আজকালকার ডিজিটাল সময়ে মানুষ নিজেকে যতো না দেখে আয়নায়, তার চেয়ে ঢের বেশি দেখে নিজেদের হাতে হাতে ধরা নানান আকারের পর্দায়। তদুপরি আমাদের দেশেই অষ্টপ্রহর প্রচারিত হতে থাকা গণ্ডায় গণ্ডায় না কুড়িতে কুড়িতে যতসব টেলিভিশন চ্যানেল মাঠে নেমেছে, তাতে কারো মুখ কারণে অকারণে টিভির পর্দায় যাওয়া মোটেও কোনও আচানক ঘটনা নয় আর আজ, যেমন ছিল তা একসময়। অথচ ছিল তা একসময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই।
যেমন আমারই বিশ্ববিদ্যালয়পর্বের শেষের দিকে, যখন মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে ঘরে দোর্দণ্ড প্রতাপে বিরাজ করছিল বিটিভি, সে সময়ে আমাদের এক সহপাঠী বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে ও দৌড়ঝাপ করে, কী প্রকারে জানি না, বিটিভির হীরামন নামের এক লোকগাথা ভিত্তিক নাট্যানুষ্ঠানের রাজার সৈনিকের একটা চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিল। তার সেই অভিনয়ের রেকর্ড হয়ে যাবার পর সে তা জনে জনে ফোন করা সহ নানান কায়দায় ঐ খবর পৌঁছেছিল। অতপর নির্দিষ্ট দিনে অধির আগ্রহে টিভির পর্দার সামনে বসে থাকার পর, আমাদের অতি অল্প কয়েকজনই তাকে খুবজোর পাঁচ সেকেণ্ডের জন্য রাজ দরবারের প্রবেশমুখে একটি বল্লম হাতে নিয়ে সৈনিকের পোশাকে খাম্বাবত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। বাকীরা তাকে নাকে দেখতেই পায়নি ! অথচ তাতেই সে তার তারকাখ্যাতিটি সুযোগ পেলেই অত্যন্ত সরব এবং সগৌরবে তা প্রচার করতে শুরু করেছিল। অথচ আজ তো এ ব্যাপার হয়ে গেছে এক্কেবারে যাকে বলে পানিভাত, যা তা।
এমতাবস্থায় এই মার্কেটের উপরের তলায় উঠার সিঁড়ির মুখে ঝুলিয়ে রাখা দৈত্যাকার এই পর্দায় নিজেদের দেখতে পেয়ে, ডিজিটাল সময়ে বড় হয়ে ওঠা পুত্রদের এরকম উত্তেজিত হবার হেতু কি বোঝার চেষ্টা করছি মনে মনে। নিশ্চিত আমি এই যে, তারাও জানে এখানকার কোনও দেয়ালে বা থামে লাগিয়ে রাখা এক বা একাধিক ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার কারণেই দেখা যাচ্ছে আমাদের পরিবারসহ এই মার্কেটের আর সব চায়নিজদের এবং নানান দোকান পাঠের ভগ্নাংশ ঐ পর্দায়। যদিও যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি সেটির স্থানিক কারণেই এ মুহূর্তে পর্দায় আমরাই হলাম এই দৃশ্যের ফোকাস। এদিকে দলের সবাইকে মহাআগ্রহে যার যার নিজ নিজ হাতযন্ত্রে এই দৃশ্যটির ছবি তুলছে দেখে, নিজেও তাদের অনুকরণ করতে করতে মনে পড়লো, বছর পনের আগে একই রকম উত্তেজিত হয়েছিলাম নিজেও।
সে ঘটনা ঘটেছিল সিঙ্গাপুরের কম্পিউটার ও সে বিষয়ক যন্ত্রপাতির মক্কা সিম লিম টাওয়ারে। সেবার ঐ মার্কেটে ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে হঠাৎ এক দোকানের কম্পিউটারের পর্দায় নিজের ছবি দেখে, চমকে গিয়েছিলাম। অথচ আমিও তো তখন জানতাম নিজেকে ঐরকম পর্দায় দেখতে পাওয়ার মাজেজা। সে হিসেবে লাজু হেলেনের তো অবশ্যই এমনকি পুত্রদেরও উত্তেজিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং পুত্ররা যে এ ব্যাপারটিতে অবাক হয়েছে সেটি একটি আশার খবরই বটে। কারণ প্রায়শই তো মনে ওরা যেন বা চারপাশের নানান ঘটনায় মোটেও অবাক হয় না। অতি অল্পতেই তারা বোরড হয়ে যায়। সেটিই আসলে চিন্তার বিষয়।
‘আমরা কি এখন উপরে যাবো বাবা ?’
নাহ চল এখানে এই তলায় কোনও কফি শপ আছে কি না দেখি। কে কে খাবে কফি তোমরা ? দীপ্রর প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই, হেলেন আর দুপুত্র সমস্বরে জানালো যে এ মুহূর্তে তাদের কফি খাওয়ার ইচ্ছে নেই। অতএব ওদেরকে এই তলায় পেটশপ পাওয়া যায় কি না তা একটা চক্কর দিয়ে দেখতে বলে, এখানকার ঝলমলে দোকানগুলোর মধ্যে খুঁজতে লাগলাম স্টারবাক্স বা ঐ জাতীয় কফিশপ।
নাহ, এ তলায় নানান জিনিষের ছোট ছোট আলাদা আলাদা দোকান থাকলেও ঐ ধরনের বিশেষায়িত কোনও কফিশপ নেই। তবে মন্দের ভাল হিসাবে একটা স্ন্যাক্সের দোকান চোখে পড়তেই ঐদিকে পা বাড়ালাম। ভাবছি ওখানে কফি পাওয়া না গেলেও এই চায়ের মুল্লুক চীনের চা অবশ্যই পাওয়া যাবে। কফি না হলেও এক কাপ গরম চা এ মুহূর্তে ধন্যতরির মতো কাজে দেবে।
নাহ, প্রদীপের নীচের অন্ধকারের মতো চায়ের মুল্লুকের এই দোকানে চায়ের আঞ্জাম দেখতে না পেলেও কফি বানানোর একটি সম্ভাব্য যন্ত্রের অস্তিত্ব চোখে পড়ল। অবশ্য চায়ের চেয়ে কফিই যেহেতু অধিক কাম্য এ মুহূর্তে, দ্রুত তাই হাতের ইশারায় যন্ত্রতিকে নির্দেশ করে দুই আঙ্গুল দেখিয়ে দু কাপের অর্ডার দিলাম। দ্রুতই সে দুই কাপ এসে হাতে পৌঁছুতেই দাম মিটিয়ে, এগুলাম সামনের করিডোরে পেতে রাখা চায়নিজ ডিজাইনের সুদৃশ্য একটা বেঞ্চির দিকে।
মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া ক্রেতাদের বিশ্রামের জন্য ধরনের বসার জায়গা থাকে আজকাল নানান ঢাউস ঢাউস মার্কেট আর মলসমূহে, যেখানে আগেই বসে পড়েছিল লাজু ও হেলেন। বসতে বসতে হেলেনকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার ওরা কোথায়? তুই যাস নি ওদের সাথে?
উত্তরেও জানালো, বিশ্রাম দরকার ওর পায়ের। এছাড়া এখানে বসেই সে ভ্রাতুসষ্পুত্রদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে, বলে দেখালো ও ওদের অবস্থান ডান দিকের করিডোরে, যেখানে এক মনে দোকান জরীপ করতে করতে এগুচ্ছে দুজন।
লাজুর হাতে তার কফির কাপ তুলে দিয় নিজের আপে চুমুক দিয়েই প্রমাদ গুণলাম। গন্ধে সামান্য কফি কফি ভাব থাকলেও স্বাদে এটিকে মোটেও কফি মনে হচ্ছে না।
‘ওয়াক, ইস, কী নিয়েছ এইটা। ফালতু! নাহ এটা আমি খেতে পারবো না।’ একটু আগে যে ভয়টি করেছিলাম সেটিই সত্য প্রমাণিত হল। বিশেষত গন্ধের ব্যাপারে তুমুল খুঁতখুঁতে লাজু থপ করে আমাদের দুজনের মাঝের ফাঁকায় বেঞ্চিতে কফির গ্লাসটি রেখে এমনভাবে তাকালো যেন এ আমার ইচ্ছাকৃত করা কোনও গভীর ষড়যন্ত্র !
হ্যাঁ তাইতো দোষ তো আমারই! মনে মনে ঘাট মেনে নিয়ে বললাম আসলেই এক্কেবারে ভুয়া এই কফি। খেয়ো না এটা। ওকে একথা বললেও পকেট থেকে বেহুদা কড়কড়ে দুটো দশ রেন মেন বি র নোটের জলে যাওয়ার শোক প্রশমনের সাথে, বাইরের হাড় কাঁপানো হিমে জমে যাওয়া শরীরকে চাঙ্গা করার মানসে চোখমুখ বুজে কফি নামের হালকা মিষ্টি এই পানীয়টির উষ্ণতাটুকু শুষে নিতে নিতে অপেক্ষায় থাকলাম ফের কোন স্ত্রীশেল নিক্ষিপ্ত এইদিকে সেই শংকায়।
অসীম দয়া তার। এলো না আর কোন অনুযোগ অভিযোগের শর। হাঁফ ছেড়ে তাই উষ্ণ ঐ তরলের উষ্ণতা গলাধকরণ করতে করতে সিদ্ধান্ত নিলাম, নাহ এই মার্কেটে কোনও কিছুই কেনাকাটা করা যাবে না। হাবেভাবে যতোই ঝলমলে হোক না কেন এই মার্কেট, কিম্বা যতোই এরা বিশাল পর্দায় আমাদের ছবি দেখিয়ে চমকে দিক না কেন, এ সবই হল এদের ভুজং ভাজুং। এইমাত্র পাওয়া কফি নামের এই বস্তুর অভিজ্ঞতা পরিষ্কার বলছে কানে কানে যে এখাকার, সবকিছুই উপরে ফিটফাট হলেও ভেতরে সদরঘাট।
‘নাহ বাবা, ঐদিকে কোনও পেটশপ নেই। এখন আমরা ওইদিকটা দেখি আসি? ‘মার্কেটের বা দিকের অংশটি এরই মধ্যে জরীপ করে ফিরে এ কথা জানিয়ে দীপ্র অভ্রসহ ডান দিকের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই।
‘না না, আর খুঁজতে হবে না পেটশপ। অনেক হয়েছে। বাদ দাও ওটা খোঁজা। চল যাই এখান থেকে এখন।’ এ কথা বলতে বলতে লাজু বেঞ্চিতে রাখা কফি নামের তরল পদার্থটির কাপটি তুলে কাছের ডাস্টবিনে ফেলার জন্য এগিয়ে যেতেই, হেলেনও বলে বেঞ্চি ছেড়ে উঠতে উঠতে স্বগতোক্তির করল, ‘এই মার্কেটের জিনিষপত্রগুলো কেমন যেন ক্ষেত ক্ষেত মনে হচ্ছে !’ দলের দুই পরাশক্তির এহেন মন্তব্যের পর আমি আর বসে থাকি কী করে ? বেশ খুশি মনে আমিও অবিলম্বে এই মার্কেট থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার ব্যাপারে একাত্মতা ঘোষণা করলাম। আসলে একটু আগে নিজেও ভাবছিলাম পাশের মার্কেটে ঢোকার কথা। কিন্তু এতক্ষণ হাঁটার পর আবারো আরেক মার্কেটে হেঁটে গিয়ে ঢোকার প্রস্তাব রাখি কী করে তা নিয়ে ভাবিত ছিলাম। সেই সমস্যার এরকম একটি চমৎকার সমাধান হয়ে যেতেই হৃষ্টচিত্তে ওদের অনুগমন করলাম।
এই মার্কেটের ওম ওম গরম ছেড়ে সদলবলে বাইরের হিমে পা রাখতে রাখতে এরই মধ্যে ঠিক করে ফেলেছি মনে যে, সামনের মার্কেটে যে কোনও একটা মার্কেট থেকে কেনাকাটা শুরু করবো নিজেই। তবে আমার জন্য না, কেনা শুরু করবো আমাদের পরিবারের তুমুল সুহৃদ মিঠু ভাই সাবিনা ভাবীর মেয়ের হবু বড় মানে আমাদের জামাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষ, যে কটা পাওয়া যায় তা।
সম্ভবত আগেও বলেছিলাম যে, মাস কয়েক আগে সুপ্রিয় মিঠু ভাই তার প্রথম কন্যার আসন্ন বিয়ে উপলক্ষে, বরের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটার পুরো দায়িত্ব আমার কাঁধে তুলে দিতেই, নিয়েছিলাম তা আমিও মহানন্দে। ফলে আমাদের এই চায়না ভ্রমণের পরিকল্পনা করার সময় সেই কেনাকাটার বিষয়টিও মাথায় রেখেছিলাম। ঝির ঝির ভাবে বইতে থাকা বাতাসের হিম কেটে কেটে ফুটপাত ধরে সামনের মার্কেটের দিকে এগুতে এগুতে সেই হবুবরের জন্য যে জিনিসটি কেনার কথা মাথায় এলো প্রথম, তা হল স্যুটপিস!
যদিও স্যুটপিস বলতেই মাথায় আসা উচিৎ ইংল্যান্ড বা ইটালির কথা, কিন্তু আমার ধারণা ঐসব কোম্পানি আজকাল তাদের যাবতীয় কাপড়ই বানিয়ে নিয়ে যায় এই চায়না থেকেই। আর ঢাকার সব নাম করা স্যুট বানানোর টেইলরেরাই মূলত চায়নিজ আর ভারতীয় টেক্সটাইল মিলে তৈরি হওয়া কাপড়ে ইংল্যান্ড, ইতালি এসব সিল মেড়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে সব আক্রা দামে। এখন এখানকার কোন ভাল ডিপার্টেন্টাল শপে যদি পেয়ে যাই স্যুট পিস, তবে ঢাকার চেয়ে কম দামে নিশ্চয় ভাল জিনিষই কেনা যাবে। কিন্তু এই বেইজিংয়ে একটু আগে পাওয়া বদখদ ঐ কফি অভিজ্ঞতার কারণে মনে হচ্ছে ফের, এখানকার কোন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর যে নির্ভরযোগ্য হবে তা তো জানি না!
‘বাবা, মা, আমরা কি এই মার্কেটে ঢুকবো?’ দ্রুতপায়ে আমাদের পিছু ফেলে হেলেনের সাথে এগিয়ে যাওয়া পুত্রদ্বয়ের মধ্যে দীপ্র গলা উঁচু করে জানতে চাইলে, তাতে সায় দিতেই দ্রুততর গতিতে ওরা ফুটপাত পেরিয়ে এগিয়ে গেল সেইদিকে।
এদিকে অগ্রগামী দলের পিছু পিছু আমরা দুজনও দ্রুত পা চালিয়ে এই মলে ঢুকে পড়তেই, প্রথম দর্শনেই মনে হল এটি এখানকার উচ্চ মধ্যবিত্তদের টার্গেট করে বানানো বিশাল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরই। নানান শহরে দেখা এসব স্টোরের শুরুর দিকেই যেমন থাকে নানান ইউরোপিয়ান আমেরিকান ব্র্যান্ডের পারফিউম শপ আর বিশেষত মহিলাদের ব্যাগ ও জুতোর সমারোহ, এটিতেও তাই আছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ভ্রমণসাহিত্যিক।