বে নি আ স হ ক লা
গাড়ি থামার সাথে সাথেই, ঝটপট নেমে গেলাম সবাই, প্রায় বলা চলে একযোগে। হ্যাঁ রাস্তার ওপাশে, রাস্তা থেকে কতো দূরে হবে? হবে হয়তো দেড়শ কি দু’শ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে তিনদিক সবুজে ঘেরা পাহাড়টা। আসলে শুধুই পাহাড় নয় ওটা। এরকম সবুজ পাহাড় তো মহাপ্রাচীর দেখতে গিয়েও যেমন ডিঙ্গিয়েছি আজই সকালে, তেমনি মহাপ্রাচিরের উপরে হাঁটাহাঁটি করার সময়েও দেখেছি ঢের পাহাড়। কিন্তু এমনটাও তো দেখিনি আর।
হ্যাঁ এমন পাহাড় আজও যেমন দেখিনি, তেমনি দেখিনি আগেও কখনও। এতে একটা ঝর্না আছে। হ্যাঁ ঝর্নাওয়ালা পাহাড় বা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্না আগেও দেখেছি দেশে বিদেশে। তারপরও বলছি এমনটা দেখিনি। কারণ এই ঝর্নার বহতা পানি, সব স্থির হয়ে আছে বরফ হয়ে এইখানকার হিমে। তাই বলছি পাহাড়ের গায়ে এরকম জমে বরফ হয়ে যাওয়া ঝর্না দেখিনি তো আগে।
আগেই বলেছি এই পাহাড়টার তিনদিক সবুজ লতাপাতা আর গাছগাছালিতে ভরা। শুধু সামনের দিকের বেশ অনেকটা অংশে উপর থেকে গড়িয়ে আসা পানি জায়গায় জায়গায় জমে গিয়ে সাদা বরফ হয়ে আছে। সামনের এই অংশটি যেটি রাস্তার দিকে, মানে আমাদের দিকে মুখ করে আছে, তার বেশ অনেকটা অংশ যেন খুবলে নিয়ে গেছে কোন অতিকায় দৈত্য। ফলে ঐ অংশটা একদম খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। ঐ জায়গাটা একদম টান টান খাড়া হওয়াতে ওখানকার লালচে মাটিগুলো চোখে পড়ছে। সেটাও অবশ্য কোনো আচানক ঘটনা নয়। আচানক ঘটনা হলো, ঐ খাড়া অংশটার ডানের অংশ ক্রমশ ঢালু হয়ে ভূমিতে নেমে আসায় ওখান দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসা ঝর্নার পানি জায়গায় জায়গায় জমে বরফ হয়ে সাদা হয়ে থাকলেও, এই খাড়া অংশটায় আছে বরফের এক ভিন্ন রূপ।
এখানে পাহাড়ের নানান কার্নিশ থেকে দেখছি ঝুলছে বিভিন্ন দৈর্ঘের বরফ চিকন স্বচ্ছ কাচখণ্ডের মতো বরফ। ঝুলছে কিন্তু দুলছে না, যদিও এখান বাতাসের তোড় ভালোই আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন ঐখানে প্রকৃতি আপন খেয়ালে ঝুলিয়েছে স্বচ্ছ ক্রিস্টালের বহুমূল্য বেশ অনেকগুলো ঝাড়বাতি। ইস এখন যদি একটু রোদ থাকতো, তবে ঐ যে বড় বড় ঝাড়বাতি থেকে নেমে এসে শুন্যে ঝুলতে থাকা স্বচ্ছ ক্রিস্টালের মতো বরফগুলো, চমৎকার ঝকমকভাবে করতো ওগুলো। এমনকি এগুলোর মধ্য দিয়ে রোদের আলো এধার ওধার চলে যাবার সময়, হয়তো পদার্থবিদ্যার নিয়মে যেমন কাচের প্রিজমের মধ্য দিয়ে আলো গেলে তার ভেতরের গোমর ফাঁস হয়ে গিয়ে যেমন বের হয়ে পড়ে নানান রং, তেমনি এখানেও রোদের সাদা রং ভেঙে গিয়ে বেরিয়ে পড়তো নিশ্চয় বে নি আ স হ ক লা পুরোটা না হলেও তার কোন না কোন রং। কিন্তু ঐ যে বলেছিলাম সেই যে কুনমিং থেকে রওয়ানা করার সময় দেখেছিলাম মুখভার, আকাশের এখনো তাই আছে। ছাই রঙ্গয়ের ধোঁয়াশায় মোড়া চারদিক। অতএব সে আশায় গুড়েবালি। কিন্তু যে দেখছি তা ই বা কম কী? এই পাহাড়ের আচানক ব্যাপার হলো এটাই। আর এতেই সবাই ঐরকম উত্তেজিত হয়ে গাড়ি থামাতে বলে তড়িঘড়ি করে নেমে এসেছে গাড়ি থেকে।
‘আচ্ছা, আমরা শুধু এখানেই দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি কেন? রাস্তার ঐ পাশে গিয়ে পাহাড়টার আরো কাছে গিয়ে ছবি তুলছি না কেন?’
হেলেনের এই প্রস্তাবে সকলেই একযোগে হুড়মুড় রাস্তা পাড় হওয়ার উদ্যোগ নিতেই, একই সঙ্গে সবার রাশ টেনে ধরার মতো গলা উঁচু করে রাস্তা পাড় হওয়ার নিয়মাবলী মনে করিয়ে দিতেই, ছবি তোলার উত্তেজনায় হেলেন বলে উঠলো
‘আরে এই রাস্তায় তো একটাও গাড়ি আসতে যেতে দেখিনি এতক্ষণেও’
এতোক্ষণ গাড়ি যায়নি বা আসেনি বলে, আমরা রাস্তা পার হতে নিলেই যে কোন গাড়ি এসে হুড়মুড় করে উঠে পড়বে না আমাদের গায়ে তা তো নয়, এই কথা বলতে বলতে, নিজেই লি খাঁর গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে, ডানে বায়ে তাকিয়ে কোনো গাড়িঘোড়া বা জনমনিষ্যির চিহ্ন দেখতে না পাওয়ায় সবাইকে হাত ইশারায় রাস্তা পার হতে বলে চলে এলাম এপাশে।
এ পাশে আসার পর, সবাই যখন যাকে বলে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে পাহাড়ের গায়ের এই সামনের অংশের নানা ঢালে আর খাঁজে নানান ঢঙ্গে আর ভঙ্গিমা জমে থাকা ঝর্নার জল নিয়ে নট নড়ন চড়ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়টি নজরে আসতেই সকলেই নানান রকম ধ্বনি আর শব্দে মানে ‘ওহ’, ‘ওয়াও’, ‘আরে কী সুন্দর’ নিজেদের মোহিত হবার ভাব প্রকাশ করলো এক চোট। কারণ রাস্তার ঐ পাড়ে দাঁড়িয়ে গাছ গাছালীর ফাঁক ফোকর দিয়ে এর পূর্ণ সৌন্দর্য পরিপূর্ণভাবে চোখে পড়ছিল না। তবে কাছে আসার পর এক্ষণে মনে হচ্ছে আমার, এখানে আসলেই কোনো জীবন্ত বা বহতা ঝর্না আছে? যদি থাকতো তবে সেই পানি গড়িয়ে নীচে তো কোনো খাল বা কুয়ার মধ্যে পড়তো। ঐরকম কিছু দেখছি না। তবে হ্যাঁ পাহাড়ের পায়ের কাছে একটা নালা মতো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এখান থেকে বুঝতে পারছি না ওটাতে পানি আছে কি নেই। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে একদম জীবন্ত ঝর্না না থাকলেও, এই পাহাড়ের গা বেয়ে স্ব সময়ে না হলেও মাঝে মাঝে হলেও পানি চুইয়ে চুইয়ে বের হয়। তাতেই এর গায়ে অন্যরকমের বরফের এই কারুকাজ দেখা যাচ্ছে।
‘এই এন, এন, ঐদিকে যাচ্ছ কেন? দেখছো না ঐদিকে মনে হয় যাওয়া যাবে না। ফেঞ্চিং দেখতে পাচ্ছ না তুমি?’
দীপ্রর এই কথায় হেলেনের দিকে চোখ যেতেই দেখি, ও রাস্তার পাশের হাঁটা পথ ছেড়ে একমনে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখে রেখে ছবি তুলতে তুলতে, ঐ পাহাড়টির দিকে এগুচ্ছে, আমাদের ছাড়িয়ে যেদিকটা থেকে এসেছিলাম গাড়িতে করে সেই দিকে, সড়কের পাশের হাঁটা পথ ধরে। এখানে, মানে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা, এখনাটায় সড়কটির হাঁটা পথ শেষে যে জমি আছে তা রাস্তা থেকে বেশ নীচুতে। আর ওইদিকটায় রাস্তার প্রায় একই সমতলে বুক চিতিয়ে ঘাস আর আগাছাযুক্ত বিঘাঘানেক বা তার চেয়ে বেশি এক খণ্ড জমি দেখছি, যেটিকে ঘিরে আছে তারের জালের বেড়া। দীপ্র সেজন্যই মানা করছে ফুপ্পিকে।
‘কি দাদা, যাওয়া যাবে না আরকেটু কাছে। এখানে তো আর কোনো লোকজন নেই। ‘কী হবে আর? যাই না একটু।’ ভাইপোর কথায় থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে হেলেন আমার অনুমতি চাইতেই, তারের ঐ বেড়ার গায়ে লাগানো ছোট্ট সাইন বোর্ডটি নজরে পড়লো। বললাম দাঁড়া, দেখি তো কী লেখা আছে ওখানে? বলেই এগিয়ে গেলাম।
সাদা জমিনের উপর ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে কালো চাইনিজে লেখা সেই সাইনবোর্ডের সামনে গিয়ে নিজে নিজেই হাসি পেল নিজের এই ভাবে। যেমন ভাব করে এগিয়েছিলাম, তাতে যে কেউ মনে করতে পারত যে এই কয়েকদিনের চায়না সফরে আমি বুঝি চায়নিজ ভাষার হাজার বিশ না ত্রিশ না কি পঞ্চাশ নাকি তার চেয়েও বেশি যে অক্ষর নাকি ক্যারেক্টার আছে, তার অধিকাংশই বুঝি আত্মস্থ করে ফেলেছি !
দেখছি আর ভাবছি, কী লেখা থাকতে পারে? এখানে কী লেখা আছে তবে যে, এটা কারো ব্যাক্তিগত সম্পত্তি। যে রকম ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি যারা নিতান্তই ভদ্র তারা লিখে রাখে শুধু দুটি পি বাচক শব্দ মানে ‘প্রাইভেট প্রপার্টি’। অনেকেই দেখেছি বেশ ধমক দিয়ে সাথে যোগ করে দেয় ‘নো ট্রেস পাসিং’। আর দেশে জমির উপর লাগিয়ে রাখা সাইনবোর্ডে ‘এই জমির মালিক, উত্তরাধিকারী বা বায়নানামা বা খরিদসুত্রে সলিমুদ্দি, কলিমুদ্দি গং’ এসব লেখা যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি সাইনবোর্ডে আদালতের রায়ের নথি নম্বরের বরাতে কারো মালিকানার ব্যাপারটি ঘোষণা করতে।
আচ্ছা এসব ভাবছি কেন? চায়নায় কি এখন জমির উপর ব্যক্তিমালিকানার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাকি? অবশ্য ভোগবাদি পুঁজিবাদের আকাশে নিজেদের পতাকা উঁচু করে উড়িয়ে চায়নার বিজয়রথ যেরকম শনৈ শনৈ গতিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজ কর্তৃত্ব স্থাপন করছে, তাতে তো নিশ্চয়ই এখানে এখন নানান পুঁজিপতিদের কোম্পানির মালিকানা দিতে হচ্ছে। আর জমির মালিকানা ছাড়া কোম্পানিরই বা মালিকানা পাবে কীভাবে কেউ?
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক