! সন্তানের জন্য মায়ের উৎকণ্ঠার তুল্য আর কিছুই হয় না, এ কথা শিরোধার্য করেই বলছি, গতকালও যদি ওরা ঠিক এই কাজটিই করতো, তবে নিজেও আমি কম উৎকণ্ঠিত হতাম না। ফলে তারই ফলাফল হিসেবে তাদের এভাবে বেরিয়ে যাওয়াটি হেলেন ঠেকাল না কেন, তা নিয়ে নিশ্চয় বিরক্ত হতাম ভীষণ। কিন্তু আজকের দিবাভাগের প্রথমাংশজুড়ে সপরিবারে এ এলাকার ফুটপাত যেমন চষে বেড়িয়েছি, তাতে এ নিয়ে বেশ একটা আস্থার বোধ তৈরি হওয়ায় তেমন কোন উৎকণ্ঠা অনুভব করলাম না। সমস্যা হচ্ছে তার মানে কিন্তু এই নয় যে, উৎকণ্ঠা আমার পিছু ছেড়েছে! প্রকৃতিতে যেমন শূন্যস্থান থাকে না, তেমনি অন্য কারো না হলেও এই অধমের জীবনও উৎকণ্ঠাহীন নয় কখনোই। বরং প্রায়শই মনে হয় বেঁচেই তো আছি নিরন্তর উৎকণ্ঠা নিরসনের জন্য। কারণ এক উৎকণ্ঠা দূর করে হাঁফ ছাড়তে না ছাড়তেই তড়িঘড়ি করে সেই জায়গা দখল নেয় দেখি অন্য উৎকণ্ঠা! হল যেমন তা এই এখনও!
হ্যাঁ যে উৎকণ্ঠায় পড়লাম এখন, তা হলো আমাদের সামজের আদি অকৃত্রিম ননদ ভাবীর মধ্যে কারণে অকারণে তৈরি হওয়ার দ্বৈরথের যাকে বলে কঠিন মাইনকা চিপায় পড়ার উৎকণ্ঠা। লাজু যে স্বরে পুত্রদের ব্যাপারে তার মাতৃসুলভ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলো, হেলেন ঠিক সেটিকেই যদি ভাইপোদের সামলানোর ব্যাপারে নিজের ব্যর্থতা হিসেবে নিয়ে নেয়, তবেই কম্ম কাবার! শুরু হয়ে যেতে পারে তাতে দুজনের মধ্যে সরব না হলেও নিরব দ্বৈরথ। এ মুহূর্তে তা হয়ে গিয়ে, এই ভ্রমণের একদম শেষ পর্যায়ে এসে, যেন বা না নেমে আসে কোন উটকো দুর্ভোগ আমার কপালে; সে আশায় দ্রুত তাই হেলেনকে বললাম, ঠিক আছে ঠিক আছে, এখন যা তুই তাড়াতাড়ি নীচে। আসছি আমিও এই চা টা খেয়ে।
কপাল ভাল, আমার কথায় দ্রুত লিফটের দিকে আগুয়ান হেলেনের ভঙ্গি দেখে মনে হল, উৎকণ্ঠার ফাঁড়া আধাআধি হলেও কেটেছে! অতএব দরজা বন্ধ করে দ্রুত চায়ের কাছে ফিরে এসে, কাপের মধ্যে জোরে জোরে ফু দিতে দিতে, চায়ের কিছুটা ইজ্জতহানি করে সেটিকে শরবতের মতো খেয়ে শেষ করার আমার প্রচেষ্টা দেখে হেসে উঠে লাজু বলে উঠল– “আরে এরকম করে খাওয়ার দরকার নাই। এই এলাকা তো আমাদের সবার চেনাই হয়ে গেছে। তবে তারপরও অভ্রটার জন্য ভয় লাগছে। ও তো বেখেয়ালে অনেক সময় চলে যায় নানান দিকে। মনে নাই ঐ যে সিঙ্গাপুরে, সৌদি আরবে আর শ্রীলংকায় ওর হারিয়ে যাবার কথা?”
স্ত্রীর এ কথায় উৎকণ্ঠার বাকি আধাআধি কেটে যাওয়ার আনন্দেও এইমাত্র জারী হওয়া স্ত্রীআজ্ঞা উপেক্ষা করার সাহস করলাম না। তার বদলে ছোট পুত্রের ব্যাপারে ওর কথায় সায় দিয়ে চায়ের কাপে মোটামুটি চায়ের ইজ্জত রক্ষা করেই চুমুক দিতে থাকলাম ।
না, ঐ যে বলেছিলাম পুরোপুরি উৎকণ্ঠামুক্ত হতে পারি না, কেন জানি! প্রমাণিত হল তা ফের। যতোই উৎকণ্ঠামুক্ত থাকার ভান করি না কেন, দুজনেই যে তা পারিনি অবশেষে এখন বোঝা গেল তা, যখন বরাবরের চেয়ে দ্রুতই চা পান শেষ করে নেমে এলাম দুজনে নীচে হোটেলের লবিতে।
এদিকে লবিতে আমাদের পা পড়তেই দ্রুত কোত্থেকে যেন দু ভাই দৌড়ে এসে আমার দু হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চুপি চুপি জানালো দুজনেই যে, আমাদের ঐ মার্কেটের দিকে যাওয়ার আগেই যেহেতু পড়বে অ্যাপেল স্টোর, ওখানে যেন কিছুক্ষণের জন্যে হলেও নিয়ে যাই ওদের।
এ ব্যাপারে ফের দুই ভাইকে একাট্টা একমত হতে দেখে ভাবলাম, ঘটনা কী? কী ব্যাপারে তাদের এই ঐকমত্য। যদিও জানি না কারণ তাদের এই ঐক্যমত্যের, তারপরেও বিনাদ্বিধায় ফিস ফিস করে জানিয়ে দিলাম যে, নো চিন্তা। সাথে মনে মনে এও ঠিক করে ফেললাম, ঠিক আছে কপালে যাই থাকুক, অভ্রকেও কিনে দেব দীপ্রর মতোই একটা হেডফোন। বেচারা ঢাকায় ফেলে আসা তার প্রিয় কুকুর ছানার জন্য খেলনা কিনতে না পেরে বড়ই মিইয়ে আছে মনে মনে। তদুপরি ভাইয়ার হেডফোন কেনার ব্যাপারে তুমুল সমর্থন দিয়ে ওটা কিনে ফেলার পর, ভাইয়া তাকে ওটা একটু পরখ করে দেখার তেমন সুযোগ দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না । এই যে এখনো দেখছি দীপ্র ঠিকই তার গলায় হালে কেনা বিটস হেডফোনটি ঝুলিয়ে হাঁটছে, আজকালকার প্রজন্মের ভাষায় কুলবয় কূলবয়ভাবে, সেরকম সুযোগ তো অভ্র পায়নি!
এসব ভাবতে ভাবতে এরই মধ্যে সদলবলে হোটেলের ওম ওম গরমের আরাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি ফের সকলে হিমমোড়া রাস্তায়। ঘড়িতে সময় এখন বিকেলের দিকে ঝুঁকে এলেও, এ মুহূর্তে চারদিকে তাকিয়ে তা বোঝার অবকাশ নাই। কারণে ঐ যে বলেছিলাম এ কয়দিনের সারাক্ষণই বেইজিং শহর দেখছি মুখ ভার করে আছে, ধোঁয়াশার চাদরে নিজেকে মুড়ে রেখে। সারাক্ষণই দেখি এখানে লেপটে আছে সন্ধ্যা! মধ্যদুপুরেই যেখানে দেখা পাইনি এক মুহূর্তের জন্যেও সুয্যি মামার, সেখানে এখন তো দিন গড়িয়েছে বিকেলের দিকে। ফলে এখনতো আর সুয্যি মামার এমুখো হওয়ার কথাই না। তাও একদিক দিয়ে কপাল ভাল যে, সময় বিকেলের দিকে ঝুঁকে পড়লেও বাড়েনি এখনো বাতাসের তোড়। তদুপরি এরই মধ্যেই সকলেই আমরা মোটামুটি খাপ খাইয়ে নিয়েছি বেইজিং হিমের সাথে, অতএব এই বাঙ্গাল শরীরেও মনে হচ্ছে বেইজিং হিম বসাতে পারছে কামড় তেমন একটা। অন্যদিকে আছে দেখছি সবারই মধ্যে, যার যার তার তার আসন্ন শপিং ভাবনা নিয়ে তুমুল উদ্যমে। বেশ দ্রুতই তাই চলে এলাম, রাস্তা পেরুবার সেই জেব্রাক্রসিং এ, যেটি পেরিয়ে ঐ পাড়ে চলে গেলেই বলা চলে পৌঁছে যাওয়া যাবে বেইজিংয়ের ডং চেং ডিসট্রিক্টের জমজমাট শপিংমল এলাকায়!
ঐ যে বলেছিলাম, উৎকণ্ঠায় উৎকণ্ঠায় কাটছে জীবন। আমার সেই হাইপোথেসিসকে প্রমাণিত করে হোটেলের লবিতে চুপিচুপি পুত্রদেরকে দেয়া কথাটি নিয়ে, শুরু হয়েছে মনে এখন ফের উৎকণ্ঠা! ব্যাপার হচ্ছে রাস্তার ঐ পাড়ে গিয়ে সোজাসুজি হেঁটে আমার মতো ছাপোষা মানুষদের জন্য উপযুক্ত শপিংমলগুলোর দিকে না এগিয়ে তার আগে যদি ডানে ঘুরে অ্যাপেল স্টোরের দিকে এগুই, তবে অবশ্যই পড়বো স্ত্রীর তুমুল বিরোধিতার মুখে। আর শেষ মুহূর্তে ঐ বিরোধিতা সামলাতে না পেরে ওখানে না গেলে, পুত্ররা হবে নাখোশ। অতএব শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ব্যাপারটি গোপন রেখে তীরে এসে তরি ডোবানোর চেয়ে, এখনি তা খোলাসা করে নেয়া দরকার। এতে যে কোন দিকেই যাক ব্যাপারটি, তা সামাল দেবার জন্য কিছুটা হলেও সময় পাওয়া যাবে হাতে।
এরই মধ্যে ট্রাফিক সিগন্যালে রাস্তা পার হবার সংকেত জ্বলে উঠতেই, রাস্তা পার হতে হতে, পুত্রদের উদ্দেশ্যে একটু জোরেই বললাম, শোন বাবারা, তোমাদের কথা মতো আমরা এখন ঐ অ্যাপেল স্টোরে যাবো, তবে তা খুব বেশী সময়ের জন্য না কিন্তু, মনে থাকে যেন?
“কেন? কেন আবার অ্যাপেল স্টোর?” অনিবার্য প্রশ্ন এল লাজুর কাছ থেকে! তবে রাস্তা পার হওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণেই হউক আর অন্য যে কোন কারণেই হউক, এই প্রশ্নটিতে তেমন কোন কঠোর নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত না হওয়ায়, সাহস পেয়ে বললাম, আরে কাল সকালেই তো রওয়ানা করবো দেশের দিকে, তার আগে যেতে চাচ্ছে যখন ওখানে, চল না যাই।
উত্তর এলো মৌনং সম্মতি লক্ষনং সূত্র মেনে। অতএব আর কী চাই? রাস্তা পার হওয়ার পর তাই আর কোনদিকে না তাকিয়ে প্রথমে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে পরে দৌড়াতে শুরু করেছিল পুত্ররা আমাদের, তাতে বেশ দ্রুতই পৌঁছে গেলাম এই মুহূর্তে ওদের মঞ্জিলে মক্সুদে, মানে অ্যাপেল স্টোরে।
আগেই বলেছিলাম বেইজিংয়ের এই ডংচেং ডিসট্রিক্টের, এই এলাকাটাতে আছে পথিবীরখ্যাত নানান খানবাহাদুর রায়বাহাদুর শ্রেণীর অভিজাত পণ্যের স্টোরগুলো। তাই এখানটায় ফুটপাতে হাঁটাহাঁটি করার লোকজন খুব একটা থাকে না যেমন, তেমনি নাই এখানে ফুটপাত হকারেরাও। অতএব পুত্ররা দৌড়ে পার হয়েছে এই এলাকা অনায়াসেই।
ওদের গতির সাথে তাল মিলিয়ে ওদের পিছু পিছু আমরাও অচিরেই এসে স্টোরে ঢুকতেই দেখি, দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে এই স্টোরের দোতালায় যাবার সিঁড়ির গোঁড়ায়। আমরা এসে পৌঁছুতেই, দুজনেই বিশেষত আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, মোটা কাঁচের তৈরি সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলার দিকে উঠতে শুরু করতেই পিছু নিলাম, আমি আর হেলেন। পায়ের ব্যাথার কারণ দেখিয়ে লাজু উপরে উঠার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে থেকে গেল নীচেই।
দোতালায় পা রাখতেই বোজা গেল কথা রেখেছে পুত্ররা। দেরী করেনি ওরা মোটেও। আমাদের আগে উঠে এরই মধ্যে এখানকার এক বিক্রয়কর্মীর সাথে কথাবার্তা মনে হচ্ছে পাকা করে ফেলেছে দীপ্র। আমাকে দেখে তাই হাতের ইশারায় করতেই, ওর সেই ডাকে ওখানে গিয়ে হাজির হতেই প্রথমবারের মতো মুখ ফুটে জানাল সে যে, দাবী তার বিশেষ বড় কিছু নয়। কিনতে চায় ও তার ছোঁয়াযন্ত্র মানে আইপ্যাডের জন্য একটা আইকভার। সাথে এও জানাল যে এই জিনিষ ঢাকায় মেলে না। একই সাথে জানাল সে ঐটির এখানকার দামও।
দাম শুনে একদম ভির্মি না খেলেও কিছুটা আমতা আমতা করছি যখন, তখন পেছন থেকে হেলেনের গলা শোনা গেল
“আরে দেস না দাদা কিনে। ও তো আর কিছুই নাকি নেবে না। এমনকি চকলেট ফকলেটও নাকি লাগবে না ওর।”
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক