হাতের মুঠোয় পৃথিবী
হাতের মুঠোয় পৃথিবী, এই কথাটি একসময় কথার কথা থাকলেও, স্টিভ জবস তার আই ম্যাজিকে সে কথাটিকে অনেকটাই বাস্তবে রূপান্তরিত করে ফেলতে শুরু করেছিল বেশ কিছুকাল ধরেই । অতপর, বিশ্বময় সে তার আপেল ছড়িয়ে দেবার জন্য নানান গুরুত্বপূর্ণ শহরের অতিব গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যে সব স্টোর করেছে তাতেও এনেছে সে যুগান্তকারী পরিবর্তন। জানি তা পেশাগত কারনেই। ফলে অ্যাপেল স্টোর দেখার ব্যাপারে একটা আলাদা কৌতূহল ছিল মনে। যতই ভ্রমণ করে থাকি না কেন এর মধ্যে পেশাগত কারণে, সেই কৌতূহল নিবৃত্ত করার সুযোগ ঘটেনি এর আগে। কারণ যে সব শহরে গিয়েছিলাম এর মধ্যে, সেসব জায়গায় অ্যাপেল স্টোর ছিল না।সেই সুযোগ ঘটলো আজ এখন এই রাতে, বেইজিং শহরে! অতএব এই স্টোরে একদম ঢোকার মুহূর্ত থেকে শুরু খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবো সব সেটাই ভেবে রেখেছিলাম।
কিন্তু সে সুযোগ পেলাম না। কারণ দীপ্র হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে সে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তার সেই প্রার্থিত হেডফোনটি, স্টোরের যেখানে ডিসপ্লে করে রাখা হয়েছে সোজা সেখানে। ওখানে আগে থেকেই মওজুদ ছিল অভ্র। ভাবটি এমন যে, এরই মধ্যে কেউ যেন এটি কিনে না যায়, তার জন্য আছে সে পাহারায়!
“ গুড ইভনিং। হাউ মে আই হেল্প ইউ ?”
পরিষ্কার ইংরেজির এই বাক্যদ্বয় কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘুরে বক্তার মুখোমুখি হবার আগেই, হাসিমুখের গাট্টাগোট্টা চেহারার সেই অ্যাপেলম্যান সামনে এসে দাঁড়ালেন।
প্রত্যুত্তরে তাকেও শুভসন্ধ্যা বলে, বাকি কথা বলার আগেই ,দু পুত্র প্রায় সমস্বরে জানিয়ে দিল তাকে এতোদিন চাপিয়ে রাখা তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা।
ওদের কথায় হাসিমুখে “ওকে , ওকে” বলে সায় দিতে দিতে অ্যাপেলম্যান, আমার দিকে তাকাতেই, পাল্টা হাসিতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানানোর সাথে মুখে জানালাম যে হ্যাঁ , নিয়ে আসো তো ভাই চাইছে যা ওরা।
“টু অর হাউ মেনি?” হাস্যোজ্জল অ্যাপেলম্যানের প্রশ্নের জবাবে ফের দু’পুত্র সমস্বরে জানিয়ে দিল
নো নো ওয়ান। ওদের কথা হাসিমুখে মনোযোগ দিয়ে শুনলেও, সাথে সাথেই তা আমলে না নিয়ে ফের সে আমার দিকে তাকাতেই হাসতে হাসতে ইংরেজিতে বললাম, শোন, তুমি বুঝতে পারছি খুবই ভাল সেলসম্যান। কিন্তু ভাই আমারে আর ফাসাইও না। ছেলে আমার দুইটা হলেও, আপাতত একটা হেডফোনেই কাজ চলবে। সাথে এসময় উচ্চশিক্ষার্থে আমার চট্টগ্রামবাসকালীন সময়ে শেখা আধভাঙ্গা চাটগাইয়া আওড়ালাম নিজ মনে,
বা’জি ওজ্ঞার দামই যে খত লইবা ,হিবাই তো নো জানি। তুঁ ই বা জি আর দু গা বেচার ধান্দা নো কর।
ভেবেছিলাম, আমার সায় পাওয়া মাত্রই বুঝি অ্যাপেলম্যান চলে যাবে স্টোরের ভেতর থেকে একটা ফ্রেশপ্যাক নিয়ে আসতে। কিন্তু দেখলাম তা না করে, আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে নিজহাতের ছোঁয়াযন্ত্রে চকিতে আঙ্গুল বুলিয়ে, তিন চার ফুট দূরের একটা বড় চৌকা পাইন কাঠের টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা ফোনের দিকে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে ওগুলো একটু পরখ করে দেখতে বলল। সাথে এও নিশ্চিত করল যে অচিরেই আসছে, এইমাত্র অর্ডার করা দীপ্রর বিটস হেডফোন।
একটা ঘোর মতো অবস্থায় ঐ টেবিলের দিকে এগুতে এগুতে, মনে মনে ফের চমৎকৃত হলাম অ্যাপেলম্যানের এই চোখা সেলসম্যানশিপে। বাহবা দিলাম স্টিভ জবসকে। কোথায় যেন পড়েছিলাম স্টিভ জবস নাকি বলেছিল যে, অ্যাপেল স্টোরে ঢুকে যেকেউ যেন ফাইভস্টার হোটেলের অভিজ্ঞতা পায়, সেটা নিশ্চিত করবে সে সর্ব উপায়ে। এ স্টোরে ঢোকার পর থেকে এই সামান্য সামান্য সময়ে ঐ রকম অভিজ্ঞতার ঝলকই পেলাম!
প্রথমত স্টোরের বহিরঙ্গ থেকে শুরু করে অন্দরের যাবতীয় ডিজাইন আসলেই কাউকে ঘুণাক্ষরেও এরকম কোন অনুভূতি দেবে না, যাতে তার মনে হবে যে, ঢুকেছে সে কোন ইলেট্রনিক্স পণ্যের দোকানে। খুব বেশী জাঁকজমকের আসবাবপত্র দিয়ে ঠেসে দেয়া হয়নি স্টোরটিকে। বেশ প্রশস্ত এই স্টোরের বুকের আর পেটের ভেতরটার নানান জায়গায় মনে হচ্ছে জ্যামিতিক সূত্র মেনে পেতে রাখা হয়েছে, নানান সাইজের পাইন কাঠের প্রশস্ত টেবিল। যেগুলোর বুকে বুকে নিরাপত্তা চেইনবদ্ধ করে ডিসপ্লে করে রাখা হয়েছে নানান আইপণ্য। যে কেউ অনায়াসে আঙুলের ছোঁয়ায় সে গুলো পরখ করে দেখতে পারে। খোলামেলা এই স্টোরটির আবহ আসলেই একদিকে যেমন মনে করিয়ে দেয় পাঁচতারা হোটেলের প্রশস্ত লবির অনুভূতি, তেমনি এর সাজসজ্জায় আছে যাকে বলে সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস ভাব !
“কী ব্যাপার ? কী করছো তোমরা এখানে?”
স্টোরের বিপরীত দিকে পেটে রাখাঁ টেবিলগুলো এরই মধ্যে দেখা শেষ করে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে লাজু জিজ্ঞেস করতেই, অবস্থা হল তখনি পড়বি পর মালির ঘাড়ের মতোই !
অ্যাপেলম্যান এসময়ই সহাস্যে বিটস হেডফোনের ঝকঝকে একটা প্যাকেট দীপ্রর দিকে এগিয়ে দিতেই , ওটা হাতে নিতে নিতে সভয়ে তাকালো সে মায়ের দিকে। যাক, কপাল ভাল ওদের। এবার আর মায়ের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোন নিষেদ্ধাজ্ঞা জারী হল না। তাতে দু পুত্রই মহা উৎসাহে বোঝাতে শুরু করেছে তাদের হেডফোনটির বিশেষত্ব ও মাহাত্ম্য।
অতএব নিজেও মনে জোর পেয়ে সাহস্যে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাপেলম্যান কি জিজ্ঞেস করলাম, দাম মেটানোর কাউন্টার কোথায়? উত্তরে সে জানালো, কোন কাউন্টারেই যাবার দরকার নাই। এখানেই দাঁড়িয়ে নাকি দাম মেটানো যাবে। সাথে সে জিজ্ঞেস করলো নগদে নাকি কার্ডে দাম মেটাতে চাই?
কার্ডে পে করবো বলতে বলতে কাঁধব্যাগে থাকা কার্ড হোল্ডার থেকে কার্ড বের করে দিতে দিতে গিয়ে দেখি এরই মধ্যে অ্যাপেলম্যান তার কোমরের বেল্টের সাথে ঝুলতে থাকা একটা স্মার্ট পাউচ থেকে, পজ মেশিন বের করেছে। আমার কার্ড তার হস্তগত হতেই ওটাতে কার্ডটি ঢুকিয়ে পিন নাম্বার দেবার জন্য এগিয়ে দিল। মেশিনে পিন দিতে দিতে ভাবছি, বাহ বেশ তো! একেই তো বলে ওয়ানস্টপ সল্যুশন।
অন্যদিকে আমার ধারনার চেয়ে দ্রুত ঐ পজ মেশিনে অন্তর্জালিক বাংলা চায়না লেনদেনটি সম্পন্ন করতেই, অ্যাপেলম্যান আমার হাতে প্রয়োজনীয় রিসিট তূলে দিতেই
“চল বাবা আমরা এখন যাই।’ বলে তাড়া দিল দীপ্র। আনন্দে উত্তেজনায় ঝলমল তার মুখ। বুকের কাছে ধরে আছে সেই চমৎকার একটা ব্যাগে করে ওর হাতে তূলে দেয়া ওর সেই মহার্ঘ হেডফোন। তা দেখে বললাম
আচ্ছা এটা একটু চেক করে নিলে না এখান থেকে?
“না, বাবা। চেক করা লাগবে না এখন। রুমে গিয়ে ওটা খুলবো।’ দীপ্রর এই কথার পিঠে যাবতীয় আইপণ্যের পাঁড় ভক্ত অভ্র জানালো, যে এটা পরখ করার কিছু নাই। অবশ্যই এটার সবই ঠিক আছে। (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক