হেলেন বলল ‘ওহ তাই? আলাদা টিকিট লাগতো! তা হলে দরকার নেই। হেঁটে হেঁটে উঠতেও অনেক মজা হল। ছবি তুলতে পারলাম। সাই করে উঠে, সাই করে নেমে গেলে তো আর ভালোভাবে দেখাও হতো না। ভালোই হয়েছে’।
‘মা,বাবা ঐ যে খাবার রেডি হয়ে গেছে’ অভ্রর এ কথায় সকলের চোখ কাউন্টারের দিকে চলে যাওয়ার সাথে সাথে, একযোগে সবাই খাবারের ট্রে আনার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই, ভাবলাম ঘটনা কী? পেটে কি তাহলে সবারই শুরু হয়েছে নাকি ছুঁচোর দলগত নৃত্য? অবশ্য হতেই পারে তা। একে তো সময় গড়িয়েছে অনেক; তদুপরি সাথে আছে মহাপ্রাচীরে পায়ে হেঁটে উঠা নামার ক্লান্তি।
তবে কাউন্টারের দিকে ভালভাবে নজর দিতেই মনে হল, খুব ক্ষিদে সবার লাগুক আর না লাগুক, এ হলো আসলে কাউন্টারে সাজিয়ে রাখা খাবারের ট্রে গুলো থেকে আসা, যাকে বলা যায় রিপল ইফেক্ট, তা। মানে ঘটেছে সামান্য ঘটনা ঐ দূরে কাউন্টারে, তাতেই গোটা টেবিলের আলোচনা ঘুরে গিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন চাঞ্চল্য! ঘটনাটি হল আমাদের পাঁচজনের খাবার দিয়ে ওরা পাঁচটা ট্রে সাজিয়েছে, যার কারণে সবারই মনে হয়েছে যে যার যার ট্রে, তার তারই নিয়ে আসা উচিৎ। ইচ্ছে করলেই ওরা দু টা না হলেও তিনটা ট্রে তেই, পাঁচজনের খাবার দিতে পারতো। কিন্তু কেন যে করলো না ওরা তা। আচ্ছা আসলেই কি তাহলে এটাকে রিপল ইফেক্ট বলা যায়? নাকি এটা ডমিনো ইফেক্ট? আবার দুটো তো মনে হয় একই?
আরে দূর মিয়া রাখো তোমার রিপল না ডমিনো ইফেক্ট বিতর্ক। যাও যাও ছেলেরা তো এগিয়ে গেছে। ওরা শুধুই তোমার ঐ ডিজিটাল ক্ষুধা না, পেটের ক্ষুধাতেও কাবু। এছাড়া তোমার নিজেরই তো পেট করছে চোঁ চোঁ, অতএব এটা হইল গিয়া ক্ষুধা ইফেক্ট। মনের কাছে মনে মনেই যাকে বলে জোর ঝাড়ি খাওয়া, তা খেয়ে পুত্রদের অনুগামী হতে হতে হেলেন আর লাজুকে বললাম, দরকার কি সবাই মিলে কাউন্টারে গিয়ে ভিড় করার। দীপ্র আর আমি দুটো করে ট্রে নিলেই হবে। রেস্ট নাও তোমরা।
সে যাক, খাবারের ট্রে নিয়ে টেবিলে ফিরে যার যার ট্রে তার তার জিম্মায় দিয়ে বসে নিজের ট্রে থেকে ফরাসি ভাজা মানে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই চিবুতে চিবুতে, পুত্রদের হাপুস হুপুস খাওয়া দেখে মায়া লাগলো। সাথে সাথেই মনে হলো, নাহ এই হাপুস হুপুস খাওয়া কথাটা ঠিক মিলছে না এখানে। সব খাদ্য, খাওয়ার বস্তু হলেও, সব খাওয়া হাপুস হুপুস খাওয়ার যোগ্য না। হাপুস হুপুস খেতে হলে সামনে থাকতে হবে খুব করে পোড়া মরিচ ডলে দেয়া এক সানকি পান্তাভাতের সাথে, নুন, কাঁচা পিয়াজ আর যে কোন ভর্তার মিশেলের অমৃত। তবে হ্যাঁ, ডাল, ভাত আলু ভর্তা ও হাপুস হুপুস করে খাওয়া যাবে। আর কোনো খানাখাদ্যের সাথেই হাপুস হুপুস নামীয় এই কাব্যছন্দময় শব্দযুগলের কোনো যোগসূত্র নেই। বিজাতীয় কোনো খাবার সাথে তো নয়ই।
আচ্ছা আমাদের ভাষায় হাপুস হুপুস খাওয়া যেমন যায়, তেমনি হাপুস নয়নে কাঁদাও তো যায়। ঘটনা কী? তাহলে কি ঘটনা হল এই যে, অনাদিকাল ধরে আমাদের দেশ ধনধান্যে পুষ্পে ভরা হলেও, সে ধান তো চিরকালই চলে যেত দেশী বিদেশী দস্যুদের গোলায়। ফলে এমনকি শায়েস্তা খাঁর আমলেও যখন নাকি এক টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত বলে কথিত আছে, তখনো আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিয়মিত এক শানকি পান্তাও জুটতো না। অতএব জুটতো যখনই তা, খেত তারা হাপুস হুপুস করেই। বাকি সময়ে না খেয়ে থেকে থেকে পেটের জ্বালায় চোখ থেকে যে অঝোর ধারায় জল ঝরতো ইচ্ছায় অনিচ্ছায়, তা তো কান্নাই। তাই ছন্দোবদ্ধ ঐ শব্দযুগল খাওয়ার আনন্দের সাথে যুক্ত হলেও, ক্ষুধার্ত মানুষের পেটের জ্বালায় ব্যথিত হয়ে এ শব্দযুগল থেকে হুপুস বিযুক্ত হয়ে তা শুধুই হাপুসে বিবর্তিত হয়েছিল!
মাথার ভেতরের এমত আজাইরা চিন্তার ফাঁকে এরই মধ্যে নিজের ফরাসি ভাজার প্যাকেট হাপিস হয়ে যেতেই, বার্গারটি খাওয়ার জন্য হা করতেই, বাংলা ভাষায় খাদ্যগ্রহণের নিমিত্তে ব্যবহৃত অন্য আরেকটি শব্দের কথা মনে পড়লো, তা হল গোগ্রাসে খাওয়া। আচ্ছা, নিতান্তই নিরীহ ঘাসখোর গরুকে মিলিয়ে এ শব্দটি তৈরি হলো কেন? সে কি বিশাল কোনো হা করে খায় নাকি? নাহ তা তো না। প্রাণীবিদ্যার জ্ঞানে মনে পড়লো গরু তো হলো জাবরকাটা প্রাণী। সে যখন ঘাস, খড়, বিচালি মানে যা কিছুই তার খাদ্য, পায় তা সামনে, ভালো করে চিবিয়ে খেয়ে সময় নষ্ট না করে, দ্রুত কামড়ে সেসব উদরস্থ করে প্রথম। করে সে এটা, অন্য গরু বা ঘেসো প্রাণী মানে ঘাস খাওয়া প্রাণীর সাথে প্রতিযোগিতা করে, নিজের টিকে থাকা নিশ্চিত করার জন্য। পরে সময় সুযোগমতো, বিশ্রাম করতে করতে ঐ খাবার পেটের ভেতর থেকে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় মুখে এনে পানখোর মানুষদের মতো মহাসুখে রয়ে সয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। সেদিক থেকে গোগ্রাসে খাওয়ার সাথে হা করার সাইজের তো কোনো যোগাযোগ নেই। আছে যোগাযোগ দ্রুতগতিতে খাবার খাওয়ার। অতএব এই আম্রিকান বার্গার খেতে গিয়ে যে বড় হা করতে হয়, তার সাথে গরুর গোগ্রাসে খাওয়াকে মিলিয়ে আর যাই হোক ঐ নিরীহ প্রাণীটির অমর্যাদা করার মানে নেই। তাছাড়া এই বিজাতীয় বার্গারটির সামান্য অংশও মুখে নিতে যে পরিমাণ হা করতে হয়, সেটিকে রাক্ষুসে হা বলাই যৌক্তিক।
কী আচানক দেখছি ব্যাপার! আজকের পৃথিবীর একক মোড়ল আম্রিকা যেমন তার রাক্ষুসে থাবা বিস্তার করে আছে এ গ্রহের নানান দিকে সর্বক্ষণই, তেমনি ঐ রাক্ষুসেপনা ভাবের হা করারই প্রয়োজন হয় তাদের এই বার্গার খেতেও দেখছি! কথা হচ্ছে গরিবেরা পেটের ক্ষুধায় কাতর হয়ে হাপুস হুপুস করে খেলে, বা গোগ্রাসে খেলে সেটিকে বড়লোকেরা অসভ্যতা মনে করে, অথচ বড়লোকেরা যে যাবতীয় খাদ্য অখাদ্য সারাক্ষণই খাচ্ছে ঐ আম্রিকার মতোই রাক্ষুসে হা করে তাতে কোনো দোষ নেই !
খাবার খেতে বসে, দুই দেশ, সমাজের খাদ্য সংস্কৃতি ও খাওয়া খাদ্য বিষয়ক শব্দ ঘিরে সমাজ, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, অল্প স্বল্প যা জানি সেসবের গোঁজামিল দিয়ে এরকম একটি ভজঘট সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভাবলাম সাধে কি আর বলে ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’! এ মুহূর্তে খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত আমার অলস মস্তিষ্ক কোনো শয়তানি চিন্তা না করে, খাদ্যকে ঘিরে ব্যবহৃত শব্দের সংস্কৃতির সাথে নানান বিষয়ের যে যোগসূত্র স্থাপন করলাম, কপাল ভালো যে তা পণ্ডিতেরা কেউ কখনও টের পাবেন না। কারণ আছেতো, তা মাথার খুলির মধ্যেই আটকা। তাতেই রক্ষা। না হয় পণ্ডিতেরা তো অবশ্যই, এমনকি আমজনতাও যে তাদের নানান সাইজের আর ওজনের স্যান্ডেল, জুতা, হাইহিল ভাঙতেন আমার মাথায়, তা নিশ্চিত। অহরহই তো সামান্য শব্দের ইজ্জত রক্ষাকল্পে তারা চড়াও হয় খোদ বাংলা একাডেমির উপর!
‘বাবা, বাবা, তুমি না বার্গার কিং এর অনিয়ন রিং খুব পছন্দ কর’? দীপ্রর এ কথায় ভজঘট ঐ চিন্তার তাল কেটে যেতেই বললাম,
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
‘এই যে দেখলে তো, আমার কথা ঠিক কি না’। মা ও ফুপ্পির উদ্দেশ্যে জিতে যাওয়ার ভঙ্গিতে এ ঘোষণা দিতেই বুঝলাম, এর মধ্যে টেবিলে এ বিষয়ক আলোচনা হয়েছে। আর নিশ্চয় তা আমার কর্ণ কুহরেও প্রবেশ করেছিল, কিন্তু মগজ আমার যেহেতু তারচে ঢের বেশি জটিল বিষয় নিয়ে তুমুল ব্যস্ত ছিল, মোটেও টেবিলের সেসব কথা আমলে নেয় নি। ফলে শুনেও ঐসব কথা শুনিনি আমি।
‘তাহলে দিলি না কেন দাদা অর্ডার অনিয়ন রিং এর? দীপ্র বলছিল যে, এই ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের বদলে নাকি অনিয়ন রিং নেয়া যেত একই দামে’।
নাহ, এমনিতেই এদের সাথে কথা বলতে গেলে মোটামুটি কুস্তি লড়ার প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হয়। তার উপর যদি এদের নরমাল প্যাকেজ ভেঙে আলাদা কিছু দিতে বলি, কোন যে ঘোরপ্যাঁচ লাগিয়ে বসে, সে চিন্তায় তা করিনি। দাম তো কোনো ব্যাপার না। বড় ব্যাপার হল ঐ ভজঘট লাগার ঝামেলা। তা তোর মানে তোমাদের কারো খেতে ইচ্ছে করছে নাকি অনিয়ন রিং? এখন দেয়া যায় শুধু অনিয়ন রিং এর অর্ডার। তো দেব ক’টা?
‘না না আমি নিজে খাওয়ার জন্য তো বলিনি। ওরা বলছিল তাই তো বললাম’ দ্রুত বলে উঠলো হেলেন। সাথে সাথে লাজুও জানাল তারও লাগবে না আর অতিরিক্ত কিছু। খাবার হয়েছে যথেষ্ট।
ঠিক আছে, তারপরও যাও তো দীপ্র, তিন / চারটা অনিয়ন রিং নিয়ে আসো তো। এই নাও টাকা। এটা হল তোমার জন্য চ্যালেঞ্জ।
‘ঠিক আছে’। যুগল আনন্দে, মানে একদিকে অতিরিক্ত অনিয়ন রিং বরাদ্দ হবার আনন্দ, অন্যদিকে খোদ বাবা কর্তৃক এরকম একটি গুরু দায়িত্ব অর্পণ করায়, সে যে অভ্রর থেকে অনেক এগিয়ে আছে সেটাই যে প্রমাণিত হল, এই আনন্দে চেয়ার ছেড়ে টাকা হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল ‘তাহলে কটার অর্ডার করবো বাবা’?
তোমাদের দুজনের জন্য দুটো তো লাগবেই, আমারও একটা লাগবে, তাহলে তিনটা হয়। তোমার মা আর ফুপ্পি তো খাবে না, তাও আরো একটা নিয়ে আসো না। মানে মোট চারটার অর্ডার দাও’। লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক











