স্বর্গশান্তির দরজা নামে ঘরটি নিয়ে অতোগুলো কথা বললাম এই কারণে যাতে, শীতের ভয়ে হউক বা মরা লাস দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছাজনিত কারণে হঠাৎ করে যদি লাজু যেন বলে না বসে যে দরকার নাই যাওয়ার ঐ লাশ ঘরে, লাশ দেখার জন্য। আর তা বললেই তো হয়ে যাবে কম্ম কাবার। সে হুকুম লঙ্ঘন করা তো যাবে না কোন উপায়ে ! এক্ষনে স্বস্তির ব্যাপার হল, ঐ কথাগুলো খরচা করায় দেখছি কাজ হয়েছে! কারণ সবাই মৌন থেকে জানান দিল যে মৌনং সম্মতি লক্ষনং।
সেই ছোটবেলাতে যখন বইয়ে পড়েছিলাম হিমালয় বিজয়ী তেঞ্জিং, হিলারির কথা সেই থেকে পর্বতারোহণ নিয়ে কিছু কৌতূহল থাকলেও কখনো নিজে পর্বতারোহণ করবো এমন ভাবিনি ভুলেও। কেন করিনি জানি না। তবে ঐ যে বললাম আগ্রহ, তা ছিল ঠিকই। সেই আগ্রহের কারনেই নানান অভিযাত্রীদের পর্বতারোহণ বিষয়ক লেখা পড়েছি, সিনেমা ডকুমেন্টারিও দেখেছি। তা থেকে জানি পর্বতারোহণকারীরা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে তাদের উর্ধ্বমুখি যাত্রায় কখনো দুর্যোগ দুর্বিপাকে পড়লে ফিরে আসেন তাদের বেইজ ক্যাম্পে। তারপর প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, শুশ্রূষা এসব নেবার পর দুর্যোগ কেটে গেলে পুনরায় শুরু করেন তাদের উর্ধযাত্রা যদিও তাতেও গ্যারান্টি নেই যে অবশেষে তাঁরা পৌছবেন কি না শিখরে।
ব্যাগঘরে আমাদের এখনকার এই যাত্রাবিরতিটিকে সেরকমই মনে হচ্ছে। তবে ব্যাপার হচ্ছে পরবর্তী যাত্রা আমাদের উর্ধ্বমুখে নয়, বরং দেহাবসান হয়ে যাবার পর আত্মার উর্ধ্মুখি যাত্রার ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে তুমুল বিশ্বাস আছে, সে বিশ্বাসকে প্রবল অবিশ্বাস আর অস্বীকার করা যে মাও সে তুং ; যাবো আমরা তার লাস দেখতে। আর আছে তা একই সমতলে। মাঝখানে আছে ইংলিশ চ্যানলের মতো তীব্র হিমের ধোঁয়াশাবৃত তিয়েন আন মেন স্কয়ার। ব্যবধান দুটো, এক এখানে নেই কোন পানি, আর কেউই আমরা ব্রজেন দাশ তো দূরের কথা পুকুরেও নিয়মিত সাঁতারকাঁটা সাতারু না। তবে শুনেছি ইংলিশ চ্যানেলে আছে হিম ঠাণ্ডা জলের অবিরল স্রোত , যার সাথে তাল মিলিয়ে এখানে মাঝে মাঝেই আসছে হিম বাতাসের ঝাপটা , যার ভেতর দিয়ে দ্রুত হেঁটে এসে এখানে আশ্রয় নেয়া পরিবারের সবাইকে কতক্ষণ এখানে সুস্থির হবার জন্য সময় দেয়া দরকার বুঝতে পারছি না। আবার খুব বেশীক্ষণ এখানে সময় কাঁটালে সময়ের টানাটানিতে পরে যাবো পরে , ভাবছি তাই মনে মনে। কি করি এখন?
নাহ কপাল দেখছি ভালই এবারও । ফলে বেশিক্ষন লাগল না, অচিরেই আমাদের দলের সবচেয়ে শীতকাতুরে যে হেলেন , সেই দিল প্রস্তাব এখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু করার। অতএব তিলার্ধ আর দেরী না করে সবাইকে নিয়ে ফের হিমসাগরে ঝাপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিতেই-“বাবা , তোমার এই গ্লাভসগুলো দিয়ে কোন কাজ হচ্ছে না” ছোট্ট তার তুলতুলে হাতে বড় হাতের মাপের ঢলঢলে হাতমোজার ফাঁক গলে যে দস্যুর মতো হিম ঢুকে পড়ে কামড়ে দিবে ওর হাত অচিরেই, নিশ্চিত এই আশংকায় ঘ্যান ঘ্যানিয়ে উঠল অভ্র “এই ছেলে তোমার নিজেরগুলো হারিয়েছ কেন? যতোই বলি নিজের জিনিষ নিজে সামলে রাখো, সে কথা তো তোমাদের কানে ঢুকে না। এখন বোঝ অবস্থা কি হয়! মায়ের কথার তো দাম নাই। এখন তো নিজেও ভুগছ আবার ভোগাচ্ছ বাবাকেও।“ তুমুল বিরক্তিতে বলে উঠলো লাজু –সমুদ্র যাত্রা প্রাক্কালে দিগন্তে ঝড়ের ঘনঘটা দেখলে কোনকালেই কোন নাবিক নিশ্চয় তার যাত্রা শুরু করেনি কখনও, এমনকি টেকনলজির এতোটা উন্নতি হবার পরও করে না যাত্রা এরকম অবস্থায় কোন ক্যাপ্টেন আজো। এই মুহূর্তে যা ঝড়ের আভাস দেখা গেল অভ্রের দস্তানা হারানোজনিত অপরাধ ঘিরে, তাতে কি তবে ক্যাপ্টেন হিসাবে এ মুহূর্তে আমাদের যাত্রা শুরু না করে, যাত্রা আরো কিছুক্ষনের জন্য স্থগিত করব না কি?
একথা ভাবতে ভাবতেই আবার সে চিন্তা দূরে ঠেলে পুত্রদ্বয় কে দুহাতে নিজের কাছে টেনে নিয়ে, এখানে কোথাও তোমার সাইজের গ্লোভস কিনতে পাওয়া গেলে সাথে সাথেই তা কিন নেব , একথা বলতে বলতে বাড়ালাম পা সামনের দিকে।
“আর কাজ নাই! এখান থেকে উনি কিনবেন গ্লোভস! আরে আশেপাশে তো মানুষই নাই, উনি আছেন গ্লোভস কেনার চিন্তায় । তারপর কতো যে দাম নিয়ে বসে আবার সুযোগ পেয়ে এরা “ আমার কথার উত্তরে গজ গজ করে এসব বলতে বলতে পেছন পেছন এগুতে লাগল লাজু।
ওর কথার জবাবে ভাবলাম বলি, যতক্ষণ শ্বাস ততোক্ষণ আশ এটাই হওয়া উচিৎ যে কারো জীবন যাপনের মূল মন্ত্র আসুক না জীবনে যতোই ঝড় ঝাপটা। আবার মনে হল, না বলি যে চায়নিজদের যে ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয় পেয়েছে সারা পৃথিবী এরই মধ্যে, তার উপর নির্ভর করে বলতে পারি নিশ্চিত যে এখানে গ্লোভস পাওয়া যাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবে ঠিক কোন জায়গাটায় পাওয়া যাবে সে বস্তু তা জানি না। তবে এটা ঠিক এরকম জায়গায় মানুষ যখন বেমক্কা ঝামেলায় পরে কিনতে যাবে এ ধরনেরই কিছু, তবে তাতে যে চায়নিজ বিক্রেতা ঝোপ বুঝে কোপ মেরে বেশী পয়সা খসিয়ে নেবে ক্রেতার পকেট থেকে, এটা বোঝে যে কোন বেকুব ব্যবসায়ীও। আর চায়নিজদের তো কথাই নাই । তবে ঘটনা হচ্ছে এরকম বেড়াছেড়া বা ছেড়াবেড়া অবস্থায় ক্রেতারও যেহেতু থাকে না কোন উপায়, তখন সে বাধ্য হয়েই যে তোয়াক্কা করে না দামের, ক্রেতামনোস্তত্বের এই ব্যাপারও তো আজকাল ঘটা করেই পড়ানো হয় নানান নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসনের ছাত্রদের। এতোসব কথা ঠোঁটের আগায় নিশপিশ করতে থাকলেও, তা বেরুতে দিলাম না শান্তি ভংগের অনিবার্য আশংকায়।
এদিকে তীব্র হিমে দুমড়ে মুচড়ে গিয়ে হাঁটছি সবাই ঐ বিল্ডিং থেকে বের হয়ে তিয়েন আন মেন স্কয়ারের বা পাশ ঘেঁসে, সযত্নে মাওয়ের লাশ সংরক্ষণ করে রাখা সেই স্বর্গশান্তি দরজা নামের প্রাচীন ঘরের দিকে। সবার মুখ থেকেই বেরুচ্ছে হিমনিরোধি নাকি বলা উচিৎ এই মরণহিমের প্রতিবাদে হু হু , উহু উহু, ইস ইস, এই সব নানান নিরর্থক শব্দরাজি।
দু পুত্রকে ভাল করে জড়িয়ে ধরে সামনে হাঁটতে হাঁটতে ফের মনে করিয়ে দিলাম যেন তারা কেউ হাত না বের করে জ্যাকেটের পকেট থেকে। ঠিক এসময়ে পেছন থেকে
“দাদা ঐ বিল্ডিংটা তো মনে হচ্ছে অনেক দূরে এখান থেকে । এই ঠাণ্ডায় ঐ পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারব বলে তো মনে হচ্ছে না। আমাদের ড্রাইভার কে একটু ডাক না “ কঁকিয়ে বলে উঠল হেলেন নাহ তাকে ডেকে লাভ নাই। এখান দিয়ে নিশ্চয় গাড়ী নিয়ে চলাচল করা যায় না। যেতে হবে হেঁটেই। পিছু ফিরে জানালাম দলের দুই নারী সদস্যকে।
“আচ্ছা, ঐ যে বড় বিল্ডিং তা দেখা যাচ্ছে, ওটা তো এখান থেকে ঐটার চেয়ে কাছে মনে হচ্ছে। তাহলে আমরা আগে ওখানে যাই। ঐ ঘরে কি আছে ? দেখার মতো কিছু থাকুক না থাকুক ঢুকতে পারলে গা তো গরম করা যাবে। তারপর না হয় যাওয়া যাবে মাওয়ের মমি দেখতে ঐ বিল্ডিং এ।’
“হ্যাঁ হ্যাঁ চলো ওটাই করি।’ ননদের প্রস্তাবে জোর সমর্থন জানিয়ে নিজ অভিমত জানাল ভাবি, যে জায়গায় আছি এখন তার ঠিক উল্টা দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল দালানটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
দ্বিরুক্তি না করে বরং যাকে বলে রাইট টার্ন করে এমুহূর্তের স্বর্গশান্তির দরজাভিমুখী যাত্রা আপাতত স্থগিত করে হাঁটা ধরলাম সেই অজানা দালানের দিকে অতএব। এরই মধ্যে দাস্তানাহীন নিজ করতলের হাড়গোড় সব তীব্র হিমে মুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে এরকম অনুভূতি হতেই ছেলেদের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে দ্রুত দুটিকে জ্যাকেটের পকেটস্থ করতে হল ।
একটু আগে ননদ ভাবির বিরল যৌথ দাবির মুখে দিক পাল্টে হাঁটলেও, এখন মনে হচ্ছে যে ব্যাপার তো একই হবে ফেরার সময়। তখন তো ঐ স্বর্গশান্তির দরজা থেকে এখানেই ফিরে আসতে হবে, কারণ লি খাঁ কে তো বলেছি ফেরার সময় ওখান থেকেই যাতে আমাদের তুলে নেয়, যেখানে নামিয়েছিল সকালে। একটু আগের পরিকল্পনা ছিল আমার যে ফেরার পথেই যাবো ঐ অজানা ঘরে, যাচ্ছি এখন যেদিকে। তবে হ্যাঁ ফেরার পথেও যদি এইহিমে এতোটা পথ হাঁটতে অপারগ হয় সবাই তাহলে, দ্বিতীয়বার ঢোকা যাবে এই ঘরে। যদিও জানি না এখনও দ্বিতীয়বার ঢোকার মতো জায়গা কি না ওটা। তবে দেশে ঠেলার নাম বাবাজি হলেও এখানে দেখছি হিমের নাম শুধু বাবাজিই, দাদাজি, নানাজি ইত্যাদি যতরকম জি আর তার সবগুলোই। অতএব যতোই অনাকর্ষণীয়ই হউক, দরকার হলে ফেরার পথেও ঢুকতে হবে ওখানে ফের জান বাঁচানর খাতিরেই। সেযাক ঐ ঘরে আর কিছু না থাকলেও যদি একটা স্যুভেনির শপ থাকে , আর তাতে যদি পাওয়া যায় অভ্রর জন্য দস্তানা , কিনে নিতে হবে তা প্রথমেই। নিজের দস্তানা পুত্রকে দিয়ে নিজে তো বুজতেই পারছি কতো ধানে কতো চালের মতোই, কতো ঠাণ্ডায় কতো দুর্গতি। এদিকে অভ্ররও হচ্ছে না কাজ ঐ দস্তানায়। আর পেলে আসলেই দু জোড়াই কিনে নেব দস্তানা, কারণ আমার দস্তানাগুলো আসলেই তেমন ভাল না। ওতে ইউরোপের মাইনাস তিন চার ডিগ্রি পাড়ি দেয়া গেলেও এখানে ওগুলোই এক্কেবারেই অচল। আর পুরানো ও হয়েছে ওগুলো বেশ।
দস্তানা কেনা বিষয়ক ঐ চিন্তা করতে করতে মনে হলো যেন জ্যাকেটের ভেতরে ঢুকিয়ে লুকিয়ে রাখা হাত দুটোতে একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল বুঝি। আবার তখনই মনে হল যে , যে কোন ট্যুরিস্ট স্পটে যে সব স্যুভেনির শপ থাকে, তাতে সব জিনিষেরই দাম থাকে মহাআক্রা। অতএব ওখান থেকে কোন কিছু কেনার ব্যাপারে নিজের বরাবর মহাআপত্তি থাকলেও, এখন দেখছি দস্তানা পেলে ওখান থেকে ওগুলো শুধু ছেলের জন্য না নিজের জন্যও এক জোড়া কিনে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি অনায়সে। আসলে এরকম ঠাণ্ডায় যে নাকাল অবস্থা এতে তো এছাড়া কোন উপায়ও নেই।
আচ্ছা এরকম কেন মানুষের ন্যায়নীতি বোধ? হঠাৎ করেই এ প্রশ্নটি এসময় ঘাই দিয়ে উঠলো মাথায়। যেকোন দেশেই যেকোন সমাজেই বলার সময় সবাই বলে, অন্ধজনে দেহ আলোর মতোই অসহায়ের হও সহায়। অথচ বাস্তবে তো করে মানুষ উল্টা। শুধুই উল্টা করেই থামে না, এই উল্টা জিনিষই তো দেখি আমার মহাসমারোহে পড়ানোও হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তা হলে কি মানুষ এখনও জানে না আসলে ন্যায়নীতি কি? নাকি তার ন্যায়নীতি বোধটি হলো রং বদলানো গিরগিটির মতো। সুযোগ সুবিধা মতো সে তার বদলায় রং। আক্রাদামের দস্তানা কেনার সুত্র ধরেই এই কথা মনে হল। কারণ যে বাণিজ্যের উপর নির্ভর করে চলছে এখনকার ভোগবাদী সভ্যতা, তাতে তো ক্রেতাকে ফাঁদে ফেলে বা ক্রেতার অসহায় অবস্থায় তার কাছ থেকে বেশী দাম আদায় করা তো ব্যবসার একটা বিরাট কৌশল। যার কারণে কি না আবার এটাই পড়ানো হয়, শেখানো হয় বিশ্বের সেরা সেরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বি বি এ, এম বি এর ছাত্রদের। ঘটনা তো দেখি ঐরকম ছোটবেলা যেমন একদিকে পরিবার থেকে শিখেছি মানুষকে ঠকানো ঠিক না, মিথ্যা বলা মহাপাপ, তেমনি আবার অংক করতে গিয়ে, শিখেছি গোয়ালা কতো সের পানিতে কতোটুকু দুধ বা কতো দুধে কতো পানি মেশালে কতো লাভ হবে! হায় রে ঘটনা তো দেখছি হায় বড়ই গোলমেলে!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক।