সকাল বেলাতেই মেজাজট খিঁচড়ে দিল, এই স্মার্ট ফেরারি সুন্দরী! নাহ এখন আর তাকে মোটেও সুন্দরী মনে হচ্ছে না। স্মার্টও মনে হচ্ছে না একটুও। বরং দেখতে পাচ্ছি সামনে ছোট কুতকুতে চোখের, হলদে জন্ডিস গায়ের রঙের বোঁচা নাকের অভব্য এক মহিলাকে। সাধে কি আর আমাদের ভাষায় বলে ব্যবহারে বংশের পরিচয়?
ছেলেদের সামনে এভাবে অপমানিত হওয়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যে, কী বলবো বুঝতে পারছি না। বিনাবাক্যব্যয়ে ছেলেদের হাত ধরে ঘুরে ঐ ফেরারি আলয় থেকে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হতে হতে ভাবলাম, আরে বেটি তুই কি করলি এটা? এটা কি চায়নার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা নাকি যে, এর কোন ছবি তোলা যাবে না? বা তুই নিজেই কি কোনও সামরিক নিরাপত্তাবিশারদ নাকি যে এই রকম করলি। এটা তো হইল স্রেফ একটা দোকান। গাড়ির দোকান আর তুই হইলি তার সেলসগার্ল।
অবশ্য তোরে সেলসগার্ল হিসাবেই বা নিল কিভাবে এরা। সেলসের লোকজনের আর যতো দোষই থাকুক, ব্যবহার তো তাদের ভালো হতে হয়। কিন্তু এ কী তোর চামার ব্যবহার? বুঝলাম তুই বুঝতে পারছিস আমরা তোর ক্রেতা না। ঢুকেছি তোদের দোকানে স্রেফ দর্শক হিসাবে। কিন্তু তা বলে কি এই হবে তোর ব্যবহার? দুটো ছোট বাচ্চার সখ হয়েছে তাদের প্রিয় ব্র্যান্ড ফেরারি গাড়ির সাথে ছবি তোলার, তাতে তোর এতো আপত্তি কেন? আমি বাঙাল না হয় কিনতে পারবো না ফেরারি, কিন্তু ওরা বড় হয়ে তো ফেরারির মালিক হতেই পারে! তখন যদি তাদের এ কথা মনে পড়ে?
‘বাবা, মা, আর হেন কে ডাকতে হবে না?’
দীপ্রর এ কথায় সম্বিৎ ফিরল তীব্র অপমানের আঘাতে বিহ্বল হয়ে পড়া আমার। এরই মধ্যে অপমানের ঘোরের মধ্যে ঐ গাড়ি শো রুম থেকে বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরে হোটেলের গেইট পেরিয়ে যাচ্ছিলাম হেঁটে সামনের দিকে, টেরই পাইনি। ফলে ভুলেই গিয়েছিলাম যে বউ আর বোন রয়ে গেছে হোটেলের ভেতরে। দ্রুত বললাম দীপ্রকে হ্যাঁ হ্যাঁ ডেকে আনো ওদের, এখন যাবো ঐ পেট শপ খুঁজতে। এই সায় পেতেই দুই ভাই একই সাথে আমার হাত ছেড়ে ঢুকে পড়লো হোটেলের লবিতে অপেক্ষমান মা আর ফুপ্পিকে ডেকে আনতে।
রাগে আগুন ধরে যাওয়া বলে যে একটা কথা আছে বাংলায়, এই হিমে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও বুঝতে পারছি তা সম্যক। কারণ ঠাণ্ডা লাগছে না। বরং ভাবছি যদি হতে পারতাম সেই দুই রাজার একজন, তবে দেখিয়ে দিতাম আজ এখন এক হাত এদের!
হ্যাঁ সেই যে একসময় ছোটবেলা, যে সাধটি ছিল জেগে উঠলো সেটি হঠাৎ। হায় বহুকাল আগে যে সাধকে অনেক দূরের পেছনে ফেলে এই বয়সে পৌঁছেছি আমি, সেই আমারই কী না ছোটবেলার মতোই রাজা হবার তীব্র সাধ হল। তবে, ছোটবেলায় রাজা না, আসলে রাজপুত্র হবার সখ ছিল। কারণ তাতেই তো পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে দেশবিদেশ ঘোরা যেত। দেও দৈত্য দানব মারা যেত। আবার রাজকন্যা পাওয়ার সাথে রাজা ও হওয়া যেত। তারপর সেইসব রূপকথার দিনগুলো গত হবার পর, যখন রাজরাজাদের নানান অরাজক কাহিনী জানতে পেরেছিলাম, তখন আবার রাজা হবার সাধ এক্কেবারেই মিটে গিয়েছিল। অথচ জাগল কি না তা আজ, এখন ! এই বেইজিং শহরে!
যেই দুই রাজার মনে পড়লো, তাদের একজন হলেন রংপুরের হারাগাছের বিড়ি সম্রাট করিমউদ্দিন ভরসা। সত্য মিথ্যা জানি না, তবে বিড়ি সম্রাটের ঐ ঘটনাটি গিয়ে শুনেছিলাম আশির দশকের একদম শেষদিকে উত্তরবঙ্গে চাকরী করতে গিয়ে। মূল ঘটনাটির সময় কাল ছিল ১৯৮৫/৮৬ সন। সে সময় বাংলাদেশের দ্বিতীয় জলপাই শাসক লেজে হোমো এরশাদের সখ হয়েছিল দেশের মানুষকে গণতন্ত্র বটিকা খাওয়ানোর। যেমন হয় আর কি সকল অবৈধ জলপাইয়ের। তো সে সময়ে প্রথমে লেজে হোমো, তার পূর্বসুরী মেসোয়াত জিয়ার অনুকরণে একটা হ্যাঁ না ভোট নামের পাতানো নির্বাচন করে নিজেকে জায়েজ করেও শান্তি পাচ্ছিল না সম্ভবত। তাই তখন সে তার আগেকার খাকিকে অনুসরণ করে নানান দলের দলছুট ধান্দাবাজ আর রাজাকারদের নিয়ে তথাকথিত একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করে একটা নির্বাচনের আঞ্জাম করছিল। সে সময় সে তার নিজজেলা রংপুরের হারগাছের বিড়ির সম্রাট করিমউদ্দিন ভরসাকে ঢাকায় ডেকে এনে, তার করা জাতীয়পার্টিতে যোগ দিতে বলে, ভরসার হাতে সংসদ নির্বাচনের একটা টিকিট ধরিয়ে দিয়েছিল।
রাজনীতির রও না জানা বিড়ি সম্রাট সাহেব, সেই টিকিট পেয়ে রংপুরে ফিরে যাওয়ার পথে ঢাকায় হোন্ডা মটর সাইকেলের শো রুমে ঢুকেছিলেন, তার সম্ভাব্য নির্বাচনকর্মীদের জন্য মোটর সাইকেল দেখার জন্য।
ভরসা সাহেব তার স্বভাবগত পোশাক লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরে সে সময়ে তরুণদের কাছে রাস্তার রাজা বলে বিবেচিত হোন্ডা শো রুমে ঢুকে মটর সাইকেল দেখছিলেন যখন, সেই শোরুমের সেলসম্যানের পছন্দ হয়নি তাকে। কিছুটা তাচ্ছিল্য ভরে সেই সেলসম্যান খোঁচা দিয়ে বলেছিল
‘ বুঝলেন চাচা এইটার নাম হোন্ডা? এইটা সাইকেল না ’
তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ভরসা সাহেব খোঁচা খেয়ে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘এইটার হালা কতো?’ বলে রাখা ভাল রংপুরের লোকজন রংপুরকে যেমন অংপুর বলে তেমনি হালি কে বলে হালা।
ভরসা সাহেবের সেই প্রশ্ন শুনে সেলসম্যান তাকে পাগল ঠাউরে, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল শো রুম থেকে। অতপর ভরসা সাহেব তার ম্যানেজারকে ডেকে এনে ঐ শো রুমের মালিকের স্টকে যতো হোন্ডা ছিল সেসময়, সবই ট্রাক ভর্তি করে রংপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
একটু আগে ফেরারি দোকানে একই রকম ঘটনার মুখোমুখি হয়ে কোন রাজ্যের রাজা না সেই ভরসা সাহেবের মতোই বিড়িসম্রাট হতে তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে আমার!
‘চল চল? কোনদিকে যাবে চল? কী ব্যাপার এখানে এরকম মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
হোটেলের ভেতর থেকে বেরিয়ে লাজু এ কথা বলতেই, ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে বরং পুত্রদের বললাম
কী বাবা, যাবে নাকি ঐ মাজারাতি আর এস্টন মার্টিন শো রুমে ছবি তুলতে?
‘নো’
‘না যাবো না।’
পরপর দেয়া অভ্র আর দীপ্রর এই উত্তরে বুঝলাম, মন খারাপ হয়েছে তাদেরও বেজায়। কিম্বা হতে পারে তারা আর পিতাকে একই ধরনের অপমানের মুখোমুখি করাতে চায় না ফের এই একই সকালে।
“কী বলছ? আবারো গাড়ির দোকানে যাবে নাকি ছবি তুলতে? তাহলে আমাদের এখনি ডাকলে কেন? ছবি তোলা শেষ করে ডাকতে।’
লাজুর এই উষ্মার জবাবে বললাম, না। শোননি যে ওরা আর গাড়ির সাথে ছবি তুলতে যেতে চাচ্ছে না। চল যাই এখন অভ্রর সেইপেট শপ খুঁজতে।
দু পুত্রের কাঁধে হাত রেখে হোটেলের সামনের সেই বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া হাঁটা রাস্তা ধরে ডান দিকে চুপচাপ এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ মনে হল চাঙা করা দরকার পুত্রদের। কী দরকার একটা বেয়াক্কেল বেল্লিক সেলসগার্লের অসৌজন্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের সকালটি মাটি করার? নিশ্চয় ওদের মন খুব ছোট হয়ে গেছে। কি জানি কি যে ভাবছে ওরা মনে। বললাম তাই
শোন বাবারা, আমাদের সাথে যা হল, অনেকদিন আগে যখন আমাদের দেশ ও গোটা ভারতবর্ষ ব্রিটিশরা দখল করে রেখেছিল, তখনও এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল লন্ডনে, রোলস রয়েসের শো রুমে। সে সময় আমাদের উপমহাদেশেই যে অনেক রোলস রয়েস বিক্রি হতো তা কি জানো?
‘নো’
‘তাই নাকি? কীভাবে? এখন তো কোন রোলস রয়েস নেই আমাদের দেশে বা ইন্ডিয়ায়। তাই না অভ্র?”
যথাক্রমে অভ্র ও দীপ্র মুখ খুলতেই বললাম এখন না থাকলেও তখন ঠিকই ছিল। বোঝ না আমাদের দেশ সহ গোটা ভারতবর্ষ তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি ছিল। সে জন্যই তো ওরা এসেছিল আমাদের দেশ দখল করতে। সে সময়ে গোটা ভারতবর্ষে প্রায় ৫০০ নাকি ৬০০ রাজা ছিলেন। যারা খুবই ধনী ছিলেন। ওরাই কিনতেন ঐসব রোলস রয়েস।
‘কিন্তু বাবা, তখন তো বাবা ব্রিটিশরা ছিল। তাহলে আবার আমাদের রাজারা ছিল কীভাবে?’ স্বভাবগত যৌক্তিক প্রশ্ন এলো দীপ্রর মুখ থেকে
থমকে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ তা ঠিক। কথা হচ্ছে তখন দেশ বা রাজ্য বলতে যা বোঝাতো তা পরে বদলে গেছে নানান কারণে। সেই মোগল আমল থেকেই গোটা ভারতবর্ষের নানান এলাকায় ছোট এলাকা নিয়ে অনেক রাজ্য ছিল। যেগুলো শাসন করতো এলাকার রাজা। যেমন মোগল আমলে, আমাদের ঢাকার কাছে যে সোনারগাঁও আছে, সেটি শাসন করতেন বাংলার বারো ভূঁইয়াদের একজন ঈসা খাঁ। মহীশুরে ছিলেন টিপু সুলতান। ঝাঁসি নামের রাজ্যে চালাতেন ঝাঁসির রানী। হায়দারাবাদ যিনি শাসন করতেন তাকে বলা হতো নিজাম। এই সব ভূঁইয়া, নিজাম, রাজা বা রানীদের বেশির ভাগই দিল্লিতে বসে ভারত চালানো ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। ব্রিটিশদের কথা মতো তারা তাদের বছর বছর ট্যাক্স দিত। ব্রিটিশরাও তাদের হাতে রাখার জন্য, রাজা, মহারাজা নাম দিয়ে তাদেরকে দিয়েই ঐসব রাজ্যগুলোর লুট করানোর ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক