দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলেয়মান | রবিবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

একটু আগেই এই পথে অ্যাপেল স্টোরের দিকে যাওয়ার সময়ও এ স্টোরটি কারোই নজরে পড়েনি। এমনকি গতকালও যখন এ রাস্তায় রেকি করছিলাম অ্যাপেল স্টোরে খোঁজে দেখিনি তখনও কেউ। এখন তা নজর কেড়েছে ওদের, যেহেতু হাঁটছিল ওরা ফুটপাত থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নানান দালান ও মার্কেটগুলো যে আছে, সেগুলোর করিডোর ধরে। জানালাবাজার মানে উইন্ডো শপিং করতে করতে ধীরেসুস্থে এগুচ্ছিল ওরা। এদিকে আমি তো হাঁটছিলাম ফুটপাত ধরে একমনে ভাবতে ভাবতে। ফলে এগিয়েও আছি বেশ কিছুটা ওদের থেকে। গতকালের মতো আজো যেহেতু দেখছি এ রাস্তায় লোকজন নাই বললেই চলে, হাঁটছিলাম তাই আশেপাশে না তাকিয়ে একমনে।

পুত্রের ওইরকম উত্তেজিত পিছুডাক কানে যেতেই, ঘুরে হাঁটা শুরু করেছি এখন। ভাবছি আচ্ছা এরকম জনশূন্যতার কারণ কী এখানে? বেইজিংহিম শুধুই তো হাড়কাঁপানো না, এক্কেবারে রক্ত মাংশ হাড় সব জমিয়ে প্রস্তরবত করে দেয়া হিম এখানে। এ কারণে নাকি অন্য কোনো কারণেই এরকম জনশূন্যতা এখন এখানে আছে, জানি না সঠিক। মজার ঘটনা হচ্ছে সেই প্রথম দিনের মতো কিন্তু ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি না এখন আর। দলের বাকীদের ভাবভঙ্গিতেও মনে হচ্ছে এরইমধ্যে বেইজিংহিমের সাথে মোটামুটি মানিয়ে নেবার সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে সবার শরীর। সাধে কি আর আমাদের ভাষায় কথা আছে ‘শরীরের নাম মহাশয় যাহাই সহান তাহাই সয়’?

পিছু হেঁটে ওদের কাছাকাছি হতেই, দীপ্র দৌড়ে এসে হাত ধরে সৈয়দবংশীয় সেই স্টোরের কাচের দেয়ালের ওপাশে চমৎকার একটি কেইস যে টি মুখ করে আছে আমাদের দিকে, সেটি দেখিয়ে বললো দেখো তো বাবা, দেখ তো এটা।

নাহ এটাকে শুধু সৈয়দবংশীয় স্টোর বললেও এর মান থাকে না। এ জাতের স্টোরগুলোকে আজকাল নতুন নামে ডাকা হয়। সে নাম হলো বুটিক। দীপ্র ঐ বুটিকের ভেতরে থাকা একটাই বস্তুর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় সেদিকেই গিয়েছিল নজর প্রথম। তাতে চোখে পড়লো স্মার্ট কিন্তু জমকালো একটা ঐ কেইসটির ভেতর ঘড়ি আছে একটা। এই ঘড়ি নিয়ে ওর বিশেষ এই উত্তেজনার কোনো কারণ ধরতে না পেরে, ভাবলাম এসে দাড়িয়েছিই যখন এই মহামান্য খানে খানান কুবলাই খান মার্কা এই বুটিকের সামনে, দেখি না ওটাকেই একটু ভালো করে।

নাহ, কোনো লোকজন চোখে পড়লো না, চমৎকার ছিমছাম ভাবে সাজানো এই বুটিকের ভেতরে। বেশ খোলামেলা এই বুটিকের ভেতটায় চমৎকার জ্যামিতিক ডিজাইনে নানান জায়গায় রাখা আছে বেশ কটা টেবিলের মতো নান্দনিক শোকেস। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেতরটার যতোটা দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে একাধিক কক্ষ আছে এর। বাইরের এই কক্ষটিতে তো বসার কোনো সোফা বা চেয়ার না থাকলেও, এই রুমটির ঐ পাশে আরেকটি যে রুম দেখা যাচ্ছে, তাতে জমকালো কিছু সোফার আভাস দেখতে পেলাম। ঐ কক্ষে ঢোকার খোলা দরজা, দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সেগুলো। ভেতরকার আর বাইরের গোটা আবহ বিবেচনা করে মনে হলো নিশ্চিত এটা কোনো অতিদামী জুয়েলারি বিক্রির বুটিকই হবে।

নানান ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট বিশেষত, দুবাই, হংকং, জুরিখ, সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে এরকম বুটিক শপের সামনে দিয়ে যাওয়া আস করলেও ঢুকিনি কক্ষনো। দেখেছি ওসব হাঁটার উপরে। এখন যখন দাঁড়ালামই এখানে ঢুকবো নাকি এর ভেতরে একটু?

এই ভেবে এদিক থেকে ভেতরে ঢোকার সম্ভাব্য দরজার দিকে তাকাতেই দেখি বন্ধ ওটা। তবে কি বন্ধ হয়ে গেল নাকি এ বুটিক আজকের মতো? সাথে সাথেই মনে হল হাবেভাবে এই বুটিকের অবস্থা যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে না ইচ্ছে হলেই যে কেউ ঢুকতে পারে এখানে যে কোনো সময়। যতোটা জানি অতি উচ্চমার্গিয় এইসব বুটিকে আসার জন্যও আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। আসেন যারা এখানে, আমাদের মতো তারা পায়ে হেঁটে নিশ্চয়ই আসেন না। এই দুনিয়ায় সবকিছুরই তো একটা তরিকা আছে। এরকম বুটিকে আসার তরিকা হল, কমপক্ষে মার্সিডিজ বি এম ডব্লিউ বা পোর্স চালিয়ে আসা। নাহ, তাহলে আর হ্যাংলার মতো এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে নেই।

শেষের এ কথাটা মনে হতেই বুটিকের অন্দরমহল জরিপে খ্যান্ত দিয়ে সবাইকে দিলাম তাড়া, চল চল যাই আমরা ডিনার করতে ম্যাকে।

তোমাকে যেটা দেখতে বললাম, তুমি কি দেখেছো ওটা বাবা’। সামনের দিকে হাঁটা শুরু করার আগে জিজ্ঞাসা করলো দীপ্র

হ্যাঁ দেখেছি তো। ঘড়ি একটা। কেন?

ওটার দামটা কি দেখেছো?’

নাহ, তা তো খেয়াল করিনি। যদিও লেখা ছিল। যা কিনবো না বা কিনতে পারবো না, তার দাম দেখে কি লাভ?

না, তাও একটু দেখো না। দেখে বলো টাকায় ওটার দাম কতো হয়’ বলেই টেনে নিয়ে গেল দীপ্র সেই ঘড়িটার কাছেই

কতো আর হবে। হবে হয়তো দশ বিশ লাখ। ওটার মুখোমুখি হয়েও ঐদিকে না তাকিয়েই বললাম মুখস্থ

তুমি তো আবারো না দেখেই বলছ। ভাল করে একটু দেখে বলো না বাবা।’ দীপ্রর এই অনুযোগে শোকেসটির মখমলে মাথা, মানে ডায়াল এলিয়ে শুয়ে থাকা ঘড়িটির ডায়ালের নীচে রাখা, ধাতব সোনালি অংকে লেখা প্রাইসট্যাগটির দিকে নজর যেতেই একটু ভিরমিই খেলাম

আরে বলে কী ! দাম তো দেখি মনে হচ্ছে লেখা আছে পাক্কা আঠারো মিলিয়ন রেন মেন বি! আচ্ছা আমি ঠিক দেখছি তো? একবারে যে দেখেছি নিজের চোখে এইমাত্র, তার উপর বিশ্বাস রাখতে না পেরে, ফের দেখলাম দামটা। লেখা দামটির প্রতিটি অংক আলাদাভাবে দেখতে দেখতে বহুদিন পর ছোটবেলায় শেখা একক, দশক, শতক, হাজার, অযুত, লক্ষ, নিযুত, কোটি পর্যন্ত মনে মনে গুনে তবেই থামতে হল!

তাইতো, তাইতো। এটার যে এতো দাম হতে পারে তা তো ভাবিনি। চল চল এখানে আর দাঁড়ানো যাবে না। কে জানে, যে কোন সময় হয়তো ভেতর থেকে কেউ এসে বলতে পারে এটা দেখতেও টিকিট কাটতে হবে জনপ্রতি দু চারশ রেন মেন বি দিয়ে।

কতো, কতো দাম ওটার?’ আমার কথার পিঠে একই সাথে দলের দু তিনজনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এই প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই হেলেন ঐ ঘড়িটির দিকে মোবাইল তাক করে ঐটির আশেপাশে আমাদের দাঁড়াতে বলল ছবি তোলার জন্য

না, না, আমি না। তোরাই দাঁড়া সবাই, আমিই ছবি তুলে দেই তোদের। বলেই এগিয়ে গিয়ে ওর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে, কয়েকটা এঙ্গেলে কয়েকটা ছবি তূলে বললাম চলো সবাই, এবার এগুনো যাক।

আমাদের টাকায় ওটার দাম কতো হয় বললে না, তো বাবা।’ জ্যাকেটের ডান দিকের নীচের অংশ খামচে ধরে এগুতে এগুতে ফের জিজ্ঞাসা দীপ্রর

এই, রাফলি ধরো বিশ কোটি টাকার মতো হবে?

বল কী? এ দাম দিয়ে তো দুই তিন টা নাকি চারটা ফেরারি লাম্বারগুনি কেনা যাবে। তাই না অভ্র?’

ইটস এ সুপার রিচ প্লেস’ দীপ্রর প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব না দিয়ে মন্তব্য করলো এতক্ষণ চুপচাপ থাকা অভ্র।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচেরাগী পাহাড়ে গেলে আজো একবার আজাদী অফিসের দিকে উঁকি মারি
পরবর্তী নিবন্ধমা-বাবার প্রতি অবহেলা নয়, তাঁদের প্রতি দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসুন