‘কি ব্যাপার? শরীর খারাপ লাগছে নাকি তোমার?’
এই মুহূর্তে কর্ণ কুহুরে প্রবেশ করা উপরোক্ত অর্থবোধক বাক্যদ্বয় ছাড়াও একটু আগ পর্যন্ত বেশ দূর থেকে ভেসে আসছিল খণ্ড খণ্ড কিছু শব্দ; সেসব কোন পরিপূর্ণ অর্থবহনকারী বাক্য গঠন না করলেও, তৈরি করছিল একটা অস্বস্তি, কিন্তু তাতেও খুব একটা গা করছিলাম না। কারণ বলেছিই তো যে একদিকে ঐ শব্দসমূহ যেমন কোন বাক্য তৈরি করছিল না, অন্যদিকে আলাদাভাবেও ঐ শব্দ কোনধরনের অর্থ বা ব্যঞ্জনা তৈরি করছিল না। সবই মনে হচ্ছিল চায়নিজ। অতএব শুনেও না শোনার ভান করছিলাম। কিন্তু এখন উপরোক্ত বাক্যদ্বয়ের সাথে, বিশেষত পিঠে মৃদু চাপড় ও কপালে আলতো হাতের ছোঁয়া লাগতেই ধড়মড় করে উঠে বসে আবিষ্কার করলাম নিজেকে রিজেন্ট হোটেলের দুগ্ধ ফেননিভ বিছানায়।
কালেভদ্রে কোনো কোনো ছুটির দিনে, দিনভর ঘুমালেও সাধারণত দিনের বেলায় ঘুমাই না। তবে যদি কখনো এরকম ঘুম চলেই আসে দিনে, আর কোন কারণে সেই ঘুম যদি কাঁচা অবস্থাতেই ভেঙে যেতো তবে মেজাজ ভীষণ তিরিক্ষি হয়ে উঠতো। কপাল ভাল যে, বিবাহিত হবার পর থেকেই সেই তিরিক্ষি মেজাজ তিরোহিত হয়েছিল অচিরেই, তাতেই রক্ষা! তদুপরি স্বামীর শারীরিক সুস্থতার ব্যাপারে এরকম উদ্বিগ্ন স্ত্রীকে তিরিক্ষি মেজাজ তো দেখাতে পারে একমাত্র পাষণ্ডই। ঘুম জড়ানো গলায় তাই যাওয়ায় হড়বড় করে কৈফিয়ত দিলাম– না, না ঠিকই আছি। একটু মনে হচ্ছে চোখ লেগে এসেছিল। তীরবেগে তাতে উত্তর এলো-“থাক থাক আর বলতে হবে না! শুধু শুধু কেন বলছ চোখ লেগে এসেছিল? বাথরুম থেকে বেরিয়েই তো দেখলাম নাক ডেকে, এক্কেবারে কাঁদার মতো শুয়ে ঘুমাচ্ছ। শরীর খারাপ লাগলে বল? আচ্ছা চা বানাবো নাকি?” না, এ নিয়ে খালি খালি তর্কের অবতারণা করে লাভ নাই। কথায় তো আছেই যে এ ধরনের তর্কে একজনই যেমন জয়ী হন সবসময়ই, তেমনি পরাজিতও হন একজনই, যার নাম হল স্বামী। স্ত্রীর দেয়া আর যে কোন অপবাদ চুপচাপ মেনে নিতে পারলেও, এই নাক ডাকার অপবাদ কেন জানি মেনে নিতে পারি না মোটেই কখনও। তাও আবার এই দিনেদুপুরে না হলেও বিকেলের ঘুমে নাক ডাকবো, এতোটা বেপতার বেয়াক্কেল তো আমি নই! তারপরও বোবার কোন শত্রু নাই কথাটিকে শিরোধার্য করে, ঠিক আছে বানাও চা, বলে বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে ভাবলাম ওর মত এ বেলা গোসল না করলেও, অন্তত জামা কাপড়ের কিয়দংশ বদলানো দরকার। বিশেষত অন্তর্বাস তো অবশ্যই, সাথে বেইজিং হিম মোকাবেলা করার জন্য যে তিন চার স্তরের গরম কাপড় দিয়ে মুড়েছি দেহ, তার অন্তত ভিতরের দিকের গুলো বদলানো দরকার, তাতে এখনকার এই ঝিম ঝিম ভাব কেটে গিয়ে শরীর কিছুটা হলেও চাঙ্গা হবে–মেঝেতে বিছিয়ে রাখা পা দেবে যাওয়া নরম কার্পেটের উপর পা ফেলে এগুতে এগুতে এসময় মনে পড়ল, রুমে ফেরার পর লাজু যখন ঘোষণা করেছিল যে, সে গোসল করবে, তখন শুধু জ্যাকেটটা খুলে তা সোফার উপর রেখে পিঠ লাগিয়েছিলাম বিছানায়। কারণ জানাই তো ছিল যে ওর ওইরকম ঘোষণার মানে হল কমপক্ষে ঝাড়া ৪০/৪৫ মিনিটের মামলা। এছাড়া এখানে যেহেতু ইন্টারনেট কাজ করে না তেমন, তাই ছোঁয়াফোনে অনলাইনে ঘুরে ঘুরে সময় কাটাবো তার ওতো নাই ছিল না। ফলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম মাওয়ের তথাপ্রচারিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা। আসলে আজকের দিনের প্রথমার্ধের ফুটপাতভ্রমণে দেখতে পাওয়া ঐ দুই ভিক্ষুককে তাড়াতে পারছিলাম না মন থেকে, কিছুতেই। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে চায়নার সেই ভূমিকার কারণে চায়নার উপর যতোই মন বিষিয়ে থাকুক না কেন, চায়নায় এরকম সামাজিক অসাম্যের মুখোমুখি হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না মন থেকে!
শুধু যে ভাবছিলাম তাও না। একই সাথে পড়ছিলামও। পড়ছিলাম মানে হোটেলের লবিতে থাকা ট্যুর অপারেটরদের কাউন্টার থেকে তুলে নেয়া লিফলেট একটা। বহুকাল থেকেই দেখেছি আমার জন্য বিশেষত দিনের বেলায় অত্যন্ত কার্যকর ঘুমের ঔষধ হল, শুয়ে শুয়ে পড়া। ব্যত্যয় ঘটেনি যে তার এবারেও বোঝা গেল তা! ঘুমের এই ঔষধের জোরটাও টের পেলাম একইসাথে এখন। এমনিতে সন্ধ্যার পরে কফি তো অবশ্যই এমনকি যাকে বলে হালকা রং চা, তাও খাই না। যদি খাই কখনো তা, কারো অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে গিয়ে; তবে সে রাত কাটে আমার তুমুল অস্বস্তিতে বিছানায়, এপাশ ওপাশ করে করে। অথচ আজ যে কফি খেলাম ম্যাকে লাঞ্চের পর, তাও কিন্তু ঠেকাতে পারেনি কি না এই ঘুম!
কল খুলে চোখে মুখে কুসুম কুসুম গরম পানির ঝাপটা দিতে দিতেই এসময় মনে পড়ল, যদিও ঐ লিফলেট পড়ার সাথে সাথে মনে চলছিল চিন্তা, চীনের সেই বহুল প্রচারিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অসারতা নিয়েই, তারপরও তারই মধ্যে টুক করে হঠাত একসময় একদম নাকডাকা ঘুমে না ডুবে গেলেও, অবশ্যই শুরু হয়েছিল স্বপ্নভ্রমণ এক। চলে গিয়েছিলাম এই ঘরের ওম ওম আরাম ছেড়ে ডং চেং ডিসট্রিক্টের আরেক বিখ্যাত স্থাপনা টেম্পল অব হেভেনে, যেখানে আদতে আমাদের যাওয়া হয়নি, আর নাইও সম্ভাবনা যাওয়ার অন্তত এইবারে! ফলে আবছাভাবে যতটুকু কানে আসছিল লাজুর কণ্ঠস্বরের, তার স্তাহে স্বপ্নের চায়নিজ ভিড়ের চুং চাং চিং চাং মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল!
ঐ যে বলেছিলাম খুব পরিকল্পনা করে আমাদের এই ভ্রমণটি না সাজানোর কারণে টেম্পল অব হেভন ছিল না ভ্রমণলিস্টিতে। কিন্তু বেইজিঙয়ে আসার পর থেকে ভ্রমণ বিষয়ক নানান লিফলেট থেকে জ্ঞান না হোক, নানান তথ্য আহরণ করার ফলে অবচেতনে ওটার ব্যাপারে একটা বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তিয়েন আন মেন স্কয়ারে সেইদিন পথ হারিয়ে অবশেষে ফর বিডেন সিটির দোর গোঁড়ায় পৌঁছে, তুমুল হিমের সম্ভাব্য দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে বউ বাচ্চাসমেত প্রবল টেনশনে পড়ে, ওটা আর দেখা না হলেও, গিয়েছিলাম তো সেখানে সেটাই বা কম কী। কিন্তু এই ডং চেং ডিসট্রিক্টে থাকা টেম্পল অব হেভনে তো যাওয়াই হয়নি। যার কারনে এই ভ্রমণের শেষদিকে এসে কেমন যেন একটা অতৃপ্তির ভাব জমেছিল মনে।
মনে আছে ছোটবেলায় অন্যান্যরা যে সব ভূতের গল্পকে গা ছম ছম করা গল্প মনে করে পড়তে গিয়ে ভয়ে সিটকে থাকতো, সেসবকে আমার মামুলি গল্পই মনে হতো কেন জানি। তবে ভয় পেতাম আমি যাকে বলে, অতৃপ্ত আত্মা বিষয়ক কাহিনী পড়তে গিয়ে। সেইসব গল্পে ঐসব অতৃপ্ত আত্মারা যেমন ঘুরে বেড়াতো তাদের অতৃপ্তির স্থানগুলোতে। ফেলতো গভীর দীর্ঘশ্বাস সুযোগ পেলেই। মনে হচ্ছে সেই সূত্র মেনে অতৃপ্ত মন আমার চলে গিয়েছিল ঘুমঘোরে সেই টেম্পল অব হেভনে, তৈরি করেছিল যা ১৪ শ শতকের শুরুর দিকে মিং রাজারা।
সামনের মানিক মিয়া এভিনিউ আর পাছনের চন্দিমা উদ্যান নিয়ে গড়ে উঠা আমাদের সংসদ ভবনের চেয়েও প্রায় তিনগুণ বড় চত্বর নিয়ে তৈরি করা বেইজিং এর অন্যতম চায়নিজ স্থাপত্যকর্মটিতে, চারশ বছর ধরে স্বর্গের দেবতাদের খুশি রাখার জন্য, চায়নার রাজ পরিবার বংশ পরম্পরায় পূজো দিয়ে আসলেও তাতে স্বর্গের দেবতারা কতোটুকু সন্তুষ্ট ছিলেন কী না জানি না। তবে জানি ১৮ শ শতকের মাঝামাঝি এই মর্তের সাম্রাজ্যবাদী দেবতারা মোটেও যে খুশি হননি, সেটি প্রমান করে তা দখল করে নিয়েছিল ব্রিটিশ আর ফ্রান্সের সৈন্যদল। উপলক্ষ দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ! অতপর ১৯০০ সালের চায়নিজ বক্সারদের বিদ্রোহদের সময় সেটিকে দখল করে নিয়েছিল ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, আম্রিকা, রাশিয়া, জাপান, ইতালি, অস্ট্রোহাংগেরিয়ানদের নিয়ে গঠিত অষ্ট সাম্রাজ্যবাদীর মিলিত সৈন্যরা।
এই মন্দির ঘিরে দ্রুত আহরিত নানান তথ্যের জটিল ভজঘট, মনের ভেতরে ঢোকার পর, তা থেকে যা নির্যাস তুলে নিয়েছিলাম, তা হল প্রথমত প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তো অবশ্যই এমন কি তারও আগে শত শত বছর ধরে এখনকার মানবতার ধ্বজাধারী ইউরোপিয়রা সর্বক্ষণই নিজেদের মধ্যে রক্তাক্ত সব যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, চায়নায় এসে কিন্তু তারা একাট্টা হয়েছিল চায়নাকে হারানোর জন্য! দেয় যা চায়নার তুমুল সম্পদের সমৃদ্ধির প্রমাণ। কারণ চোর ডাকাত দস্যু তো ভিক্ষুকের ঘরে হানা দেয় না! অন্যদিকে এটি প্রমাণ করে সেসময়ের চায়নার শক্তিমত্তার ব্যাপারটিও। কারণ কুং ফু সহ চীনের শতধারার মার্শাল আর্টের গুরু ও ছাত্রদের নিয়ে কৃষকেরা সেসময় টেম্পল অব হেভন ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী লুটেরার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে, ঐ অষ্টবাহিনী জোট বাধতে বাধ্য হয়েছিল । যার মধ্যে একমাত্র এশিয়ান দেশ/জাতি একটাই ছিল! তা হল জাপান।
শতধারার চায়নিজ মার্শাল আর্টের চর্চাকারীরা সবাই ইউরোপিয়ানদের কাছ চায়নিজ বক্সার নামে পরিচিত ছিল ফলে সে যুদ্ধটা ইতিহাসে বক্সার বিদ্রোহ নামেই পরিচিত। মজার ঘটনা আমার কাছে কিন্তু সেই যুদ্ধটাকে অনেকটা ধর্মযুদ্ধই মনে হয়েছে। কারণ চায়নিজ কৃষকদের সেই বিদ্রোহটি মোটাদাগে বিদেশী দখলদার বিরুদ্ধে হলেও অন্তরে তাদের মূল শত্রু ছিল কিন্তু ঐ সব সাম্রাজ্যবাদীদের ধর্মীয় শাখা খ্রিস্টান মিশনারিরা আর চায়নিজ খৃস্টানরা। ঐ সময়টায় চায়নার দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী ইয়েলোর অববাহিকায় ব্যাপক বন্যার হবার পর পরই, গোটা এলাকা ফের প্রবল খরার কবলে পড়ায় প্রচুর ফসল হানি হলে, চায়নিজরা তাদের পবিত্র ভূমিতে খ্রিস্টানদের আগ্রাসনকেই প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের জন্য দায়ী করে, এই যুদ্ধের সূচনা করেছিল!
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক