দেশ হতে দেশান্তরে

দুধ সাগর, ক্ষীর সাগর

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৮ জুন, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

ব্যাপারটাকে কাকতালীয়ই মানলাম। মানে পেছনের সিট থেকে দীপ্রর করা প্রশ্নের সাথে লি খাঁ র উত্তরের এই হঠাৎ মিলে যাওয়াটা। একই সাথে আরেকটা ব্যাপারেরও উত্তর মিলল এখন। তাহলো ঐ যে মুতিয়ানু থেকে রওয়ানা করার সময় লি খাঁ বলেছিলাম, চল যাই সামার প্যালেসে, তখন সে মুখে কোনো উত্তর না দিলেও, তার দেহভঙ্গিতে কেমন যেন একটা ভাব ফুটে উঠেছিল, যাতে কিছুটা ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম। এখন এতো দ্রুত, মানে এই ২৫/৩০ মিনিটের মধ্যেই সে যখন বলছে এসে পড়েছি, তাতে বুঝলাম তার ঐ দৃষ্টি আর দেহভঙ্গির মানে ছিল

আরে মিয়া সবুর করো না। আমি হইলাম এই এলাকার রাস্তার রাজা। আইছ তুমি দুইদিন হইল বেইজিং এ, আর তুমিই কি না আমারে কইতাছো কোথায় যাইতে হবে আগে! বড়ই আচানক ব্যাপার তো!’

নিজে নিজে লি খাঁর সেই দেহভঙ্গির এই অনুবাদ দাঁড় করাতে করাতে মনে পড়লো, পেশাগত জীবনে শেখা লিডারশীপ বিষয়ক সেই সুত্রের কথা, যা নাকি বলে, দলের নেতা সব জানে এটা যেমন ঠিক না ; তেমনি দলের কোনো সদস্য যদি কোনো ব্যাপারে নেতার চেয়ে বেশি জানে, তবে নেতার উচিৎ না, তাকে খুব বেশি ঘাঁটানো। কারণ ঘাঁটালে সে বিরক্ত হয়। বরং যে যেই ব্যাপারে এক্সপার্ট তাকে সেই ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়াটাই ভালো নেতার লক্ষণ। অবশ্য তার পূর্বে দুজনের মধ্যে বিশ্বস্ততার সম্পর্কও স্থাপিত হতে হবে। গতকাল থেকে এ পর্যন্ত লি খাঁ একদিকে যেমন শোফার হিসাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে, তেমনি অবিশ্বস্ততার কোনো কিছু তো সে করেনি। ফলে আমার ঐ ফোঁপর দালালি তার পছন্দ হয়নি নিশ্চয়। আসলে নেতৃত্ব নিয়ে যারাই লিখেছেন নানান বইপত্র আর থিউরি, তারা তো আর ঘাস খেয়ে ঐসব লিখেন নি, বা আমাদের দেশের তথাকথিত অনেক জ্ঞানীগুণীদের মতো টুকলিফাই থিওরি দেন নি।

সে যাক, এদিকে লি খাঁ সোজা গাড়ি চালিয়ে বেশ দূরে গিয়ে ইউটার্ন নিয়ে, ফের সেই এলাকায় ফিরে আসতেই গেট আর চত্বরের ডিজাইন মিলে যে আবহ দেখছি চারদিকে, তাতে এক্কেবারে নিশ্চিত হওয়া গেল যে এসে পড়েছি চায়নার শেষ রাজবংশ চিংদের তৈরি বাগান বাড়িতেই অবশেষে।

কীব্যাপার? চলে এসেছি নাকি আমরা? নামতে হবে নাকি?’

চত্বরে গাড়ি ঢুকিয়ে লি খাঁ নির্দিষ্ট জায়গায় তা পার্ক করার উদ্যোগ নিতেই, একদম পেছনের সিট থেকে লাজু হেলেন আর দীপ্রর ত্রয়ী প্রশ্ন ভেসে আসতেই

তাইতো মনে হচ্ছে বলে, প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর দিলেও, তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর দেবার ব্যাপারে আর ঝুঁকি নিলাম না। কে জানে যদি বলি হ্যাঁ, নামতে হবে, তাহলে যদি খাই ধমক! যেহেতু মহাপ্রাচির অভিযান শেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ও যে গাড়ি থেকে আর নামবে না, সে সংকল্প তো জানিয়ে দিয়েছিল আগেই।

আমরা কি নামবো এখন, বাবা?’

একটু বসো সবাই। এখনই নেমো না তোমরা কেউ। বাইরে যে ঠাণ্ডা আর যে জোর বাতাস শুরু হয়েছে তা তো বুঝতেই পেরেছ একটু আগে। টিকিট কিনে আনি, তারপর নেমো তোমরা, যার যার ইচ্ছা। দীপ্রর প্রশ্নের উত্তরে এই কথা বলে, লি খাঁ কে সঙ্গী করে গাড়ি থেকে নেমে এগুলাম টিকিট ঘরের দিকে।

টিকিট ঘরের সামনে টানানো দ্বিভাষিক পোস্টারে টিকিটের দামের ছকে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, এখানেও নানান ক্লাসের টিকিট আছে। মানে প্রথমত আছে ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষিত সামার প্যালেস নামের বাগান বাড়ির এলাকায় ঢোকার জন্য টিকিট। তারপর ঐ চত্বরের ভেতরের নানান দর্শনিয় স্থানে ঢুকতে হলে গুনতে হবে আরো কড়ি, কিনতে হবে টিকিট আরো।

যদিও জানি সময় নেই হাতে তেমন, আসছে ঘনিয়ে সন্ধ্যা, তারপরও ফের একবার টিকিট ঘরের বাইরে চত্বরে একবার চোখ ফেলে সন্ধ্যা যে অত্যাসন্ন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিলাম। সমস্যা হচ্ছে এটা তো জানি না যে, সন্ধ্যা হওয়ার পরও এটি খোলা থাকবে কি না দর্শনার্থীদের জন্য? আচ্ছা জিজ্ঞেস করবো নাকি ব্যাপারটা?

কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবো? লি খাঁ কে জিজ্ঞেস করার যন্ত্র, মানে তার সেই দ্বিভাষিক হাতফোন তো গাড়ির ড্যাশবোর্ডের যে ফোকরগুলো দিয়ে বেরুয় হিটারের আরামদায়ক উত্তাপ, দোল খাচ্ছে ওখানে বসে চুপচাপ। যতোই হোক এটি ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট, এখানকার টিকিট ঘরে আছেন যারা তারা নিশ্চিত খাস চায়নিজ। অতএব আমার বাংরেজি বা বাংলিশে কাজ হবে না। থাক, কী দরকার এই সন্ধ্যায় ঝামেলায় যাওয়ার, কিম্বা ঝুঁকি নেবার। চত্বরে ঢোকার জন্য যে টিকিট লাগে, সেটাই কিনি আগে সবার জন্য। তারপর ভেতরে গিয়ে দেখা যাবে। ওখানেও নিশ্চয়, ঐ যে যেসব জায়গায় ঢোকার জন্য আলাদা টিকিট লাগে, ঐসব টিকিট পাওয়া যাবে।

অতএব দুটো পঞ্চাশ রেন মেন বি নোট লি খাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে, হাতের পাঁচ আঙুল মেলে ধরে নাড়িয়ে বললাম, যান তো কাগু নিয়ে আসেন আমাদের জন্য টিকিট পাঁচটা। হ্যাঁ পাঁচটা টিকিটই নিতে বললাম। যতোই জানি বউয়ের গাড়ি থেকে না নামার সঙ্কল্পের কথা, মাত্র বিশ রেন মেন বি বাঁচাতে গিয়ে কেন অযথা ডেকে আনি নিজে নিজেরই জন্য দুর্যোগ। যেখানে খোদ কবিগুরু বলে গিয়েছেন,

রমণীর মন! সহস্র বৎসরের সখা সাধনার ধন’

সেখানে আমি কোন ছার! এমনিতেই মনে হচ্ছে, বেইজিং এর পাখির বাসার চত্বরে সবাই নেমেছিলাম যখন, তখন ঘুম ভাঙ্গিয়ে ওকে নামতে না বলায় একটুখানি তেতে আছে! তদুপরি এখন যদি ওর জন্য টিকিটই না কিনি, তাতে আবার কোন মহাভারত যে অশুদ্ধ হয়ে যায়, তা তো বলা যায় না। গেলে যাক বিশ রেন মেন বি গচ্ছা। এই বিশে যদি বিষক্ষয় হয়, তাতেই তো বিরাট রক্ষা!

টিকিট ঘরের সামনে এ মুহূর্তে সম্ভাব্য টিকিট ক্রেতা আছি আমরা দু’জনই, মানে লি খাঁ আর আমি। অতএব দ্রুতই এলো হাতে টিকিট। দ্রুত পার্কিং লটে গাড়ির গিয়ে ইশারা করতেই হুড়মুড় করে লাজু বাদে নেমে পড়লো সবাই। ভাবলাম, ও কি তাহলে গাড়ি থেকে আর না নামার সে প্রতিজ্ঞাতেই অটল থাকছে না কি? তাহলে তো আসলেই গেল গচ্ছা বিশ রেন মেন বি। এদিকে হেলেন আর পুত্ররা আমার কাছ থেকে টিকিট নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে গেইটের দিকে।

কিন্তু না, ফাঁড়া কেটেছে দেখছি। টিকিট কাটাতে এবারে আসলেই রক্ষা পেয়েছি। না হয় খবর ছিল! নামছে সে ধীর সুস্থে, পা টেনে টেনে। বুঝতে পারছি না, এ কি তার পায়ের ব্যথার জন্য? নাকি এতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকার জন্য পায়ে ঝি ঝি ধরেছে, সে জন্য?

কী ব্যাপার ব্যথা বেড়েছে নাকি তোমার পায়ের?

না না ব্যথা বাড়েনি। ঝি ঝি ধরেছে? আর ওরা গেল কোথায়? ভেতরে গিয়ে যদি খুঁজে না পাই ওদের। যাও যাও আমার টিকিট টা দিয়ে তুমি এগোও।’

বাবা, বাবা, মা, মা তাড়াতাড়ি আসো তোমরা, দেখে যাও কী অবস্থা!’ লাজুর কথার পিঠাপিঠি হৈ চৈ করে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে ডাকতে শুরু করেছে এরই মধ্যে দীপ্র।

বুঝতে পারছি না, সামার প্যালেসের ঢোকার মুখেই কী অমন ঘটনায় অমন হন্তদন্ত উত্তেজিত অবস্থা পুত্রের। দ্রুতই এগুলাম তাই নিজেও।

গেট পেরিয়ে ডানে নাকি বায়ে যাবো এমন ভাবনার অবকাশও পেলাম না। হাত ধরে টেনে পুত্র সোজাসুজি নিয়ে গেল সামনে। যেখানে আগে থেকেই হেলেন আর অভ্র অবাক নাকি বিমুঢ় হয়ে সামনে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক!

আরে তাইতো? ঘটনা কী? দেখছি কী আমি চোখের সামনে? এ কি তবে সেই ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে পড়া দুধ সাগর না কি? যদিও এজন্য কোনো তেপান্তরের মাঠ পার হতে হয়নি আমাদের। আসতে হয়েছে শুধু বঙ্গভূমি থেকে চায়নায়!

না না, এটা কে তো দুধসাগর বলা চলে না। এমন জোর হিমবাতাস এখানে, তাতেও ঐ দুধ সাগরের দুধে দেখছি না কোন কাঁপন। একে আসলে বলতে হয় ক্ষীরসাগর। হ্যাঁ ঐ ক্ষীর সাগরের বয়ানও পড়েছিলাম রূপকথাতেই। আর দুধসাগরের চেয়ে ক্ষীরসাগরে যাওয়ার লোভই ছিল সেই ছোটবেলাতে। দুধের চেয়ে ক্ষীরের প্রতি সেই পক্ষপাতিত্ব এখনো আছে আমার। সেজন্যই সেই আশাই কী তবে পূরণ হল এতদিনে?

বাবা, বাবা, চলো না নামি আমরা। ঐ যে দেখো না কতো লোক নেমেছে? ‘দুই দিক থেকে দুই পুত্র হাত ঝাঁকিয়ে আমার নিজেরও হতবাক অবস্থা থেকে বের করে আনতেই, হৃদয়ঙ্গম করলাম যে চোখের সামনে বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকা কুনমিং লেইকের পানি সব জমে নিস্তরঙ্গ সাদা বরফ হয়ে আছে! আর লেইকের মাঝ খানটায় প্রচুর প্রচুর লোকজন দেখা যাচ্ছে। এই বরফ জমাট লেইকের মাঝে যে পরিমাণ লোকজনের নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে এখন, তাতে এই প্রথমবারের মতো মনে হল, এসেছি আমরা আসলেই পৃথিবীর বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবার জন্য
পরবর্তী নিবন্ধসংগীত, আধ্যাত্মিকতা ও শিল্পীর দায়