বেশ কিছুক্ষণ হলো গোসল টোসল শেষ করে শুয়েছি এসে বিছানায়। ভেবেছিলাম যে রকম ধকল গেছে সারাদিন তাতে বুঝি বিছানায় শুয়ে পড়লেই আসবে প্রগাঢ় ঘুম। ওইরকমটাই তো মনে হচ্ছিল রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে এসে যখন শুয়েছিলাম সোফায়। দুচোখ জুড়ে যে ঘুম নেমে এসেছিল তখন, পাত্তা দেই নি সেটিকে। ভেবেছিলাম গোসল করার পর বিছানায় শুয়েই দেব গভীর ঘুম। কিন্তু এখন দেখছি দেখা নাই তার। মনে হচ্ছে তখন যে তাঁকে উপেক্ষা করেছিলাম সেটির প্রতিশোধ নেবার ব্যাপারে ঘুম বাবাজি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বুঝি।
একই অবস্থা একটু আগেও ছিল মনে হয় অভ্ররও। যদিও ওর ইচ্ছা ছিল আজ রাতে ঐ রুমে ঘুমানোর, কিন্তু সদ্য কেনা বিটস হেড ফোন নিয়ে, ওর ভাইয়ার সাথে ওর খিটমিট লাগতে পারে; কিম্বা ঐটি নিয়ে দুজনে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে ফুপ্পির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, এরকম হওয়ার শত ভাগ সম্ভাবনা থাকায় ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এ রুমেই তাঁকে ঘুমাতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাতে স্বভাবতই বেশ ক্ষুব্ধই হয়েছিল ও।
এমনিতেই ঘুম না আসা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে ও বেশ নড়াচড়া করে। তদুপরি এখন এখানে শুয়েছে সে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ নিয়েই। মনের সেই ক্ষোভের কারণেই হয়তোবা আজ আমাদের দুজনের মাঝে শুয়ে আরো বেশিই নড়াচড়া করছিল। আমার ঘুম না আসার সেটিও একটি বড় কারণ হতে পারে। কিন্তু তারপরও কিছুই বলিনি ওকে, যেহেতু এরই মধ্যে মায়ের কড়া ধমকও খেয়েছে বেশ ক’বার। মায়ের ধমকের কারণে বেশ কষ্ট করে হলেও ঘাপটি মেরে নটনড়ন চড়ন হয়ে শুয়ে থাকার চেষ্টাও যে করছিল সে প্রাণপণ অনেকক্ষণ, বুঝতে পারছিলাম তা। তবে এই বেশ কিছুক্ষণ হল, শ্বাস প্রশ্বাসের তাল লয় আর ওর শুয়ে থাকা ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে ও অবশেষে। তারপরও নিশ্চিত হবার জন্য ঘাড় তুলে রুমের অন্ধকারের মধ্যে ওর মুখের দিকে নজর দিতেই নিশ্চিত হওয়া গেল যে আসলেই ঘুমিয়েছে ও। এদিকে ওর ওপাশে লাজু ও যে ঘুমিয়ে পড়েছে তাও নিশ্চিত। হায়! এই অভাগার চোখেই শুধু দেখছি নেই ঘুম!
আচ্ছা নিবো নাকি তাহলে চান্স একটা? ক’টাই বা বেজেছে এখন? খুব জোর সাড়ে এগারোটা হবে। হ্যাঁ ভাবছি, সবাই যখন ঘুমিয়েই পড়েছে, যাবো নাকি তাহলে পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরিয়ে নীচে ঐ বারে? পেগ দু তিন ভদকা মেরে আসতে পারলে মন্দ হতো না। ঘুমটাও আসতো তাতে জম্পেশ। ভাবতে ভাবতে বিছানার সাথে গা ঘষতে ঘষতে অভ্রর কাছ থেকে সরে গিয়ে, শুয়ে থেকেই বিছানা থেকে মেঝেতে পা নামাতে গিয়েও নামলাম না।
প্রথমত কথা হচ্ছে, যে পোশাকে আছি এখন সে পোশাকে তো আর বারে যাওয়া যাবে না। যার মানে হচ্ছে উঠে মোটামুটি হলেও ভদ্রোচিত জামাকাপড় চড়াতে হবে গায়ে। ওসব করতে গিয়ে টুকটাক শব্দে যদি দুজনের মধ্যে যে কারোই ঘুম ভেঙ্গে যায়, তবে এই রাতে এইরকম ফিটফাট হয়ে যাচ্ছি কোথায়, এর জবাবই বা দেব কী? ধরে নিলাম আমার অতিসতর্কতা আর ওদের গভীর ঘুম এই দুইয়ের যোগফলে ঘটলো না ওরকম কিছু। অতএব গেলাম চলে নিরুপদ্রবে রুম থেকে। কিন্তু বার থেকে ঘণ্টা দেড়েক ঘণ্টা পর রুমে ফেরার পর যদি কোনো কারণে ঘুম ভেঙে লাজু আবিষ্কার করে, যে ফিরেছি আমি ফুলবাবু কোনো গোপন নিশীথ অভিযান শেষে, তবে আমি যে শুধুই বারেই গিয়েছিলাম, তা বললে তো ভবি ভুলবে না মোটেও।
নাহ মাঝে মধ্যে দু এক পেগ খাওয়া নিয়ে ওর তেমন কোনো বিষম আপত্তি নেই। তবে এই মাঝরাতে ওর ভাবনা যদি সুরার গ্লাস ছেড়ে চলে যায় সাকীর দিকে, তবে তো নাই আর রক্ষা এই অধমের। এ ঘোরতর রাতে বেইজিং এর বুকের এই হোটেল রুমেই শুরু হয়ে যাবে তবে নতুন এক ভয়াবহ আফিম যুদ্ধ! ১৮৩৯ সালে শুরু হওয়া প্রথম আফিমযুদ্ধে, ব্রিটিশ আফিম বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কিম্বা ১৮৫৬ সালের দ্বিতীয় আফিমযুদ্ধের সময় ফ্রান্স আর ব্রিটিশ যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে চায়না যতোটা বিক্রমে লড়ে সে যুদ্ধকে তিন চার বছরে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছিল, তার কিছুই তো করতে পারবো না আমি। নিমিষেই ঘটবে পরাজয় এ অধমের! তাও কিনা একদমই একটা ডাহা মিথ্যা কারণে, রেশ যার শেষ হবে না এই ইহজীবনে আর।
নাহ থাক। কিছুতেই নেয়া যাবে না ওইরক আজীবনের ঝুঁকি। তার চে ভাল হতো যদি সারাদিনের ঘয়ারঘুরির কোনো এক ফাঁকে চুপেচাপে অনুনয় বিনয় করে একটু অনুমতি নিয়ে রাখতাম ওর। তাতে সেসময় ও রাগ করলেও ঘটনা অতো গুরুতর দিকে মোড় নিত না, নিতে পারে যা এখন। কিন্তু সে সুযোগ তো হারিয়েছি। আবার এখন ঘুম ভাঙিয়ে ওরকম অনুমতি নিতে যাওয়া শুভবুদ্ধির পরিচয় হবে না। নাহ, তীরে এসে তরি ডোবানোর কোনো মানেই হয় না। কালই তো আমাদের শেষদিন চায়নায়। তারপরই তো যাবো ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে। আনন্দময় স্মৃতির বদলে শেষ দিকের এসে এরকম অঘটনজনিত তিক্ততা দেশ পর্যন্ত টেনে নেবার মানে নেই।
অতএব সন্তর্পণে বিছানার সাথে গা ঘষতে ঘষতে অভ্রর দিকে ফিরে আসা শুরু করতেই, মগজের নিউরনে নিউরনে নিউরনে ফের বেজে উঠলো ‘কান্ট্রি রোড টেক মি হোম’।
কাকতালীয় এই ব্যাপারটি সেই থেকে বারবারই মাথায় ঘুরছে। প্রথমত কথা হল আমার কিশোরবেলার বিখ্যাত এই গান এতবছর পরের প্রজন্মের অভ্রও যে শুনতে পারে, তা তো কখোনই ভাবিনি। দ্বিতীয়ত যখনই দেশের বাইরে যাই নিজে, প্রথম কয়েকদিন নতুন জায়গার নানান কিছু নিয়ে তুমুল ব্যস্ত থাকলেও যতই দিন যেতে থাকে ততোই কেমন যেন দেশের ফিরে যাওয়ার একটা টান অনুভব করি। বেশিরভাগ সময়েই যেহেতু গিয়েছি বা যাই এখনো নানান দেশে বিশেষত পেশাগত কারণেই একা, ভাবতাম তাই ঐ যে ফিরে যাবার টানটা, তা বুঝি আপনজনদের কাছে পরিবারের কাছে, বন্ধুবান্ধবের কাছে ফিরে যাবার টান। কিন্তু তারপরও যে অল্প কবারই ঘুরতে গিয়েছি সপরিবারে তখনও কিন্তু দেশে ফিরে যাবার এই টান টের পেয়েছি। পাচ্ছিলাম তা এখানেও দিন দুয়েক ধরে ক্ষণে ক্ষণে। ঐ গানটির শোনার পর থেকেই ভাবছি, তুলনামূলক চুপচাপ স্বভাবের আমার এই ছোট পুত্রটিও কি আমার মতোই পাচ্ছে নাকি দেশে ফেরার টান? না হয় কেন সে শুনতে গেল ঐ গান, এবং শোনাল তা অতপর আমাকেও?
কিন্তু ছোটদের ক্ষেত্রে যে ওরক হবার কথা নয়, তা তো আমি নিজেকেই দিয়েই জানি। হ্যাঁ ছোটবেলায় আমার ভ্রমণের দৌড়তো বেশিরভাগই ছিল নিজের জেলার চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ। স্কুলের ছুটিতে যেতাম কুমিল্লাস্থ নিজেদের বাসা থেকে তৎকালীন কুমিল্লারই মহকুমা শহর চাঁদপুরে, দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি, খালার বাড়িতে। কালেভদ্রে যাওয়া হতো জেলার সীমানা পেরিয়ে পাহাড়ি চট্টগ্রামে, খালার বাসায়। সেটিই ছিল আমার জন্য তখন বিদেশ ভ্রমণ। মনে আছে ঐ সব ভ্রমণের শেষ দিনগুলোতে নিজেদের বাসায় ফিরে যাওয়ার দিন যতোই এগিয়ে আসতো দ্রুত, মন ভীষণ খারাপ হতো। কারণ ফিরে গেলেইতো হারাতাম বেড়ানোর দিনগুলোতে পাওয়া অপার স্বাধীনতা। বাসায় গেলেই তো বসতে হবে পড়ার টেবিলে। সাথে যোগ হবে এটা কড়া যাবে না ওটা করা ঠিক না ইত্যাকার বিধিনিষেধ।
সেই একই রকম তো হওয়ার কথা এখন পুত্রদেরও। দেশে ফেরার টান তো তাদের মনে আসার কথা না। তাছাড়া আশপাশ থেকে সর্বক্ষণ তারা যতোভাবে যতো ভঙ্গিতে নানান জনের মুখে শুধু দেশের বদনামই শোনে, তাতে তো দেশ নিয়ে তাদের মনে কোনো ভালো ধারণা তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। তদুপরি সারাক্ষণই তো বাস্তবে নানান জনের গল্পে কথায় এবং সোশ্যাল মিডিয়া মারফত নানান বঙ্গসন্তানের মহানন্দে বেহেস্তে গমনের মানে আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা গমনের খবর পায় ওরা। এছাড়া অহরহই তো সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান জন তাদের ঐ বেহেস্তি টিকিট পাওয়ার খবর চাউড় করার জন্য, ঐ ভিনদেশের নাগরিকত্ব নামের মহার্ঘ টিকিটটি হাতে ধরে সেই দেশের পতাকার নীচে আকর্ণ হাসি দিয়ে ছবি তুলে সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে, ক্যাপশন দেয়
‘টু ডে আই আম ভেরি হ্যাপি টু এনাউন্স দ্যাট, নাউ আই এম এ প্রাউড আম্রিকান /কানাডিয়ান / অস্ট্রেলিয়ান! আলহামদুলিল্লাহ ফর এভ্রিথিং। আল্লাহুম্মা বারিক লাহা।’
এইসব বালখিল্য জাতীয় পোস্ট দেখে তুমুল বিরক্ত যেমন লাগে আমার, তেমনি অমন ঘটা করে নিজ আত্মপরিচয় বিসর্জনের খবর চাউর করা দেখে করুণাও হয় জাতকূল হারানো ঐ বেচারাদের প্রতি। কিন্তু বাচ্চারা ঐ সব ঘোষণাকে তো তাদের বিরাট অর্জনই মনে করতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশ নিয়ে তাদের মনে কোনো উচ্চ ধারণা তৈরি হবার সুযোগটাই বা কই। হায়রে আমার অভাগা দেশ !
এ মুহূর্তে তাই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে এলাম যে দেশের ডাক পাবার কারণে নয়, ঐ গানটিকে নিশ্চয় অভ্র সেটির সুরের মাহাত্ম কিংবা জন ডেনভারের অপূর্ব গায়নভঙ্গীর কারণেই পছন্দের তালিকায় তুলে নিয়েছে। তবে ডিজিটাল সময়ের কিশোর কিশোরী তরুণ তরুণীদের পছন্দের তালিকার সবচেয়ে উপরের দিকে যখন হেভি মেটালের স্থান, তখন নিতান্তই শিশু অভ্রর পছন্দের তালিকায় এই গানটি থাকা বেশ অবাক হবার মতো ব্যাপারই, যা টের পাইনি আমি নিজে কক্ষনো এর আগে।
অবশ্য ওর খুব ছোটবেলা থেকেই দেখেছি ছবি আঁকার প্রতি ওর বিশেষ ঝোঁক। এই কিছুদিন আগেও ও একমনে নিজে নিজে নানান কার্টুন স্ট্রিপ আঁকতো, এস্টেরিক্স ওবেলিক্স, আর ওর পছন্দের বই দা ডায়েরি ওফ উইম্পি কিডস আদলে। যার কারণে হেলেন ছোটবেলা থেকেই ওকে বাচ্চা পিকাসো বলে ডাকে। তদুপরি গতকাল তিয়েন আন মেন স্কয়ার ঘুরতে গিয়ে ওখানকার গ্রেটহলের নানান পেইন্টিং এর প্রতি ওর যে বিশেষ আগ্রহ দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে ওর জীনে শিল্পসাহিত্য বিষয়ক সুকোমল প্রবৃত্তির একটা বিশেষ স্থান আছে বলেই মনে হচ্ছে।
লেখক: ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।