পাশ থেকে ফের দীপ্রর ঐ ঘড়ি বিষয়ক প্রশ্ন ঘুরে আসতেই বুঝলাম বেমক্কা ধাক্কা খেয়েছে ও একটু আগে, আমার ছোটবেলায় রূপকথা গল্পে পড়া সাপের মাথার মণি নাকি অতিদুর্লভ নীলকান্তমণি জাতীয় পাথরের দামের মতো দামী ঐ ঘড়ির দাম শুনে! সে ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো ও। ফলে ওটা এ যুগের কোন জাতের সাপের মাথার মণি নাকি নীলকান্তমণি নাকি অন্যকিছু জানতে চাইছে।
বললাম রোলেক্স, পাটেক ফিলিপ বা কার্টিয়ার হবে হয় তো। নাহ, বাবা ঠিক বলতে পারছি না। আসলে কি যে ব্র্যান্ড সেটা লক্ষই করিনি। দামেই তো মাথা ঘুরে গিয়েছিল। নাম দিয়া আর কাম কি? তবে বাবা এসব ফালতু জিনিসের ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে কোন লাভ নাই। অতএব বাদ দাও ওটা।
‘না না তোমার হয়নি। আমি দেখেছি, ওটা হলো পিয়াজে।’
বিজয়ীর ভঙ্গিতে বেশ কায়দা করে সুইস কোম্পানির ফরাসি নাম চরধমবঃ উচ্চারণ করে দীপ্র উঁচু গলায় হেলেনের সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়া অভ্র ডেকেই, একটু আগে কেনা তার মহাপ্রার্থিত বেটস হেড ফোনের বাঙটি বা হাতে বুকের কাছে ধরে দিল দৌড় সামনে। ওর দৌড়ের গতিপথ ধরে চোখ সামনে যেতেই দেখি, এই রাস্তাটির এদিকটার শেষপ্রান্ত যা এয়ারপোর্ট থেকে গড়িয়ে আসা মূল রাস্তার পেটে ধাক্কা খেয়ে মোড় নিয়েছে ডানে, দাঁড়িয়ে আছে ঐখানে এখন অভ্র ও হেলেন।
‘এই, এই দৌড়াবে না এভাবে! পড়ে যাবে, পড়ে যাবে! আচ্ছা তুমি কিছু বলছ না কেন ওকে?”
পাশাপাশি হাঁটতে থাকা পুত্র নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন মায়ের আশংকার পিঠে সওয়ার হয়ে স্বামীর দিকে তাক করা অনুযোগের তীর উপেক্ষা করে, মনে এখন বাজছে আমার রিন রিন করে, একটা বইয়ের নাম ‘মুল্য এক কোটি টাকা মাত্র’! আমার মতো বেকুব স্বামীর জন্য ব্যাপারটি অবশ্যই অতীব ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু কী করবো? মনের সাথে তো পারা যায় না। এছাড়া বেকুবেরাই তো এই গ্রহে নানান সময়ে নানান ঝুঁকি নেয়, কারণে অকারণে।
আচ্ছা, ঐ বইয়ের কোন জিনিসটার দাম যে ছিল এক কোটি টাকা, তা তো দেখছি মনে নেই। হ্যাঁ, সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী দার লেখা মাসুদ রানা সিরিজের সেই বইটির কথা মনে পড়তেই মনে হল, হায়রে কী যে দারুণ ছিল সেইসব দিন! ঐ সময় এক কোটি টাকা যে কতো টাকা তা নিয়ে কোন ধারনাই ছিল না। অবশ্য তা নিয়ে চিন্তাও করিনি। মূল ব্যাপার তো ছিল, তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ মাসুদ রানার গোয়েন্দাগিরি। আমাদের ঐ প্রজন্মটিকে বইমুখি করার ব্যাপারে, কাজী’দার অবদান নিয়ে তো আজ সুধীমহলে কোনও কথাবার্তা নেই। অথচ নিজেকে দিয়েই তো জানি, শুধু বই পড়া নয়, কাজিদার কারণেই তো পরিচিত হয়েছিলাম সে সময় বিশ্ব সাহিত্যের অনেক নাম করা বইয়ের সঙ্গে। মনে পড়লো এ ব্যাপারে একদিন ঢাকার অফিসে কথা হচ্ছিল সহকর্মী শাহরিয়ার জামানের সাথে।
শাহরিয়ার সেদিন বলেছিল, ‘সেলিম ভাই আমার ক্ষমতা থাকলে আমি কিন্তু কাজী’দারে একুশে পদক দিয়া দিতাম!’
সাথে সাথেই আমি তা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলাম।
‘এই শোন এখানে কি সিল্কের দোকান আছে? নাকি যেতে হবে অন্য কোথাও।’
“মূল্য বিশ কোটি টাকা মাত্র” স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে মুখে একথা উচ্চারিত হতেই, বেশ উষ্মা ও বিরক্তির মিশেলে ছুটে এলো শব্দ তীর।
‘কী ফালতু কথা বলছো? সিল্কের কিসের দাম বিশ কোটি টাকা?’
সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, না না তা তো না। ভাবছিলাম ঐ ঘড়িটার কথা। নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে সিল্ক এখানকার দোকানেও। না হয় যাবো বেইজিঙয়ের বিখ্যাত সিল্ক স্ট্রীটে। যতোই দূরে হোক, ওখানেই নিয়ে যাবো তোমাদের। কাল তো শপিং ডে।
‘না না, শুধু সিল্ক কেনার জন্য ওখানে যেতে হবে না। এখানে পেয়ে গেলে কী দরকার ওইখানে যাওয়ার। আর তুমি তো বলেছিলে যে ঐখানের মার্কেট নাকি ঠগ বাটপারে ভরা। দরকার নাই ওখানে যাওয়ার।’
স্ত্রীর কাছ থেকে এরকম অভাবিত প্রস্তাব পেয়েই বড়ই আশ্বস্ত হলাম। যাক অন্তত একবারের জন্য হলেও বঙ্গনারীর কাছে ভাতৃআজ্ঞার উপরে তাহলে স্বামীর মতামত মূল্য পেল!
‘বাবা, আমরা কি এখন ম্যাকেই যাবো? নাকি …’
রাস্তার মাথায় আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকা ওদের তিনজনের কাছে এসে পৌঁছুতেই দীপ্র এ কথা জিজ্ঞেস করতেই, আমি কিছু বলার আগেই জারী হল মাতৃআজ্ঞা
‘হ্যাঁ, আমরা ম্যাকেই যাবো। কোনও চায়নিজ নুডুলস বা অন্য কোনও রেস্টুরেন্টে ঢোকা চলবে না।’
কথা হচ্ছে খাওয়া আমরা যাই খাই না কেন, যেতে হবে আমাদের ঐ ডান দিকেই। এই ব্লকটা থেকে আর দুটো ব্লক সামনে গেলেই পাওয়া যাবে ম্যাক। তার আগে অবশ্য একটা লাল সবুজ নুডুলস বারও আছে। আছে নিশ্চয়ই আরো রেস্টুরেন্ট। গতরাতে ঐ নুডুলসবারে ঢুকেছিলাম দীপ্র কে নিয়ে। জানি না আজো আবার তার সেই নুডুলস খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে কি না। তবে সে ইচ্ছা হয়ে থাকলেও, এ মুহূর্তে মাতৃআজ্ঞার বিপরীতে দুই ভাইয়ের কেউই কিছু না বলায় বরং ভালই হল। নিজেদের মধ্যে একটা অহেতুক নটঘট আর লাগলো না।
হাঁটছি সামনে সবাই একসাথেই। হিমের সাথে নেমে আসা ধোঁয়াশা, রাতের আঁধারকে চেপে না ধরলে রাস্তার এই অংশটাকেও ঝলমলেই বলা যেতো। নানান গাছে গাছে আর দালানে দালানে জ্বলছে নানান রঙয়ের আলো। কিছু কিছু দালান দেখে ওগুলোকে শপিং মল বলেই ঠাহর করলাম। কারণ ওসবের সামনে আছে আলোর মালায় তৈরি করা বিশেষ গেইট। সাথে লেখা আছে কি সব যেন চায়নিজে। ধারনা করছি ঐ সব লেখা নিশ্চয়ই ঘোষণা করছে নানান পণ্যের বিশেষ ছাড়ের বা সেলের কথাই। তবে বানর বছর হওয়াতে প্রতিটি গেইটের সাজসজ্জাতেই আছেন নানান আকারে ও আকৃতিতে বানর মহোদয়।
এরই মধ্যে একটা আলোকিত ও বৈদ্যুতিক কারসিমায় নড়াচড়া করছে এরকম বানরের মূর্তি সম্বলিত গেইটে কে পেছনে রেখে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো ভাতুষ্পুত্রদ্বয়কে নিয়ে হেলেন। এই মার্কেটটি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তাতেও ঐ বানর মহোদয়ের বিশ্রাম মেলে নি। চলছেই তার লাফঝাপ!
‘এই শোন, এখন আর দেরী করতে মানা করো তো ওদের। কি দরকার পড়ছে এখন ছবি তোলার? চলো তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে যাই রুমে। খুব টায়ার্ড লাগছে।’
লাজুর এই অনুযোগে সাড়া দিয়ে সবাইকে তাড়া দিয়ে ফের এগুতে লাগলাম সামনের দিকে। এই রাস্তাটিকেও মোটামুটি জনশুন্যই বলা চলে। তবে ডান দিকের পাশ রাস্তা থেকে কিছুক্ষণ পর পরই হুস হাস করে বেরুচ্ছে নানান আকারের গাড়ি। আসলে এই হিম কে হাঁটে বাইরে? তদুপরি এই এলাকার দোকানপাট দেখে বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার, এটি উচ্চ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তদের শপিং ডিসট্রিক্ট। অতএব এদিকটায় যারা আসেন বাজার সওদা করতে, গাড়িতে করেই করেন তারা আসা যাওয়া। ফলে এই আবহাওয়ার রাস্তা শুন্য থাকাটা খুব বেশি অস্বাভাবিক কিছু না।
নাহ পথে আর কোথাও কেউ দাঁড়ায়নি যেহেতু ছবি তোলা বা অন্য কোন কারণে, ফলে খুবে জোরে না হাঁটলেও পৌঁছে গেলাম বলা চলে দ্রুতই সেই ম্যাক এলাকায়। এসেই কেমন যেন মনে হল এসেছি নিজের এলাকায়। এ ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি। মানে কোনও অচেনা শহরের কোনও এলাকায় প্রথমবার যাওয়ার বহুদিন পরও যদি ঐ শহরে গিয়ে যাই ঐ এলাকায়, মনে হয় তখন বড়ই চেনা আমার সে এলাকা। সেদিন তিয়েন আন মেন স্কয়ারে পথ হারিয়ে তিন চক্কর খাওয়ার পর আমাদের কুবলাই খান শোফার লি খাঁ ঐ গোলক ধাঁ ধাঁ থেকে উদ্ধার করে ক্ষুধায় কাতর আমাদের দলকে এখানেই নিয়ে এসেছিল খাওয়ানোর জন্য। সেটা তো আছেই, তারপরও এসেছিলাম যেহেতু ফের সেই খাবার কেনার জন্য, ফলে জায়গাটাকে বেশ চেনা মনে হবে সেটাই স্বাভাবিক।
এদিকে ম্যাকের সেই বিখ্যাত হলুদ এম দৃষ্টিগোচর হতেই দু পুত্রই তাদের মা ফুপ্পির সকল নিষেধ উপেক্ষা করে দিয়েছে দৌড় সেই দিকে। তাতে হেলেনও এগুতে লাগলো দ্রুত অনেকটা জগিং এর ভঙ্গিতে।
ভালই হল। ওরা আগে গিয়ে আমাদের বসার মতো খালি একটা টেবিল দখল করতে পারলেই হবে। এই সুযোগে আশপাশের নানান সম্ভাব্য মার্কেট গুলোর দিকে নজর বোলাতে বোলাতে এগুতে এগুতে লাজুকে বললাম, আচ্ছা তুমি গিয়ে বসো না ওদের সাথে টেবিলে। আমি একটু দেখে আসি ঐ দালানটায় কোন ধরনের দোকানপাঠ আছে। উত্তরে
‘না না, দরকার নেই যাওয়ার তোমার এখন। চলো আগে খেয়ে নিই।“
অতএব দ্বিরুক্তি না করে ওর সাথেই ঢুকে পড়তেই হলো ম্যাকে।
নাহ, বাইরের রাস্তা জনশুন্য হিমকারবালা হলেও, ম্যাকের এই ওম ওম গরম গহ্বরে বেশ লোকজন আছে দেখছি। তবে একদম উপচে পড়া ভিড় নয়। এই তলার বেশির ভাগ টেবিলেই নানান জন বসে বসে খাচ্ছে, না হয় চুমুক দিচ্ছে কফি বা ড্রিংক্সের কাগুজে গ্লাসে। কাউকে কাউকে দেখলাম খাওয়া দাওয়া শেষ করে এখানকার মুফতে পাওয়া ওয়াই ফাইয়ের কৃপায় বসে বসে হাত বোলাচ্ছে ছোঁয়াফোনের পর্দায় । বড় কথা হলো খাওয়া নেওয়ার কাউন্টারে ভিড় নেই তেমন।
অনেকটা এল শেপের এই স্টোরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এসেও সব টেবিলই চায়নিজে চায়নিজাকার হয়ে থাকতে দেখে, ভাবছি যখন ওরা কি টেবিল পায় নি নাকি এ তলায়, তখনই উপরের উঠার সিঁড়ির মাঝামাঝি থেকে আসা অভ্রর ডাকে বুঝলাম সেদিনের মতো আজো উপরের তলাতেই পাওয়া গেছে খালি টেবিল। এদিকে অভ্র আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই উল্টো দিকে ঘুরে উঠে গেছে উপরে ফের।
এখন উপরে উঠলে ফের তো নামতেই হবে নীচে আবার খাবার নেবার জন্য। অতএব লাজুর খাবারের মেন্যু জেনে নিয়ে ওকে যেতে বলে, বললাম অভ্র আর দীপ্রকে পাঠিয়ে দিতে। তবে সাথে যেন হেলেনের মেন্যুও জেনে আসে ওরা। এ কথা বলে দাঁড়িয়ে থাকলাম নিজে সিঁড়ির গোড়াতেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক