অন্য কার কী রকম মনে হয় তা জানি না। তবে উপেক্ষা হোক তা যারই বা হোক তা যতোই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এমনকি ক্ষুদ্রতমও, মরমে জ্বালায় পোড়ায় তা বড়ই আমায়! স্যুট নিয়ে ঐ সেকশনে খটমট বাঁধার পর, সেখানকার বিক্রয়কর্মীরা আমার উপস্থিতির ব্যাপারে যে নীরব উপেক্ষার প্রদর্শনিটির অবতারণা করেছিল, তাতে যতোই হাবেভাবে চলাফেরায় ধরে রাখি না কেন বঙ্গলাট ভাব, মনে মনে হয়েছিলাম বড়ই ম্রিয়মাণ। জুতার সেকশনের বিক্রয়কন্যার এখনাকার এই সহাস্য আমন্ত্রণ মনের আকাশ থেকে অস্বস্তির ঘনকালো মেঘ সরিয়ে দিতেই শুধু যে পেলাম, তা নয় বরং একই সাথে হয়ে গেলাম বিগলিতই। বিক্রয়কন্যাদের এ ধরনের মেকি হাসির ট্রিকে বিগলিত হওয়ার ঝুঁকি বিষয়ে যতোই থাকি না কেন অবগত সচেতন, তারপরও এক্ষণে এ বাঙ্গালের একটু আগে লুপ্ত হয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধারের আনন্দে, ঠোঁটে আকর্ণ হাসি ঝুলিয়ে এগুতে এগুতে ভাবছি, আমাদের দেশে গরু মেরে জুতা দানের ঘটনা কখনও ঘটেছিল কি না তা জানি না, তবে কথাটা তো প্রচলিত আছে। আর চায়নায় এ ধরনের সে প্রবাদ থাকুক আর না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না, ঘটনা তো ঘটলো তেমনি এখানে। স্যুটের উপেক্ষিত ক্রেতা পাচ্ছে জুতায় সাদর আমন্ত্রণ!
এদিকে যতোই এই চায়নাকন্যা চুং চিং করে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকুক না কেন, তার হাবভাবের সপ্রতিভতায় কেন জানি মনে হয়েছিল এ নিশ্চয় ইংরেজি জানে ভালো! তাই ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করলাম, বলো কন্যা কোন ব্র্যান্ডের দায়িত্বে আছো তুমি? এ কথা জিজ্ঞেস করার কারণ হল এখানে পাশপাশি প্রায় সব ক’টা চেনা আন্তর্জাতিক জুতার ব্র্যান্ডের সাথে অচেনা চায়নিজ ব্র্যান্ডও দেখতে পাচ্ছি । আর সব ব্র্যান্ডের সাবসেকশনেরই দায়িত্বে আছে একজন বিক্রয়কন্যা, কিন্তু আমন্ত্রণ যেহেতু জানিয়েছে এই কন্যা, তাই পছন্দ হলে কিনবো আমি তারটাই।
সমস্যা হলো ভুল করে বরাবরের অভ্যাসমাফিক দ্রুতলয়ে বলা আমার ইংরেজি তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও, তা সে হৃদয়ঙ্গম করার বদলে মনে হচ্ছে ভির্মিই খেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অথচ তাকে অপ্রস্তুত করা তো হবে নিতান্তই কৃতঘ্নতার সামিল! দ্রুত তাই হাত নেড়ে বোঝানোর সাথে বাংলায় বললাম এবার, বল কন্যা যাই কোনদিকে। বাংলায় কাজ হল নাকি করল কাজ দেহভাষা, ‘তাহা লইয়া আর ভাবিত না হইয়া, কাজ যে হইল এতে’, তাতেই আনন্দিতচিত্তে তার পিছু পিছু গিয়ে হাজির হলাম ক্লার্ক জুতার পসরার মাঝে। দ্রুত এক নজরে এ অংশের পেছন, ডান আর বা দিকের শেলফগুলোতে আর মাঝের একটা গোল টেবিলের উপর চমৎকারভাবে সাজিয়ে রাখা নানান ডিজাইন ও রঙ্গয়ের জুতোগুলো জরীপ করটে গিয়ে, যা বলেছিলাম আগে, চোখ গিয়ে আটকালো ঠিকই আব্বার জেন্টলম্যান সেই সু’জেই।
‘জেন্টলম্যান ইজ নোন বাই হিজ সুজ’ প্রতিবার এই কথাটিই আওড়িয়ে ছোটবেলা আব্বা আমার জন্য বরাবরই অর্ডার করতেন কালো রঙ্গয়ের অঙফোর্ড সু, যার সামনের দিকটায় থাকতো ফুটকি তোলা কাজ। জুতো বানানোর সেই দোকানে সাজানো নানান ফ্যাশনেবল জুতোর স্যাম্পলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে করা আমার যাবতীয় কান্নাকাটি হতো ব্যর্থ। ব্যর্থ আমি চোখ মুছতে মুছতে ভাবতাম, যাক পা টা এখন তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলেই বাঁচি! তাহলেই নিশ্চয়ই পরেরবার হালফ্যাশনের জুতো পাওয়ার একটা সুযোগ আসবে। কিন্তু হায়! তা আর হতো না।
হ্যাঁ ঠিকই বলছি, ছোটবেলায় জুতো আমাকে অর্ডার করেই বানিয়ে দেয়া হতো। কারণ রেডিমেইড বাটা জুতোর দাম যা ছিল তখন, সেগুলোর ভার আব্বার দুর্বল পকেট নিতে পারতো না তো। এছাড়া জুতোও তো আমার কপালে হরহামেশা জুটতো না। আগের জুতো ছিঁড়ে ফেটে ফানা ফানা না হলে তো আর জুতো কেনা হতো না। আবার সে সময় যে খাঁটি চামড়ায় জুতো বানাতো আমাদের শহরের মুচিরা, সে সবের তো ছিল কই মাছের প্রাণ। তাই পা বড় হয়ে গেলেই আরেক জোড়া নতুন জুতো পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, যখন অক্ষত পুরানোটির জায়গা হতো ছোট ভাইয়ের পায়ে। সেসব কথা থাক, একসময়ে আব্বার পছন্দের যেই জুতোকে নিতান্তই সেকেলে মনে করতাম আজ কি না সেই জুতোই উঠে গেছে আমার প্রথম পছন্দের তালিকায়! আগেকার মতো এখন তো আর পা বড় হওয়ার কারণে জুতো বদলাতে বাধ্য হই না। তদপুরি এখনকার জুতোগুলো আগেকার মতো অজর অমর নয়। জুতো এখন কিনি এবং কিনতে পারি যখনই ইচ্ছা হয় তখন। এমতবস্থায় প্রতিবারই জুতো কিনতে গিয়ে দাঁড়াই শেলফে সাজানো অক্সফোর্ড জুতোর সামনেই। আচ্ছা এভাবেই কি আব্বা তাঁর অনিবার্য ও অনন্ত অনুপস্থিতি সত্ত্বেও এই অধম পুত্রটিকে আগলে রেখেছেন তাঁর দীর্ঘ ছায়ার নিচে?
আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে বইতে থাকা ঐসব মনভাবনার ঝড়ের মধ্যেই, চায়নাকন্যার ইশারায় কলের পুতুলের মতো ইতোমধ্যে বসে পড়েছি একটা গদিআঁটা টুলে। আর বসামাত্রই দেখি কন্যা ঠিক ঠিক সেই অক্সফোর্ড জুতোই এনে হাজির করেছে সামনে। চমৎকৃত হলাম এই ভেবে যে, তার চায়নিজ ব্র্যান্ডের চোখ ঠিকই রেখেছিল চোখ এই বাঙ্গালের চোখের উপর। কিন্তু সমস্যা তো হল যতোই হোক না তুমুল পছন্দ এ জুতো আমার। কিম্বা হোক না যতোই এ, যাকে বলে কাল অতিক্রম করা ক্লাসিক আনুষ্ঠানিক জুতো, ইংরেজিতে যাকে বলে টাইমলেস ক্লাসিক ফর্মাল সু, বেশিরভাগ তরুণদের পায়েই তো এই জুতো আগেও দেখিনি দেখি না এখনো। অতএব এ তো কেনা যাবে না পূষনের বরের জন্য। তদুপরি জীবজগতের নিতান্তই প্রাকৃতিক তাড়নার বিষয়টি সামাজিক রাজনৈতিক খোলসে বিয়ে হয়ে মানব সমাজে ঢুকে পড়ার পর পর, এর রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর থাকলেও, আধুনিক সময়ে এসে এটিকে অনেকে ব্যক্তিগত বিষয় ভাবলেও আসলে কি তা ঠিক! আগেও যেমন এই ব্যাপারটিতে ব্যক্তিগত মনোজাগতিক ব্যাপার পাত্তা পেত না, পায় না তা এখনো। আগেও যেমন অভিজাতরা এ অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে তাদের আভিজাত্য আর শক্তির মহড়া দিত, এখন হয়ে উঠেছে তা টাকার তাতে তাতানো সামাজিক ফ্যাশনবেল শো অফের কর্মকাণ্ডে। তদপুরি আজকের ডিজিটাল সড়কের পথ বেয়ে ঐ অনুষ্ঠানটিতে নানান সংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গ যোগ হয়ে হারিয়েছে এটির নিজস্ব সংস্কৃতির ক্লাসিক ভাবটি। ফলে ক্লাসিক আনুষ্ঠানিকতার বদলে এ হয়ে উঠেছে ফ্যাশনের মহড়ায়। যদিও জানি অত্যন্ত মার্জিত রুচির মিঠু ভাই সাবিনা ভাবীর মধ্যে কোন লোক দেখানোর ভড়ং নাই, ফলে তা থাকার কথা নয় তাঁদের সন্তানদের মধ্যেও, তারপরও পিয়ার প্রেসার বলে একটা ব্যাপার আছে না, যাকে বাংলায় বলে পাছে লোকে কিছু বলে। নতুন প্রজন্মের এই যুগল সেই পাছে লোকে কিছু বলে কে কতোটা সামলাতে পারবে তা তো জানি না। আর কন্যাকে আমি যতোটা চিনি, বরের ব্যাপারে ত জানি সে হল মেধাবি ডাক্তারই শুধু। অতএব কি দরকার ক্লাসিক ফর্মাল জুতো কেনার ঝুঁকি নেবার? বলা তো যায় না, হয়তো সে জুতো দেখে অনুষ্ঠানের দিনই কেউ বলে বসল, কি যে একটা বোরিং স্যু পরেছে জামাই! তাহলেই তো হল।
নাহ কিনবো একদম হাল ফ্যাশনের না হলেও মোটামুটি মাঝামাঝি জাতের একটা জুতাই। তরুণদের পায়ে যা দেখি আজকাল, তা হল নানান ডিজাইনের লোফার, যেটিকে পাম্প স্যু নামেই চিনতাম। লেইসহীন ঐ পাম্প স্যুকে আব্বা কখনোই ফর্মাল স্যুর মর্যাদা না দেয়ায়, যতোই ভাবছি যাবো ঐ দিকে পারছি না তবু যেতে চট করে। এদিকে ফর্মাল কিম্বা ফ্যাশনেবল জুতোর মধ্যে কোনটা কিনব এই যখন দ্বাদ্বিক অবস্থা মনের, সেই ফাঁকে হাসিমুখে তুমুল মনোযোগে বিক্রয়কন্যা আমার পায়ে দুই তিন রকমের অক্সফোর্ড জুতো পরাতে গিয়ে হয়েছে ব্যর্থ। লাগছে না কোনওটাই পায়ে ঠিক মতো। লাগবেই বা কীভাবে? না সে জিজ্ঞেস করেছে পায়ের মাপ, না বলেছি আমি তাকে! ঘটনা দুটোই ঘটেছে সম্ভবত ঐ ভাষা বিভ্রাট এড়াতে গিয়েই।
এ আমার জন্য বরং শাপে বর হয়েই দাঁড়াল। কারণ ঐ যে হয়ে পড়েছিলাম এর হাস্যোজ্বল আমন্ত্রণে বিগলিত, তাতে তো পড়েছি আরেক দ্বৈরথে। যার কারণে কীভাবে বলি যে, যে জুতো সে এনেছে তা আমার অতি পছন্দের হলেও, এখন তো আমি আমার জন্য কিনবো না। আবার যার জন্য কিনবো তার জন্য কোন জুতো যে কিনবো সে ব্যাপারে একটা আবছা ধারণা তৈরি হলেও, স্থির প্রতিজ্ঞ তো হইনি এখনো। ভাবছি বরং দেখতে দেখতে যেটা মিলে যাবে মনের ঐ আবছা ডিজাইনের সাথে ঐটা কিনে নেব। না মিললে নেব না। এখন এই জুতোগুলো পায়ে না লাগায় সুযোগ বুঝে, হাত পা নেড়ে বোঝালাম যে দেখতে চাই আমি বাকি ব্র্যান্ডগুলোর সেকশন।
লেখক: কলামিস্ট ও ভ্রমণ সাহিত্যিক