সকল সময়েই এ অধম মুক্তকণ্ঠে এ কথা স্বীকার করি যে, বিশেষত পারিবারিক সামাজিক জীবনে স্ত্রীর কথার ব্যত্যয় করি না আমি মোটেও সাধারণত। তাতে এজন্য যদি কেউ আমায় স্ত্রৈণ অভিধাও দেয় কিছু যায় আসে না তাতে আমার। কারণ অধমের মতো নিতান্তই ছাপোষা সাংসারিক মানুষের জীবনে, সবার উপরে হল গৃহশান্তি। আর হবেই না বা কেন তা? কথা হচ্ছে যেদিন বিবাহিত হবার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেদিনই নিজেরই অজান্তে জীবনের মূল লক্ষ ঠিক করে নিয়েছিলাম আপদ বিপদ ঝঞ্ঝাটমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের। তো অন্তত পারিবারিক জীবনে স্ত্রীর বাধ্যগত হলে যদি তা নিশ্চিত হয়, তবে তাতে আপত্তি করার কী আছে? আসলে কারো জীবনে লক্ষ্য যাই হোক, একবার তা ঠিক করার পর সেই লক্ষ্যে পৌঁছানতেই তো হয় মোক্ষ লাভ। এই যেমন একটু আগে, ঐ আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে ঢোকার মুখে স্ত্রীর সাবধানবাণী বিনা ওজর আপত্তিতে মেনে নেয়ায়, কী বাঁচাটাই না বেঁচে গেলাম সপরিবারে।
হ্যাঁ মিনিট চল্লিশেক আগে লাজুর নিষেধ যদি উপেক্ষা না করতাম, তবে নির্ঘাত এখনো যে কোথায় না কোথায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতাম সপরিবারে, এই হিম বেইজিং শহরের রাস্তায়, তা কে জানে? দুদিন আগে যেমন তিয়েন আন মেন স্কয়ারের আন্ডারপাস ধরে মাও মেমোরিয়েল হলের দিকে এগুতে গিয়ে দিককানা আমি সবাইকে নিয়ে পৌঁছেছিলাম কি না শেষে, তুমুল হিমের ভেতরে নিষিদ্ধ নগরীর গেটে, সেই রকম তো ঘটতে পারত আজো। সেদিন না হয় কাছে ধারে মজুদ ছিল আমাদের উদ্ধারকর্তা বন্ড মিয়া, সে তো নেই আজকে। অবশ্য ওরকম কিছু ঘটলে, এখন পর্যন্ত আমাদের তাবৎ মুশকিলের আসানকারী হিসেবে প্রমাণিত, রিজেন্ট হোটেলের চৌকষ কন্সিয়ার্জ কন্যা মিস ইনাকে ফোন করলে কোনও না কোনও একটা উপায় সে বের করতোই, কিন্তু তাতে কি আর শেষ রক্ষা হতো? আগামীকাল সকালেই তো ধরতে হবে আমার সোনার বাংলায় ফেরার প্লেন। আর তার ঠিক আগের দিন, মানে যেদিনটাকে ঘোষণা করা হয়েছে শপিং ডে হিসেবে, সেইদিন পথ হারিয়ে, অচেনা ও ভাষাবিভ্রাটসংকুল এই হিম শহরে নাস্তানাবুদ হওয়ার তো মানে নেই কোনই। তদুপরি এই তো আমার বিদেশের মাটিতে ভুগর্ভস্থ রাস্তা ব্যবহার করতে গিয়ে প্রথম পথ হারানো নয়। বেইজিং এর তুলনায় ঢের পিচ্চি শহর সিঙ্গাপুরের ভূগর্ভস্থ মেট্রো স্টেশন থেকে বেরুতে গিয়ে একই বিভ্রাটে পড়েছিলাম বহু আগে এক রাতে তাও তো মনে আছে। সেদিনও পরদিন ভোরেই দেশে ফেরার ফিরতি প্লেন ধরার কথা ছিল। সে বার বেঁচে গিয়েছিলাম, কারণ সিংগাপুরে ভাষাগত কোনও সমস্যা ছিল না এবং ট্যাক্সিও ধরতে পেরেছিলাম সহজেই। এছাড়া সিঙ্গাপুর তো এখানকার তুলনায় ঢের বেশি পর্যটক বান্ধব এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে বিশ্বসেরা।
‘আচ্ছা বাবা, এখান থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরে যাওয়ার সময় আমরা কি আবার একটু অ্যাপেল স্টোরে যেতে পারি? যাওয়ার পথেই তো পড়বে ওটা।’ টেবিলের ওপাশে বসে বড় এক কামড়ে ম্যাকের বার্গার মুখে নিতে নিতে দীপ্র এ কথা জিজ্ঞেস করতেই, আমি কোনও উত্তর দেবার আগেই পাশে বসে থাকা তার মা, তার পিঠে একটা চাটি বসিয়ে ঘোষণা করল ‘না না, খাওয়া শেষে যাবো সোজা হোটেলের রুমে। অন্য কোথাও না খবরদার! বুঝতে পারছি না আবার তুমি কেন যেতে চাচ্ছ ঐখানে? তোমার বিটস হেডফোন তো কেনা হয়ে গেছে। ওটা কেনার পর থেকে সারাক্ষণই তো দেখছি ওটা খালি খালি গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। শুনে রাখো হোটেলের রুমে যাওয়ার পর খুব বেশি দেরী করা যাবে না রুমে। তাড়াতাড়িই ফিরতে হবে কিন্তু এখানেই। আমার শপিং তো কিছুই হয়নি এখনো।’ ঘণ্টা তিনেক আগে রাস্তার হকারের কাছ থেকে কেনা চায়নার চমৎকার মিষ্টি ভোমা সাইজের মিষ্টি আলুতে কামড় দিতে দিতে, স্ত্রীর কথা গভীর মনোযোগে শুনতে শুনতে ক্রমাগত মাথা নেড়ে সায় দিতে দিতে, তারই অলক্ষ্যে চোখের ইশারার সাথে মুখভঙ্গিতে বড় পুত্রকে আশ্বস্ত করতেই, কথা বাড়াল না আর ও।
হ্যাঁ এই মিনিট পনের আগে স্ত্রী–আজ্ঞা মেনে, এখান থেকে কতো হবে, হবে হয়তো দুই বা আড়াই কিলোমিটার দূরের সেই ভূগর্ভস্থ স্টেশনের কাছ থেকে রাস্তার হিম বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে অবশেষে পদব্রজে এসে পৌঁছেছিলাম, এরই মধ্যে আমাদের অতি চেনা হয়ে ওঠা ম্যাকডোনাল্ডসের আরামদায়ক ওমের ভেতরে। কিন্তু তাতেও দেখছি রক্ষা হয়নি। সকালবেলা সেই নাস্তা করার পর থেকেই কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত পদব্রজে থাকার গোটা দোষের অধিকাংশই চেপেছে এ দলে থাকা একমাত্র স্বামী নামের অবোধ জীবটির উপর। বাকি সামান্যটুকুর দায় অভ্রর।
হ্যাঁ অভ্র সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই, ঢাকায় ফেলে আসা তার প্রিয় বাচ্চা কুকুর প্লুটোর জন্য খেলনা কেনার প্রতিজ্ঞায় গুগুল করে পেট শপ খুঁজতে গিয়ে উল্টাপাল্টা ঠিকানা বের করাতে, এবং একটা কুকুরের বাচ্চার জন্য ছোটপুত্রের এই আদিখেত্যাকে এইরকম লাই দেবার কারণে, সবাই মিলে এতক্ষণ হিম রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘোরার যাবতীয় দায় যে আমাদের দুজনের, এই রায় তার মা ঘোষণা করেছে এরই মধ্যে বারকয়েক। ফলে মায়ের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য অভ্র বসেছে ভিন্ন টেবিলে ফুপ্পির সাথে।
কথা হচ্ছে রাস্তায় আর অন্যান্য সব জায়গায় তেমন লোক না দেখলেও এ স্টোরে পা দিয়েই দেখেছিলাম লোকে লোকে গিজ গিজ করছে এটির নীচতলা। যার ফলে এমনকি এটির দোতালায় উঠেও পাচ্ছিলাম না পাঁচ জন এক সাথে বসার জন্য কোন খালি টেবিল। এখন মনে হচ্ছে একসাথে বসতে না পারায় বরং মন্দের ভালোই হয়েছে। না হয় মায়ের বিরক্তির চোটপাটের আঁচ থেকে রক্ষা পেত না বেচারা। ভাবছি যখন এই, ঐ টেবিলে বিগম্যাকে নিমগ্ন অভ্রর দিকে তাকিয়ে, তখনই হেলেনের চোখে চোখ পড়তেই, ওর হাতে থাকা আলুপোড়ার অংশবিশেষ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল
“লাগবে নাকি আলু দাদা? আমি আর খাবো না। নিতে পারিস আমারটা।’
যদিও জানি আশেপাশের টেবিলে থাকা চায়নিজদের কেউ বুঝবে না, এইমাত্র বাংলায় কী বলল হেলেন, তারপর একই সাথে বিব্রত ও বিরক্ত বোধ করলাম বোনের এই আচরণে। মুখের ভাষা না বুঝলেও দেহ ভাষা তো বুঝে যাবার কথা। এমনিতেই পৃথিবীর যে কোনও দেশের তাবৎ রেস্টুরেন্টই বাইরের খাবার নিয়ে ঢোকা নিষেধ। সেই বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কী না আমরা দুই ভাইবোন ম্যাকে বসে খাচ্ছি রাস্তা থেকে কেনা আলু পোড়া!
হ্যাঁ, ম্যাকে এসে বাকি তিনজনের জন্য বার্গার নিলেও, আমরা দুজন ঠিক করেছিলাম, ঘণ্টা তিনেক আগে যে ভোমা মিষ্টি আলু কিনেছিলাম রাস্তা থেকে সে দুটোর অনেকটাই যেহেতু রয়ে গেছে, দুপুরের লাঞ্চ সারবো আমরা তা দিয়েই। মেঘনাপাড়ের নানুবাড়ির পোড়া মিষ্টি আলুর গন্ধ যেহেতু আমাদের অস্তিত্বে এখনো মৌ মৌ করছে, সেই নেশা অগ্রাহ্য করার উপায় বা ইচ্ছা কোনটাই নেই দুজনেরই। তদুপরি খাবার–দাবার নষ্ট করা অতি গর্হিত কাজ এ তো শিখেছি সেই ছোট বেলাতেই দুজনে, অতএব না খাওয়া আলু দুটো তখন থেকেই বয়ে বেড়াচ্ছিল হেলেন ব্যাগে। কিন্তু আলুগুলো আকারে এতোই বড় যে দু দফায় খেয়েও হেলেন ওটাকে শেষ করতে পারেনি। তাই সে শরণ নিতে চেয়েছে আমার। এতে বিব্রত ও বিরক্ত হলেও বিরক্তিটি প্রকাশ না করে হাতের ইশারায় বোঝালাম ওকে, যে লাগবে না আমার আর আলু।
‘এই শোন, কফি খাবো।’
আহা কী যে করি! একটু আগেই বোনের আচরণের কারণে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বিরক্তিটি ধামাচাপা দিতে না দিতেই, স্ত্রীর জারী করা হুকুমে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে! আর দেবেই না কেন তা? কারণ বার্গারের অর্ডার দেবার সময় কফি আনব কি না জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু রাগে গজ গজ করতে থাকায় সেসময় কোনও সদুত্তর পাইনি তার কাছ থেকে। এখন কী না বলছে হঠাৎ যে কফি খাবে সে! যদিও ম্যাক কফি আমার মোটেও ভালো লাগে না, তারপরও ও যদি তখন বলতো যে খাবে কফি, তাহলে আমার জন্যেও নিতাম একটা। যে হিমে হেঁটেছি সারাক্ষণ তাতে কফিটা ভালোই কাজ দিত। তখন কিছু না বলে এখন বলায়, ফের গিয়ে দাঁড়াতে হবে লোক গিজ গিজ করা এই স্টোরের লাইনে শুধু কফির অর্ডার দেবার জন্য, কপাল কুঁচকে এই কথা ভাবতে ভাবতে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি যখন, ওপাশ থেকে দীপ্র সোৎসাহে জানাল ওর যেহেতু খাওয়া হয়ে গেছে, তাই ও কফি আনতে চায় আমাদের জন্য।
ফের বুঝলাম টিন এইজ দীপ্র সুযোগ পেলেই যে প্রমাণ করতে চায় ও বড় হয়ে গেছে, এটাও তারই একটা। নিজে লাইনে দাঁড়ানোর ঝঞ্ঝাট মুক্ত হতে পারায় একগাল হেসে পুত্রকে প্রয়োজনীয় রেন মেন বি হাতে দিতেই, মহানন্দে সে বিজয়ীর ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে অন্য টেবিলে বিগম্যাকের অবশিষ্টাংশ নিয়ে ব্যস্ত ছোটভাইকে ভেংচি কেটে কাউন্টারের দিকে যাওয়ার জন্য এগুলো নীচতলায় নামার সিঁড়ির দিকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।