ধীরে সুস্থে সবার ম্যাকডিনার শেষ হওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ দেখছি টেবিল ছাড়ার নাম করছে না দলের মহাদুই শক্তিধর নারীসদস্য। প্রায়শই ঠাণ্ডা লড়াইয়ে এ অধম নাকাল হলেও, দু জনেই এখন দিচ্ছেন চুমুক ধীরে সুস্থে একই ভঙ্গিতে যার যার ঠাণ্ডা পানিয়ের কাগুজে গ্লাসে। চুমুক দেয়ার ভাবে মনে হচ্ছে কোল্ড ড্রিংক্স না, এই হিমে পান করছেন তারা বুঝি এইমাত্র আগুন থেকে নামিয়ে গরম কফি! পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সারাদিনের দৌড়ঝাঁপজনিত তুমুল অবসাদ শরীরে জেঁকে বসার যে সুযোগ পেয়েছে, করছে তারা সেটির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার। থাকলাম আমিও গা এলিয়ে তাই, চেয়ারে। এ সময়টায় ম্যাকস্টোরের এই দোতালা অংশের টেবিলগুলোর বেশীর ভাগই ফাঁকা। অতএব ফাস্ট ফুডের দোকানের নিয়ম অনুযায়ী দুদ্দাড় ফাস্ট ফুড খেয়ে ফাস্ট টেবিল ছাড়ার নেই তাড়া।
তদুপরি, আগামীকাল আর নেই তেমন কোন দৌড়ঝাপের তাড়া। দিন নয় নাকি দশ আগে ঢাকা থেকে সপরিবারে বেরুবার পর, সারাক্ষণইতো ছিলাম দৌড়ের উপর। কাল আর থাকবে না সেই দৌড়। আগামীকালের দিনটিকে যেহেতু শপিং ডে ঘোষণা করে রেখেছি, তাতে আপাতত সেটাই মনে হলেও নিশ্চিত হওয়ার কারণ নেই যদিও। এই দুই মহাশক্তিধরের শপিংলিস্টিতে যে কী কী আছে সেটাই তো জানি না। এটুকুই জানি শুধু যে লাজু সিল্ক কিনতে চায়। সে ব্যাপারে এরকম একটা নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে একটু আগে যে, সিল্ক কেনার জন্য তার আর সিল্ক রোডে যাওয়ার খায়েশ নাই। যা কেনার এখান থেকেই কিনে নেবে। হেলেনের অবশ্য শপিং করার জন্য লিস্ট লাগে না। শপিং সেন্টারে গেলে লিস্ট ছাড়াই তার ব্যাগ ভরে উঠে, নানান সওদায়। মানে বিপণনের ভাষায় আজকের ভোগবাদি বাজার ব্যবস্থায় যাকে বলে ইম্পালস বায়ার, ও হল তা। এদিকে আমার লিস্টিতে আছেন শুধু মিঠু ভাই। মানে যে দায়িত্ব তূলে দিয়েছেন কাঁধে ডাঃ মোসলেহউদ্দিন ওরফে মিঠু ভাই, মাস কয়েক আগে আর আমিও যে সে দায়িত্ব মহাআনন্দে নিয়েছি কাঁধে তূলে, মনে পড়লো সে কথাই। ঘটনা হচ্ছে বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার ভতিজি, মানে ডাঃ মিঠু ভাই ও ডাঃ সাবিনা ভাবীর বড় মেয়ের। এই বিয়ে উপলক্ষে সাবিনা ভাবী, অচিরেই শ্বশুর হতে যাওয়া মিঠু ভাইকে একটা গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন। তা হল যৌতুক তো অবশ্যই নয়, তবে এমনিতে বিয়ে উপলক্ষে জামাইকে প্রথামাফিক যা যা দিতে হয় হবে তার সবই তাঁকেই কিনতে হবে।
আপাদমস্তক রোগী অন্তপ্রাণ ডাঃ মিঠু ভাই তাতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন। কারণ এ ব্যাপারে তিনি নিজেকে একদম অযোগ্য মনে করেন। অপর দিকে আমাকে মনে করেন এ বিষয়ের কেষ্টুবিষ্টু। ফলে কয়েকমাস আগে হঠাত করে এক দুপুরে আমার অফিসে হাজিরা দিয়ে, মুখ কালো করে এই গুরু দায়িত্ব পাওয়ার কথা জানিয়ে আমতা আমতা করছিলেন যখন, তখন জিজ্ঞেস করছিলাম যে এ ব্যাপারে আমি কী করতে পারি। তাতে তিনি হালে পানি পেয়েছিলেন। দ্রুত তাই জামাইবাজার করার গোটা গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে চড়িয়ে দিয়ে তুমুলভাবে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে, হাসতে হাসতে বলেছিলেন সেদিন “আপনার যা যা পছন্দ হবে জামাইর জন্য, কিনবেন তা। দাম নিয়ে ভাববেন না। কথা একটাই সবকিছুর দামই নিতে হবে গুনে গুনে আমার কাছ থেকে।”
আমিও হাসতে হাসতেই নিয়েছিলাম সে দায়িত্ব। মিঠু ভাই সাবিনা ভাবী এই ডাক্তার দম্পতির সাথে পেশাগত কারণে একসময় পরিচয় হলেও, তাঁরা তো ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আমার আত্মার আত্মীয়। ওনাদের কাছে জমেছে অনেক ঋণ। সময়ে অসময়ে, নিজের পরিবারের প্রয়োজনে তো বটেই পরিচিত অনেক জনেরই চিকিৎসা বিষয়ক প্রয়োজনে যখনই নিয়েছি ওনাদের শরণ, নির্দ্বিধায় হাসিমুখে কাঁধে তূলে নিয়েছেন সে দায়িত্ব। এই প্রথমই কি না একটা সামান্য ব্যাপারে উনি করছেন আমার উপর নির্ভর। অতএব এ ছিল মহানন্দের ব্যাপার আমার জন্য। সেইদিন থেকে গত বেশ কয়েক মাস ধরে যখনই যে দেশে গিয়েছি পেশাগত কারণে, আমার শপিং লিস্টের একদম উপরে বিরাজমান নিরন্তর, আমাদের সেই হবু জামাই বাবাজি-“বাবা, বাবা, চল এবার হোটেলে যাই।”
প্রাণরসায়নের ভাষায় যদি বলি, তবে বলতে হয় বয়সজনিত কারণে আমাদের বালকপুত্রদ্বয়ের শরীরে এড্রেনালিন এখনো লাফঝাপ থামায়নি। অতএব খাওয়া শেষ হতেই আমরা ঝিম মেরে গেলেও, ওরা ঘুরছিল এতক্ষণ গোটা ম্যাকস্টোরটির আগাপাশতলায়। এইমাত্র তারা ধুপধাপ করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসেছে নিচতলা থেকে। হাফাচ্ছে দু’জনেই। ভাবলাম একবার যে, তাদেরকে একটু বিশ্রাম নিতে বলি, কিন্তু দুজনের দেহভঙ্গিতে বলছে উল্টা কথা। তাই দীপ্রর দেয়া প্রস্তাব সমর্থন করে বললাম– হ্যাঁ তাইতো! চলো ফেরা যাক হোটেলে, এ বলে নিজে গাত্রোত্থান করতেই, বাকি দুই মহাশক্তিধরও বিনা বাক্যব্যয়ে দিলেন টেবিল ছেড়ে। সবাইকে নিয়ে, ওম ওম গরমের আরাম ছেড়ে ম্যাকের পেট থেকে বাইরে পা দিয়ে শরীর সিটিয়ে যেতেই নিজের মাথার হুড, মাফলার এসব ঠিকঠাক করতে করতে, বললাম সবাইকে ঢুকবো নাকি, ঐ যে মার্কেটটা দেখা যায় ওখানে?
“না, না বাবা এখন রুমে যেতে চাই।” জানালো সাথে সাথেই অভ্র।
কে জানে, কেন রুমে ফেরার এই তাড়া অভ্রর? তার কি তবে বাথরুমে যাওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে নাকি? এ বিষয়ে তার পছন্দ অপছন্দ তো অতীব সূক্ষ্ম। যেকোন বাথরুমেই কাজ চলে না ওর। আর সেটাই যদি হয়ে থাকে এই তাড়া দেবার কারণ, তবে দ্রুতই ফেরা উচিৎ। প্রাকৃতিক এই ডাক যে বড়ই বেয়াড়া তা তো প্রমাণিত করেছেন বহুদিন আগেই মহামতি গোপাল ভাঁড়। অতএব ধরলাম হোটেলমুখী রাস্তাই।
এমনিতেই চেনা পথে মনে হয় দ্রুত এগুনো যায়। তদুপরি এরই মধ্যে বারকয়েক এ এলাকায় পদচিহ্ন পড়ায়, কিছু সংক্ষিপ্ত রাস্তা , মানে আমাদের খাস কথ্য বাংলায় যাকে বলে কোনাইচ্চা রাস্তা, দিক কানা হওয়ার পরও সে রকম রাস্তা আন্দাজ করে হাঁটতে পারায়, দ্রুতই রাস্তার হিমসাগর পেরিয়ে সেঁধিয়ে যেতে পারলাম হোটেলের ওম ওম গরম পেটের ভেতর। পুত্রদের কারনে অ্যাপেল স্টোরে যাওয়ার তাড়া থাকায়, হোটেল থেকে বেরুবার সময় চোখে পড়েনি। এখন লবি ধরে লিফটের দিকে আগুয়ান হতেই, চোখে পড়লো হোটেল লবির ডান দিকের মাঝামাঝি অংশ থেকে, মানে যেখান থেকে শুরু এ তলার রেস্টুরেন্ট টি, যা পেরিয়ে গেলে বাঁয়ে পাওয়া যাবে মদিরা কক্ষ বা বার, সেই গোটা অংশজুড়েই বেশ একটা উৎসবমুখর ভাব। কোন পার্টি পার্টি হচ্ছে মনে হয়। অবশ্য শিকার উপরে মাছের হাঁড়ি থাকলে বিড়ালের তো তাতে হা হুতাশই বাড়ে শুধু ?
অনাহুত বা রবাহুত কোন ভাবেই পার্টিতে যোগ দেবার রুচি এখন অবশ্যই আর নাই। সবাইকে নিয়ে লিফটবন্দি হতে হতে ভাবছিলাম শুধু যে গোটা রেস্টুরেন্ট পুরো বুক করে পার্টি দিলেও, বার তো নিশ্চয়ই সেই বুকিংয়ের আওতার বাইরে থাকার কথা।এছাড়া এখনও পার্টি চললেও অচিরেই তো ভাঙবে তা। আসবো নাকি তাহলে বারে,সবাই ঘুমিয়ে পড়লে চোরাগোপ্তাভাবে দু এক দু পেগ চাখার জন্য! সারাদিন হিমে যে দৌড়ঝাঁপ করেছি তাতে এ এক্কেবারে সারবাদি সালশার মতো কাজ দেবে।
তবে এরই মধ্যে লিফট জায়গামতো এসে থামায় মনের ভেতরে ওই দুই নম্বরি চিন্তায় পড়লো ছেদ। লিফট থেমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুয়ার খুলে দিতেই দুদ্দাড় পুত্ররা যেভাবে রুমের দিকে দিল ছুট, তাতে দুজনেরই আছে জরুরী প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেটাই মনে হল। যার মানে হল দুটো রুমই খোলা দরকার । দ্রুত তাই ওদের পিছু পিছু আমাদের রুমের দিকে এগুতে এগুতে দেখি, দুজনেই ঢুকছে ঐ রুমে। ঐ রুমের বাড়তি চাবিটা তো ছিল দীপ্রর কাছেই।
ব্যাপার তো তাহলে গুরুতর হয়ে উঠতে পারে আচিরেই। মানে প্রাকৃতিক ডাক দুজনের এক সাথেই এসে থাকলে দুজনেই জড়িয়ে পড়বে দ্বৈরথে এখন ঐ রুমের টয়লেটের দখল নেবার জন্য। দ্রুত তাই এ রুম খুলে সেটির দরজা ঠেলে ধরে রেখে নিরব এই করিডোর মুখরিত করে অভ্রকে সামান্য গলা উঁচিয়ে ডাকলেও পেলাম না সে ডাকে সাড়া তার! এরই মধ্যে লাজু আর হেলেন এসে পৌঁছে যাওয়াতে, লাজুকে এরুমের দখল দিয়ে হেলেনের পিছু পিছু এগুলাম ঐ রুমের দিকে।
নাহ, যা ভেবেছি তা নয়। টয়লেট বিষয়ক কোনই হাঙ্গামা নয়। দীপ্র দেখছি এ সন্ধ্যায় কেনা তার বিটস হেড ফোনের প্যাকেট খঅলায় ব্যস্ত। আর পাশে বসে অভ্র দেখছে তা গভীর মনোযোগে। মনে পড়লো ছোটবেলায় কালেভদ্রে নতুন কিছু পেলে দ্রুত সেটির প্যাকেট খোলার জন্য কিরকম টগবগ উত্তেজনায় থাকতাম। সে হিসাবে এ মহার্ঘ বস্তুটি এতোক্ষণ যে প্যাকেটে বন্দি ছিল সেটাই তো বেশি। এ কারণেই যে ওরা হোটেলে ফেরার তাড়া দিচ্ছিল বোঝা গেল তা এখন। ওদের তুমুল আনন্দময় নিবিষ্ট এই ব্যস্ততায় কোন ব্যাঘাত না ঘটিয়ে দিলাম ফিরতি হাঁটা নিজেদের রুমের দিকে।
রুমে পা রাখার আগেই জানতাম প্রাকৃতিক ঘরে জায়গা পাওয়া যাবে না এখন। অতএব ঢুকেই দ্রুত নিজের ভারী জ্যাকেট মাফলার দস্তানা মুক্ত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেও অচিরেই মনে হল, বড় সড় সোফা যেহেতু, শুয়েই পড়ি না কেন?
যে ভাবা সেই কাজ। শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই মনে হল মহাপ্রাচীরে উঠা থেকে শুরু করে সারাদিনের দৌড়ঝাপে শরীর উপর ভালই ধকল গেলেও গতকালের তুলনায় আজকের দিনের ষোলআনার জায়গায় আঠারো আনাই উশুল করা গেছে । তিয়েন আন মেনে পথ হারিয়ে গতকাল তো দিনের পরিকল্পনার আট আনাই মিছে হয়ে গিয়েছিল। ফলে যেতে পারিনি গতকাল বেইজিঙয়ের পাখির বাসা মানে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। গতকালের সেই অপূর্ণতাটি পূরণ করে দিয়েছে আজ শোফার লি খাঁ। বাৎচিত তার সাথে তেমন করা না গেলেও, এই হোটেলের কন্সিয়ার্জ কন্যা মিস ইনার ভ্রাতা, কুবলাই চেহারার লি খাঁ, বেইজিং এর পথঘাট যে চেনে নিজের হাতের তালুর মতো, সেটাই মনে হয়েছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক