দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

গোলাকার গ্রহের চক্রাকার নীতি

শুধুই যে নামছি সামনের দিকে, তা নয়। মাঝে মাঝেই ঘাড় ফিরিয়ে জরীপ করছি চায়নার গর্ব গ্রেট হলের চেহারা। কম বেশি যতটুকুই হউক অন্দর মহল তো দেখেছি এতক্ষণ এর, কিন্তু এর চেহারা মানে সামনের দিকটা তো দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া এর আগে। অন্তত এই বিদায় বেলায় দেখি না তারে তবে চক্ষু মেলিয়া, হৃদয় ভরিয়া।
এইমাত্র যেদিক দিয়ে বেরিয়ে এলাম গ্রেট হল থেকে, মানে যেদিকটা সম্ভবত এর মূল প্রবেশ পথ, সেখানে দেখছি পর পর অনেকগুলো বেশ উঁচু আর মোটা মোটা গোল থাম। ওগুলো কেন যেন ছবিতে দেখা গ্রীসের প্রাচীন এথেন্সের একটা বিখ্যাত স্থাপনার থামগুলো মনের আয়নায় ভসে উঠল। ভাবলাম, তাহলে কি সমাজতান্ত্রিক চীনের গৌরব আর শক্তির উদাহরণ হিসাবে নির্মিত এই মহাভবনের স্থাপত্যকে প্রাচীন গ্রীস প্রভাবিত করেছিল নাকি? তবে এসব ব্যাপারে অবস্থা তো হলো আমার মোল্লার দৌড়ের মতো, অতএব তার ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় উচিৎ না। এ ভেবে সেই ছবিটা মন তাড়ানোর চেষ্টা করতেই, কানে গেল পরিবারের নানান জনের মুখনিঃসৃত নানান শব্দ।
শব্দ করে ঠাণ্ডা তাড়ানো যায় বা প্রতিরোধ করা যায়, এ কোথাও কোনোদিন প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা নেই, তারপরও দেখেছি ঠাণ্ডায় কাবু মানুষকে উহু, আহা, ইস এসব শব্দ করে ঠাণ্ডার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতে। সেরকমই এখানকার প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় দুমড়ে মুচড়ে কুঁকড়ে যাওয়া পরিবারের সবাই যখন নামছে সেই সিঁড়ি বেয়ে আমার পিছু পিছু, মুখ দিয়ে তাদের বেরুচ্ছে নানান রকম ঠাণ্ডা নিরোধক শব্দ। ঘাড় ঘুরিয়ে এসময় সবাইকে বললাম থামতে, উদ্দেশ্যে এই মহাভবনকে পিছনে রেখে একটা অন্তত ছবি তোলা। ভেবেছিলাম এরকম ভয়াবহ ঠাণ্ডায় সবার যখন যাকে বলে এক্কেবারে ছেড়াবেড়া অবস্থা না শুধু তার চেয়েও ঢের বেশি দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থা, তখন এ প্রস্তাব মোটেও হালে পানি পাবে না । কিন্তু না, আজকালকার সেলফি উইফির যুগে মানুষেরা যখন নাকি মরতে মরতেও ছবি তুলে, মরে যাবার আগ মুহূর্তে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেয়াই নিয়ম, সে নিয়মের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে সবাই থেমে একাট্টা হয়ে পোজ দেবার আয়োজন করতেই বললাম -না না, যে যেভাবে আছ সেভাবেই থাক। একটা ন্যাচারাল ছবি তুলব।
‘তুলো তোমার ন্যাচারাল ছবি তাড়াতাড়ি। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারবো না এভাবে’, আমার কথার পিঠেই এরকম স্ত্রী আজ্ঞা চড়ে বসতেই, ছোয়াফোনের খোঁজে জিনসের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়েই বুকটা এক্কেবারে ছ্যাত করে উঠলো। নাহ ! নাই সেখানে ফোন! গেল কই ওটা, ডান পকেট থেকে দ্রুত হাত বের করে বা পকেটে হাত চালিয়ে দেখি ওখানেও বিরাজ শুধুই শূন্যতা! ‘কী ব্যাপার ছবি তুলছ না কেন?’ এরই মধ্যে ফের দিল তাড়া লাজু – মিন মিন করে বললাম পাচ্ছি না খুঁজে ফোনটা ! ‘বল কী কোথায় ফেলে এসেছ ওটা? আবারো ঢুকতে হবে নাকি ভেতরে ওটা খুঁজতে! সারাক্ষণইতো সবাইকে উপদেশ দিয়ে বেড়াচ্ছ, এখন তো দেখি তোমার নিজেরই ফোনের খবর নাই! এই নাও আপাতত এটা দিয়ে ছবি তোল’! এরকম একটা ঝাড়ি দিয়ে নিজের ফোন বাড়িয়ে ধরল লাজু – কপাল ভাল, কী কারণে যেন ডান হাতটা ঠিক তখনই জ্যাকেটের উপর দিয়ে বুকের বা পাশে হাত বোলাতেই মনের ভেতরে রিন রিন করে কেউ গান গেয়ে উঠল ‘আমার বুকের মধ্যখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে’! হ্যাঁ বউয়ের ঝাড়ি বুকের মধ্যে তীরের মতো বিধে যাওয়াতেই হউক আর যে কারণেই হউক, হাতটা ঐ অঞ্চলে বোলানতেই টের পেলাম অস্তিত্ব ওখানে ফোনটার! ধড়ে প্রাণ ফিরে এল তাতে, সাথে সাথেই মনে পড়ল, এই মহাভবন থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার আগে সবাইকে ঠিকঠাক মতো মাথা, কান, গলা, হাত, গরম কাপড়ে মুড়ে নেবার জন্য তাড়া দিতে দিতে নিজেও যখন করছিলাম একই কাজ, ঠিক তখন ফোনটাকেও তার বরাবরের নির্দিষ্ট স্থান প্যান্টের ডান পকেটে না রেখে, রেখেছিলাম জ্যাকেটের বুক পকেটে। এই বিশেষ জ্যাকেটটির উপরিভাগ বায়ু নিরোধক হলেও তাপ অপরিবাহী কিনা জানি না, তবে ভেতরের দিকটা পশমি হওয়াতে তা তাপ অপরিবাহী, অতএব বেশ গরম, আর সেখানেই আছে একটা বাড়তি পকেট। ‘তিয়েন আন মেন’ স্কয়ারে ঠাণ্ডার দাপটে সকালে ফোন ভির্মি খেয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, এখন যাতে সেই একই অবস্থা না হয় সেজন্যই ঐটিকে স্থানচ্যুত করে রেখেছিলাম ওখানেই।
সাথে সাথেই মনের অজান্তেই, পেয়েছি পেয়েছি, বলে মহানন্দে ওটা বের করে, লাফিয়ে লাফিয়ে আরো কয়েক সিঁড়ি নীচে নেমে সবার দিকে ওটা তাক ছবি তোলার জন্য ওটির পর্দায় চোখ রেখে যুৎ মতো ছবি তোলার জন্য ওটির পর্দায় হাত বুলিয়ে, এই মহাভবনের সেই গ্রীক ধাঁচের বিশাল থামগুলো দেখে ভাবলাম, গুনে দেখি কটা থাম আছে। কিন্তু একই সাথে দ্রুত ছবি তোলার ব্যাপারে স্ত্রী আজ্ঞাটি মনে পড়তেই সেই ফালতু চিন্তা বাদ দিয়ে ঝটপট ছবি তুলে ফেললাম কয়েকটা।
ছবি তোলা শেষে সবাই যখন ফের নামতে শুরু করলো নীচে, তখন এই দূর থেকেই ধোঁয়াশার ফাঁক গলে দৃষ্টি পার করে দিয়ে, গুনে দেখি মোট ১১ টা থাম আছে। ঐ থামগুলোর আর গ্রেট হলের মানে মহাভবনের দেয়ালের রং হলদেটে হলেও, এর কার্নিশ বের করা ছাদের রং লাল। সামনের এই উঁচু থামগুলো একেকটা কত উঁচু তা তো জানি না, তবে চোখের আন্দাজে মনে হচ্ছে হবে আমাদের দেশের তিন, নাহ তিন না চার তলার সমান উঁচু। থামগুলোর ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়, বঙ্গরমণীর কপালের লাল টিপের মতো এরও আছে বিশাল এক টিপ, যার ভেতরটা লাল, আর বাইরের বর্ডার হল সোনালি রঙের। হ্যাঁ মহাভবনের কপালের ঐ টিপটা হলো চায়নার জাতীয় এমব্লেম বা প্রতীক। থামগুলোর আকার আকৃতির কারণে ওগুলোকে দেখে সেই এথেন্সিয় স্থাপত্যের কথা মনে পড়লেও, লাল ছাদের কার্নিশ এটিতে এনে দিয়েছে চায়নিজ ভাব, যার উপরে উড়ছে লাইন ধরে লাল চায়নার অনেকগুলো লাল জাতীয় পতাকা ।
‘কী দেখছ বাবা’। হাত ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে অভ্রের এই প্রশ্নের উত্তরে বললাম যে দেখছি ঐ টিপ টা আর এই ঠাণ্ডায়ও জমে না গিয়ে ছাদের উপরে উত্তুরে হাওয়ায় উড়তে থাকা পতাকাগুলো।
‘আচ্ছা বাবা, ঐ যে গোল্ডেন পাঁচটা তারা দেখা যাচ্ছে ওটার ভিতর, ওগুলো দিয়ে কী বোজাচ্ছে? গ্রেট হলের ঐ বিরাট অডিটোরিয়ামের ছাদেও তো দেখেছিলাম বড় একটা তারা’। সেই টিপের দিকে ফের দৃষ্টি গেল দীপ্রর এই প্রশ্নে।
‘বাবা, এদের পতাকাতেও আছে ঐ রকম পাঁচটা তারা। এগুলোর কী মানে’। যোগ করল আরো দীপ্র
কপাল ভাল চাকরির ইন্টারভিউ দেবার কারণে না জানি অন্য কোনো কারণে, চায়নার পতাকার এই পাঁচ তারার মাজেজা খুঁজেছিলাম বহুদিন আগে। আবছা করে সেই উত্তরটা মনে পড়তেই দু পুত্রকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে এগুতে এগুতে বললাম যে, বড় তারাটা হল চায়নার কমিউনিস্ট পার্টি। সেই বড় তারাকে ঘিরে থাকা চারটি তারার একটি হল চায়নার কৃষকেরা, অন্যটা শ্রমিকেরা, আরেকটা তারা মানে মধ্যবিত্ত, আরেকটা সম্ভবত বুর্জোয়ারা।
‘বুর্জোয়া ! বুর্জোয়া মানে কী’? তুমুল কৌতূহলে এই প্রশ্ন দীপ্রর মুখ থেকে বেরিয়ে আসতেই, চায়নার এই মহাভবনের সিঁড়ি থেকে হাত ধরে তা নিয়ে গেল সুদূর শৈশবে !
ভাবলাম এ কী করে হয়? ঘুরে ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন আসে কিভাবে একই পরিবারের দুই প্রজন্মের পুত্রের মুখ থেকে দুই প্রজন্মের পিতার কাছে? গোলাকৃতির এই গ্রহের সবকিছুই কি চক্রাকার নীতিই মেনে চলে নাকি ?
সেই শৈশবে মাঠে ঘাটে দৌড় ঝাঁপ আর খেলাধুলা বাদে বাকি অবসর সময় কাটানোর প্রধান উপায় তো ছিল আমাদের বই পড়া। কিন্তু পর্যাপ্ত বইও মিলত না হাতের কাছে তখন সহজে। খুঁজতে হতো তা নিরন্তর। সে সময় সদ্য স্বাধীন দেশে, আমাদের এলাকায় মানে কুমিল্লার জাঙ্গালিয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের স্টাফ কলোনিতে হঠাৎ করেই কী করে যেন হাজির হয়েছিল রাশিয়ার প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত অত্যন্ত উন্নত কাগজে ছাপা অনেক বাংলা বই। ঠিক কোথায় থাকত সেই বইগুলো মনে পড়ছে না। তবে ঘুরতো তা পাড়ার পড়ুয়াদের হাতে হাতে। পাড়ার সকল বইপোকাদের মাঝে তাতে এক মহা মচ্ছব লেগে গিয়েছিল। ম্যাক্সিম গোর্কীর মা, আন্তন চেখভের গল্প থেকে শুরু করে, দুনিয়া কাঁপানো দশদিন, উভচর মানুষ এসব নানান বিখ্যাত বই যেমন ছিল, তেমনি ছিল অনেক রাজনৈতিক বইও। যেগুলোকে বলা হত লালবই। তো একবার কোনো গল্পের বই না পেয়ে হস্তগত করেছিলাম সেই রকমই ছোট্ট পকেট আকৃতি লাল বই। দীপ্রর এখনকার বয়সের চেয়ে কিছুটা ছোটই ছিলাম মনে হয় সে সময়।
একটি নতুন বই হাতে আসার আনন্দে সে সন্ধ্যায় পড়ার বইয়ের নীচে লুকিয়ে রেখে সে বই পড়তে গিয়ে, প্রলেতারিয়েত, বুর্জোয়া শব্দগুলোর মতো অবোধ্য শব্দের মুখে পড়ে কোনোই কূল কিনারা করতে পারছিলাম না। কী কারণে যেন প্রলেতারিয়েত শব্দটিকে রাশিয়ান মনে করছিলাম, কিন্তু বুর্জোয়া শব্দটিকে বাংলাই মনে হচ্ছিল। রাশিয়ান শব্দের অর্থ না জানি ত ঠিক আছে, কিন্তু বাংলা বুর্জোয়া শব্দের অর্থ জানি না কেন? এ নিয়ে বড়ই ক্ষুণ্ন হয়ে পড়েছিলাম যখন, তখনই ভুলটা করে বসেছিলাম ।
মানে, পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে অন্যরুমে চেয়ারে বসে বসে পত্রিকা পড়তে থাকা আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই একই প্রশ্ন করল যা দীপ্র একটু আগে মানে ‘বুর্জোয়া মানে কী’? পত্রিকা পড়া বাদ দিয়ে চমকে আব্বা জিজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় পেলি এই শব্দ’? সাথে সাথেই টনক নড়ে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম গেছি ধরা পড়ে। পড়ার সময়ে পড়ার বই বাদ দিয়ে গোপনে যে অপাঠ্য ঘোষিত বই পড়ছি রাষ্ট্র হয়ে গেল তা এ মুহূর্তে, নিজেরই বোকামিপ্রসূত কৌতূহলের কারণে। ইংরেজির ‘কিউরিসিটি কিল্ড দ্য ক্যাট’ অবস্থাই দাঁড়িয়েছিল সে সন্ধ্যায়। কিম্বা বলা চলে বাংলায় যাকে বলে ‘দশদিন চোরের তো একদিন গৃহস্থের’, অবস্থা সেরকমই দাঁড়িয়েছিল !
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধলালখানবাজারের নাম শহীদনগর করার উদ্যোগকে জানাই স্বাগত
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাসবিদ আসমা সিরাজুদ্দীন স্মরণে