আচ্ছা ঘটনাটা কী তাহলে? জানামতে তো রক্তে আমার কোন চিনিবিষয়ক জটিলতা নাই । কারো চিনিবিষয়ক জটিলতা না থাকলে তো তার রক্তে চিনিস্বল্পতার মতো অঘটন ঘটার কথা না, যে চোখে ঝাপসা দেখবে সে। খিদেয় আমার এখন পেটে ছুঁচোর কেত্তন চললেও পরিষ্কারই তো দেখতে পাচ্ছি সব! আবছা বা ঝাপসা তো দেখছি না। তাহলে এরকম খণ্ডিত ও অলিক দৃশ্য দেখলাম কেন দণ্ডকাল আগে?
লাজুর সাথে অভ্রও যে আছে, তা চোখে পড়লো না কেন? আবার হলুদপরী হিসাবে ভ্রম হওয়া লাজু তো বেরিয়েছে মহাপ্রাচিরের ঐ ঘুমটি ঘর থেকে। সে জায়গায় কেন মনে হলো প্রাচীরের ওপাশের কোথাও থেকে বুজি ও এসে বসেছিল ওইখানে? এমন খণ্ডিত আর আচানক দৃশ্য দেখার মানে কি?
অবশ্য একথা তো ঠিক যে মানুষ তার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মগজের নানান ধরনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় প্রায়শই খণ্ডিত অংশই দেখে বেশীরভাগ জিনিষেরই বা ঘটনার। সবাই সবকিছু কেন যে দেখতে পায় না , তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা ভুঁড়ি ভুঁড়ি গবেষণা করেছেন, এবং করছে চলেছেন এখনো। যার কারণেই তো একই জিনিষ নিয়ে নানানজন উপনীত হয় নানান মতে। তাতে তৈরি হয় নানান বাদানুবাদ, বিতর্ক। এসবেও অবশ্য কোন সমস্যা নাই। সমস্যা তো হল তাদের নিয়েই, যারা ইচ্ছে করেই কোন কিছু পুরো দেখার পরও, নিজেদের ধান্দার জন্য প্রয়োজনীয় খণ্ডিত অংশকেই পুরো অংশ বলে সেটিকেই সত্য বলে প্রমাণিত করার জন্য জোর খাঁটায় বা বিভ্রান্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠকে। তারপর বিভ্রান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠদের বলে কিম্বা নিজেদের পাশব শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তারা, অত্যল্প যে ক’জন পুরো জিনিষটা দেখতে পায় তাদেরকে করে নিগৃহীত। ধুরন্দরদের এই ইচ্ছা অন্ধত্ব যাকে ইংরেজিতে বলে সিলেকটিভ মায়োপিয়া, এটি ভাঙিয়েই তো চুতিয়ে করছে ওরা সমাজে নানান দুর্বৃত্তপনা।
থাক ওসব কথা। ব্যাপার হচ্ছে এখনতো আমার ওইরকম খণ্ডিত কিছু দেখাতে কোনই লাভ নাই। স্বার্থপর মানুষ হিসাবে লাভ ছাড়া তো কোন কিছু আমারও করার কথা না। তাহলে ঐরকম হল কেন? মোদ্দা কথা হচ্ছে আমার নিজের মন বলি আর মগজই বলি, তারই তো মতিগতি দেখছি বুঝি না আমি নিজেই!
“বাবা, বাবা পানি খাব। আবার একটু পানির বোতলটা বের করে দাও না।” মহাপ্রাচিরের এদিকটার ঢালের অংশটি সহজে দৌড়ে পার হয়ে যেতে পারলেও, চড়াইয়ের দিকটায় খানিকটা উঠেই হাঁফিয়ে উঠেছে দীপ্র ফের। এখানে দাঁড়িয়ে তাই অপেক্ষা করছিল পিছিয়ে পড়া আমার জন্য।
তোমাকে না বললাম বাবা, দৌড়াদৌড়ি না করতে। এমনিতেই তো তোমার খিদে পেয়েছে। ওরই পিঠব্যাগে রক্ষিত পানির বোতলটি বের করে ওর হাতে তুলে তুলে দিতে ফের সাবধান করলাম যাতে ঢক ঢক করে পানি না খায় ও। এই উৎরাইটা পেরিয়ে দেড়শ দু’শ মিটার এগুলেই মিলিত হওয়া যাবে বাকীদের সাথে। এমুহূর্তে দেখছি ঘুমটি ঘর ছেড়ে ওরা সব বেরিয়ে এসে খোলামেলা মহাপ্রাচিরের বুকে হিম হাওয়ার তোড়ে তুলছে ছবি অনবরত। আশ্বস্তই হলাম তাতে।
ওদের দিকে এগুতে এগুতে ভাবনা এলো, আচ্ছা দুই হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে প্রায় একুশ বাইশ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাপ্রাচির বানাতে কতো লোককে যে শ্রম দিতে হয়েছিল তা নিয়ে তো কোন কথা শুনিনি কখনও। ছোটবেলা থেকেই যেমন জানি যে, তথাকথিত সপ্তাশ্চর্যের এক আশ্চর্য তাজমহল, বানাতে ২২ হাজার শ্রমিকের বিশ বছর, নাকি যেন ২০ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময় লেগেছিল! আবার মিশরের পিরামিড বানাতেও খরচ হয়েছিল হাজার হাজার নাকি লাখ লাখ ক্রীতদাসের শ্রম, ঘাম ও রক্ত । যদিও কতোটা ঐতিহাসিক সত্য কথাটি তা জানি না, তবে কোথাও যেন পড়েছিলাম, ফারাও রাজারা ইউসুফ নবীর নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষপীড়িত কেনান রাজ্য থেকে মিশরে আসা ইহুদীদের, বিশেষত ইউসুফ নবীর মৃত্যুর পর ক্রীতদাস বানিয়ে, তাদের পিঠে চাবুক চালিয়ে চালিয়ে নাকি অনেকগুলো পিরামিড বানিয়েছিল । আর চলছিল তা ততোদিন, যতদিন না ফারাও রাজা রামেসিসের প্রাসাদে পুত্রবৎ স্নেহে বড় হওয়া মুসানবী ইহুদীদের সেই দাসত্ব থেকে মুক্ত করে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের নিজভূমি কেনানে। এই কথাটি মনে পড়তেই চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই অন্ধ ছেলেটি, গাইছে সে গান -“এয়াকুব নবী বাস করিতেন কেনানে /বারোটি ছেলে দিয়েছিলেন আল্লা তাঁহাকে / সবার চেয়ে বাসতেন ভাল তিনি ইউসুফকে “
কি আশ্চর্যের ব্যাপার! এই ঘটনা তো বহুকাল আগের। সেই আমার শৈশবের শহর কুমিল্লার দৃশ্য এটি। ১৪/১৫ বছর বয়সের একটি অন্ধ ছেলে নিয়ম করে প্রায়শই আসতো আমাদের এলাকায় ভিক্ষা করতে। চমৎকার গলা ছিল তার । বড়ই দরদ দিয়ে গাইতো সে উপরের ঐ গান নাকি পুথির লাইনগুলো। ওর সুরেলা কণ্ঠের গান তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে নিজেই আমি চলে যেতাম সেসময় সেই কোন দূর অজানার কেনানে। এই গানের কথাতো এতকাল মনেই ছিল না। এখন কি না হঠাত মনে পড়লে সেই গান! বড়ই আচানক ব্যাপার তো! একইসাথে এতকাল পর কি না মনে পড়ল দাদিনানির মুখে আর পাড়ার নানান মাহফিলে হুজুরদের ওয়াজে শোনা সুপুরষ ইউসুফ নবীর গল্পের কথা! যে গল্প শুনে শুনে খ্যাংরা কাঠি ভুতো চেহারার আমারও ওইরকম সুপুরুষ হবার ভূত চাপতো মাথায় সেসময়। যদিও জানতাম ইউসুফ (আঃ) এর হিংসুটে ভাইয়েরা তাঁকে কুয়ায় ফেলে দিয়েছিল মেরে ফেলার জন্য! কিন্তু তাতে কী? রানী জোলেখার মতো কারো প্রেম পাওয়ার জন্য তারপরও নিজেরও সুপুরুষ হবার সাধ জাগতো! যদিও প্রেম ব্যাপারটা যে কি তা বুঝতাম না তখনো। তবে এটুকু বুঝতাম পরিষ্কার যে, জুলেখা যেহেতু রাণী ছিলেন, সেহেতু উনি যে চাচ্ছিলেন ইউসুফ নবিকে, তা কোন যা তা জিনিষ হতে পারে না। নিশ্চয় তা অত্যন্ত বহুমূল্য জিনিষ ছিল, যা দেবার ক্ষমতা শুধু রানী বা রাজকন্যাদেরই থাকে। অতএব আমারও তা চাই কিন্তু হা কপাল আমার! যতোদিনে বুজতে শিখেছি যে সেই প্রেম এমনি এক মহার্ঘ বস্তু, যা পুরুষকে দেবার ক্ষমতা আছে এ পৃথিবীর যে কোন নারীরই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ততদিনে একইসাথে আমার এও অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে যে, আমার ভূতমার্কা চেহারা মোবারক দর্শনমাত্রই রানী জুলেখা তো লক্ষ কোটি যোজন দূরের ব্যাপার, এমনকি বাংলাদেশের মালেকা ছালেকা ও না, রহিমন করিমনরাও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বরাবর চলে যাচ্ছে অন্যসব তরুণ বা যুবকের সাথে । আর প্রতিবারই ব্যর্থ আমি মনে মনে আউড়াচ্ছি : “সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি / বোলোনাকো কথা ঐ যুবকের সাথে ;”
খাড়াও মিয়া, খবর আছে তোমার আজ । এইতো মাত্র একশ বা দেড়শ গজ দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি , যাকে তুমি একটু হলুদপরী ভেবেছিলে। তোমার এই সুরঞ্জনাগিরি ভাবনার খবর উনি পেলে বিরাট খবর আছে। সুরঞ্জনাখায়েশ তোমার মিটে যাবে এক্কেবারে জনমের মতো, আত্মরক্ষার সুতীব্র তাগিদে এসময় অবচেতন মন একথা বলে হুঁশ ফিরিয়ে দিতেই দ্রুত ঘুরে গেল চিন্তার মোড় সামনের দিকে এগুতে এগুতে এবার গোবেচারা ভাবনা এলো, আচ্ছা চীনের এই মহাপ্রাচীরও কি ক্রীতদাসদের দিয়েই বানানো হয়েছিল নাকি? এদিকটায় কি তখন ঐ ক্রীতদাস ব্যবসাটি প্রচলিত ছিল নাকি? আর তা যদি হয়েই থাকে তবে চায়নিজরা কি ঐ মংগোলিয়ানদেরই ক্রীতদাস বানিয়েছিল নাকি?
নাহ এ ব্যাপারটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছুই জানি না। তবে চায়নিজরা বহুকাল মঙ্গোলিয়ানদের মার খেয়ে খেয়ে পরে তারা যদি তাদের ক্রীতদাস বানিয়েও থাকে, এক জায়গায় কিন্তু চায়নিজরা মার খেয়ে গেছে এক্কেবারে ঐতিহাসিকভাবে , যেটি আর বদলানোর কিছু নাই। ঘটনা হচ্ছে, ঐ যে নৃতত্ত্ববিদরা মানুষের প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্সের ভেতর যে চারটি ভিন্ন রেইসের খোঁজ পেয়েছেন, তার মধ্যে এই বোঁচা নাকে, ছোট ছোট কুতকুতে চোখ আর পিঙ্গল গাত্রবণের্র জনগোষ্ঠী যেটিকে আমরা চায়নিজ বলে ডাকি , সেটির নাম কিন্তু মঙ্গোলয়েড রেইস রেখে দিয়েছেন। জানি না ঐ নৃতত্ত্ববিদরা কুবলাই চেঙ্গিস খানদের অসিম বীরত্ব বলে পরিচিত সাম্রাজ্যবৃদ্ধির তুমুল নৃশংসতাতে মোহিত হয়েই ঐ নাম দিয়েছিলেন কি না?
“কি ব্যাপার, তোমরা কি আজ এখানেই দিন কাটাবে নাকি ? খাওয়া দাওয়া করতে হবে না?”
হ্যাঁ, হ্যাঁ এক্ষুণি নামতে শুরু করবো। সেজন্যই তো ফিরে এলাম। বরাবরের নিয়মমাফিক স্ত্রীবচন কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্রই দিলাম সায়।“এদিকে আসো তো। তোমার তো আবার আমার সাথে ছবি তোলার ইচ্ছা হয় না, তাই না? এই দীপ্র দে তো একটা ছবি তুলে আমাদের।”মনের অজান্তে সুরঞ্জনাগিরি করার অপরাধবোধ দ্রুত ধামাচাপা দেয়ার জন্য বিনা বাক্যব্যয়ে অতিদ্রুত বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালাম ওরা পাশে, একটা বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট ছবি তোলার জন্য।
নাহ এক ছবিতে কাজ হল না ! দেখা গেল মহাপ্রাচীরের উঠার অভিজ্ঞতাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য মায়ের নির্দেশে, নানান ব্যাকগ্রাউন্ডে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলতে হল দীপ্রকে।
এরই মধ্যে ঘুমটিঘরের আশ্রয় থেকে হেলেনও বেরিয়ে আসাতে শুরু হল পারিবারিক ছবি তোলা পর্ব। চলতে থাকলো তাও নানান ব্যাকগ্রাউন্ড পেছনে রেখে নানান ভঙ্গিতে। সেই বাংলাদেশ থেকে অতো দূরত্ব পাড়ি দিয়ে আসার পর, এতো সিঁড়ি ভেঙ্গে মহাপ্রাচীরে উঠার ধকল সামলে অল্পস্বল্প হলেও তো দীপ্র আর আমি কিছুটা হলেও হাঁটতে পেরেছি, ওরা তো তাও পারেনি ! এতক্ষণ তো ঘুমটিঘরে বসে বিশ্রাম নিতে গিয়ে যে ক্ষতি হয়েছে ওদের, মনে হচ্ছে তা পূরণ করার লক্ষেই চলছে এখনকার এই বিরামহীন ছবি তোলাতুলি পর্ব।